প্রবৃত্তি ও নীতিবোধের দ্বন্দ্ব
সুমন বলে, "আচ্ছা, একটা কাল্পনিক পরিস্থিতি ভাব। পাপিয়া একটি কুড়ি বছরের মেয়ে। প্রিয় একটি বাইশ বছরের ছেলে। দুজনেরই শৈশব, কৈশর কুয়াশাচ্ছন্ন। ওদের আলাপ হলো। পরস্পরকে পছন্দ হোলো। বছর দুয়েকের মেলামেশায় তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়লো। মাস ছয়েক লিভ টুগেদার করে তারা নিজেদের অন্তরঙ্গ ভাবে জানলো। এবার যখন তারা বিয়ে করবে ভাবলো তখন জানা গেল তারা একই মায়ের সন্তান। অর্থাৎ সহোদর ভাই বোন। খুব ছোটবেলায় তারা কোনো ভাবে আলাদা হয়ে গেছিল। আইনত ও সামাজিক বিধানে এ সম্পর্ক নিষিদ্ধ। তাই বিয়ে করা গেল না। এবার কি তারা এক বাড়িতে ভাই বোন হিসেবে থাকতে পারবে?"
ওরা তিনজনে খানিক মুখ চাওয়াচায়ি করে। শেষে তুলি বলে, "তুই একটা বিটকেল সিচুয়েশন দিলি। এরপর এক বাড়িতে থাকা তো দুরের কথা পরস্পরের দিকে তাকাতেও ওদের লজ্জা করবে।"
সুমন বলে, “বেশ। এবারে ধর, কিছুদিন পর আরো অনুসন্ধানে জানা গেল, প্রাথমিকভাবে যা জানা গেছিল, তা ঠিক নয়। অর্থাৎ তারা সহোদর ভাই বোন নয়। এবার তাদের মনোভাব কেমন হবে?”
তুলি বলে, “এসব কী গুগলি ছাড়ছিস রে তুই!”
ঈশু বলে, “সহোদর ভাই বোন যখন নয় তখন তারা অবশ্যই রিলিভড্ ফিল করবে, কারণ এবার আর বিয়েতে মানসিক, সামাজিক কোনো বাধাই রইলো না।” চুণিও ওর মতে সায় দেয়।
সুমন বলে, "এই বিটকেল কাল্পনিক সিচুয়েশনটা হচ্ছে প্রবৃত্তির সাথে নীতিবোধের দ্বন্দ্বের উদাহরণ। প্রবৃত্তির তাড়না আদিম, অকৃত্রিম, স্বাভাবিক। তাই পাপিয়া প্রিয় পরস্পরের প্রতি স্বাভাবিকভাবে আকৃষ্ট হয়েছে। নীতিবোধ, সংস্কার ইত্যাদি অনুশাসন নির্ধারিত হয় কিছু সামাজিক উদ্দেশ্যসাধনে। তাই তা আরোপিত। সেই অনুশাসন পালনের তাগিদ তাই যত না আন্তরিক তার থেকেও বেশি পরিণতি নির্ভর। তবে নানান সামাজিক আচার, প্রথা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বহুদিন ধরে পালনে তৈরী হয় সমষ্টিগত অভ্যাস, লোকাচার মানে customs, rituals যেটা অজান্তে প্রভাবিত করে মানুষকে।”
“এই উদাহরণে প্রথমে পাপিয়া ও প্রিয় ছ মাস লিভ ইনের পর সানন্দে বিয়ে করতে যাচ্ছিল। যখন জানলো ওরা ভাইবোন তারপর ওদের পক্ষে এক সাথে থাকা মানসিক যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়াবে। সেটা অপরাধবোধের জন্য নয় কারণ অতীতে তাদের মিলনের বিচ্যূতি হয়েছে অজান্তে। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু এরপরেও একসাথে থাকলে ওদের সম্পর্কে দ্বিমাত্রিক (প্রবৃত্তি ও নীতিবোধের) টানাপোড়েন ওদের জীবন দূর্বিষহ করে তুলবে। অবশেষে যখন জানলো তারা আসলে সহোদর ভাইবোন নয়, আবার উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। এই থিমের ওপর নারায়ণ সান্যালের একটা সুলিখিত উপন্যাস পড়েছিলাম - তাজের স্বপ্ন।”
"তবে বিচ্যূতি ঘটার আগেই সংযমের উদাহরণও আছে। যেমন যম আর যমী যমজ ভাই বোন হয়েও যমী তার ভাই কামনা করে। যমের মনে হয় সেটা ঠিক নয়। সে বোনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তার থেকে দু্রে চলে যায়। তাই আজও ভাই ফোঁটার দিন বোন না বুঝেই আউড়ে যায় - "ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা৷ যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমিও দিই ভাইকে ফোঁটা"। অর্থাৎ ভাইকে কামনা করে যে বিচ্যূতি যমী বা যমুনার হয়েছিল, তা যেন আমার কখনো না হয়।"
চুনী বলে, "এটা তো জানতাম না!"
