জেঠুর দলে চুনি
চুনি বলে, "জেঠুর পরে কী মনে হয়েছে জানি না। আজ কিন্তু কয়েকবার আমার জেঠুর কাল রাতের কথাগুলো মনে পড়ছিল। দ্যাখ, ও কিন্তু নিজের জায়গায় সৎ। পুরুষের দুর্বলতা, প্রবণতা যাই হোক, ছেলে হিসেবে ও যেভাবে ভেবেছে তা ও পরিস্কারভাবে বলেছে। সেটাই সামগ্ৰিকভাবে পুরুষ জতের বৈশিষ্ট্য কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু মেয়ে হিসেবে আমাদের তো ওর কথাগুলো ফ্যালনা মনে হয়নি। কিন্তু মেয়েদের ওপর অত্যাচারের জন্য পুরুষের দিকে আঙুল তোলা ছাড়া ঈশু কি মেয়েদের আচরণের ব্যাপারে কিছু বলেছে? তাহলে পুরুষের দিকে তোলা অভিযোগের তীরগুলো কিছুটা ভোঁতা হয়ে যায়। তাই না?"
ঈশু বলে, "তুই কী বলতে চাইছিস খুলে বলতো। আমারও কাল মনে হচ্ছিল আলোচনাটা যেন কেমন একপেশে হয়ে যাচ্ছে। জেঠু যেন পুরুষ জাতটার হয়ে স্বীকারোক্তি করে যাচ্ছিল।"
চুনি বলে, "কালকের আলোচনায় সামাজিক অবদমন, পারিবারিক নির্যাতন এসব ছাড়াও নারীর ওপর পুরুষের অত্যাচারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল যৌন অনাচার। মানছি অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের তরফে কোনো প্ররোচনা ছাড়াই পুরুষ তার ওপর একতরফা আকর্ষিত হয় বা জোরপূর্বক ভোগ করে। কখোনো চূড়ান্ত অমানবিকতায় তার ওপর অকথ্য নির্যাতনও করে। এ ধরনের আচরণ নিশ্চয়ই ঘৃণিত ও শাস্তিযোগ্য। কিন্তু মেয়েরাও কি গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসীপাতা? অনেক মেয়েরই সাজগোজ, রকমসকম পুরুষকে বিচলিত করতে পারে। মনে হয় এর পিছনেও মেয়েদের অবচেতনে কাজ করে এক প্রবৃত্তিগত তাড়না। পুরুষদের নজরে নিজেদের মোহিনী, আকর্ষণীয় দেখতে চাওয়ার বাসনা। ফুল যেমন রঙ, সুবাস, মধু দিয়ে ভ্রমরকে আকর্ষণ করে, ঠিক তেমন।"
ঈশু বলে, "নাঃ, তোর কথাটাও ফ্যালনা নয়।"
চুনি বলে, "আবার দ্যাখ, প্রকৃতিতে কিন্তু কোনো দ্বিচারিতা নেই। সেখানে নারী পুরুষকে আকর্ষণ করে মিলিত হওয়ায় জন্য এবং পুরুষ মিলিত হতে চাইলে ধরা দেয়। কিন্তু মনূষ্যসমাজে কোনো সুন্দরী তার রূপের মোহে সজ্ঞানে পুরুষকে আকর্ষিত করবে। তারা আকর্ষিত হচ্ছে জেনেও রহস্য করে উপেক্ষা করবে। ধরা দেবে কেবল তার পছন্দের পুরুষের কাছে। তার পরিচিত পরিমণ্ডলে বাকি উপেক্ষিত পুরুষদের মনে জ্বলবে ইর্ষার আগুন। এদের মধ্যে যদি কারুর তাড়না, সাহস, অপরিণামদর্শীতা বেশি হয় এবং আত্মসম্মান, নীতিবোধ, সংযম কম হয় তখনই ঘটতে পারে দূর্ঘটনা।"
তুলি বলে, "তুই কী বলতে চাইছিস? পুরুষরা সুন্দরী মেয়েদের দেখে দুর্বল হয়ে পড়বে বলে মেয়েরা সাজগোজ করবে না?"
