শৈলারোহণের স্বর্ণ নিয়ম
অমিয়দা বললেন, "আচ্ছা বেসিক কোর্সে তোমাদের নিশ্চয়ই কিছু Golden Rules of Rock Climbing সম্পর্কে বলা হয়েছে। দেখি কতটা মনে আছে তোমাদের। প্রত্যেকে একটা করে বলো।"
ঈশুই প্রথমে বলে, "Plan your climb."
অমিয়দা বলেন, "ঠিক। এটা শুনতে খুবই সহজ। কিন্তু করতে অভিজ্ঞতা ও নিষ্ঠার প্রয়োজন। রুটটা ভালো ভাবে স্টাডি না করেই অনেকে চড়া শুরু করে। এর ফলে মাঝপথে আটকে যেতে পারে। অনেক সময় যেখান দিয়ে ওঠা যায় সেখান দিয়ে নেমে আসা খুব সোজা নাও হতে পারে।"
তুলি বলে, "Stand upright, don't hug the rock."
অমিয়দা বলেন, "এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তোমাদের মধ্যে অনেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছো। Composition & Resolution of forces theory নিশ্চয়ই জানো। যতো পাথরের দিকে ঝুঁকবে শরীরের ওজনের পাথরের ঢাল বরাবর নীচের দিকের force component টা তত বাড়বে, ফলে পা পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে।
সুমন বলে, "Always maintain 3 point contacts."
অমিয়দা বলেন, "এটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম। আমরা হাঁটার সময় দ্বিপদ হলেও শৈলারোহণের সময় হয়ে যাই চতুষ্পদ-সদৃশ। তখন এক বারে হয় একটি হাত বা একটি পায়ের স্থান পরিবর্তন করা উচিত যাতে বাকি তিনটি contacts পাথরে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। ফলে ঐ অবস্থায় আরো একটি contact point যদি slip করে তাহলেও বাকি দুটিতে কোনোরকমে ভারসাম্য রক্ষা করে পতন রোখা সম্ভব।"
চুনি বলে, "Don't cross limbs."
অমিয়দা বলেন, "এটাও ঠিক। হাত ও পা তাদের স্বাভাবিক বাঁদিক ও ডানদিকের অবস্থান অনুযায়ী মুভ করবে। চড়ার সময় কিছু ক্ষেত্রে পায়ের ক্রশ মুভমেন্ট হয়ে যায়। খুব অভিজ্ঞ না হলে বা বিশেষ প্রয়োজন না হলে এটা করা উচিত নয়। তাতে নিজের পায়ে জড়িয়েই পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।"
গৌরব বলে, "Don't frequently stretch too high. Maintain hand position around head level as far as possible."
অমিয়দা বলেন, "এটা শক্ত ও লম্বা ক্লাইম্বিংয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। পায়ে রক্ত পাঠাতে হার্টকে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। কিন্তু হাত বেশিক্ষণ মাথার অনেক ওপরে থাকলে মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে হার্টকে হাতে রক্ত পাঠাতে বেশী বেগ পেতে হয়। রক্ত সঞ্চালন কমে গিয়ে হাত ক্লান্ত হয়ে যায়। তাই মাথার লেভেলের একটু ওপরে আশেপাশের হোল্ডস ধরে ছোট ছোট স্টেপে উঠলে, সুযোগ পেলেই একটু হাত ঝুলিয়ে রক্তসঞ্চালন করে নিলে হাত সহজে ক্লান্ত হয়ে পড়বে না।"
বরুণ বলে, "Maintain body weight on foot and balance with hands."
