জলজ্যান্ত উদাহরণ
সুমন বলে, স্বাভাবিক প্রবণতা এড়িয়ে যাওয়ার একটা হাতেনাতে উদাহরণ দিতে পারি।
তিনজনেই একসাথে বলে ওঠে, কী?
-যেমন ধর, আমি যদি বলি ঈশুকে দেখলে আমার ভালো লাগে কিন্তু ওর বয়কাট হেয়ার স্টাইল দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়, সেটা তোরা অন্যভাবে নিতে পারিস। ঈশুকে নিয়ে আমি তিনজন ফেমিনিস্টকে দেখলাম এক টাইপ কাস্ট। বয়কাট চুল, সিরিয়াস হাবভাব, প্যান্ট শার্ট পরা, কোনো সাজগোজ, অলঙ্কারের বালাই নেই। যেন ফেমিনিস্ট হতে গেলে প্রচলিত নারীসত্তার ইমেজ ত্যাগ করা খুব জরুরী।"
ওর কথা শুনে ওরা তিনজনেই চুপ করে যায়।
সুমন বলে, "ঈশুর আমার কথা খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু ডিসেম্বরে কোর্সে ওকে প্রথম দেখেই এটা মনে হয়েছিল। আজ কথা প্রসঙ্গে বলে ফেললাম, অনধিকার চর্চা হয়ে গেল, প্লিজ কিছু মনে করিস না ঈশু।"
ঈশু বলে, "না না, তোর কথায় কিছু মনে করিনি। তবে তোর সততা আমায় নাড়িয়ে দিলো। এভাবে কেউ মুখের ওপর বলে না।"
তুলি বলে, "জেঠু তুই কিন্তু আমায় বলতে পারিস, আমি কিছু মনে করবো না।"
-"কী বলবো?"
-"এই, যে আমায় দেখে তোর ভালো লাগে। মানে যদি লাগে, তবেই বলিস। মেয়েদের দেখে ছেলেরা কী সব উদ্বুদ্ধ টুদ্বুদ্ধ হয় বলে না, সেরকম কিছু বলতে পারিস।"
-"সেটা বলেই তো তোর হাতে তখন ঝিঁটকি নাড়া খেলাম। যাই বল, বেশ লেগেছে কিন্তু।"
-"সে তো তুই পেজোমি করছিলি তাই। আবার করলে, আবারও ঝিঁটকি নাড়িয়ে দেবো তোর।"
সুমন বোঝে, তুলি কায়দা করে পরিস্থিতিটা হালকা করে দিলো।
আগুনের পরশমণি
চিতা আর বরুণ এসে জানায় ক্যাম্পফায়ার রেডি। ওরা সবাই গিয়ে জড়ো হয় বাংলোর সামনে আঙিনায়। গৌরব আগুন জ্বালায়। দেখতে দেখতে আগুন বেশ চনমনে হয়ে ওঠে।
অমিয়দা কাছে এসে বলেন, "কি জেঠু, এখন আর মুড অফ নেই তো?"
