চলো পাহাড়ে
গতকাল রাতে বলাইদার থেকে একটা বড় ডেকচি নিয়ে রেখেছিলেন মলয়দা। ভোরে উঠে তাতে চিঁড়ে ভিজিয়ে দিয়েছেন। ওপরে গিয়ে দুপুরে খাওয়া হবে। নীচে থেকে ভিজিয়ে নিয়ে গেলে ওপরে বেশী জল খরচ হবে না। সাথে নেওয়া হয়েছে গাজর, শশা, গুড় ইত্যাদি। মলয়দা বললেন, "কাল রাতে বলাইয়ের কাছে জ্যারিক্যান চেয়েছিলাম। এতোজন আছি আমরাই নীচ থেকে একটু বেশী জল নিয়ে যেতাম। ও বলেছে বাবলুকে দিয়ে দুটো ক্যানে করে একটা নাগাদ সাত, আট লিটার জল পাঠিয়ে দেবে। ঠিক আছে, আমরা তো ছেলেটাকে যাওয়ার আগে কিছু পয়সা দিতামই তবু বাবলু খেটে রোজগার করার অভ্যাস করুক। হাত পেতে বখশিশের প্রত্যাশা করে থাকা ভালো নয়। তবে তোমরাও যতটা পারো জল নিয়ে যেও। সকালে বেরিয়ে এতোখানি হেঁটে ওপরে উঠে সারাদিন ধরে ওখানে কসরৎ করে খুব জল তেষ্টা পাবে। গরমের রেশ পড়ে গেছে। যথেষ্ট জল না খেলে ডিহাইড্রেশন হয়ে যাবে।"
বলাইদার দোকানে পরোটা আর আলু, কুমড়োর তরকারি দিয়ে ভালোই জলখাবার হোলো। চা খেয়ে ওরা আটটা নাগাদ রওনা হলো পাহাড়ের দিকে। সুন্দর অরণ্যময় পথ ধীরে ধীরে উঠে গেছে ওপরে। হালকা চড়াই। পথে দেখা হোলো কলকাতার এক পাহাড়ে চড়া দম্পতির সাথে। দোলের ছুটিতে এসেছেন। তবে দলে নয়। শুধু স্বামী স্ত্রী। বসু দম্পতির সাথে আছে ওনাদের বছর আটেকের পুত্র। ফুটফুটে ছেলেটি বেশ ছটফটে। মাথায় পুঁচকে টুপি পরে, হাতে একটা ছোট্ট লাঠি নিয়ে উৎসাহে আগে আগে চলেছে। ওনারা কলকাতার পাহাড়িয়া গোষ্ঠীর। তাই মলয়দা, সুশীলদা, অমিয়দার সাথে পূর্ব পরিচিত। কাল ছিলেন গ্ৰামে পরিচিত একজনের বাড়িতে। ভদ্রলোক বলেন, "দলে তো প্রায়ই আসা হয় এখানে, ভাবলাম এবারে আমরা তিনজনেই যাই। ছোটুকে শুশুনিয়ার সাথে আলাপ করিয়ে দি। আমার কাছে অনেক গল্প শুনেছে। একটু হাতে-রকও হয়ে যাক।"
ছোটুকে বোল্ডারে রকে-খড়ি করানোর জন্য ৫০ ফুটের ছোট্ট একটা ১০মিমি র্যাপেলিং রোপের টুকরোও এনেছেন সাথে। ওনার স্ত্রীও এসেছেন পাহাড়ে চড়ার পোষাকে - পরণে ট্র্যাক শ্যূট, পায়ে স্পোর্টস শু। কথাবার্তার সময় মিটি মিটি হাসছেন। বোঝা যায় ওনারও সায় আছে এতে। সবারই খুব ভালো লাগলো ওনাদের দেখে। ছেলেটি কী সুন্দর প্রকৃতি, আউটওয়ার্ড বাউন্ড এ্যাক্টিভিটির সাথে পরিচিত হচ্ছে বাবা মার সান্নিধ্যে। বাবা মা চাইলে তাঁদের সন্তানের মধ্যে ছোটো থেকে অরণ্য, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, মমত্ববোধ গড়ে তুলতে পারেন। একটু এগিয়ে ওনারা অন্য দিকে চলে গেলেন।
