মাটিতে নামার ভবিতব্য
সুমন শুয়ে পড়ার পরেও ওদের আড্ডা চলতে থাকে। সুমন ক্লান্ত ছিল। অচিরেই ঘুম এসে যায়। গভীর রাতে নরম স্পর্শে ঘুম ভেঙে যায়। চোখ থেকে রুমাল সরিয়ে দ্যাখে দলের সবাই শুয়ে পড়েছে। একদিকের সীটে ঈশু আর চুনি, ওদিকের সীটে চিতা আর বরুণ কোনোরকমে কেৎরে শুয়ে আছে। গৌরব আছে ইন্সট্রাক্টরদের সাথে পাশের খোপে। দলের দুটো নতুন ছেলে সুমনের আইডিয়া লাগিয়ে ওর একপাশে কাটা কলাগাছের মতো পড়ে আছে। জানলার নীচে ডাঁই করে রাখা সবার স্যাক, পাহাড়ে চড়ার সরঞ্জাম।
তুলি এতক্ষণ ঈশু, চুনির টানা সীটের কোনে কোনোমতে একটু পেছন ঠেকিয়ে বসে ছিল। আর হয়তো পারে নি। মালের পোঁটলা আর ওর পাশে মেঝেতে এক চিলতে জায়গায় ঠেলেঠুলে ঢুকে শোয়ার চেষ্টাতেই হয়েছে সুমনের নমনীয় নিদ্রাভঙ্গ। ওর চোখে নীরব প্রশ্ন দেখে তুলি মিনমিন করে বলে, "বেশ ঘুম পাচ্ছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করলাম বসে থাকতে। আর পারছি না। তুই ঠিক বলেছিলি, একটু শুয়ে নিলে ভালোই হবে। নইলে কাল সারাটা দিন বেশ ক্লান্ত লাগবে। তুই একদম বুক চিতিয়ে শিবের মতো শুয়ে আছিস কেন? একটু সরে শো না বাবা।"
কিন্তু সরবে কোথায় সুমন। জায়গাই তো নেই। এপাশে চালের বস্তার মতো পড়ে আছে দুজন ওপাশে জানলার নীচে মালের পাহাড়। গভীর রাতে চলন্ত ট্রেনে সীটের নীচে আলোছায়াময় সঙ্কীর্ণ পরিসরে তখন অতি বিপজ্জনক নৈকট্যে মিষ্টি তুলির চিকন মুখ। আলেয়ার হাতছানির মতো ওষ্ঠ। চোখের কালো তারায় দক্ষ নাবিকেরও শান্ত পাথারে দিগভ্রষ্ট হওয়ার নিয়তি লিখন। তুলির চেহারাটা ছোটখাটো, গদুগদু টাইপের। ওর রকমসকম, কথা বলার ভঙ্গিও আদুরে। তাই পাশ ফিরে ওকে টেডির মতো জড়িয়ে শুলেই স্থান সংকীর্ণতার সমস্যা মিটে যায়। কিন্তু তা তো আর হয় না। ঘনিষ্ঠতা সেই পর্যায়ে যায় নি।
তাছাড়া মানুষ যেদিন থেকে গাছ থেকে মাটিতে নেমে ছাল পড়া ধরেছে, সেদিন থেকে তাকে ছাড়তেও হয়েছে অনেক কিছু। শুরু হয়েছে ইচ্ছার ওপর সংযমের অনুশীলন। ফলে পশুরা যা স্বাভাবিকভাবে পারে মানুষ তা সভ্যতার শর্তে পারে না। আবার অবদমিত ইচ্ছার বিভ্রান্ত তাড়নায় সভ্য মানুষ যা করে তা পশুসমাজে বিরল। তথাকথিত সভ্যতার সাথে বিবর্তিত মানবের আচরণ তাই আপাতবিরোধীতায় পরিপূর্ণ।
একবিংশ প্রজন্মের যৌবনে চক্ষুলজ্জা কম। তাই তারা জনসমক্ষে একে অপরকে সাবলীলভাবে জড়িয়ে ধরে বীয়ারহাগ দেয়, গালে চুমু খায়। ওষ্ঠেরটা বাঁচিয়ে রাখে বিশেষ জনের বা সময়ের জন্য। হয়তো এসব পাশ্চাত্য প্রভাবের ফল। আন্তর্জালের অবদান। তবু মন্দ কী। প্রকৃতির পরম উপহার তো ক্ষণস্থায়ী। পরে পেশা ও সংসারের যাঁতাকলে পিষে যৌবনের অনেক সুকুমার বৃত্তিই উপে যাবে। জীবনের মহার্ঘ্য এই অধ্যায়ে বেহিসেবি খরচ, সব রহস্যের উন্মোচন না করেও নৈকট্যের কিছু মায়াবী উষ্ণতার আবেশ উপভোগ করতে চাওয়ার ইচ্ছা তাই মোটেও দোষণীয় নয়।
