শব্দেরা বিশ্রামে তখন
প্রায় মধ্যরাত। পাহাড়ে ওঠা নামা, সারাদিন প্র্যাক্টিস করে সকলেই ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে। সুমন আগে নেমে একটু বিশ্রাম নিয়েছে। ওর তাই ক্লান্ত লাগছিল না। ও মলয়দার ছোট্ট ক্যাসেট রেকর্ডারটা নিয়ে একটু দুরে সেই পাথরটায় বসেছে। ওখানে আস্তে চালালে কারুর ঘুমের ব্যাঘাত হবে না। চলছে ওর খুব প্রিয় একটা গান। মলয়দারও হয়তো প্রিয়। তাই নিয়ে এসেছিলেন ক্যাসেটটা।
आप की याद आती रही, रात भर
चशम-ए-नम मुस्कुराती रही, रात भर
মানেটা ভাবানুবাদে এরকম -
সারারাত ভাসতে থাকে তোমার স্মৃতিকথা
সাথী হয়ে হাসে মোর ভিজে চোখের পাতা
অনবদ্য গানের কথা। অপূর্ব গায়কীতে সুরের আবেগমথিত মূর্ছনা। স্থায়ী ও অন্তরার মাঝে ইন্টারলিউডে রাতের গানেও সরোদে রাগ ভৈরবীতে ভোরের স্নিগ্ধতার পরশ। দ্বিতীয় ইন্টারলিউডে বাঁশির সুরে হা হা শুন্যতা। এহেন নানান আবেশে মাখামাখি এই গানটা বহুবার শুনেছে সুমন আগে। তবু শুশুনিয়ায় জোৎস্নালোকিত নিস্তব্ধ চরাচরে সেই বহুবার শোনা গানটির অভিঘাতে আবারও কোথাও কিছু জমাট বেঁধে ওঠে। ঝর্নাতলায় চুনির গান শুনেও অমন লেগেছিল।
গানের মাঝে পাশে এসে চুপটি করে বসেছে ঈশু। আকাশে ঝকঝকে পূর্ণিমার চাঁদ। ঈশুর গা থেকে আসছে মিষ্টি সুবাস। গানটা শেষ হতে সুমন বলে, "কী রে, শুতে যাস নি?" ঈশু অন্যমনস্ক গলায় বলে, "ঘুম আসছে না - কাল চলে যাবো - অদ্যই শেষ রজনী - এরপর গরম পড়ে যাবে - অনেকদিন আর বেরোনো হবে না - বড্ড তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল তিনটে দিন।"
ওর দিকে না তাকিয়ে আত্মমগ্ন হয়ে কথাগুলো বলছিল ঈশু। সুমন ভাবে, হোলো কী মেয়েটার! এমন ভাবালুতা তো আগে কখনো দেখেনি ওর মধ্যে? দুরে তাকিয়ে আছে ঈশু। কিছুই সেভাবে দেখছে না হয়তো। জোৎস্নায় চরাচরের অস্পষ্টতা কিছুটা স্পষ্ট হয় মাত্র। বিশেষ কিছু বোঝা যায় না। ঈশুর দৃষ্টিতেও তেমনি বিহ্বল শুন্যতা। মুখের ধারালো আভিজাত্য মৃদু বিষন্নতায় মোলায়েম দেখায়। একটু আগে আগুনের পাশে নৃত্যরতা উচ্ছল মেয়েটাকে খুঁজে পায় না সুমন। ওকে দেখে আগেও সুমনের মনে হয়েছে হয়তো ওর কোনো বিষাদময় অতীত আছে। ও তা লুকিয়ে রাখতে চায়। তাই আপাত কাঠিন্য দিয়ে ঢেকে রাখে নিজেকে। কিছু অসতর্ক মূহুর্তে তা সামান্য প্রকাশ হয়ে পড়ে।
ঈশু বলে, 'গানটা আর একবার চালাবি জেঠু? আমি পুরোটা শুনতে পেলাম না। আগে কখোনো শুনিনি। কিন্তু প্রথমবার একটু শুনেই খুব ভালো লাগলো। তুই জানিস গানটা কে গেয়েছেন?"
