সূর্যমুখীতে রোশনাই
একটু বাদে এ্যাঙ্করমুক্ত হয়ে রকের কিনারায় এসে দাঁড়ায় ঈশু। বলে "এবার বুঝেছিস জেঠু, ঐ পড়ে যাওয়ার মতো জায়গাটা কোথায়?” সুমন ঘাড় নাড়ে। হাড়ে হাড়ে বুঝেছে।
ঈশু বলে, "ওখানে আগে ডান পা না বাড়িয়ে বাঁ পায়ে ভর রেখে একটু পুশ করলেই বাঁহাতে একটা ভালো ‘থ্যাঙ্ক গড হোল্ড’ পাবি। বাঁ পা বাড়িয়েও হাত যাচ্ছিল না বলে আমিও ওখানে একটু ঘাবড়ে গেছিলাম। কিন্তু তুই তো লম্বা। তোর অসুবিধা হবে না। নীচে থেকে ঐ আপারকাট হোল্ডটা দেখা যায় না। পাথরের গায়ে হাত বোলালে পেয়ে যাবি। ঠিক আছে? এবার উঠে আয়।"
তবু সুমন দাঁড়িয়ে থাকে নীচে। ঈশুর মুখে গত রাতের বিষন্নতা এখন উধাও। বোঝা যায় ক্লাইম্বটা খুব উপভোগ করেছে ও। সকালের নরম রোদে ঝকঝক করছে মুখটা। সবুজ ট্র্যাকের ওপর হলুদ টি শার্টে লাগছে যেন একটা জীবন্ত সূর্যমুখী। এ্যাঙ্কর করার জন্য কোমরের কাছে একটা টেপ-স্লিং টাইট করে বেঁধেছে ও। তাতে উনিশ বসন্তের পরিপুষ্ট বক্ররেখা পেয়েছে আরো বিপজ্জনক মাত্রা। নিরাভরণ সুঠাম দুটো হাত রাখা কোমরে। এমন শরীর বিভঙ্গেই লেখা হয় অবুঝ পতঙ্গের মৃত্যু পরোয়ানা। ঈশুর বয়কাট চুল সুমনের মনশ্চক্ষে রূপান্তরিত হয়ে যায় আদুরে হর্সটেলে। শৈলারোহণ মাথায় ওঠে। ঈশুকে দেখতে থাকে বিমুগ্ধ হয়ে। প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি!
ঈশু দড়িটা একবার জোরে নাড়িয়ে দেয়। ঘোর ভেঙে যায় সুমনের।
- "কী রে, হাঁ করে দেখছিস কী তখন থেকে?"
- "তোকে।"
- "মানে?" ঈশু ভ্রু কোঁচকায়।
- "কী সুন্দর তুই ... উঠে গেলি। অথচ একটু আগে আমার পা পিছলেছে। এখনও বুক ধরফর করছে। তাই তোকে দেখে একটু এনার্জি নিচ্ছি।" ওর দিকে তাকিয়ে জোরে একটা নিঃশ্বাস নেয় সুমন। মুখে দুষ্টুমি মাখা হাসি।
ঈশুও হেসে ফেলে। একটা সূর্যমুখীতে খেলে যায় শতেক সূর্যের রোশনাই। ঈশু বলে, "তুই রকে এসেও ফাজলামি করবি? সাধে কী আর তুলি তোর ঝিঁটকি নেড়ে দেয়। এবার ওঠ, আমি গিয়ে বিলে ধরছি, এটা পাঁচ বার করতে হবে আমাদের, মনে আছে তো?" এবার ঈশুর শলা অনুযায়ী সুমন ঠিকঠাক উঠে যায়।
জোৎস্নারাতে পদযাত্রা
