বিবর্তিত মানুষের আচরণ
সুমন বলে, "আসলে যা বলতে চাইছি সেটা একটু গুছিয়ে নিতে চাইছিলাম। তবে বিষয়টাই তো জটিল। তবু চেষ্টা করছি সহজ ভাবে বলতে। ঐ উদাহরণে যদি দুজনেই সহনশীল হোতো তাহলে একজন সরি বলতো, অন্যজন মেনে নিতো, যেমন জাপানে হয় বলে শুনেছি, চ্যাপটার ক্লোজ। মামলা একটু গরম হয়ে গেলেও একজন যদি মাঝপথে চেপে যেতো তাহলেও জল বেশি গড়াতো না।
কিন্তু তা হোলো না কারণ এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে দুজনেরই অহংবোধ। ফলে দুজনেই যুগ্মভাবে ভুগলো।
তুলি বলে, "তুই কী বলতে চাইছিস এহেন অহংবোধ মানুষেরই একচেটিয়া প্রবণতা, পশুদের মধ্যে নেই?”
সুমন বলে, "অনেকটা তাই। প্রায় নেই বললেই চলে। তাই একটা কুকুর আচমকা অন্য একটা কুকুরকে তেড়ে গেলে দ্বিতীয়জন দূর্বল, ভীতু টাইপের হলে পালিয়ে যায়। কিন্তু আক্রান্ত কুকুরটি যদি শক্তিশালী হয় বা দলে থাকে এবং আক্রমণকারী কুকুরটি নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন না হয়েই তেড়ে যায় তাহলে ওরা দলবদ্ধভাবে প্রতি-আক্রমণ করলে সে তখন পত্রপাঠ ল্যাজ গুটিয়ে পালায়। অর্থাৎ চাচা আপনা প্রাণ বাঁচা। সে প্রবৃত্তির দ্বারা তাড়িত হয়ে প্রথমে তেড়ে যায় বটে কিন্তু অহং দ্বারা চালিত হয়ে অহেতুক মরণপণ লড়াই করে মরে না। তা সে করবে একমাত্র আত্মরক্ষার্থে। তবে তখনও দেখবি খানিক কামড়া কামড়ি করে - শক্তিমান ও দূর্বল - দুজনেই দুদিকে চলে যায়।"
ঈশু বলে, "একদম সহমত"।
সুমন বলে, "কিন্তু মানুষ একা থাকলে বা দলে কমজোর হলে তখনকার মতো পিছু হঠবে কিন্তু ঐ অপমান সে সহজে ভুলতে না পারলে তার দুটো পরিণতি হতে পারে। এক, সেই অপমান হজম করার গ্লানি তার অবচেতনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলতে পারে। দুই, তার প্রতিশোধস্পৃহা বেশী হলে সুযোগ মতো সে লাঠি-সোঁটা, ছোরা, বন্দুক, দলবল নিয়ে রীতিমত প্রস্তুত হয়ে ফিরে আসতে পারে হিসাব বরাবর করতে। আহত অহংকার বা অপমানবোধের প্ররোচনাজাত প্রতিশোধস্পৃহার সাথে অপরিণামদর্শীতা মিশলে কী বিনাশকারী পরিণতি হতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ। সেই ট্রাডিশন আজও চলছে। অপমানবোধ ও প্রতিশোধস্পৃহার তাড়না পশুদের মধ্যে প্রায় বিরল বা খুব ক্ষীণ কিন্তু মানুষের মধ্যে তা অত্যন্ত প্রবল। তাই এটা পাশবিক তাড়না নয়, মানবিক বৈশিষ্ট্য।"
চুনি বলে, "তোকে আগে ইয়ারকী ফাজলামি করতেই দেখেছি। তুই যে এমন গুছিয়ে কথা বলতে পারিস কখনো ভাবিনি। খুব ভালো লাগছে তোর কথা শুনতে"।
সুমন বলে, "থ্যাংকস ফর দি কমপ্লিমেন্ট। আমারও ভালো লাগছে বলতে। নানা বিক্ষিপ্ত চিন্তা এভাবেই সুসংহত ভাবনায় রূপান্তরিত হয়। না হলে চর্চার অভাবে ফিকে হয়ে যায়। তো যা বলছিলাম, অধিকাংশ মানুষ অকারণে অপমানিত হওয়ার ঘটনা সহজে ভুলতে পারে না, মনের মধ্যে জমা থাকে ঋণাত্মক অভিজ্ঞতার স্মৃতি। ক্ষেত্রবিশেষে তা উপরিতলে ভেসে ওঠে। তবে তা উপেক্ষা করতে পারা সেই ঋণাত্মক মানবিক প্রবণতার ওপর আত্মসংযম ও শুভবুদ্ধির জয়। এটা ধণাত্মক মানবিক উত্তরণ। এ জিনিস আয়ত্ত করা সহজসাধ্য নয়। গভীর উপলব্ধি ও সাধনার ব্যাপার। তবে কখনো উপেক্ষা, ক্ষমার আপাত মোড়কের অন্তরালে থাকতে পারে অক্ষমতা, কাপুরুষতা। যেমন সদাচারণের আড়ালেও থাকতে পারে পরিণামের ভীতি। কেউ ঘুষ খায়না ধরা পড়ে চাকরি যাওয়ার ভয়ে, সংস্কারের ভ্রুকুটিতে, অসৎ উপার্জনের কর্মফলে দুর্ভোগের আশাঙ্কায়। সদাচরণ যে সর্বদা নীতিবোধ দ্বারা নির্ধারিত - তা নাও হতে পারে। কখনো তা হতে পারে চারিত্রিক দূর্বলতাজাত। অসৎ, দূর্নীতিপরায়ণ হতে গেলে চাই বুকের পাটা, যেটা সবার থাকে না।