সুমন বলে, গানটি মুজফ্ফর আলীর প্রথম পরিচালিত ছবি 'গমন' সিনেমার। গেয়েছেন ছায়া গাঙ্গুলী। সুর জয়দেবের। জীবনে প্রথমবার সিনেমায় নেপথ্য সংগীত গেয়ে এই গানটির জন্য ছায়া গাঙ্গুলী শ্রেষ্ঠ মহিলা নেপথ্য কণ্ঠশিল্পীর রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পান। জয়দেবও পান রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। সিনেমাটা দেখিনি কিন্তু গানটি বহুবার শুনেছি। গানটা খুব প্রিয় আমার।"
গানটা আবার চালায় সুমন। আত্মমগ্ন হয়ে শোনে ঈশু। গান শেষ হয়। সুমনের পরিচিত এক সুলেখক পাহাড়ি দাদার একটি লেখার শিরোনাম সুমনের খুব মনে ধরেছিল - 'শব্দেরা বিশ্রামে আজ'। তার প্রেক্ষিত ছিল ভিন্ন। শুশুনিয়ায় প্রায় মধ্যরাতে ঐ গানটি শেষ হওয়ার পর সুমনেরও মনে হয়েছিল তখন কথাকে একটু ছুটি দেওয়াই ভালো। ওরা দুজনে অনেকক্ষণ সেই জোৎস্নাস্নাত নির্জন রাতে নির্বাক বসেছিল। অন্তরে উপলব্ধি হয় কিছু অবোধ্য গুঞ্জন। হয়তো একেই বলে চন্দ্রাহত অবস্থা। এক সময় সুমন বলে, "ঈশু, রাত অনেক হোলো, এবার চল শুয়ে পড়া যাক। কাল ভোরে উঠতে হবে তো।"
চটপটে ঈশু - নড়বড়ে জেঠু
পরদিন সকাল থেকে সবকিছু চললো ছবির মতো নিঁখুত ভাবে। ওপরে পৌঁছে অমিয়দা সুমন আর ঈশুকে নিয়ে গেলেন একটা খাড়া পাথরের কাছে। মাটি থেকে ফুট তিরিশেক উঠে একটা ফুট ছয়েকের সমতল চাতাল মতো। তারপর ঢালটা আবার ওপরে উঠে গেছে।
উনি বললেন, "এই তিরিশ ফুটের ফেসটা তোমরা অন্তত বার পাঁচেক চড়বে। আমি লিড করছি। বিলে করার প্রয়োজন নেই কারণ মাঝে কোথাও এ্যাঙ্কর করার জায়গা নেই। পাথরের ঢাল প্রায় আশি ডিগ্ৰি খাড়া। হেলমেট, নি-ক্যাপ, এলবো-ক্যাপ পরেছি। স্লিপ করলে ঢাল বেয়ে স্লাইড করে পড়ার সময় হাত পা হাঁটু দিয়ে ঘষটে পতনের গতি কমিয়ে দেবো। চিন্তা কোরো না। তোমরা দুজনে জমিতে রকফেস থেকে ফুট ছয়েকের মধ্যে সতর্ক হয়ে দাঁড়াবে। স্লিপ করে মাটিতে পড়লে যাতে ভারসাম্য না হারিয়ে ফেলি সে জন্য আমায় ধরে নেওয়ার চেষ্টা করবে।
ঈশু বলে, "অমিয়দা আমি কি ওপাশ দিয়ে উঠে আপনাকে বিলে করবো? আপনি দড়ি ছাড়া উঠছেন, আমার ভয় করছে।"