সুমন বলে, "এমন অনেক সামাজিক প্রথা আছে যার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য না জেনেই আমরা তা পালন করে থাকি। যম আর যমীর উদাহরণ তো পৌরাণিক, কিন্তু বাস্তব উদাহরণও আছে। যেমন ধর কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও তাঁর বোন ডরোথির কথা। তাঁরা একসাথে থাকতেন ইংল্যান্ডের ছবির মতো লেক ডিস্ট্রিক্টের গ্ৰাসমেয়ারে। প্রায়ই তাঁরা দুজন ও কবি কোলরিজ একসাথে দীর্ঘ পদচারণায় যেতেন। জন্মতারিখগুলো খেয়াল কর - উইলিয়াম ৭ই এপ্রিল ১৭৭০, ডরোথি ২৫শে ডিসেম্বর ১৭৭১ এবং কোলরিজ ২১শে অক্টোবর ১৭৭২. কোলরিজ সুদর্শন। তবু দশ মাসের বড় কোলরিজের সাথে ডরোথির কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠলো না। তৈরী হোলো একুশ মাসের ছোট ভাই উইলিয়ামের প্রতি দূর্বোধ্য আকর্ষণ।"
"তবে ডরোথির তাঁর প্রতি দূর্বলতা সত্ত্বেও উইলিয়াম কিন্তু দিদির দূর্বলতায় ভেসে যাননি। যমের মতো দুরেও চলে যাননি। একই বাড়িতে থাকতেন তাঁরা। উইলিয়াম যেদিন মেরী হাচিনসনকে বিয়ে করলেন, সেদিন ডরোথি নিজের আঙুলে একটি আংটি পরে বিছানায় উপুড় হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আংটিটা সে এতোদিন সযত্নে রক্ষা করে রেখেছিল তার ভাবী প্রেমিকের জন্য। ডরোথি আর বিয়েই করলো না। ভায়ের বিয়েতে ডরোথি চার্চে যায়নি। নতুন বৌকে নিয়ে ভাইকে আসতে দেখে ডরোথি সেই যে চিলেকোঠায় গিয়ে ঢুকলো, বেরোলো কুড়ি বছর বাদে উইলিয়ামের মৃত্যুর পর। উইলিয়াম মারা গিয়ে ডরোথিকে তাঁর প্রতি অবুঝ আকর্ষণ থেকে মুক্তি দিয়ে গেলেন। এক বাড়িতে থেকেও বিয়ের পর ডরোথি আর কখনো ভাইয়ের মুখোমুখি হয় নি। আত্মহত্যা নয়, ডরোথি বেছে নিয়েছিলেন স্বেচ্ছায় আত্মনির্বাসন। আমৃত্যু উইলিয়ামও এজন্য নিদারুণ মনোকষ্ট পেয়েছেন। এহেন সব সম্পর্কের স্বত্তা অনুধাবন প্রচলিত ধারণায় অসম্ভব।"
সুমন চুপ করতে ওরা স্থব্ধবাক। মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে। দুর থেকে অজানা রাতচরা পাখির ডাক ভেসে আসছে। উজ্জ্বল জ্যোৎস্না। আনন্দময় পরিবেশ। তবু দুই শতাব্দী অতীতে দুর দেশের ডরোথির অবুঝ দুঃখ কিছুক্ষণ যেন ভারী হয়ে চেপে থাকে সেখানে।
ইডিপাস কমপ্লেক্সের অন্য দিক