অমিয়দা বলেন, "এটা দারুণ বলেছে বরুণ। বাঁদরের পায়ের আঙ্গুলও হাতের মতো। তাই ওরা পা দিয়েও সরু পাইপ পাকিয়ে ধরতে পারে। ল্যাজ দিয়েও গাছের ঢাল পাকিয়ে ঝুলতে পারে। এছাড়া হালকা শরীরে অবিশ্বাস্য শক্তি, লম্বা লাফানোর ক্ষমতা, দীর্ঘ হাত, নিয়ত লাফালাফির ফলে ছিপছিপে শরীরে জন্য ওরা Born climber. আদতে মানুষ বানর প্রজাতির বংশধর হলেও দূর অতীতে গাছ থেকে মাটিতে নামার পর কয়েক লক্ষ বছরের বিবর্তনে মানুষের অনেক বাঁদুরে শারীরিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেছে। প্রাকৃতিকভাবে মানুষের পা শরীরের ভার বহনের জন্য মজবুত ভাবে তৈরী হলেও রকে চড়তে গিয়ে অনেকেই সেটা ভুলে যায়। হাতের জোরে শরীর টেনে তুলতে চায়। ফলে অচিরেই হাত ক্লান্ত হয়ে যায়। হয়তো আঙুল দিয়ে হোল্ড ধরতে পারি বলে ভার্টিকাল সারফেসে পায়ের থেকে আমাদের হাতের ওপর ভরসা বেড়ে যায় কিন্তু হওয়া উচিত বরুণ যা বললো সেটাই।"
চিতা বলে, "People used to get hurt on easy rocks."
অমিয়দা বলেন, "এটা একটা মূল্যবান কথা বলেছে চিন্ময়। এটা ঠিক নিয়ম নয় - সতর্কীকরণ। পাহাড়কে কখোনো হালকা ভাবে নেওয়া উচিত নয়। আপাতদৃষ্টিতে সোজা পাথরে মানুষের মনসংযোগ কমে যায় আর তখনই হয় দূর্ঘটনা। পাহাড়ে এমন অনেক উদাহরণ আছে। যাই হোক তোমরা মূখ্য নিয়মগুলো ঠিকঠাক বলেছো। বারংবার প্র্যাক্টিস করে এটুকু মনে রাখতে পারলেই যথেষ্ট। তোমরা নিশ্চই কোর্সে Belay কথাটা শুনেছো এবং করেছো। ঈশিতা তুমি কি এটা আমাদের আর একবার বোঝাতে পারো?"
ঈশু একটু ভেবে নিয়ে বলে, "Belay একটা ফরাসী শব্দ। এটা হচ্ছে সুরক্ষিত আরোহণের একটি পদ্ধতি। এক্ষেত্রে যে চড়ে সে climber এবং যে সুরক্ষা প্রদান করে সে Belayer যার দায়িত্ব চড়তে গিয়ে সঙ্গীর পা ফসকালে তার পতন রোধ করা বা পতনজনিত অভিঘাত কম করা। যে পদ্ধতিতে বিলে করা হয় তাকে বলে Belaying."
অমিয়দা বলেন, "একদম ছবির মতো বললে ঈশু। It seems you assimilated this topic well. বিলে মূলতঃ দু ধরণের হয় - বডি বিলে এবং মেকানিক্যাল বিলে। বডি বিলে পর্বতারোহণের শুরুয়াতি পর্ব থেকে চলে আসছে। এতে ভারী শরীরের কারুর পতন হলে বিলেয়ারের শরীরে ভালো ঝটকা লাগতে পারে। এই পদ্ধতিতে বিলেয়ারকে খুব সতর্ক থাকতে হয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে কিছু উপকরণ লাগে যা বিদেশে সহজলভ্য হলেও কলকাতায় এখনও বিশেষ আসে নি। এই পদ্ধতিতে বিলে করা সেফ এবং এফিসিয়েন্ট।”
A. Sitting position belay. এখানে বিলেয়ার যেখানে বসেছে সে জায়গাটা ডেলিকেট বলে সে আগে নিজেকে পিছনে একটা পাথরের খাঁজে (গাছও চলতে পারে) নিজেকে সেলফ্ এ্যাঙ্কর করেছে। (লাল তীর)। তবে বিলেয়ার যদি সমর্থ হয়, গোড়ালি ঠিকমতো পাথরে গ্ৰিপ করে রাখতে পারে, তাহলে স্ট্যাটিক বিলের (#) ক্ষেত্রে সেলফ এ্যাঙ্কর না করলেও চলে।
