আত্মপরিচয় পর্ব
সন্ধ্যার আগে ওরা ফিরে আসে বাংলোয়। বলাইদার কিশোর সহকারী বাবলু ধামায় করে মুড়ি আর থালায় পিঁয়াজি কাঁচা লঙ্কা নিয়ে আসে। এরপর চা আসবে। এবার দলে দুটি নতুন ছেলে এসেছে। মলয়দা বললেন, "একটা সেল্ফ ইন্ট্রোডাকশন হলে কেমন হয়? আমরা কয়েকজন তো একে অপরকে চিনি। তাহলে নতুন যারা এসেছে তারা আমাদের, আমরাও তাদের জানতে পারি। অপরিচয়ের বরফ না গললে তো বেড়াতে এসে আনন্দ নেই, তাই না।" ওরা সবাই সায় দেয় মলয়দার প্রস্তাবে।
ইনস্ট্রাক্টরদের মধ্যে মলয়দা যাদবপুরেরই চাকরি করেন। ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে, পাশ করে চলে যায় কিন্তু উনি JUMAHC এর সাথে অনেকদিন ধরে যুক্ত। শান্ত, স্বল্পভাষী, মৃদুহাস্যময় মানুষটিকে দেখলেই ভালো লাগে।
মধ্যতিরিশের অমিয়দা ও সুশীলদা গেস্ট ইনস্ট্রাক্টর। ওরা দুজনে অনেকদিন ধরে হিমালয়ে যাচ্ছেন একসাথে। মলয়দার সাথেও পূর্বপরিচিত। মলয়দার অনুরোধেই এসেছেন এখানে। সদ্য বেসিক কোর্স করা কটা ছেলেমেয়ে প্রথমবার শুশুনিয়ায় প্র্যাক্টিসে আসছে। নতুন জায়গায় রকফেস, রুট কিছুই ওদের জানা নেই। অনভিজ্ঞতায় বা উৎসাহের আতিশয্যে যাতে কোনো দূর্ঘটনা না হয়ে যায় সেই জন্য এসেছেন তাঁরা। অমিয়দা হাসিখুশি মানুষ। ওদের সাথে এর মধ্যেই বন্ধুর মতো মিশে গেছেন। নামের মতোই সুশীলদাও মলয়দার মতো শান্ত, স্থিতধী। পাহাড়ে এমন মানুষ পাশে থাকলে ভরসা হয়।
পূর্বপরিচিতদের মধ্যে বরুণ ও চিন্ময় মেকানিক্যাল ইঞ্জিয়ারিং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বরুণ শান্ত, চুপচাপ। চিন্ময় ঠিক উল্টো। প্রাণশক্তিতে ভরপুর। দোহারা চেহারা। চুলটা বক্সারদের মতো কদমছাঁট। সাজপোষাক এ্যালবেলে। মুখে সর্বদাই লেগে আছে অমলিন হাসি। বন্ধুরা ওর নাম দিয়েছে চিতা। চিন্ময় তালুকদার থেকে আদ্যক্ষরী চিতা সবার খুব প্রিয়। তাই "এ্যাই চিতা জলটা দে না", "এই চিতা ওটা নিয়ে আয় না" বন্ধুদের এমন ফরমাশ লেগেই থাকে। কখনো বা শীতের ভোরে স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণতা ছেড়ে বেরোতে অনিচ্ছুক কোনো মেয়ে নেকুপুষুমুনুর মতো শরীর মুচড়ে, চোখ সরু করে আদিখ্যেতা করে বলে "চিতাআআআ চা টা নিয়ে আয় না রে।" ফরমাশের শেষে আবার আদুরে মেনীর মতো যোগ করে "প্লিইইইজ"।
সব বোঝে চিতা। তবু মুখে সামূদ্রিক বাতাসের মতো মন ভালো করা হাসি মেখে দুহাতে থালায় করে দু চারটে চায়ের কাপ নিয়ে টেন্টে এসে বলে, "নাও মামণিরা, চা খেয়ে উদ্ধার করো"। বোঝাই যায় এমন ফরমাশ শুনে চিতা তো কিছু মনে করেই না বরং উপভোগ করে মেয়েদের আদুরেপনা। তবে শুধু মেয়েদের নয়, সবাইকে সাহায্য করায় ও যেন সদাই উন্মুখ। তাই মালের ব্যাগ বাসের ছাদে তোলা, জল আনা বা বন্ধুদের ফাইমরমাশ খাটায় ওর কোনো হেলদোল নেই। এমন নিঃস্বার্থ, উদার মনের ছেলে যে কোনো টিমের প্রাণ। ও একাই অনেকটা জড়িয়ে ধরে রাখে সবাইকে। সবাই তাই চিতা বলতে অজ্ঞান। এসবই দলে ঘোরার মজা। কতদিন এ দল থাকবে জানা নেই। কলেজ ছাড়লেই হয়তো ছানা কেটে যাবে। সবাই ছড়িয়ে যাবে যে যার পথে।