ঈশু বলে, "এগ্ৰিড"।
সুমন বলে,"আমি বলেছিলাম বটে বাসে ঝগড়া করা দুটি মানুষের আচরণ পাশবিক প্রবৃত্তির উদাহরণ নয় কারণ পশুরা তুচ্ছ কারণে খেয়োখেয়ি করেনা। কিন্তু দুটি মানুষ যখন ওভাবে ঝগড়া করে তখন তাদের অভিব্যক্তি কেমন হয়? ক্রোধে উন্মত্ত দুটি মানুষের বিকৃত মুখভঙ্গি, বিস্ফারিত নাসা, লাল চক্ষু, নিকটে দাঁড়িয়েও বজ্রনিনাদ - এসব কোন ছবি মনে পড়ায়? জঙ্গলে দাঁত খিঁচিয়ে বুক চাপড়ানো দুটো গরিলা বা নর্দমার ধারে খেয়োখেয়ি করা দুটো নেড়ী কুকুরের মতো নয়?"
- "ঠিক তাই। তবে তুই যে বললি এই উদাহরণে আছে আরো কিছু পাশবিক প্রবৃত্তির লক্ষণ, সেটা কী?" এবার সুমন প্রশ্নসূচকভাবে ওর বক্তব্য শেষ করার পর তুলি ওর প্রশ্ন পেশ করে।
সুমন বলে, "এমন মনোযোগী শ্রোতা হলে আলোচনা করেও সুখ। সেই অন্য পাশবিক উপাদানটি - যা পশুদের মধ্যে প্রবলভাবে বিদ্যমান - তা হোলো Fight or Flight instinct. অর্থাৎ আক্রমণ অথবা পলায়ন প্রবৃত্তি। দলবদ্ধ শিকার ছাড়া প্রজননের জন্য সঙ্গিনী নির্বাচন বা দলপতি হিসেবে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে পশুরা নিজের ক্ষমতায় লড়ে। বাকিরা দর্শকের মতো দেখে। নিজ নিজ ক্ষমতার মূল্যায়ন করে যখন বোঝে প্রতিপক্ষ শক্তিশালী, একজন পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে। তবে লড়াই ছেড়ে পলায়নরত দুর্বল প্রতিপক্ষকে তাড়া করে মেরে ফেলার ঘটনা পশুসমাজে বিরল। Never chase a fleeing foe এই নীতিবোধ তাদের মজ্জাগত। তবে তারা দুজনেরই যদি তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে ভুল ধারণা থাকে তখন সেই লড়াইয়ের পরিণতি হতে পারে একজনের বা দুজনেরই মৃত্যুতে।"
তুলি বলে, "বেশ বললি এটা"।
সুমন বলে, "মানুষের মধ্যেও এই Fight or Flight instinct কাজ করে। তাই পা মাড়িয়েও দাদাগিরি করা লোকটা যদি পালোয়ান গোছের হয় এবং জুতোর গুঁতো খাওয়া লোকটা হয় চিমসে, তাহলে সে একটু মিনমিন করে চেপে যাবে। তবে মানুষ কূট-কৌশলী জীব। তাই তালপাতার সেপাই হয়েও লোকটি হয়তো নাকে কেঁদে জন-সহানুভূতি আদায় করতে পারে। তখন কিছু লোক একত্রে - এটা কী হচ্ছে দাদা বলে - ফুঁসে উঠলে সেই পালোয়ান লোকটা নিতান্ত গোঁয়ার না হলে হাওয়া প্রতিকুল বুঝে চেপে যেতে পারে।"
- "দারুণ বলেছিস", সায় দেয় চুনি।