সুমন ওনার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলে, "অমিয়দা, আমি খুব দুঃখিত, আপনার কথা রাখতে পারি নি।"
অমিয়দা সুমনের হাত ছাড়িয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেন, "আরে ঠিক আছে, ঠিক আছে।" হয়তো উনি পাহাড়ে দেখেছেন এর চেয়েও অনেক জটিল পরিস্থিতি, এতো কিছুই নয়। তাই বোঝেন একটু সময় দিলে অনেক ভুল বোঝাবুঝি ঠিক হয়ে যায়, গভীর অভিমানও গলে যায়। তখন নৈঃশব্দও বাঙময় হয়ে ওঠে। আলতো করে বাঁ হাত দিয়ে সুমনের পিঠে হাত বোলান। সেই হাত, যার মধ্যমার কিছুটা নেই। তবে তাতে উষ্ণতায় কোনো ফারাক বোঝা যায় না।
চিতা ঘোষণা করে, "আজ ক্যাম্পফায়ারে বিশেষ আকর্ষণ একটা স্কিট - আঙ্কল স্যামকো গুস্সা কিঁউ আতা হ্যায়। পরিচালক গৌরব। অভিনয়ে গৌরব ও বরুণ। গৌরব করে অমিয়দার রোল। বরুণ সুমনের। সেই জল না পেয়ে সুমনের নেমে আসার পর্ব। ঘটনাটা টেনে, অতিরঞ্জিত ও ক্যারিকেচার করে দেখায় ওরা। সবাই হেসে অস্থির। ওরকম একটা সেন্টু সিচুয়েশনও যে গৌরব অতো রম্যরসময় করে তুলতে পারে তা ওরা কেউ কল্পনাও করতে পারে নি। দুজনের অভিনয়ও দারুন।
আগুন ঘিরে সবার প্রাণখোলা হাসি তামাশায় উধাও হয়ে যায় সুমনের মনের মেঘ। উষ্ণতা ছড়িয়ে যায় ওদের ঘিরে। তুলি আর চুনি কয়েকটা গান গায়। দুজনেরই গানের গলা ভালো। কোর্সেও ওরা ক্যাম্পফায়ারের দিন মাতিয়ে দিয়েছিল। সুশীলদা ভরাট গলায় আবৃত্তি করেন। অমিয়দা রঙ্গ করে শোনান কয়েকটা জোকস।
মলয়দা নিয়ে গেছিলেন একটা ছোট স্যানিও ক্যাসেট রেকর্ডার। তাতে চালিয়ে দিলেন 'Staying Alive' - ৭৭এ রিলিজ হওয়া জন ট্রাভোলটার সেই উদ্দাম ডিস্কো নাচের 'Saturday Night Fever' সিনেমার গান। Bee Gees ব্যান্ডের কম্পোজিশনের ঐ কাল্ট সঙটা একদা সারা পৃথিবীর ডিস্কো প্রেমীদের মাতিয়ে দিয়েছিল। অনবদ্য সে গানের মেলোডি, বিটস রক্তে দোলা জাগানো। মুখ্য গায়ক ব্যারী গিবসের হাই রেঞ্জে হাই পিচ ফলসেটো গায়কীর জন্য মনে হতে পারে গানটি কোনো মহিলার গাওয়া। ঐ গানে ব্যারীর সাথে কণ্ঠ মিলিয়েছে তার ছোট দুই যমজ ভাই - রবিন ও মরিস। পরবর্তীতে বহুবছর ধরে বহুবার শুনেও গানটির মাদকতাময় আকর্ষণ মলিন হয়নি সুমনের মনে।
চিতা যে ভালো নাচে তা ডিসেম্বরে কোর্সের ক্যাম্পফায়ারেই বোঝা গেছিল। তাই গানটা চলতেই, "আরে ব্বাস, স্টেয়িং এ্যালাইভ!" বলে চেঁচিয়ে উঠে পত্রপাঠ নাচতে শুরু করে নিঁখুত ছন্দে। যোগ দেয় গৌরব। সেও ভালো নাচে। একে একে বরুণ, তুলি, চুনি, নতুন দুটো ছেলে এমনকি অমিয়দাও নাচতে শুরু করেন। সবার প্রাণে দোলা লেগেছে বুঝে মলয়দা আবার চালিয়ে দেন গানটা।
আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে হাতে তালি দিচ্ছিল ঈশু, শেষে আর থাকতে না পেরে সেও সবার সাথে কোমর দোলাতে শুরু করে গানের তালে তালে। নিমেষে উধাও ওর সিরিয়াস হাবভাবের আলখাল্লা, যেটে পরে থাকতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে ও। বডি হাগিং জীনস পরা দীঘল দুটো পা, কমলা টপ পরা ছিপছিপে শরীর, সাপুড়ের বাঁশির তালে নাগিনীর মতো আগুনের শিখার পাশে দুলতে থাকে ঈশু। সে এক মনোহরা দৃশ্য!