B. Standing Hip Belay C.
সঙ্কীর্ণ জায়গায় সেলফ্ এ্যাঙ্করড বডি বিলে - 1. স্ট্যান্ডিং হিপ বিলে 2. শোলডার বিলে (২১ তম পর্বে উল্লেখ আছে অমিয়দা C-2 মেথডে রকের কিনারায় দাঁড়িয়ে ঈশুকে শোলডার বিলে করেছিলেন)
এখানে অরণ্যদেব যেভাবে দড়িটা কোমরের পিছন দিয়ে ঘোরানোর আগে ফোরআর্মের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে পাঞ্জায় ধরে আছেন - ওটা বিলে করার মেথড নয় - শিল্পীর ভাবনা। তবে চলমান অশরীরী বলে কথা - তায় ছেলেমেয়ে দুটি ছোট - হয়তো দুজনে একসাথে সিলিপ খেলেও তিনি লৌহমুষ্টিতে ধরে ফেলবেন ওদের।
শৈলারোহণে climbing rope কে বলা হয় life line. তাহলে চড়ার সময় পর্বতারোহীর জীবন ঝোলে ঐ জীবনরশিতে যার প্রান্তটি ধরা থাকে Belayer এর হাতে। তাই আগে নিজে সুরক্ষিত না হয়ে অন্যকে বিলে করতে যাওয়া উচিত নয়। বিলে করাকালীন মূহুর্ত্তের জন্যও অন্যমনস্ক হবে না। আমি একবার দেখেছিলাম ক্লাইম্ব চলাকালীন এক বিলেয়ার রোপ থেকে একটা হাত সরিয়ে পকেট থেকে চুয়িংগাম বার করছে। তার বন্ধুটি তখন ক্লাইম্বিংয়ের মাঝামাঝি এক জায়গায় পাথরেই দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। বিলেয়ার হয়তো ক্লাইম্বারের সাথে কথা বলে, সে নিরাপদ স্থানে আছে জেনেই চুয়িংগাম খেতে গেছিল, তবু এ ধরনের ক্ষণিকের বিচ্যূতিতেও ঘটতে পারে বিপদ।"
"চিন্ময় যেটা বললো - People used to get hurt on easy rocks - এটা কখনো ভুলো না। আমি দুটো বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি শোনো।"
"টম প্যাটি ছিলেন এক বিখ্যাত স্কটিশ ক্লাইম্বার। তিনি ছিলেন দুঃসাহসিক, দক্ষ কিন্তু বিনদাস আমুদে ধরণের মানুষ। খুব সিগারেট খেতেন। ক্রিশ বনিংটন, রাস্টি বেলি ও তিনি Old Man of Hoy প্রথম চড়েন। ওটা ছিল স্কটল্যান্ডের উত্তর উপকুলে ৪৫০ ফুট খাড়া চিমনির মতো একটা Sea Stack. ১৯৬৭তে The Great Climb নামে BBC ওটার Second Ascent তিনদিনের TV প্রোগ্ৰামে দেখায়। ক্রিশ ও টম তাঁদের প্রথম আরোহণের রুট ধরেই ক্লাইম্ব করেন। কিন্তু জো ব্রাউন, ডুগল হেস্টন, আয়ান ম্যাকনট ডেভিস, পিট ক্রু এমন সব দিকপাল ক্লাইম্বাররা আরো দুটি নতুন রুটে সেবার ওটায় চড়েন। সেই বিপজ্জনক ক্লাইম্বিংয়েও প্রথমবার টম মুখে সিগারেট নিয়ে লিড ক্লাইম্ব করেছেন।"
"সী স্ট্যাক ক্লাইম্বিং ছিলো টমের খুব প্রিয়। ১৯৭০এর মে মাস। উত্তর স্কটল্যান্ডের সাদারল্যান্ডের সমূদ্র উপকুলে - পূর্ব ও পশ্চিম দিকে পাশাপাশি দুটি স্বল্প উচ্চতার সী স্ট্যাক - The Maiden. টম আরো তিনজন আরোহীর সাথে প্রথমবার চড়লেন পূর্বের মাত্র ১৮৪ ফুট উঁচু স্ট্যাকে। সেখান থেকে র্যাপেলিং করে নামার সময় দড়ি গুছোতে গিয়ে সটান নীচে পড়ে মারা যান টম। তখন তাঁর বয়স মোটে ৩৮ - আরো কতো চড়া বাকি ছিল আমুদে আরোহীর। নীচের ছবিতে মারা যাওয়ার একটু আগে টম - যথারীতি মুখে সিগারেট!"