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। ওরা মালপত্র গুছিয়ে বসে আছে বাংলোর দাওয়ায়। আজ প্র্যাক্টিস খুব ভালো হয়েছে। সবাই খুব খুশি। চিতা, বরুণ, গৌরব গেছে বলাইদার দোকান থেকে প্যাকড্ ডিনার আনতে। ছাতনা একটা ছোট্ট স্টেশন। ওরা যখন রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ওখানে পৌঁছবে তখন স্টেশনের আশপাশে খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। তাই বলাইদা বানিয়ে দিচ্ছেন রুটি, আলুভাজা। সাথে পিঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কা। আর কী চাই। প্র্যাক্টিসে এসে এটুকু পেলেই যথেষ্ট। ব্যাগে খাবার ভরে ওরা সাড়ে সাতটা নাগাদ রওনা হয়।
নির্জন রাতে জোৎস্নালোকিত রাস্তা ধরে ওদের বারো জনের দলটা চললো হৈ হৈ করতে করতে। চুনি, তুলি মাঝে মাঝে গান করছে। গৌরব মাউথ অর্গানে সঙ্গত করছে। এর আগেও এরকম পথ কিছু হেঁটেছে সুমন। ভবিষ্যতে হেঁটেছে আরো বহুবার। কিন্তু বেশিরভাগ সে হাঁটা ছিল হয় দুই বন্ধুতে বা নিজের সাথে - একা। কদাচিৎ মুষ্টিমেয় কজনের সাথে। চাঁদনী রাতে এমন দল বেঁধে দীর্ঘ হন্টন সেই প্রথম।
ওরা স্টেশনে পৌঁছয় দশটা চল্লিশে। আস্তেই হেঁটেছে ওরা। ট্রেন লেট আধ ঘন্টা। প্রায়শই তাই থাকে। ওরা যে যার প্যাকড্ ডিনার বার করে খেয়ে নেয়। এতটা হেঁটে এসে ক্ষিধে পেয়েছে খুব। তখনো সাথে আছে শুশুনিয়ার ঝর্ণার হজমি জল।
ডিনারের পর তিন ইনস্ট্রাকটর মালপত্র এক জায়গায় রেখে, প্লাস্টিক পেতে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন। হাওড়া থেকে যাত্রা শুরু করে এই কদিন একসাথে অনেক হাসি গল্পের পর এখন সবারই প্রায় কথা শেষ হয়ে গেছে। তাছাড়া ফেরার সময় আসার মতো সেই উৎসাহও থাকে না। বরং কেমন যেন একটা আলগা মন খারাপ ভাব ছেয়ে ধরে। তাই সবাই একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। গৌরব আলোর তলায় গিয়ে বই নিয়ে বসেছে। সুমন প্ল্যাটফর্মের এমাথা থেকে ওমাথা একাকী পায়চারি করছে আনমনে। ঈশু প্ল্যাটফর্মের কিনারায় দাঁড়িয়ে দূরে অন্ধকারে লাল সিগন্যালটার দিকে তাকিয়ে আছে।
ভাঙলো মিলন মেলা
একবার পায়চারি করতে করতে চুনির মুখোমুখি পড়ে যায় সুমন। চুনি আলতো হাসে। মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় সুমনের, "চুনি, তুই খুব ভালো রে।"
সুমনের বলার ধরণে হয়তো অদ্ভুত কিছু ছিল। চুনি অবাক চোখে তাকায়, "কী হয়েছে রে তোর?"