নটার আগেই ওরা পৌঁছে গেল রক সাইটে। মালপত্র, দড়ি দড়া নামিয়ে ওরা একটা জায়গায় রাখলো। দেখা গেল মলয়দা বলা সত্ত্বেও গৌরব আর বরুণ ওদের জলের বোতল আনেনি। ওরা দুজনে অবশ্য দড়িদড়া গুলো নিয়ে এনেছে। তবে হার্নেস, স্লিংস, পিটনের থলে, হেলমেট ... বাকিরা সবাই কিছু না কিছু নিজেদের স্যাকে ঢুকিয়ে এনেছে। কেবল ইনস্ট্রাক্টরদের কিছু আনতে দেয়নি। ওনারা নিজেরা যখন প্র্যাকটিসে আসেন অন্য কথা। এখানে ওরা নজন থাকতে ওনাদের কোনো মাল আনতে দেয়নি ওরা।
চুনি বলে, "তোরা কী রে? জলের বোতলগুলো বাংলোতে রেখে এলি? আমাদের তো বলতে পারতিস, আমরা নিয়ে আসতাম।" নতুন ছেলে দুটোও স্কুলের বাচ্চার মতো দুটো পুঁচকে জলের বোতল এনেছে। মলয়দা বলেন, "ঠিক আছে যা হবার তা হয়ে গেছে। তোমরা বোতলগুলো এই পাথরের তলায় রাখো। নয়তো রোদ উঠলে জল গরম হয়ে যাবে। যতক্ষণ না বাবলু জল নিয়ে আসছে একটু রেশনিং করে খেও। জেঠুর ফেল্ট দেওয়া মেটাল ক্যানটা অনেকক্ষণ ঠান্ডা থাকবে। তাই ওটায় সবার শেষে হাত দেবো আমরা। এক লিটার জল অন্ততঃ এমার্জেন্সীর জন্য বাঁচিয়ে রেখ, কেমন।"
অমিয়দা আর সুশীলদা ওদের একটু আগে এসে কোথায় চড়া হবে সেই রুটগুলো দেখতে চলে গেছিলেন। ফলে এই জল সংক্রান্ত আলোচনা ওনারা শুনতে পেলেন না। শুনলে হয়তো সেদিনের ঘটনাপ্রবাহ একটু অন্য খাতে বইতে পারতো।
এসো ঝালিয়ে নিই
একটু পরে রকে কিছু রুট, বোল্ডারিং পয়েন্টগুলো দেখে অমিয়দা ও সুশীলদা এ্যাসেম্বলি পয়েন্টে এসে গেলেন। অমিয়দা বললেন, "তোমরা দুজন করে টিম বানাও। গৌরব, তুমি ক্লাইম্বিংটা ভালো পারো বলে শুনেছি, তুমি তাহলে নতুন দুটি ছেলেকে নিয়ে কিছু বোল্ডারিং প্রাকটিস করো। আমি এদের ক্লাইম্বিংগুলো বুঝিয়ে দিয়ে তোমাদের সাথে পরে যোগ দেবো। আমরা একটা ওভারহ্যাং ক্লাইম্ব করার চেষ্টা করবো, একটু শক্ত, কিন্তু মনে হয় মজা পাবে।"
সুমন-ঈশু, বরুণ-তুলি, চিতা-চুনি মিলে তিনটে টিম হোলো। মনে হয় ক্লাইম্বিংয়ের সময় যাতে মনযোগ ব্যহত না হয় তাই বরুণ ও চুনি ইচ্ছে করেই এক টিমে থাকে নি।
অমিয়দা বললেন, "ক্লাইম্বিংয়ের ব্যাপারে আমি একটু সনাতনপন্থী। আমি যা কিছু অভিজ্ঞ পাহাড়ী দাদাদের কাছে যেভাবে শিখেছি তোমাদের সাথে সেভাবেই ভাগ করে নিতে চাই। কতটা দিতে পারবো জানি না তবে তোমরা যতটা নিতে পারবে সেটা তোমাদের কৃতিত্ব। কী রাজি তো?"