যৌবনের এমন অমল ইচ্ছায় লাগাম টানলে পরবর্তীতে ঘটনাচক্রে আলুনী হয়ে যাওয়া জীবনের সাদাকালো পর্বে বা বার্ধক্যে একাকীত্বের ফাঁকফোকর থেকে উঠে আসতে পারে চাপা দীর্ঘশ্বাস। আশির দশকে একটা চকিত চুম্বনের জন্যেও ভাবতে হোতো আকাশ পাতাল, খুঁজতে হোতো চিলেকোঠার আড়াল। বান্ধবীর গায়ে অজান্তে গা ঠেকে গেলেও মনে হোতো, ভাবছে না তো এ্যাডভান্টেজ নিচ্ছি? বেশীক্ষণ তুলির দিকে তাকিয়ে থাকা নিরাপদ নয় বুঝে চোখে আবার রুমাল টেনে সুমন প্যাসেজের দিকে পাশ ফিরে শোয়। তুলি শোয় জানলার দিকে ফিরে। স্থানের স্বল্পতায়, ট্রেনের দুলুনিতে ওদের পৃষ্ঠদেশ মাঝে মাঝে স্পর্শ করে পরস্পরকে। তবে সেই স্পর্শের ভাষা বিচলিত করার মতো নয়। একটু পরেই আবার ঘুম এসে যায় ক্লান্ত সুমনের।
ছাদে যাক ছেলেরা
ট্রেন লেট করে ছাতনা পৌঁছল পৌনে সাতটা নাগাদ। স্টেশনের বাইরে এসে জানে শিডিউল বাস বেরিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হোলো পরের বাসের জন্য। পরের বাস আসতে কজন ছেলে সবার স্যাক, পাহাড়ে চড়ার দড়িদড়া, সরঞ্জামের পোঁটলা নিয়ে ছাদে ওঠে। তুলি ছটফটে, প্রাণপ্রাচূর্যে ভরপুর। ওরও ইচ্ছে ওদের সাথে বাসের ছাদে বসে যাওয়ার। মলয়দা বলেন, ভেতরে সীট খালি আছে, মোটে ১২ কিমি রাস্তা, বেশীক্ষণ লাগবে না, ছাদে ওঠা নামা পড়তায় পোষাবে না। ওদের কাছে অনেক মাল, ওরা বরং যাক ছাদে। তুলি একটু চাপা বিরস মুখে ভেতরে গিয়ে বসে। কিন্তু মলয়দা ঠিকই বলেছিলেন। এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে লোক ডেকেও পৌনে ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেল শুশুনিয়া পাহাড়ের কাছে। রাস্তার ধারে বলাইদার চায়ের দোকানটাই শুশুনিয়া বাসস্টপ। ওদের নামিয়ে দিয়ে বাসটা চলে গেল। ওদের বারো জনের দলটা ছাড়া সেদিন আর কেউ নামলো না ওখানে।
শুশুনিয়ার প্রেক্ষাপট
শুশুনিয়া তখনো জনবহুল হয়নি। দুরে দুরে ইতস্তত কিছু ঘরবাড়ি। তখন চাষের সময় নয়। তাই চারপাশে বিস্তীর্ণ উষর প্রান্তর। মাঝে মাঝে কয়েকটা বড় বড় প্রাচীন গাছ। ডানদিকে একটু দুরে সমূদ্রতল থেকে প্রায় ১৫০০ ফুট উঁচু শুশুনিয়া পাহাড়। বাঁকুড়া বৃষ্টিবিরল জেলা। তাই শুশুনিয়ার জঙ্গল মূলতঃ পর্ণমোচি বৃক্ষ অধূষ্যিত। সদ্যবিগত শীতে শাল, সেগুন, পলাশ, মহুয়ার পাতা ঝরে যে শুন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল তা বসন্তে নতুন পাতার আগমনে পূরণ হতে শুরু করেছে। প্রাচুর্য এখনো আসেনি তবে তাদের পেলব লালিত্য চোখে পড়ার মতো।
