বিবর্তনের ধারা
সুমন বলে, "ধরতাইটা ভালো দিলি। স্বীকার করছি যা আলোচনা করতে যাবো তা নিয়ে আমার একটু সংকোচ ছিল কিন্তু তোদের কথায় তা কেটে গেল। তবে আমি হয়তো তোর মতো অতো গুছিয়ে বলতে পারবো না, আমার পড়াশোনার গণ্ডী সীমিত। তবু চেষ্টা করছি আমি যেভাবে ভাবি - বলতে।
"দ্যাখ এটা স্বীকৃত সত্য যে বর্তমান মানুষ আদিমানবের রূপান্তরিত রূপ। সেই আদিমানব ছিল প্রাইমেটসদের সমগোত্রীয়। ওরাংওটাং এবং শিম্পাঞ্জি তাই বর্তমান মানুষের পূর্বপুরুষের নিকটতম প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য হয়। ট্রেনিং দিলে এরা মানুষের হাবভাব অনেকটা অনুকরণ করতে পারে। তবে আদিমানব ছিল পশুরই মতন। চার হাত পায়ে চলতো, কাঁচা মাংস, ফলমূল খেত। একদিন সে পেছনের দুপায়ে দাঁড়াতে শিখল। সামনের দুটো হাত শরীরের ভারবহন থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সৃজনশীল যন্ত্রে রূপান্তরিত হলো। তা আবিস্কার করলো আগুন, চাকা, লোহার ব্যবহার। এই তিনটি যুগান্তকারী আবিস্কার তাকে আর ফিরে তাকাতে দিল না। কয়েক কোটি বছরের বিবর্তনের পরে আজও গরু হাম্বা হাম্বা বা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে চলেছে কিন্তু মাত্র এক কোটি বছরের মধ্যে মানুষের অবিশ্বাস্য রূপান্তর হোলো। ফলে মানুষ যে কেবল পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীকুল থেকে আলাদা হয়ে গেল তাই নয় তাদের ওপর কায়েম করলো নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রন। এতো অল্প সময়ে এহেন উত্তরণ কী ভাবে সম্ভব হোলো? বিবর্তনবাদে এই মিসিং লিঙ্ক বিশেষজ্ঞদের গবেষণার বিষয়, তা আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে।"
সুমন একটু থামে। এখন জোৎস্না উজ্জ্বল। তিনজন গভীর অভিনিবেশে তাকিয়ে আছে সুমনের দিকে। সুমন বলে চলে, "আদিমানবের আদিতেও ছিল কয়েক কোটি বছরের ক্রমবিবর্তনের ধারা। ফলে পশুসমাজের নানান প্রবৃত্তিগত বৈশিষ্ট্য আদিমানবের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। বহু কোটি বছরের সঞ্চিত প্রবৃত্তিগত বৈশিষ্ট্য বা instictive characteristics মাত্র এক কোটি বছরের বিবর্তনের ফলে বিশেষ পরিবর্তিত হওয়া সম্ভব নয়। ফলে পশুসূলভ নানা প্রবৃত্তিগত বৈশিষ্ট্য বিবর্তিত মানুষের মধ্যেও সুপ্ত ভাবে রয়ে গেল।"
"তবে বুদ্ধি ও যুক্তিবোধের বিকাশের ফলে মানুষ বুঝতে শিখলো সমাজবদ্ধ জীবনে মানুষ কেবল প্রবৃত্তিগত তাড়নায় পশুর মতো আচরণ করতে পারে না। তৈরী হোলো আইন কানুন, বিধি-নিষেধ, প্রথা, লোকাচার। ঘোষিত হোলো সমাজে গ্ৰহণযোগ্য আচরণের প্রেক্ষিতে বিচ্যূতির শাস্তি। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সচেতন বিবেচনাবোধ ও সংযমী অভ্যাসে সমাজস্বীকৃত আচরণ করতে শিখলো। তাই ক্ষিধে পেলে ভিক্ষা চাওয়া যেতে পারে কিন্তু কেড়ে খাওয়া উচিত নয়। তবে অবচেতন মনে রয়ে যাওয়া অবদমিত প্রবৃত্তিগত বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে কিছু আচরণ কখনো সচেতন মনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আর তখনই হয় সমস্যা। কখনো তা বাহ্যিকভাবে শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ায় প্রকাশিত হয়। কখোনো তা চিন্তা ভাবনাকে প্রভাবিত করে।"
প্রবৃত্তি ও প্রবণতা
চুনি বলে, "বাব্বা, জেঠু! লোহা, সিমেন্ট, বালি ঘাঁটা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে তুইও তো দেখছি ঈশুর মতো গুছিয়ে কথা বলছিস! বিবর্তনের ফলে ক্রমশ তথাকথিত অর্থে উন্নত হয়েও মানুষের মধ্যে কেন কিছু পাশবিক প্রবৃত্তি রয়ে গেছে সেটা তো ভালোই বললি। কিছু উদাহরণ দিয়ে কী খোলসা করা যায়?"