গৌরব তৃতীয় বর্ষ ইলেকট্রিক্যাল। সুন্দর স্বাস্থ্য। দলে বেড়াতে এসেও সে একটা মোটা বই নিয়ে এসেছে। সময় পেলেই দলের হৈচৈ থেকে একটু দুরে বসে ও বই পড়ে। আড্ডায় তার বিশেষ উৎসাহ নেই। তবে এজন্য ওকে কেউ আঁতেল ভাবে না। পেছনেও লাগে না। সবাই জানে ও মিতভাষী, ভাবুক টাইপের ছেলে। তবে ক্লাইম্বিংটা ও সিরিয়াসলি করে। বেশ ভালো পারেও।
বরুণ, চিন্ময়ের সাথেই এক ক্লাসে পড়ে চন্দ্রিমা বা চুনি। মাজা রঙ, ছোটোখাটো, কমনীয় চেহারা, শান্ত স্বভাব। রিনরিন করে উইন্ড চাইমের মতো আলতো গলায় ওর কথা বলার ভঙ্গিটা খুব শ্রুতিমধুর। চুনি হচ্ছে সেই ধরনের মানুষ যার সাথে কারুর ব্যক্তিত্বের সংঘাত হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। মুখের থেকে ওর চোখই বেশি কথা বলে। চুনিকে দেখে ভবিষ্যতের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বা বর্তমানে পাহাড়ে যাওয়া রাফ-টাফ মেয়ে বলে মনেই হয় না। কিন্তু চিতার মতো চুনিও দলের কাজে হাত লাগাতে সদা তৎপর। ওর সাথে বরুণের একটা মাখো মাখো ভাব ডিসেম্বরে কোর্সেই লক্ষ্য করেছে সবাই।
তা বলে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, দুরে দুরে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর মতো জোড়ে ওদের দেখাই যায় না প্রায়। দলের মধ্যে থেকেই ওরা দুজনে কখনো একসাথে একা হয়ে যায়। তখন ওদের নীরব দৃষ্টির মধ্যে ফুটে ওঠে বাঙ্ময় রসায়ন। এসব খেয়াল করলে বোঝা যায়। তবে ওদের দুজনকে কখনো একসাথে একটু একান্তে দেখলে সবাই ইচ্ছে করে এড়িয়ে যায়। থাকুক ওরা খানিক নিজেদের মধ্যে একাত্ম হয়ে।
তিলোত্তমা বা তুলি ফর্সা, সুন্দরী, খুব প্রাণবন্ত মেয়ে। হাসলে গালে টোল পড়ে। তখন আরো মিষ্টি লাগে ওকে দেখতে। ও হাসেও খুব। গোলগাল আদুরে চেহারা হলে কী হয়, দারুণ ফিটনেস। শরীরে যৌবনের ঐশ্বর্য কিন্তু স্বভাবে কৈশরের চঞ্চলতা এখনো যায় নি ওর। তুলি হচ্ছে সেই ধরণের মেয়ে যাকে বন্ধু হিসেবে খুব ভালো লাগে, কিন্তু একান্তে গাঢ় চোখে তাকিয়ে "আমি তোকে ভালোবাসি" বলা যায় না। হয়তো সরল হেসে বলবে, "সে তো আমিও বাসি তোদের, খুউউউব, তোকে, চিন্ময়কে, বরুণকে,..।'
তখন কি বলা যায়, "না রে, অমন ভালোবাসার কথা বলছি না?" বিশ্বাস নেই, ও হয়তো বলবে, "তবে?" তখন থতমত খেয়ে "না, মানে, ইয়ে, তোকে আমার একটু অন্যরকম ভালো লাগে, মানে...।" - বাস্তবে বলার আগেই এমন সব কাল্পনিক কথোপকথনের সম্ভাবনা মাথায় এলে অন্যরকম ভালো লাগার ভাবনা উপে যেতে পারে। তাই কারুর মনে এলেও এমন কথা হয়তো ওকে বলে না কেউ।