পূর্বঘাট পর্বতমালার শেষপ্রান্তে ছোটনাগপুর মালভূমিতে অবস্থান হেতু শুশুনিয়াতে আছে কিছু চিরহরিৎ বৃক্ষও। তাই তারা সারা বছরই পত্রময়। মার্চে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া অঞ্চলে হালকা গরম শুরু হয়ে যায়। তখন দিনভর শৈলারোহণ প্র্যাক্টিসের সময় ভর দুপুরে সূর্য যখন মধ্যগগনে তখন পিতামহের মতো কোনো প্রাচীন গাছের ছায়া আশীর্বাদ মনে হয়।
কোলে বাংলোর কোলে
রাস্তা থেকে ডানদিকে একটু গিয়ে একটি রেস্ট হাউস। অতীতে এখানে ছিল একটি জার্মান মালিকানাধীন স্টোন ক্রাশার। বাংলোটি ছিল তাঁদের। পরে কলকাতার বিখ্যাত কোলে পরিবার - যাঁদের নামে কোলে বিস্কুট ও কোলে মার্কেট - এটি কিনে নেন। এটা তাঁদের অবসরকালীন আবাস। বাংলোটি বছরের বেশিরভাগ সময় বন্ধই থাকে। কয়েকটি তালাবন্ধ ঘরের দুদিকে ফুট দশেক চওড়া টানা বারান্দা। ওপরে ঢালু টিনের চাল। এটাই কোলে বাংলো নামে কলকাতার পর্বতারোহী মহলে পরিচিত। কয়েকজন মিলে দু তিনদিনের প্র্যাক্টিসে এলে তারা ঐ বারান্দাতেই থেকে যায়। খোলা বারান্দায় শুলেও রাতে বন্যজন্তুর ভয় নেই। ওখানে মালপত্র রেখে সারাদিন পাহাড়ে প্র্যাক্টিসে গেলেও জিনিসপত্র চুরি যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। এখানে অনেকবার আসা ইনস্ট্রাক্টরদের কাছে জানা গেল আশপাশের গ্ৰামের লোক এখনো বেশ গরীব হলেও তারা ওসব মালপত্র ছুঁয়েও দেখবে না। বাংলোটির অবস্থান ও পরিবেশ খুব সুন্দর।
তখন সেখানে চৌকিদার বা কেয়ারটেকারের দেখা পাওয়া গেল না। মার্চ মাস বলে বৃষ্টির সম্ভাবনা বা গরম নেই। মনোরম আবহাওয়া। বাংলোটা তালাবন্ধ বলে তার টয়লেটও ব্যবহার করা যাবে না। তা আর কী করা যাবে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে প্রকৃতির কাছেই যেতে হবে। পাহাড়ে যাওয়া মেয়েরাও এতে অভ্যস্থ। ওরা সেই ঢাকা বারান্দায় প্লাস্টিক শীট, ম্যাট পাতে। এখানেই দুটো রাত তিনটে দিন দিব্যি কেটে যাবে।
বিখ্যাত ঝর্ণা
সেদিন আর দেড় কিমি হেঁটে পাহাড়ের মাথায় উঠে রক ক্লাইম্বিং করার কারুরই বিশেষ ইচ্ছে ছিল না। ঠিক হোলো সে দিনটা ওরা আলস্যময় ভাবে আশপাশে ঘুরে বেড়িয়ে গল্প করেই কাটিয়ে দেবে। কাল সকালে যাবে পাহাড়ে। বলাইদার দোকানে চা নাস্তা করে ওরা গেলো সেই বিখ্যাত ঝর্ণাটি দেখতে। এটার কথা সবাই জানে।
কোলে বাংলো থেকে শ তিনেক মিটার দক্ষিণে গ্ৰামের রাস্তার ধারে একটা ন ফুট উঁচু ইঁটের পাঁচিল। রিটেনিং ওয়ালের মতো সেই দেয়ালের পিছন থেকেই পাহাড়ের ঢাল উঠে গেছে। নীচে সিমেন্টের মেঝে করা আছে। আট ফুট ওপরে ফুট ছয়েক ব্যবধানে দেওয়ালে লাগানো দুটি লোহার সিংহ মুখ। তার থেকে অবিরাম পড়ছে ইঞ্চি দেড়েক মোটা জলের ধারা। স্বচ্ছ, শীতল। এটাই ঝর্ণা। শোনা গেল গ্ৰীষ্মেও যখন আশপাশের পুকুর শুকিয়ে আসে তখনো এই জলধারা একই ভাবে বজায় থাকে। তাই লোকজন অনেক দুর থেকেও এখানে পানীয় জল নিতে আসে।