ঘাসে বসে মুগ্ধতার আবেশে দেখতে থাকে সুমন ওদের সম্মিলিত আনন্দনৃত্য। ঈশু হাতছানি দিয়ে ডাকে সুমনকে। সুমন একদমই নাচতে পারে না। ও সভয়ে হাত নাড়ে। শোনে না ঈশু। কাছে এসে জোর করে ওর হাত ধরে টেনে তোলে, "ওঠতো, চল, চিতা, গৌরব ছাড়া আমরা কেউ বা ছাই নাচতে পারি, গানের তালে তালে শুধু একটু শরীর দোলাবি, ব্যস। দাদুর মতো মাটিতে বসে আছিস কেন ঠুস মেরে?"
এসব হুল্লোড়ের মধ্যেই বলাইদা খিচুড়ি আর আলু পিঁয়াজ ভাজা দিয়ে যান। নাচের শেষে আগুনের পাশে গোল হয়ে বসে ওরা খেতে বসে। সবাই খুব তৃপ্ত। হোঁচট খাওয়া অপরাহ্নের ছানাকাটা মুড আগুন ঘিরে সবার উৎসাহে রূপান্তরিত হয়ে গেছে আনন্দময় পরিণতিতে।
খাওয়ার পর কালকের প্রোগ্ৰাম নিয়ে আলোচনা হয়। তারপর ইচ্ছে না হলেও আলোচনা করতেই হয় ফেরা নিয়ে। অমিয়দা বলেন, "ছাতনার দিকে শেষ বাস এখান দিয়ে বিকেল পাঁচটা নাগাদ চলে যায়। তাহলে আমাদের তিনটে নাগাদ ওপর থেকে নামতে শুরু করা উচিত।"
চুনি বলে, "তিনটে! তাহলে আর কীই বা প্রাকটিস করবো? আজ তো আমি আর চিতা জল আনতে এসে সেরকম কিছুই করতে পারলাম না।"
সুশীলদা বলেন, "আর একটা উপায় আছে, যদি তোমরা রাজি থাকো। তাহলে আমরা ওপরে ছটা অবধিও থাকতে পারি।"
সবাই সমস্বরে হৈহৈ করে ওঠে, "কী, কী?"
সুশীলদা বলেন, "যদি আমরা এখান থেকে ছাতনা স্টেশন হেঁটে যাই তাহলে বাস ধরার জন্য তাড়াহুড়ো করে না নামলেও চলে। আমরা কয়েকবার হেঁটে গেছি। বারো কিমি সুন্দর পাকা রাস্তা, আড়াই ঘন্টার বেশি লাগেনা। তবে মাল আছে আমাদের সাথে। ধরা যাক তিন ঘন্টাই না হয় লাগলো। তাহলেও আমরা সাড়ে সাতটাতেও রওনা হলে, সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবো স্টেশন। ট্রেন আসে এগারোটার পর। চাঁদনী রাতে এ রাস্তায় হাঁটার মজাই আলাদা। কী বলো তোমরা?"
