ঈশুর তুলোধোনা
ফিরে এসে ওরা আবার সেই রোয়াকে বসে। সুমন বলে, "ঈশু আমাদের আলোচনাটা কিন্তু অধুরা রয়ে গেছে। পুরুষদের তুলোধোনা করা তোর এখনো অনেক বাকি আছে মনে হয়। বলে ফ্যাল"।
- "হ্যাঁ, যা বলছিলাম", বলে ঈশু আবার শুরু করে। ওকে আজ কথায় পেয়েছে। এতো কথা আজ অবধি কখোনো বলতে দেখা যায় নি ওকে। এর জন্য দায়ী সুমন। ওকে উস্কে দিয়েছে। ঈশু বলে, "দ্যাখ, এটা তো অনেকদিন জানা গেছে নারীর বন্ধ্যাত্বর জন্য সে একা দায়ী নয়। পুত্রসন্তান না হওয়া তো জেনেটিক্যালি নারীর ওপর নির্ভরই করে না। এ নিয়ে অনেক প্রচারও হয়েছে। তবু আজও কেবলমাত্র এই দুটি কারণেই মেয়েদের অনেক দূর্ভোগ সইতে হয়। গ্ৰামাঞ্চলে বেশি, কিছু উদারমনা পুরুষের জন্য শহরে তূলনামূলক ভাবে কম।"
তুলি বলে, "একদম ঠিক বলেছিস তুই।"
ঈশু বলে, "বিয়ের পর মঙ্গলসূত্র, শাঁখা, সিঁদুর পরে বিজ্ঞাপন করে মেয়েদেরকে জানাতে হয় সে সধবা। স্বামীর মৃত্যুতে সাদা কাপড় পড়ে জানাতে হয় সে বিধবা। কেন? বিবাহিত বা বিপত্নীক পুরুষের জন্য তো এমন কোনো নিয়ম নেই। বরং পুরুষরা চাইলে ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়াতেই পারে। মেয়েদের বেলাতেই যতো নিয়মের বেড়াজাল।
সুমন বলে, "অকাট্য যুক্তি"।
ঈশু বলে, "আবার ধর, বরপণের জন্য বধূহত্যার ঘটনা তো আমরা নিত্য দেখছি। ১৯৫৬ সালে হিন্দু ম্যারেজ এ্যাক্ট হওয়ায় আগে অবধি তো হিন্দু পুরুষরা বহুবিবাহও করতে পারতো। অতীতে মুসলমান সমাজে স্বামী যতবার খুশি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে পরে চাইলে আবার পূনর্বিবাহ করতে পারতো। পরে কোরান নির্ধারিত শরিয়তী আইনে স্বামী তার কোনো স্ত্রীকে তিন বার তালাক দিতে পারে। প্রথম দু বার তালাক দিয়ে তাকে পূনর্বিবাহ করতে পারে কিন্তু তৃতীয় বার তালাক দিয়ে ত্যাগ করলে তাকে আবার পূনর্বিবাহ করতে চাইলে প্রাক্তন স্ত্রীকে অন্য কাউকে বিবাহ করতে হবে। সেই অন্য স্বামী তাকে তালাক দিলে তবেই আগের স্বামী তাকে চতুর্থবারের জন্য বিবাহ করতে পারে। সেই অন্য স্বামীর সাথে বিয়েটাও শুধু নিয়মরক্ষার জন্য নয়, বিয়েটা consummate করতে হবে অর্থাৎ তিনতালাকি প্রাক্তন স্ত্রী কে তার খেলনা বিয়ের স্বামীর শয্যাসঙ্গিনীও হতে হবে।"
তুলি বলে, "তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে বিয়ে নয়, শেয়ার মার্কেটে শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে।"
ঈশু বলে, "অনেকটা সেরকমই ব্যাপার। হিন্দু সমাজে গৌরীদান, সতীদাহ এসব তো অনেক কষ্টে বন্ধ হয়েছে। তবে পুরুষরা যখন বহুবিবাহ করতে পারতো তখনও মেয়েদের সেই অধিকার ছিল না। কারণ পু্রুষের কাছে নারী চিরকালই আসবাবের মতো বস্তুবিশেষ এবং উপভোগের সামগ্ৰী। নারী কী করতে পারে বা পারে না সেটাও পুরুষ সমাজপতিরাই ঠিক করে দেবেন।"
সুমন বলে, "তোর কথায় এমন ক্ষুরধার যুক্তি যে তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই"।
ঈশু বলে, "দ্যাখ জেঠু, এসব কথা বলতে কিন্তু আমারও খারাপ লাগছে যেমন লাগছে তোর শুনতে। কিন্তু এসব তো বাস্তব সত্য। হয়তো ভবিষ্যত সমাজে এমন অসাম্য, অবিচার থাকবে না। তখন আমাদের মতো কেউ এমন আলোচনা করবে কেবল অতীত বিচ্যূতি পর্যালোচনার জন্য। তবে আমার জীবদ্দশায় তেমন দিন আমি দেখে যেতে পারবো বলে মনে হয় না।
সুমন বলে, "না রে ঈশু, তোর কথা শুনে আমি কিচ্ছু মনে করছি না। বরং ভালো লাগছে আমাদের মধ্যে এমন একজন আছে যে এসব ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করে। আমরা এই আলোচনা করছি র্যাশনাল এ্যাঙ্গেল থেকে। এখানে ব্যক্তির বিচ্যূতি নয় সমষ্টিগত আচরণই বিচার্য। আর বাস্তব সত্য, তা যতোই কঠিন, অস্বস্তিকর হোক, তার মুখোমুখি না হতে পারলে যেভাবে হোক তা অস্বীকার করতে হবে তেমন স্বভাব আমার নয়। তো এহেন বঞ্চনা, অবিচারের বিরুদ্ধে ফেমিনিস্ট মুভমেন্টের শুরুটা কী ভাবে হয়েছিল?"