সেই জলধারার নীচে দাঁড়িয়ে ছেলেরা খালি গায়ে সর্টশ পড়ে হৈহৈ করে চান করতে শুরু করে। তিনটে মেয়ে জুলজুল করে দেখছে। ইচ্ছে ওদেরও খুব হচ্ছে কিন্তু অমন বেবাক ফাঁকা জায়গায় চান করাটা ওদের পক্ষে একটু অস্বস্তিকর। তুলি তো বলেই ফ্যালে, "তোদের কী মজা!" যে কদিন ওরা ছিল ওখানে, ঐ জলই পান করেছে। কী তার স্বাদ! প্রাকৃতিক মিনারেল ওয়াটার। কোথায় লাগে বিসলেরি। তখন অবশ্য বোতলের জলের চলও ছিল না।
এরকম যুগ্ম জলধারা আছে গুপ্তকাশীতে বিশ্বনাথ মন্দিরের সামনে মণিকর্ণিকা কুন্ডে। পিতলের গোমুখ ও হাতিমুখ থেকে অবিরাম ধারায় জল বেরোয়। লোকমতে তা গঙ্গা ও যমুনার ধারা। গোপেশ্বরে বৈতরণী কুণ্ডেও তিনটি পাথরের হাতিমুখ দিয়ে বেরোয় এমন জলধারা। কিন্তু ওগুলি হিমালয়ের বৃষ্টিপ্রবণ এলাকায়। আশেপাশে সুউচ্চ পাহাড়।
শুশুনিয়াতে সারা বছর কোনো গভীর কুয়োতে জল থাকলে অতটা আশ্চর্যের কিছু লাগতো না। কিন্তু জমি থেকে আট ফুট ওপর থেকে কলের মতো চব্বিশ ঘণ্টা অমন জল বেরোলে আশ্চর্য হওয়ারই কথা। বিশেষত পিছনে যখন কোনো জলাশয় নেই এবং শুশুনিয়া বৃষ্টিবিরল, রুক্ষ জায়গা। ঝর্ণার আশেপাশে মাটিতে আর্দ্রতার আধিক্যের ফলে বেশ কয়েকটি বড় বড় গাছ রয়েছে। ফলে জায়গাটা বেশ ছায়াময়। ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করে না।
শুশুনিয়াতে পাওয়া গেছে প্রস্তর যুগের কিছু পাথরের হাতিয়ার, চতুর্থ শতকের রাজা চন্দ্রবর্মনের শিলালিপি। তাই শুশুনিয়ার কিছু পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্বও আছে। তবে ওরা সেসব দেখতে ওখানে যায়নি। ওদের উদ্দেশ্য সদ্য শেখা রক ক্লাইম্বিং প্র্যাক্টিস করা।
ফিরে এসে ওরা বলাইদার দোকানে লাঞ্চ করে। শৈলারোহণ শিবির ও প্র্যাক্টিসে আসা ছেলেমেয়েদের দৌলতে বছরের ঐ কটা মাস বলাইদার কিছু আয় হয়। অন্য সময় মাছি তাড়ায়। লাঞ্চের পর ইনস্ট্রাক্টররা বাংলোতেই থেকে গেলেন। পাহাড়ে চড়ার দড়িদড়া, যন্ত্রপাতি বড় ব্যাগ থেকে বার করে চেক করবেন। আলাদা করে ছোট ছোট প্যাক করবেন। কাল কয়েকজন মিলে ভাগাভাগি করে নিয়ে যেতে হবে পাহাড়ে।
ওরা ঘুরতে গেল গ্ৰামে। মাটির সাথে সম্পর্কহীন শহুরে মনে চাকচিক্যহীন সাদামাটা গ্ৰাম্য পরিবেশ অন্যরকম ছাপ ফেলে। শহরের কোলাহলমূখর ঘিঞ্জি পরিবেশ ছেড়ে বাইরে উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে শান্ত, নির্জন, গ্ৰামের মধ্যে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াতে তাই ভালোই লাগে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।