সুমন একটু থতমত হয়ে যায়। "কী আবার হবে? কিছু না তো। এমনই। এই যে আমরা কদিন একসাথে কাটালাম, কী ভালো কাটলো।" কথাগুলো ওর নিজের কানেই কেমন বেসুরো শোনায়।
চুনি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। গভীর, অতলস্পর্শী সে দৃষ্টি। যারা কথা কম বলে তারা কি অন্যের না বলা কথাও বুঝে যায়? কেমন একটা ধরা পড়ে যাওয়ার মতো অস্বস্তি হয় সুমনের। আসলে তখন ওর মনের পর্দায় দ্রুত খেলে যাচ্ছে কয়েকটি দৃশ্যের মন্তাজ - পাহাড়ে রোদে পোড়া তামাটে মুখে চকচকে চোখে ওর সেই বাড়িয়ে দেওয়া জলের বোতল, বিকেলে পাথরে বসে স্নেহমাখা কথার প্রলেপ, ঝর্ণার পাঁচিলে বসে সেই অন্তরাত্মা অবধি নাড়িয়ে দেওয়া গান। চুনির কোমল সান্নিধ্যে যেন ঋষিকেশের গঙ্গায় অবগাহনের আনন্দময় অনুভূতি হয়।
চুনি বুদ্ধিমতী। হয়তো অনুভব করছে সুমনের মনে চলছে কিছু অব্যক্ত আবেগের ঢেউ। কিছু অনুভূতি তার মাধুর্য হারায় প্রকাশে। তৎক্ষণাৎ তাই কথা ঘুরিয়ে বলে, "ঠিক আছে, তাহলে একটা ট্রিট দে আমায়।"
সুমন বলে, "বল না।"
চুনি বলে, "চা খাওয়া আমায়।"
সুমন হেসে ফেলে, "ব্যস, এই? ঠিক আছে খাওয়াবো। তবে শুধু তোকে কেন, সবাইকে খাওয়াবো। তুই জেনে আয় কে কে খাবে।"
চুনি ওখান থেকেই সরু গলায় চ্যাঁচায়, "এ্যাই ভাই, শোনো সবাই। জেঠু আমাদের চা খাওয়াবে বলছে। কে কে খাবে হাত তোলো।" শোনা মাত্র দশটা হাত একযোগে উঠে যায়।
ঈশু চেঁচিয়ে বলে, "জেঠু, চায়ের পর দিবি তো? এখোনো কিন্তু ক্যাম্প শেষ হয়নি।"
হাত তুলে সুমন আশ্বস্ত করে। চায়ের পর সাদাকাঠি না হলে জমে? স্টেশনের চা ওয়ালাটাও অসময়ে এক ডজন চায়ের অর্ডার পেয়ে খুশি। সুমনের খুব ভালো লাগে। চা কেন, চাইলে কোল্ডড্রিংক, আইসক্রিম যা বলতো চুনি ও খাওয়াতে রাজি ছিল। এমন কিছু আনন্দময় মুহূর্ত যদি পছন্দের কিছু মানুষের সাথে ভাগ না করতে পারা যায় তাহলে আর উপার্জন করে কী লাভ? চিতা আর বরুণ সবাইকে চা দিয়ে আসে।
চা খেয়ে সুমন ঈশুর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সাদাকাঠি দিতে হবে ওকে। বলে, "ঈশু একটা কথা বলবো?"
ঈশু ঘুরে তাকায়। দৃষ্টিতে সাবলীল স্বচ্ছতা। "বল।"
- "তুই এবার চুলটা হর্সটেল করে ফ্যাল।" ফস করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় কথাটা।
কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকে ঈশু। কালাহারিতে বইতে শুরু করেছে জোলো বাতাস। চোখ থেকে দিদিমণি মার্কা চশমাটা খুলে নেড়েচেড়ে দ্যাখে ঈশু। স্বগতোক্তি করে, "ভাবছি কলকাতায় গিয়ে এটাও বদলাবো।"
এবার তাহলে ঈশু হারাবে ওর আরোপিত নির্জনতা। ঈশুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুমন যেন নিজের মনে শুনতে পায় অনেকের অস্পষ্ট কোলাহল। তখনও তা দূরাগত। ঈশুর যে রূপান্তর ও অন্তর থেকে দেখতে চেয়েছিল, তা হলে সুমনই হয়তো হারিয়ে যাবে ভীড়ে। তা হোক। তবু ঈশু বেরিয়ে আসুক ওর খোলস থেকে। ওটা ওকে মানায় না। সিগন্যালটা লাল থেকে সবুজ হয়ে যায়। ট্রেন আসছে।
(সমাপ্ত)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।