নারীবাদের ধারণা
ঈশু বলে, "উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ইংল্যান্ড, আমেরিকার কিছু উদ্যমী মহিলা শুরু করেন এই মুভমেন্ট। প্রথমে তা সীমিত ছিল বিবাহ, সন্তান প্রতিপালন, সম্পত্তির উত্তরাধিকার ইত্যাদিতে সমানাধিকারের দাবিতে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে তা বিস্তৃত হয় রাজনৈতিক ও আইনী ক্ষেত্রেও। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে মহিলাদের ভোটাধিকারের দাবির স্বীকৃতি এই আন্দোলনকে জোরদার করে। ক্রমশ বাল্যবিবাহ, গৃহে বা কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা, অনৈতিক শোষন ইত্যাদি বিষয়গুলি জনআলোচনা, গণবিতর্কে উঠে আসে। কিছু উদারমনস্ক পুরুষও মহিলাদের এই আন্দোলন সমর্থন করেন। তবে দেখা যায় কিছু দ্বিচারিতাও।
চুনি বলে, "দ্বিচারিতা! মানে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড? কীরকম?"
ঈশু বলে, "যেমন ধর যে বছর ভারতে হিন্দু ম্যারেজ এ্যাক্ট পাশ হয় সেই ১৯৫৬ সালেই মিশরের রাষ্ট্রপ্রধান গামাল আবদেল নাসের আইন করে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যমূলক আচরণ বা Gender Discrimination নিষিদ্ধ করেন। তবে একই সাথে তিনি ফেমিনিস্টদের রাজনৈতিক সক্রিয়তাও দৃঢ় হাতে দমন করেন। অর্থাৎ, আগে যা বলেছিলাম, পোষা কুকুরকে যতটুকু পাঁউরুটির টুকরো ছুঁড়ে দেবো তাতেই সে খুশিতে ল্যাজ নাড়বে। রাজনৈতিক পরিমন্ডলে আবার মহিলাদের মাথা গলাবার দরকার কী বাপু। হয়তো নাসেরের সেই দমননীতির মূলে কাজ করেছিল মহিলাদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ফলে ভবিষ্যতে পুরুষশাসকদের গদি টলে যাওয়ার ভয়।"
মলয়দা এসে বলেন, "চিতার কাছে শুনলাম তোমরা নাকি সিরিয়াসলি কোনো আলোচনায় মগ্ন। খুব ভালো। কেবল হালকা ঠাট্টা ইয়ারকীতে মজে না থেকে বাইরে বেড়াতে এসে খোলামেলা পরিবেশে কিছু বিষয়ে আলোচনা আমাদের বোধবুদ্ধি, ভাবনাচিন্তার পরিসর বিস্তারে সাহায্য করে। তবে চলো আমরা আগে খেয়ে আসি। তারপর যতক্ষণ খুশি আলোচনা কোরো।"
তুলি বলে, "এত তাড়াতাড়ি? সবে তো আটটা বাজে!"