কিন্তু সুমনকে আজ বলায় পেয়েছে। ও বলে চলে "ফ্রয়েডের সমসাময়িক, ফিনল্যান্ডের এডওয়ার্ড ওয়াটারমার্ক-এর মতবাদ ছিল ফ্রয়েডের বিপরীত। তাঁর মতে একই পরিবারে শৈশব থেকে একসাথে বড় হওয়ার ফলেই অতি নিকট রক্ত সম্পর্কের মধ্যে কোনো যৌন আকর্ষণ তৈরী হয় না। ফ্রয়েড প্রবর্তিত ইডিপাস কমপ্লেক্সের ভিত্তি অনেকটাই তাঁর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। তিনি সাত বছর অবধি বিছানায় হিসি করে ফেলতেন বলে বাবার কাছে ধাতানি খেতেন, "এ ছেলের দ্বারা কিস্যূ হবে না"। ফলে বাবার প্রতি তাঁর তৈরী হয়েছিল তীব্র বীতরাগ। যেমন হয়েছিল কাফকার তাঁর অত্যন্ত রাশভারী পিতার প্রতি। কিন্তু ফ্রয়েডের মা এ্যামেলিয়া তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। খুব উৎসাহ দিতেন, ভাবতেন সে বড় হয়ে নিশ্চিত বিরাট কিছু করবে। ফ্রয়েড বলতেন, তাঁর জীবনে মায়ের জায়গা আর কোনো মহিলা নিতে পারবে না। ফ্রয়েডের স্ত্রী মার্থাও সেটা বুঝতেন। কিন্তু মা ও সন্তানের মধ্যে শৈশবে যে শারীরিক নৈকট্য থাকে ফ্রয়েডের সাথে এ্যামেলিয়ার তা ছিল না। ফ্রয়েড শৈশব থেকে কোলে, কাঁখে করে বড় হয়েছেন তাঁর দুধ-মার কাছে…"
- "দুধ-মা? সেটা আবার কী?" অবাক গলায় প্রশ্নটা করেই চুনি বলে ফেলে, "সরি, সরি, আমিও তুলির মতো কথার মাঝে কথা বলে ফেললাম।"
সুমন বলে, "না, না, ঠিক আছে। তুই একটা শব্দের মানে জানিস না, তাই জানতে চেয়েছিস। তাতে কী হয়েছে। অতীতে অভিজাত মহলে কিছু মহিলা শুধুই গৃহবধূ হয়ে অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে থাকতে চাইতেন না। তাঁদের থাকতো ক্ষমতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা বহু পুরুষের নয়নের মণি হয়ে থাকার বাসনা। তাঁদের কুহকী যৌবনের মাদকতায় তাঁরা পছন্দের পুরুষদের মজিয়ে রাখতে ভালোবাসতেন। ফলে তাঁরা মা হতে চাইতেন না। অসাবধানতাবশতঃ হয়ে গেলে - তখন তো আর বেবিফুডের চল ছিল না - তাঁরা একটি দুগ্ধবতী ধাইমা নিযুক্ত করতেন শিশুকে স্তন্যপান করাতে এবং নিজের ফিগার ঠিক রাখতে। ফলে গর্ভধারিণী না হলেও দুধ-মার সাথে শিশুটির যে একাত্মতা তৈরী হোতো তার কিয়দংশও হোতো নাঊ জন্ম-মায়ের সাথে।"
সুমন বলে, "আর একটা উদাহরণ দিই। শের আফগানের সাথে বিয়ের পর মেহেরুন্নিসা বেগম বা নুরজাহানের একমাত্র কন্যা লাডলীর জন্ম হয়, তাও হয়তো তিনি চাননি। হয়তো এ্যামেলিয়ার মতোই লাডলীকেও তিনি রেখেছিলেন কোনো দুধ-মার হেফাজতে। তাই আজীবন নুরজাহানের সাথে লাডলীর সম্পর্ক ছিল শীতল। জাহাঙ্গীর ষড়যন্ত্র করে শের আফগানকে হত্যা করলেন। লোক-দেখানো তিন বছর শোক পালন করে নূর সেই সেলিম বা জাহাঙ্গীরকেই বিয়ে করেন। কারণ সেলিমের প্রতিই ছিল তাঁর প্রথম প্রেম, গোপন অনুরাগ।"