চুনি বলে, "প্রশ্নটা তুই যতো সহজ ভাবে করলি, ব্যাপারটা কিন্তু আসলে অতো সরল নয়। আয়নায় নিজেকে রুগ্ন, বিষন্ন, অপরিচ্ছন্ন দেখতে কারুরই ভালো লাগে না। বরং নিয়মিত শরীরচর্চা করে আয়নায় স্বাস্থ্যোজ্বল শরীর, ঝকঝকে মুখ দেখলে বেঁচে থাকার উৎসাহ পাওয়া যায়। আয়নায় নিজেকে সুন্দর দেখতে চাওয়ার তাড়না Narcissism এর পর্যায়ে না চলে গেলে তা দোষের নয়। কিন্তু যখন আয়নার গণ্ডী ছাড়িয়ে নিজেকে অন্যের চোখে সুন্দর দেখতে চাওয়ার বাসনা তীব্র হয়ে ওঠে তখনই হয় সমস্যা। এটা তো মানবি অনেক মেয়ে নিজেদের পুরুষের চোখে আকর্ষণীয় করে তুলতে অনেক কিছু, এমনকি নানা কৃত্তিম পন্থাও অবলম্বন করে। কিছু মেয়ে শরীরী সৌন্দর্য হাইলাইট করতে এমন সব পোষাক পরে যে মেয়ে হয়ে আমারই তাকাতে অস্বস্তি হয়। তো ছেলেদের কী অবস্থা হবে ভাব।"
ছবিতে ধূসরের মাধুর্য
সুমন বলে, "নারী পু্রুষের সম্পর্ক জটিল বিষয়। অনেক সময় তা বেশ আলোছায়াময়। পুরুষের কাছে নারীর আকর্ষণের মূলে সৌন্দর্য ও যৌনতাই একমাত্র বিবেচ্য নয়। শারীরিক আকর্ষণ ক্ষণস্থায়ী। তা ছাড়িয়ে নারীর কোমলতা, মমত্ব, সংবেদনশীলতা, বুদ্ধি অর্থাৎ কেবল feminine sensuality নয় feminine sensibilities পুরুষকে অনুপ্রাণিত করে। সেই আকর্ষণ মানসিক এবং দীর্ঘস্থায়ী। তাই Behind every successful man there is a woman প্রবাদবাক্যটি ষাটের দশকে ফেমিনিস্ট মুভমেন্টের একটি শ্লোগানে পরিণত হয়েছিল প্রায়। তবে পুরুষ যেভাবে তাদের জীবনে নারীর ভূমিকা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছে, এমন কোনো শ্লোগান নারীদের তরফে আছে বলে আমার অন্ততঃ জানা নেই।"
"যেমন ধর রবীন্দ্রনাথের কথা। ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে দীর্ঘ আটবছর ধরে কবি শ দুয়েক চিঠি লেখেন যা পরে 'ছিন্ন পত্রাবলী' নামে প্রকাশিত হয়। কবি যখন ছাব্বিশ বছর বয়সে ইন্দিরাকে প্রথম চিঠি লেখেন তখন তার বয়স চোদ্দ। কবির বয়স যখন তেত্রিশ আর ইন্দিরার একুশ, তখন একটি চিঠিতে কবির এক অনন্য স্বীকারোক্তি আছে। তাতে তিনি লিখেছেন, ইন্দিরাকে লেখা কিছু চিঠিতে যেভাবে তাঁর মনের নানান বিচিত্র ভাব, গভীরতম সত্য প্রকাশ পেয়েছে তা তাঁর লেখাতেও প্রকাশ পায়নি।"
"বা ধর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ফণিভূষণ অধিকারীর কণ্যা রাণু অধিকারীর কথা। কবির থেকে বয়সে পঁয়তাল্লিশ বছরের ছোট হয়েও সে কবিকে বড়দের মতো 'রবি বাবু' বলে চিঠি লিখতো। সে তার পরিচয় দিয়েছিল বেনারসের এক অনুরাগিণী পাঠিকা। কিন্তু তার চিঠিতে নিশ্চই এমন কিছু থাকতো যা কবির মনকে আকৃষ্ট করেছিল। তাই কবিও সেই অপরিচিতা পাঠিকাকে অনেক চিঠি লিখেছেন।"