ওরা সবাই একযোগে মাথা নাড়ে। অমিয়দা বললেন, "দ্যাখো আমি তো তোমাদের কোর্সে বা এর আগে কখনো পাথরে চড়তে দেখিনি। তাই সরাসরি পাথরে গিয়ে চড়ার আগে শৈলারোহণের যে কিছু নিয়মকানুন আছে, যা তোমরা বেসিক রক ক্লাইম্বিং কোর্সে শিখেছো সেগুলো একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক। তোমরা হয়তো জানো এই শৈলারোহণ ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল ইওরোপে, বলা ভালো মূলতঃ ব্রিটেনে। তাই এখোনো বহু দেশে ব্রিটিশ মাউন্টেনিয়ারিং কাউন্সিল বা BMC প্রবর্তিত ক্লাইম্বিং টেকনিক, প্রোটোকল, সুরক্ষা নিয়ম, ইকুইপমেন্ট স্পেসিফিকেশন ইত্যাদি গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। তার কারণ ব্রিটিশরা খুব মেথডিক্যাল।"
"তাই আমরাও চড়ার আগে কয়েকটা সংজ্ঞা, নিয়ম, ধারণা আর একবার ঝালিয়ে নেব। এগুলো মনে গেঁথে গেলে চড়তে গিয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম। আমি প্রশ্ন করবো, তোমরা জবাব দেবে। তোমরা সবসময় যে নিজেদের মধ্যেই চড়বে তার তো কোনো মানে নেই, পরে কখোনো অবাঙালি বা অভারতীয় দলেও অভিযানে যেতে পারো, তাই standard climbing calls গুলো আমরা এখানে ইংরেজিতে বলবো। পাহাড়ে চড়ার সময় দুজন ক্লাইম্বারের মধ্যে দুরত্ব বেড়ে গেলে, পাথরের আড়াল হয়ে গেলে বা জোরে হাওয়া চললে অনেক সময় কথা শোনা বা বোঝা যায় না। তখন লম্বা বাক্য বলার প্রয়োজন নেই। এই Standard Climbing Calls গুলো তাই সেভাবে তৈরী। একটি দুটি শব্দে। এখানেও আমরা এগুলো পরিস্কার গলায় উচ্চস্বরে বলার অভ্যাস করবো। মনে রেখো, পাহাড়ে চড়ার সময় ক্লাইম্বিং পার্টনারদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির ফল হতে পারে মারাত্মক।"
"What is rock climbing?" অমিয়দা জানতে চাইলেন। প্রশ্নটা খুব সরল বলেই ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। শেষে ঈশুই দলের মান রাখে, "Rock climbing is moving on the predominantly vertical rock surface with some specific techniques within the margin of safety." সুমনের মনে হয় মেয়েটা খুব সিনসিয়ার।
অমিয়দাও বলেন, "Excellent! একদম textbook definition. ঈশিতার শেষ কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ - within the margin of safety. শৈলারোহণ একটি ঝুঁকিপূর্ণ adventure activity. ঝুঁকি নিতে না চাইলে ক্যারম বা দাবা খেলা যেতে পারে। তবে আমরা নেবো calculated risks এবং প্রয়োজনীয় safety measures. তারপরেও যদি দুর্ঘটনা ঘটে সেটা দুর্ভাগ্য। এ দুটো ব্যাপার খেয়াল না রাখলে শৈলারোহণ দায়িত্বজ্ঞানহীন আনাড়ীপনা হয়ে যায়। তোমাদের মধ্যে ভবিষ্যতে কত জন সিরিয়াসলি শৈলারোহণ করবে জানি না কিন্তু শুরুর দিকেই কোনো bad fall হলে মনে ভয় ঢুকে যেতে পারে যা কাটিয়ে ওঠা মুশকিল। সেটা মোটেও কাম্য নয়। তাই আশা করবো তোমরা সুরক্ষা পদ্ধতি উপেক্ষা করবে না।"
ওরা সবাই সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।