"নুরের ছিল আকাশচুম্বী উচ্চাশা। ভেবেছিলেন তাঁর রূপের রোশনাইতে জাহাঙ্গীরকে মজিয়ে বকলমে তিনিই হবেন ভারতের সম্রাজ্ঞী। সে স্বপ্ন অনেকটা পূরণও হয়েছিল কারণ আরো ১৮টি পত্নী থাকা স্বত্ত্বেও জাহাঙ্গীর মদিরাক্ষী নুরজাহানের মোহে ছিলেন বিভোর। রাজকার্যের অনেক ব্যাপারে তিনি নুরের ওপর নির্ভর করতেন। আকবরেরর আমল থেকে মোহর কাটা হোতো গোল করে। নুরের প্রেমে মোহাচ্ছন্ন জাহাঙ্গীর হুকুম দিলেন চৌকো মোহর কাটানোর - তাতে বাদশাহ সেলিমের সাথে নুরের নামও খোদাই করা হলো। দূর্ধর্ষ চাঘতাই মোগল বংশে সেই প্রথম কোনো জেনানার নামও দেখা গেল সুলতানী মোহরে। ব্যবসায়ীরা ভালো ভাবে নিলো না তা। মোহরের দাম পড়ে গেল বাদশা দর বেঁধে দেওয়া সত্ত্বেও।"
"জাহাঙ্গীর মানে জগতজয়ী। আর নূরজাহান মানে জগতের আলো। দীর্ঘ ১৬ বছরের বিবাহিত জীবনে জগতের আলো প্রায় নিত্য নিশীথে জগতজয়ীর শয্যা আলো করেও দ্বিতীয়বার আর মা হননি। শয্যাক্রীড়ার সাথে গর্ভসঞ্চারের অমোঘ কার্যকারণ সম্পর্ক সর্বজনবিদিত। একটু আগে আমরা ঈশুর কাছেই জেনেছি শাহজাহান ও মূমতাজের মধ্যে সেই কার্যকারণ সম্পন্ন হয়েছিল উনিশ বছরে চোদ্দোবার। সেলিমের পিতা হবার যোগ্যতাও ছিল সংশয়াতীত। হিসাব অনুযায়ী পাঁচ বৈধ পত্নী ও দুই জন রক্ষিতার মাধ্যমে সেলিম ৫ টি পুত্র ও ১০টি কন্যা সন্তানের জনক হয়েছিলেন। হিসাববহির্ভূত কিছু থাকলে তা ঐতিহাসিকরা লিখে যাননি।”
ঈশু বলে, “প্রিয় পত্নী হওয়া সত্ত্বেও জাহাঙ্গীর ও নূরজাহানের কিন্তু কোনো সন্তান ছিলনা।”
সুমন বলে, “ঠিক বলেছিস। কিন্তু ১৬ বছরের বিবাহিত জীবনে নূর সেলিমের সন্তান ধারণ করেননি কেন? ১৬১১ খ্রীষ্টাব্দে ৪২ বছর বয়সী সেলিমের সাথে বিবাহকালে নূরের বয়স ছিল ৩৪ - প্রাইম টাইম। হতে পারে তার আগেই ১৮টি পত্নী, বহু উপপত্নী ও হারেমবাসিনীদের সাথে শয্যাক্রীড়া করে ১৫টি সন্তানের জন্ম দিয়ে জগতজয়ী সেলিম থিতিয়ে গেছিলেন। তিনি প্রথমবার পিতা হন ১৮ বছরে। শেষবার ২৮ বছর বয়সে ১৫৯৭ সালে। দশ বছরে ম্যারাথন গতিতে পঞ্চদশ সন্তানের জনক হয়ে হয়তো জগতজয়ীর কোটা ফুরিয়ে গেসলো। তাই ৫৮ বছর বয়সে ভবলোক ত্যাগ করার আগে নূর সহ ১৯জন পত্নীর কারুর মাধ্যমেই সেলিম আর পিতা হননি।"
“অথচ চার্লি চ্যাপলিন ৫৪ বছর বয়সে চতুর্থবার বিয়ে করলেন তাঁর থেকে ৩৬ বছরের ছোট অষ্টাদশী উনা ওনিলকে। উনা 'না না করকে' চার্লিকে উপহার দিলেন ৮টি অমৃতস্য পুত্র-কন্যা। বাকি তিনটে বিবাহ থেকে উৎপন্ন হয়েছে আরো তিনটি - কুল মিলাকে একাদশ পুত্র-কন্যার জনক চার্লি এগারোতম পুত্র ক্রিস্টোফারের পিতা হয়েছিলেন ৭৩ বছর বয়সে - উনা তখন ৩৭. সুতরাং পিতা হবার পক্ষে ৫৮ বছর বয়সটা খুব বেশী নয়। নূরের সাথে সেলিমের বিবাহ হয় শেষবার পিতা হওয়ার ১৪ বছর পরে ১৬১১ সালে। তাহলে দ্বিতীয়বার জননী না হওয়ার কারণ অবশ্যই নূর নিজে নন।”