জীবনে প্রেম, বিশেষতঃ প্রথম প্রেম সাধারণত ভেবে চিন্তে হয় না। তা প্রায়শই আচমকা হোঁচট খেয়ে পড়ার মতো ঘটনা। তাই তো বলে প্রেমে পড়া। কেউ বলে না, অমুকের প্রেমে উঠেছি। তুলি কোনোরকম চোখইশারায় ডাক দেওয়া বা বিশেষ নৈকট্য খোঁজায় নেই। তাই সবার সাথেই ও হৈ হৈ করে মেশে। যেমন চিতা, তেমন তুলির মতো মেয়েরাও দলের প্রাণ। ও পড়ে ইংলিশে অনার্স।
দলের মধ্যে সুমনকে সব থেকে ভাবিয়েছে ঈশিতা বা ঈশু। এই নিয়ে তিনবার জেঠু ওদের সাথে এলো। প্রথমটা বেসিক কোর্স আর দুটো প্র্যাকটিস। তবু ওকে ঠিক বোঝা যায় না। ও তুলির সাথেই পড়ে ইংলিশে অনার্স। ঈশুও বেশ ফর্সা। পানের মতো ধারালো মুখ, টিকোলো নাক। চিবুকের পেলব ডৌল। হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হাসলে জমাট ভুট্টাদানার মতো সুন্দর দাঁতের সারিতে চোখ আটকে যায়। তবে সে এক দূর্লভ ঘটনা। কালাহারিতে বৃষ্টির মতো। ওর সুন্দর মুখশ্রী, দীঘল অঙ্গসৌষ্ঠবের জন্য ওকে খুব আকর্ষণীয় লাগার কথা। কিন্তু ওর দিঘির মতো শান্ত চোখে গ্ৰীষ্মের মধ্যাহ্নের নির্জনতা, মাপা কথা, মার্জিত আচরণ এসব মিলিয়ে এমন একটা আভিজাত্যময় ব্যক্তিত্ব ওকে ঘিরে থাকে যে বয়সের তুলনায় ওকে বেশ প্রাজ্ঞ মনে হয়।
পড়াশোনাতেও দারুণ ভালো ও। তাই হয়তো ছেলেরা ওর কাছে ঘেঁষতে একটু অস্বস্তি বোধ করে। তাছাড়া বয়কাট চুল ও দিদিমণি মার্কা চশমায় - ‘আমি ফেমিনিস্ট' - এহেন একটা বিজ্ঞাপন যেন ও ইচ্ছে করে ঝুলিয়ে রাখে। মনে হোতো, কারণ যাই হোক, কখনো ও ইচ্ছে করে একটা খাঁচায় ঢুকে এখন আর বেরোবার দরজা খুঁজে পাচ্ছে না।
ঈশু সর্টশ পরলে ইউক্যালিপটাসের পেলবতা লজ্জা পায়। বডি হাগিং টপ পরলে কোমরের বালি ঘড়ির বাঁকে দৃষ্টি পড়লে থমকে যায় দ্রষ্টার সময়। অন্যমনস্ক টি শার্টের ফাঁক দিয়ে স্নিগ্ধ বালিয়াড়ির আভাস মায়া ছড়ায়। এই সব মিলিয়ে ওকে ঘিরে সৃষ্টি হয় এমন এক মোহময় আবেশ যার ফলে ওর হাবভাব একটু নরম, সহজগম্য হলে ওর আশপাশে ভ্রমরের ভীড় অনিবার্য। তাই হয়তো ওর আরোপিত মুখোশের সাথে স্বেচ্ছারোপিত সখ্যতা। এসব ছিল জেঠুর অনুমান।
দলের বাকি দুটি নতুন ছেলেও ভালো কিন্তু ওদের ভীড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো বৈশিষ্ট্যহীনতা মনে দাগ কাটে না। যেন সাগরবেলায় আঙুল দিয়ে লেখা নাম। তাই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও চিতা, তুলি, চুনি, ঈশু, অমিয়দা - নানা কারণে থেকে যায় স্মৃতিতে, বাকিরা হয়ে যায় ধূসর।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।