অমিয়দা বলেন, "না রে ভাই না, অতো ভয়ের কিছু নেই। আসলে এইখান থেকে বছর দুয়েক আগে আমি একবার পড়ে গেছিলাম। দিন তিনেক হাসপাতালে শুয়ে ভেবেছি আমি ওখান থেকে পড়লাম কী করে। তারপর সুস্থ হয়ে আমি এই ক্লাইম্বটা দড়ি নিয়ে কয়েকবার করে বুঝেছি দোষটা ছিল আমারই। মাত্র একটা ভুল লেগ মুভমেন্ট - নাহলে ওখান থেকে পড়ার কথা নয়। তারপর যতবার শুশুনিয়া এসেছি এই রুটটা দড়ি ছাড়া করেছি। এটা আমার কাছে মন্দিরে বিগ্ৰহ দর্শনের মতো। মনে জোর পাই। ভয়টা জয় না করতে পারলে মনে বাসা বেঁধে যায়। তবে কাল বলেছিলাম মনে আছে? Calculated Risk. তাই প্রয়োজনীয় সুরক্ষা নিয়েছি। তোমরা নীচে আছো ধরে নেওয়ার জন্য। পড়ার সম্ভাব্য জায়গাটা মাটি থেকে ফুট পনেরোর মধ্যে, তাই খুব ভয়ের কিছু নেই।"
অমিয়দা উঠতে শুরু করলেন। ওরা দুজনে সতর্ক হয়ে দুপাশে দাঁড়ায়। অমিয়দা কয়েক মিনিটের মধ্যে ওপরে উঠে গেলেন। ওঠার সাবলীল ভঙ্গিতেই বোঝা যায় বহুবার করে অভ্যস্থ হয়ে গেছেন। তবু যেভাবে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছিলেন সুমনেরও একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কাল ডেমো দেওয়ার মতো আস্তে আস্তে নয়, এখন বেশ দ্রুত উনি উঠে গেলেন। পড়ে যাওয়ার মতো জায়গাটা যে কোথায় তা বোঝাও গেল না।
ঈশু বলেও ফেললো, "অমিয়দা, পড়ে যাওয়ার মতো সেই জায়গাটা কোথায়? আপনি এতো তাড়াতাড়ি উঠে গেলেন, কিছুই তো বুঝতে পারলাম না।"
অমিয়দা ওপর থেকে মুচকি হেসে বলেন, "তা আমি বলবো না। তোমরা নিজেরা চড়তে গিয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা করবে।" বিলে করার প্রয়োজন না থাকলেও অমিয়দা কোমরে দড়িটা বেঁধে উঠেছিলেন। ওপরে গিয়ে একটা পাথরে এ্যাঙ্কর করে কোমরে দড়ি বেঁধে অমিয়দা একদম চাতালের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, "এবার ঈশু উঠে এসো। আমি তোমায় বিলে করছি। জেঠু, তুমি ওর চড়াটা ভালো করে খেয়াল করো।"
অমিয়দা ঈশুকে রকের কিনারায় দাঁড়িয়ে শোলডার বিলে করতে থাকেন। (১৫ তম পর্বে ছবি C-2 অনুযায়ী তবে এখানে জায়গা অনেকটা ছিল)। বসে বিলে করলে যেমন দড়িটা কোমরের পিছন দিয়ে একপাক ঘুরিয়ে নেওয়া হয় তেমনি উনি এখন দড়িটি পিঠের পিছন দিয়ে কোনাকুনি এনে কাঁধের ওপর দিয়ে নীচে নামিয়ে দিয়েছেন। এতে দড়িটা শরীরের অনেকটা অংশে লেগে থাকায় ঘর্ষন বাড়ে। ঈশু পড়ে গেলে পিঠে দড়ির ঘর্ষণজনিত বাধা ও কাঁধের সাপোর্টে ওকে ধরে নেবেন। হাতে বিশেষ জোর পড়বে না। অভিজ্ঞ ও দক্ষ না হলে শোলডার বিলে করা উচিত নয়। তবে পদ্ধতিটা শিখে রাখা জরুরী, কারণ পাহাড়ে অনেক সময় খুব সংকীর্ণ জায়গায় বসে বিলে করার উপায় থাকে না।