চুনি বলে, “জেঠু, তুই কিন্তু ফ্রয়েড থেকে অনেক দুরে সরে গেছিস।”
সুমন বলে, “এই হচ্ছে আমার দোষ। আমি এমন কাছাখোলা আড্ডায় তালগাছের মতো সটান কথা বলতে পারি না। আমগাছের মতো ডালপালা মেলে ফেলি।”
তুলি বলে, “তাতে কী হয়েছে। অনেক বিচিত্র সব ব্যাপারও তো জানা যাচ্ছে।”
সুমন বলে, “আচ্ছা ফিরে আসছি ফ্রয়েডে। ওনার ক্ষেত্রে দুধ-মার ওপর কোনো ইডিপাস কমপ্লেক্স তৈরী হয়নি, হয়েছে তাঁর জন্ম-মায়ের ওপর যাকে তিনি হয়তো ঠিক মা বলে কখোনো ভাবেনই নি। তাঁকে দেখতেন এমন এক মহিলা হিসেবে যিনি তাঁর জীবনে ছিলেন বিশেষ অনুপ্রেরণা স্বরূপ। একবার প্রাকযৌবনে ট্রেন যাত্রায় পোষাক বদলের সময় তিনি এ্যামেলিয়াকে নগ্ন অবস্থায় দেখে ফেলেন। সেই অয়দিপাউসের মতো, যা দেখার নয় তাই দেখে, তিনি এমন বিচলিত হয়ে যান যে আমৃত্যু সেই ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। গ্ৰীক নাটকে থিবেসে যোকাস্তার গর্ভে অয়দিপাউসের জন্ম হলেও সে পালিত পুত্র হিসেবে শৈশব থেকে বহুদুরে কোরিন্থে বড় হয় তার পালক পিতা পলিবাস ও পালিকা মাতা মেরোপের কাছে। নিঃসন্তান মেরোপ তাকে কোলেপিঠে করে অত্যন্ত আদরে মানুষ করেন। তবু মেরোপের প্রতি অয়দিপাউসের ইডিপাস কমপ্লেক্স জনিত তির্যক শারীরিক আকর্ষণ তৈরী হয়নি।"
"তাই ফ্রয়েডের ইডিপাস কমপ্লেক্স তত্ত্ব যেন প্রকারান্তরে ওয়াটারমার্কের মতবাদকেই বেশি মান্যতা দেয়। ফ্রয়েড তাঁর নিজের এবং গুটিকয় নমুনার অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে একটি তত্ত্ব খাড়া করলেন এবং তা সার্বজনীন সম্ভাব্যতা বলে দেগে দিলেন। এটা ঠিক মানা যায় না। তাই তাঁর ইডিপাস কমপ্লেক্স তত্ত্ব সবচেয়ে বিতর্কিত। তা যেন নিয়মের থেকে ব্যতিক্রম, প্রবণতার থেকে বিচ্যূতিকেই বেশি সূচীত করে।"
হবো না মোরা তিন বাঁদর
"তাহলে বলা যায় অবিরত অকপট অভিনিবিষ্ট অনুসন্ধিৎসায় অন্বেষিত অভিজ্ঞতার উপলব্ধিতেই অভীষ্টসিদ্ধি সম্ভব - অর্থাৎ জ্ঞানার্জন।"
ফোঁস করে একটা জোর নিঃশ্বাস ফেলে ঈশু বলে ওঠে, "উরেঃ বাবা, জেঠু, thou-thy-thee-shalt গোছের ভিক্টোরিয়ান ইংরেজির মতো এ কী হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ বাংলা বললি রে ভাই!"