সুশীলদার প্রস্তাবে চিতা, গৌরবের তীব্র সিটির সাথে বাকি সবার সম্মিলিত কণ্ঠে সম্মতিসূচক যে হুল্লোড়টা উঠলো - পৃথিবীর কোনো ভাষায় তা প্রকাশ করা অসম্ভব। সেই উদ্দাম উল্লাসধ্বনী, তীব্র সিটির আওয়াজে কয়েকটা পাখি ভয় পেয়ে ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। বেচারিরা বারান্দার টিনের চালের নীচে কোনো ফাঁক ফোকরে শুয়েছিল বোধহয়।
প্রায়শ্চিত্তের প্রাপ্তি
ডিনারের পর বলাইদা হাঁড়ি কুড়ি নিয়ে চলে গেলেন। গতকাল ডিনারের পর ওরা সবাই যে যার মেস্টিন (হ্যান্ডল ওয়ালা ওভাল শেপের পাত্র, পাহাড়ে খুব চলে) ঝর্ণাতে গিয়ে ধুয়েছে। সুমন বলে, "আজ আমি সবার মেস্টিন মেজে আনবো।"
চিতা বলে, "কেন? তুই কেন একা সবার মেস্টিন ধুতে যাবি? আমরা সবাই মিলে যাই চল, কালকের মতো।"
সুমন বলে, "না, আমি একা সবারটা ধুয়ে আনবো। এটা আমার প্রায়শ্চিত্ত। অমিয়দার কথা না রাখতে পারার। তোরা কেউ যাবি না।"
অমিয়দা সুমনের কথা শুনে হা হা করে প্রাণখোলা অট্টহাস্য করে ওঠেন। বলেন, "ঠিক আছে, এতে যদি জেঠু মনে শান্তি পায়, তোমরা বারণ কোরো না, ওকে যেতে দাও। তাছাড়া কাজ করার অভ্যাস থাকা তো খারাপ নয়।"
চুনি বলে, "জেঠু, আমি যাই তোর সাথে? কথা দিচ্ছি, তোর কাজে একটুও হাত লাগাবো না। শুধু দেখবো।"
চিতা বলে, "কী দেখবি তুই?"
চুনি বলে, "জেঠুকে প্রায়শ্চিত্ত করতে। আমি আজ অবধি কাউকে চোখের সামনে প্রায়শ্চিত্ত করতে দেখিনি। শুধু কাহিনীতে পড়েছি।"
চুনির গম্ভীর মুখে ফচকেমিতে সবার কণ্ঠে হাসির ফোয়ারা ওঠে। সুমনও হাসতে হাসতে বলে, "চল তাহলে।"
ঝর্ণায় গিয়ে চুনি পাঁচিলটার ওপর উঠে পা ঝুলিয়ে বসে। ঝকঝকে জোৎস্নায় সুমন বারোটা মেস্টিন নিয়ে ঝর্ণাতলায় মেঝেতে বসে মাজতে থাকে। চুনি বলে, "জেঠু, এত সুন্দর পরিবেশ, একটা রবীন্দ্রসংগীত গাইতে ইচ্ছে করছে, গাইবো?"
সুমন বলে, "গা না, ভালোই তো। আমি গান শুনতে শুনতে মাজি।"
চুনি নরম গলায় ধরে, "জীবন মরণের, সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে।" এ গানটা যতবার সুমন দেবব্রতর ভরাট গলায়, অনবদ্য গায়কীতে শুনেছে, গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠেছে কিছু অনুভূতি। সেদিন সেই জোৎস্নালোকিত ঝর্ণাতলায় চুনির মৃদু গলায় গানটা শুনে গভীর রাতে নিঃশব্দে বৃষ্টি আসার মতো প্রশান্তি ছেয়ে যায় সুমনের মনে। মনে হয় বারোটা কেন, তিরিশটা মেস্টিন হলেও ক্ষতি ছিল না। সেই চরাচরব্যাপী নিস্তব্ধতায় শুধু ঝিরঝির করে সঙ্গত করে তিনটে সিংহমুখ থেকে অবিরল ধারায় পড়ে যাওয়া ঝর্ণার জল।
পুনশ্চঃ - থাকলো সে রাতে আগুনের পাশে ব্যারীর রক্তে দোলা জাগানো এবং নিস্তব্ধ ঝর্ণাতলায় চুনির গাওয়া জর্জদার কন্ঠে শোনা আবিষ্ট করে দেওয়া - দুটি বিপরীতধর্মী সংগীতের লিংক।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।