কাল অমিয়দা যেমন শিখিয়েছিলেন, ঈশু ঠিক সেই রকম ক্লাইম্বিং কল দিয়ে চড়তে শুরু করে। বোঝা যায় মেয়েটা খুব সিরিয়াস। জিমন্যাস্টদের মতো সুঠাম চেহারা ঈশুর। ঠিক অমিয়দার মতোই সুললিত ছন্দে উঠতে লাগলো। সুমন দেখতে থাকে। মাঝে এক জায়গায় একটু থেমে পাথরে হোল্ড খুঁজতে একটু হাতড়ায় ঈশু। পরক্ষণেই প্রত্যয়ী ভঙ্গিতে আবার উঠতে থাকে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওপরে উঠে যায় ও। অমিয়দা কিনারায় ঝুঁকে বিলে করার সময় ওর চড়ার ভঙ্গিটি দেখছিলেন।
উঠে আসতে বললেন, "খুব সুন্দর চড়েছো তুমি। অনেকে এমন হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় করে চড়ে যে মনে হয় রকে কুস্তি করছে। দেখতে তো ভালো লাগেই না অমন চড়া, ওভাবে চড়লে অযথা শক্তি ক্ষয়ও হয়। ওঠা উচিত এই রকম ছন্দময় ভঙ্গিতে। লেগে থাকলে তোমার হবে। ঠিক আছে, এবার তুমি জেঠুকে বিলে করবে। তবে কিনারা থেকে সরে গিয়ে ঐ পাথরে এ্যাঙ্কর করে, বসে। ক্লাইম্বিং কল গুলোও অভ্যাস করবে। আমি যাই গৌরবের সাথে যেটা করবো ভেবেছিলাম কাল, দেখি হয় কিনা।"
অমিয়দা চলে যেতে সুমনও প্রোটোকল মেনে প্রথামাফিক চড়া শুরু করে। কিন্তু পনেরো ফুটের মাথায় এক জায়গায় ডান পাটা বাড়িয়েই ওর মনে হয় বাঁ পাটা নড়বড় করছে। ভারসাম্য হারাচ্ছে শরীর। ক্লাইম্বিং কল টল মাথায় ওঠে। পাতি বাংলায় চেঁচিয়ে ওঠে সুমন, "ঈশু, পা স্লিপ করছে রে।"
ঈশু OK বলে দড়িটা টেনে ধরে। তাও শেষ রক্ষা হয় না। দুটো পাই হঠাৎ স্লিপ করে পাথরচ্যূত হয় সুমন। প্রাণের দায়ে বা ভয়ের চোটে SOS কলটা ঠিকঠাক হয়। একটা গগনভেদী H-O-L-D বেরোয় মুখ দিয়ে। বুকের ভেতরটা খালি হয়ে যায়। ভাবে এই বুঝি পড়লো ধাঁই করে মাটিতে। কিন্তু না, ঈশু দক্ষ বিলেয়ারের মতো আটকে দিয়েছে সুমনের ফল।
শুঁড় ধরে ঝুলিয়ে রাখা আরশোলার মতো খানিক খচর মচর করে আবার পাথরে পা রেখে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ একটা জায়গায় থিতু হয়ে দাঁড়ায় সুমন। নেমে আসার কল ওদের শেখান নি অমিয়দা। তাই সুমন চেঁচিয়ে বলে, "ঈশু এখন ঠিক আছি, নামবো, একটু ঢিল দে।" ঈশু আস্তে আস্তে দড়িতে ঢিল দেয়। সুমন নেমে এসে মাটিতে দাঁড়ায়। এবার মনে পড়ে ক্লাইম্বিং কল। সুমন বলে, I AM OK. ঈশু উপরে অদৃশ্য অংশ থেকে বলে, BELAY OFF.
পুনশ্চ - থাকলো সেই গানটি
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।