"আর এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান স্কটিশ ক্লাইম্বার
ডুগল হেস্টন। তিনি অন্নপূর্ণা সাউথ ফেস, এভারেস্ট সাউথ-ওয়েস্ট ফেস এর মতো অত্যন্ত কঠিন, বিপজ্জনক রুটে প্রথম আরোহণ করেন। কিন্তু তিনিও মাত্র ৩৭ বছর বয়সে সুইজারল্যান্ডে তাঁর স্থাপিত ক্লাইম্বিং স্কুলের পিছনের পাহাড়ের ঢালে স্কি করতে গিয়ে তুষারধ্বসে মারা যান। ঐ দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার আগে তিনি বিগত দশ বছর ধরে ছিলেন ঐ স্কুলের ডিরেক্টর। ঐ পাহাড়ি এলাকা ছিল তাঁর হাতের তালুরেখার মতো পরিচিত।"
"কী বলতে চাইছি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো। টম বা ডুগল ক্লাইম্বিং জগতে মহাপুরুষ। ওনারা দুঃসাহসিক, নমস্য, ব্যতিক্রম। দুজনেই ৩৮ ও ৩৭ বছর বয়সে পাহাড়ে দূর্ঘটনায় অকালে প্রয়াত। আমরা সাধারণ মানুষ। পাহাড়ে চড়া আমাদের পেশা নয় - শখ। বাহাদুরি দেখিয়ে অকালে মরতে আমরা পাহাড়ে যাই না। বাড়িতে আমাদের প্রিয়জনেরা অপেক্ষা করে বসে থাকেন শখ মিটিয়ে আমরা বাড়ি ফিরে আসবো এই আশায়। আমরা তাই চলবো সুরক্ষা নিয়ম মেনে। তারপরেও যদি কিছু অঘটন হয় - ধরে নেবো that's part of the game. কী মনে থাকবে, তো?"
শৈলারোহণ যে মোটেও ছেলেখেলার বিষয় নয় তা অমিয়দা দুটো বাস্তব উদাহরণ দিয়ে প্রাঞ্জল ভাবে বুঝিয়ে দিলেন।
অমিয়দা বললেন, "এবার আমি ও সুশীল একটা ছোট্ট ক্লাইম্ব করে তোমাদের সামনে Climbing Call গুলো একবার রিহার্স করবো। প্রতিটি কলের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করবো। মন দিয়ে লক্ষ্য করবে সবাই। আশা করবো তোমরা এই প্রোটোকলগুলি এখানে ও ভবিষ্যতেও পাহাড়ে চড়তে গেলে ফলো করবে। ঠিক আছে? শুরু করি?"
ওরা সবাই সায় দেয়। বেশ লাগছে সুমনের। যেন ডিসেম্বরে বেসিক কোর্সে যা শিখেছে তার একটা রিফ্রেশার্স কোর্স হচ্ছে।
পুনশ্চঃ - (#) Static & Dynamic Belay প্রসঙ্গ আসবে পরবর্তী পর্বে
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।