তুলি ধরে সানাইয়ের পোঁ, "এ্যাতো অ-কারান্ত শব্দের সমাহারে যেন মনে হোলো - অ এ অজগর আসছে তেড়ে।"
চুনির তৎক্ষণাৎ ফোড়ন, "তাই আ-এ আত্মারাম গেল খাঁচা ছেড়ে।"
সুমন অট্টহাস্য করে বলে, "বাঃ, দারুণ বললি তো তোরা। একদম ইন্সট্যান্ট কফির মতো। কী তাল, মিল! ঐ বিটকেল বাক্যটা আমি মজা করতে বলেছি। অনেকক্ষণ ধরে হ্যাজর হ্যাজর করে সিরিয়াসলি হেজিয়ে চলেছি তো। তাই আবার একটু কমিক রিলিফ নিলাম। তবে জোকস এ্যাপার্ট, যা বলতে চেয়েছি তা নিশ্চই বুঝেছিস। সেই তিনটে বিখ্যাত বাঁদরের মতো চোখে, কানে সংস্কারের ঠুলি না পরে থেকে আমরা যদি মুক্ত মনে দেখতে, শুনতে, ভাবতে এবং বলতে পারি - সেটাই মুক্তমনস্কতার পরিচয়। সবসময় হয়তো কোনো সিদ্ধান্তে নাও আসতে পারি। তাতে ক্ষতি নেই। নানা কিছু নিয়ে ভাবার চেষ্টাও তো এক ধরনের মানসিক ঋদ্ধতার অনুশীলন। তাই না?"
ঈশু বলে, "ঠিক বলেছিস। দ্যাখ, এই ক্যাম্পিংয়ে একমাত্র গৌরব ছাড়া আমরা আর কে কতটা রক ক্লাইম্বিং করতে পারবো জানি না তবে আজকের এই আলোচনাটা আমি খুব এনজয় করলাম। অনেক কিছু জানলাম। এর আগে কোনোদিন এমন সব স্পর্শকাতর বিষয়ে এভাবে খোলামেলা আলোচনা কারুর সাথে হয়নি। তাই এই আউটিংটা বহুদিন মনে থাকবে আমার। থ্যাঙ্কস জেঠু। তোকে প্রায়শঃই চ্যাংড়ামি করতে দেখে ভাবতাম তুই একটা লঘুচিত্ত, চপলমতির ছেলে। তুই যে এমন সব সংবেদনশীল বিষয়েও এতো সাবলীল ভাবে আলোচনা করতে পারিস, জানা ছিলো না।"
সুমন ক্যাচ লোফার ভঙ্গিতে ঈশুর দেওয়া থ্যাঙ্কসটা নিয়ে বলে, "বাহ্যিকভাবে দেখে, ওপর ওপর ব্যবহারে অনেক মানুষকেই ঠিক চেনা যায় না। অনেকে আবার জল মাকড়সার মতো জলের ওপর তলে ভেসে বেড়াতেই ভালোবাসে। তাদের কোনো কিছু নিয়েই গভীরে যাওয়ার ইচ্ছা নেই। তবে কেউ কেউ হয় হিমশৈলের মতো। দশ পারসেন্ট দৃশ্যমান। নব্বই পারসেন্ট ডুবে থাকে জলের তলায়। তাদের সাথে খোলামেলা আলোচনা না হলে তাদের স্বরূপ বোঝা যায় না। যেমন আমিও এতোদিন তোকে দেখে ভাবতাম খুব ডাঁটিয়াল। তাই কাউকে পাত্তা দিতে চাস না। আমারও সে ভুল ভাঙলো।"
তুলি বলে, "ঠিক বলেছিস জেঠু। ওপর ওপর দেখে অনেককেই ঠিক বোঝা যায় না।"
চুনি বলে, "আজকের এই আলোচনাটা আমিও খুব এনজয় করলাম।"
ঈশু বলে, "এবার চল আমরা শুতে যাই, অনেক রাত হয়েছে। কাল সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।"
তখনও সুমন জানতো না আগামীকাল গভীর রাতে ওকেই আবার এই কথাটা বলতে হবে ঈশুকে, অন্য এক পরিস্থিতিতে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।