মলয়দা বলেন, "বলাই আজ একটু তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করতে চায়। বাড়িতে কিছু কাজ আছে বলেছে। তবে আমিও বলে দিয়েছি, কাল আমাদের ক্যাম্পফায়ার। কাল কিন্তু আমরা নটার আগে খাবো না।"
ওরা মলয়দার কথায় সায় দিয়ে খেতে যায়।
রাতের খাওয়া সেরে ওরা সেই সিঁড়িতে ফিরে আসে। এতক্ষণ তুলি, চুনি মাঝে মধ্যে দু একটা প্রশ্ন করা ছাড়া আর কিছু বলে নি। ঈশু বলে, "জেঠুটা আমায় ঘাঁটাচ্ছে আর আমিও সমানে বকবক করে যাচ্ছি। তোরা বোর হচ্ছিস না তো?" ওরা সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, না, না।
তুলি বলে, "কোনো আউটিংয়ে এসে এরকম আলোচনার অভিজ্ঞতা আমার আজ অবধি হয়নি। বেশিরভাগ সময়ই মলয়দা যা বললেন তাই হয়। হালকা ইয়ার্কি ফাজলামি, এর তার পেছনে লাগা। নিছক টাইম পাস। তবে জানিস জেঠু, এক ক্লাসে পড়লেও, ঈশুর সাথে এভাবে কোনোদিন আলোচনা হয় নি। ও খুব চুপচাপ থাকে। আজ তুই এইসব প্রসঙ্গ তুললি বলে ও এতো কথা বলছে। নিজে থেকে তো ও কথাই বলে না প্রায়"।
চুনিও বলে, "আমারও খুব ভালো লাগছে এই আলোচনা। কত কী জানতে পারছি।"
জেঠুর জ্যাঠামি
- "এতদূর আমরা ঈশুর থেকে যা শুনলাম" এবার সুমন আলোচনায় ঢোকে, "তা তথ্য এবং যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ। দ্বিমত হওয়ার জায়গা নেই। তাই ঈশুর সাথে আমি একমত। তবে আমারও কিছু ভাবনা আছে, পুরুষের হয়ে সাফাই দিতে নয়। বলতে চাই এমন কিছু প্রবৃত্তিগত প্রবণতার কথা যার প্রভাব শুধুমাত্র পুরুষের জীবনেই নয়, মানবজীবনেও প্রায় নিয়তির মতো অমোঘ। আমি যা বলতে চাই তা সেই প্রবণতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পুরুষের বিচ্যূতিমূলক আচরণের যৌক্তিকতা খুঁজতেও নয় বরং তার পশ্চাৎপট অনুধাবন করতে। আমি যা বলবো তা আমি যেভাবে ভাবি। আমি তা তথ্য, প্রমাণ দিয়ে ঈশুর মতো প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না। তবে যুক্তি, অনুসিদ্ধান্ত, উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যার চেষ্টা করতে পারি। তোরা মুক্ত মনে ভেবে দেখতে পারিস তা কতটা গ্ৰহণযোগ্য। কিছু প্রসঙ্গ কিন্তু বেশ অস্বস্তিকর লাগতে পারে। তোরা যদি রাজি থাকিস তাহলেই এগোনো যায়।"
ঈশিতা বলে, "দ্যাখ জেঠু, আমরা চারজনই প্রাপ্তবয়স্ক। যাদবপুর মূলতঃ একটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ও অপেক্ষাকৃত নবীন। তা প্রেসিডেন্সি বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রাচীন, ঐতিহ্যময় নয় তবু এখানেই বুদ্ধদেব বসু স্থাপনা করেছিলেন তুলনামূলক সাহিত্যের মতো একটি নতুন ও আধুনিক বিভাগ। কবে? সেই ১৯৫৬ সালে। কী আশ্চর্য আপতন দ্যাখ, এই সালটা আমাদের আলোচনায় তিনবার ঘুরেফিরে এলো। তাই একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাওয়ার সুযোগ পেয়ে আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করতে পারি। সেক্ষেত্রে তোর আলোচনায় আমাদের অস্বস্তি হবে কেন?"
তুলি বলে, "কিন্তু যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই তো নীতিগতভাবে হওয়া উচিত মুক্তচিন্তার পৃষ্ঠপোষক। আমাদের ভাবনা চিন্তাতেও তাই মুক্তচিন্তার প্রতিফলন ঘটা উচিত। কোনো প্রচলিত প্রথা বা মতবাদ যদি আমাদের রুচি, ধারণায় যথার্থ না মনে হয় আমরা পাল্টা যুক্তি, তথ্য, বিশ্লেষণ সহকারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করতে পারি। না হলে উপেক্ষা করতে পারি। এটাই যুক্তিবাদী এবং উদারনৈতিক মনোবৃত্তির পরিচয়। যুক্তি, বিশ্লেষণ শিকেয় তুলে উন্নাসিকতা দেখিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা বা অসহিষ্ণুতার বশবর্তী হয়ে উগ্ৰতা, অশালীনতার প্রকাশ মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। যদি আমরা সজ্ঞানে মুক্তচিন্তার অনুশীলন না করতে পারি তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কেবল ডিগ্ৰি হাসিলের করুণ কসরতে পরিণত হয় - তাই না?"
ঈশু বলে, "একদম তাই। সিলেবাস ভিত্তিক পড়াশোনা হয় ক্লাসে - কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বই পড়া, পারস্পরিক আলাপ আলোচনা, মতবিনিময় এসবই তো আমাদের কলেক্টিভ কনসাসনেশ সমৃদ্ধ করার মাধ্যম। আউটিংয়ে এসে কেবল খেজুরে আড্ডা না মেরে যেভাবে আমাদের আলোচনা নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হচ্ছে, আমার তো ভালো লাগছে। কিছুটা আন্দাজ করতে পারি এখান থেকে আলোচনাটা কোন দিকে যেতে পারে। তবু তোর মুখ থেকেই শুনতে চাই। তোর দ্বিধার কোনো কারণ নেই জেঠু। যা বলতে চাস আকারে ইংগিতে নয়, সোজাসুজি বলতে পারিস। মনে হয় আমরা সবাই তা নিতে পারবো। এতক্ষণ তো আমিই কথা বলে গেলাম। তোর ভাবনাটাও তো আমাদের জানা উচিত। তোরা কী বলিস?"
তুলি ও চুনিও ঈশুর কথায় সায় দেয়।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।