সুমন বলে, "এখানে বিচার্য বিষয় হোলো বাসে ফুঁসে ওঠা অনেক লোকই কিন্তু মনে মনে বোঝে তারা কেউই একা ঐ পালোয়ানের মোকাবিলা করতে পারবে না। তাই তাদের ব্যক্তিগত দূর্বলতা তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ করতে উদ্বুদ্ধ করে। এটা কিন্তু পাশবিক প্রবৃত্তি নয়, এটা একটা মানবিক প্রবণতা। ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, বাঘা যতীনের মতো রবীন্দ্রনাথ অকুতোভয়ে মৃত্যুবরণ করতে এগিয়ে জাননি। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ছাড়া কখনো পথেও নামেন নি। প্রবল উত্তেজনায় শুভবুদ্ধি হারানো উন্মত্ত জনতার হাতে মার খাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা সত্ত্বেও গান্ধীর মতো নির্ভীকচিত্তে কলকাতা, নোয়াখালীর দাঙ্গাবিক্ষুব্ধ অঞ্চলে ছুটে যাননি তা নিবারণে।"
"তবে হ্যাঁ, তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তদানীন্তন বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ডকে শানিত ভাষায় চিঠি লিখে নাইটহুড প্রত্যাখান করেছেন। নোবেলজয়ী কবি জানতেন তখন তাঁর যে আন্তর্জাতিক খ্যাতি তার ফলে তাঁকে গ্ৰেপ্তার করতে ব্রিটিশরাজকেও যথেষ্ট ভাবতে হবে। তিনি শান্তিনিকেতনে বসে কবিতা লিখেছেন - অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে; তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে বা যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে...। কিন্তু তিনি রাস্তায় নেমে পুলিশের লাঠি খাননি বা জেলে যাননি।”
একটু ভেবে নিয়ে সুমন বলে, “তদানীন্তন স্বাধীনতাকামী আপামর মানুষ যারা সত্যাগ্ৰহ আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের লাঠি গুলি খেয়েছে তাদের ওনার কবিতা আত্মিক সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু একজনকে পা মাড়ানোর ফলে কিছু বাসযাত্রীর সম্মিলিত প্রতিবাদ অমন সমষ্টিগত উত্তরণ নাকি নিছক ব্যক্তিগত আহত অহংয়ের উস্কানি তা সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়। তবে এহেন মানবাচরণ তবু কিছুটা সুলভ। কিন্তু দূর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মহান উদ্দেশ্যে, কারুর সহযোগ না পেয়েও, শহীদ হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা জেনেও যে একা প্রতিবাদ করতে এগিয়ে যায় তারা দূর্লভ সম্প্রদায়ের মানুষ। এমন প্রবণতাকে কী বলা যায়?"
ওরা তিনজনেই খানিক মুখ চাওয়াচায়ি করে। শেষে চুনি বলে, "দ্যাখ এর উত্তর দেওয়া খুব সোজা নয়। কারণ নৈর্ব্যক্তিক ভাবে বিচার করলে নীতিগতভাবে এর একটাই উত্তর হয়। কিন্তু যেই প্রেক্ষিতটা ব্যক্তিগত হয়ে যায় তখনই শুরু হয় দোলাচল। আমি কি বোঝাতে পারলাম।"
সুমন বলে, "হ্যাঁ বুঝেছি। অর্থাৎ নীতিগতভাবে কী করা উচিত তা আমাদের হৃদয় বোঝে কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে তা করা উচিত হবে কিনা সেই ভাবনায় বুদ্ধিমান মানুষ ভাবিত হয়ে পড়ে। মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে চারকোনে ধূপকাঠি গোঁজা খাটিয়ায় শুয়ে আছে সে, বৌয়ের বিধবা বেশ বা ফুটপাতে বাটি হাতে সন্তানের মুখ। নীরবে গজায় অজুহাত। কী করবো, বৌ, ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘর করতে হয়। তখন বিবেকদংশনে ব্যান্ড-এড হয়ে দেখা দেয় সাংসারিক দায়। মনে হয় সহন বা পলায়নই তখন বাঞ্ছিত পন্থা। একাকী প্রতিবাদ, প্রতিরোধ - এসব অপরিণামদর্শীতা।"
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।