"রবীন্দ্রনাথ অনেক চিন্তাশীল মানুষের মতোই চিঠি লিখতে ভালো বাসতেন। অনেক আগে বেনারসে কবি রাণুকে খুব ছোটবেলায় একবার দেখেছিলেন। পরে যখন তাকে বেনারসের বাসায় দেখলেন ও জানলেন এই সেই অপরিচিতা পাঠিকা, তখন রাণু পনেরো বছরের এক উজ্জ্বল কিশোরী। কবির বয়স তখন ষাট। নানা শোক ও সমস্যায় জর্জরিত। লেখায় মন বসছে না। ফণিভূষণের সাথে পুরোনো যোগাযোগ ছিল। তাই রাণু কলকাতায় এলে ঠাকুরবাড়িতে নাটকে অংশ নিতো। পয়তাল্লিশ বছরের ব্যবধান সত্ত্বেও সে কবিকে ডাকতো 'ভানু দাদা' বলে! রাণু শান্তিনিকেতনে গিয়েও থাকতো। কবি তার সাথে অনেক গল্প করতেন। রাণু কবির গাল ধরে লম্বা চুলে চিরুনী চালিয়ে দিতো। কবির তখন ছোট বৌঠান কাদম্বরী দেবীর কথা মনে পড়তো। কবি আবার ফিরে পেলেন লেখার অনুপ্রেরণা। ফিরে এলো সুর, ছন্দ, ভাষা। জীবনে ও কাব্য চর্চায়। পারিবারিক ভ্রমণে গেলেন শিলং। সেখানেও সঙ্গী রাণু। কবি লিখলেন, 'শেষের কবিতা'। তারপর মাত্র উনিশ বছর বয়সে রাণুর বিয়ে হয়ে গেলো শিল্পপতি স্যার বীরেন মুখার্জির সাথে। কবির স্নেহের রাণু হয়ে গেলেন লেডি রানু মুখার্জি। কবি বললেন, আর আমায় ভানুদাদা বলে ডেকো না। রাণুর সাথে কবির সেই চার বছরের মনোরম সাহচর্য, যা সেদিনও অনেকে ভুল বুঝেছে এবং পরেও বুঝবে - শেষ হয়ে গেল।"
"কোন সংজ্ঞায় ব্যাখ্যা করা যায় এহেন মাধুর্যময় অথচ দুর্বোধ্য সম্পর্ক? নাকি এসব ব্যাখ্যার অতীত, কেবল অনুভবগ্ৰাহ্য ব্যাপার? নাকি এসব সম্পর্ক সমাজপতিদের নিদানে এককথায় বিচ্যুতি বলে দেগে দেওয়া হবে? যেমন ছিল কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও তাঁর বোন ডরোথির মধ্যে? মনে আছে কাল বলেছিলাম, নারী পুরুষের সম্পর্ক একটা রঙিন ছবির মতো যাতে আছে ধূসরেরও নানা প্রকাশ। এগুলো সেই ধূসর ক্ষেত্র। এখানে যৌনতার প্রকট উচ্ছাস নেই। আছে পুরুষের জীবনে মননে নারীসত্তার সেই অমোঘ প্রভাব যা অস্বীকার করা যায় না। সেই প্রভাব বান্ধবী, বন্ধুপত্নী, বৌদি, শ্যালিকা, ভ্রাতুষ্পুত্রী, সহোদরা, আত্মজা, জায়া, জননী কার মাধ্যমে যে বাহিত হয়ে প্রভাবিত করবে পুরুষকে বলা যায় না। না হলে কোনো ভাইপোকে লেখা চিঠি নিয়ে কেন হয় না, 'ছিন্ন পত্রাবলী'? কোনো পাঠকের সাহচর্যে কেন লেখা হয় না 'শেষের কবিতা'? এসব কী নিছক আপতন? মনে হয় না। বরং এগুলো এমন গভীর সত্য যা উপলব্ধি করেও মানুষ স্বীকার করতে লজ্জা পায়।"
তুলি বলে, "মনে হয় আমি চুনি ও জেঠু, দুজনের বক্তব্যেরই সারমর্ম বুঝতে পারছি।"
ঈশু বলে, "আমিও। আসলে জেঠু এমন সব কঠিন সত্য তুলে ধরছে যা স্বীকার করতে গেলে যে ধরণের সাহস, মানসিক উদারতা থাকা প্রয়োজন আমরা তেমন পরিমণ্ডলে মানুষ হইনি। সবসময়, সবাইকে দেখেছি বাস্তব সত্য, স্বাভাবিক প্রবণতাকে হয় এড়িয়ে চলতে নয়তো ধামাচাপা দিতে।"
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।