সুমন বলে, "ঠিক বলেছিস। যতই আমরা তাত্ত্বিক আলোচনা করি না কেন, উদাহরণ তা বুঝতে সাহায্য করে। যেমন ধর প্রাণীদের মধ্যে লড়াই মূলত হয় প্রজননের জন্য সঙ্গিনী নির্বাচন, দলের ওপর আধিপত্য কায়েম এবং এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে। মাংসাশী প্রাণীর শিকার করা লড়াই নয় কারণ তা কেবল ক্ষুধার তাড়নায়। এছাড়া গোষ্ঠীবদ্ধ প্রাণী - যেমন হাতি বা সিংহ - দল থেকে বিতাড়িত হলে ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। তেমনি সন্তানের বিপদের আশাঙ্কায় মা পশুও রক্ষণাত্মক কারণে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া পশুরা অহেতুক নিজেদের মধ্যে মারামারি, খেয়োখেয়ি করে শক্তি ক্ষয় করে না। একান্তচারী শ্বাপদ, যেমন দুটো পুরুষ বাঘও যদি আচমকা জঙ্গলে মুখোমুখি হয়ে যায় তাহলে তাদের প্রথম প্রবৃত্তিগত প্রতিক্রিয়া হবে পরস্পরকে এড়িয়ে যাওয়া। অর্থাৎ LIVE AND LET LIVE. তবে এই আপ্তবাক্য তারা দর্শনশাস্ত্র, গেম থিয়োরী ইত্যাদি ঘেঁটে শেখেনি। শিখেছে জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতায়।"
"এবার দেখা যাক বুদ্ধিমান মানুষ কী করে। ভীড় বাসে অজান্তেই পা মাড়িয়ে দেওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনাতেও কথা কাটাকাটি থেকে খিস্তি খেউড়, হাতাহাতি হয়ে ব্যাপারটা হয়তো থানা পুলিশ অবধি গড়িয়ে গেল। তার ফলে হয়তো দুজনেই ভুগলো।"
তুলি বলে, "কিন্তু জেঠু, এটা কী বুদ্ধিমান মানুষের পশুর মতো প্রবৃত্তিগত তাড়নায় আচরণের উদাহরণ হিসেবে ঠিক হোলো? তুই তো এইমাত্র বললি পশুরা ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি করে না।"
সুমন বলে, "তুলি, তুই একটা মোক্ষম ক্লু দিলি। এক্ষেত্রে তুইও একটি প্রবৃত্তিগত তাড়না, মানে কৌতূহল, দমন করতে পারিস নি। তাই আমি বক্তব্য শেষ করার আগেই পেশ করলি তোর প্রশ্ন। অবশ্য এ তাড়নাও দমন করা সহজ নয়।"
তুলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে, "ওঃ, হ্যাঁ, তাই তো। তুই তো সবে একটা উদাহরণ দিয়েছিস মাত্র। তার পশ্চাৎপট, পরিণতি কিছুই ব্যাখ্যা করিস নি। সরি, সরি, ভুল হয়ে গেছে।"
সুমন বলে, "ঠিক আছে। ডোন্ট মাইন্ড। এই উদাহরণ বিশ্লেষণ করলে দেখবি এতে প্রকাশ পাবে কিছু পাশবিক প্রবৃত্তিগত আচরণ যা মানুষের মধ্যে আজও সুপ্ত ভাবে রয়ে গেছে। আবার দেখবি এমন কিছু প্রবণতা যা একান্তভাবে মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। তা আবার পশুদের মধ্যে নেই। এই প্রবণতাগুলির কিছু ধনাত্মক - যা জ্ঞান, চেতনা, শুভবুদ্ধির উন্মেষের ফলে মানব চরিত্রে বিকশিত হয়েছে। কিছু প্রবণতা আবার ঋণাত্মক - যেগুলি মানুষের নিজের জীবনে বা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কখনো আপাতদৃষ্টিতে ঋণাত্মক বৈশিষ্ট্যর প্রভাবও হতে পারে সৃজনশীল। ফলে নানা পরিপ্রেক্ষিতে বিবিধ পরিণতি সৃষ্টিকারী প্রবণতাগুলি যথেষ্ট জটিল, কখনো বিতর্কিত। এগুলোকে এক ছাঁচে ফেলা খুব মুশকিল।
ঈশু বলে, "এই মাত্র তুই যা বললি তা যেন loud thinking বা আত্মকথনের মতো লাগলো। মানে, তোর মনে কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে যা তুই নিজের মনেই আওড়াচ্ছিস। একটু জটিল হয়ে যাচ্ছে জেঠু। একটু সহজ ভাবে বল না বাবা"।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।