এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • দোলজ‍্যোৎস্নায় শুশুনিয়া‌য় - ৪

    সমরেশ মুখার্জী লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৫ এপ্রিল ২০২৪ | ৪৫৭ বার পঠিত
  • সুবাসে উতলা মন

    সেল্ফ ইন্ট্রোডাকশনের পর চা এসে গেল। চায়ের গ্লাস হাতে সবাই ইতস্ততঃ ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। সুমন চা খেয়ে একটু দুরে বারান্দা‌র উল্টো‌দিকের সিঁড়িতে বসে সিগারেট ধরায়। ছেলেদের মধ‍্যে সুমন,  গৌরব আর ইনস্ট্রাক্টররা ছাড়া আর কেউ সিগারেট খায় না। গৌরব বা ইনস্ট্রাক্টরদের কোনো ব্র‍্যান্ডের বাছবিচার নেই। যা পায় তাই খায়। 

    বলাইদার দোকানে বিড়ি ছাড়া চারমিনার, পানামা, নাম্বার টেন গোছের সস্তা সিগারেট পাওয়া যায়। গোল্ড ফ্লেক, ক‍্যাপস্টান কিং সাইজ গোছের একটু দামি সিগারেট ওখানে অমিল। ওরা চারমিনার‌ খাচ্ছে। সুমন ধরায় ওর পছন্দের উইলস ফিল্টার। ওটা ছাড়া ওর চলে না। ও জানতো এসব জায়গায় তা পাওয়াও যাবে না তাই তিনদিনের ট্রিপের জন‍্য কলকাতা থেকেই কিনে এনেছে দশ প‍্যাকেট। 

    এসেই তিন ইনস্ট্রাক্টরকে এক প‍্যাকেট ক‍রে দিয়ে দিয়েছে। খুব খুশি তারা। বলে, "আরে বাঃ! এতো মেঘ না চাইতে‌ই জল। বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে খাবো!" সামান্য কারণে সরল আনন্দের প্রকাশ দেখে ভালো লাগে। পর্বতারোহীদের সিগারেটের নেশা না থাকলে‌ই ভালো‌। দমে টান পড়ে। তবে থাকলে, এমন জায়গায় তার যোগান না পেলে মজাই মাটি। সুমন একটু বেশি এনেছি‌ল এই জন‍্য‌ই। তাছাড়া শৈলারোহণ সুমনের নিছক শখ। এ নিয়ে বেশীদুর যাওয়ার ইচ্ছা ওর নেই। তাই ও সিগারেট খেতেই পারে।

    মেয়েদের মধ‍্যে ঈশিতা‌কে আগের বার কোর্সেই মাঝে মধ‍্যে খেতে দেখেছে। পরে একটা প্র‍্যাকটিসে‌ও দেখেছে। বোধহয় হালকা নেশা আছে ওর। চুনি কচিৎ কখোনো একটু আধটু টান মারে। তুলির ওসব বালাই নেই। ঈশু পাশে এসে বসে। বলে, "জেঠু, কাউন্টারটা দিস।" 

    - "দ‍্যাখ, ওসব কাউন্টার ফাউন্টার দেওয়া নেওয়া আমার পোষায় না। তুই একটা গোটাই নে।" প‍্যাকেট খুলে একটা গোটা সিগারেট ওর দিকে বাড়ায় সুমন।

    - "না, না, তোর স্টক শেষ হয়ে যাবে। আমি বলাইদার কাছে খোঁজ নিয়ে‌ছি এখানে পাওয়া‌ যায় না এটা"। একটু ইতস্ততঃ করে ঈশু।

    - "নে, নে, ধর, বেশি ফর্মালিটি করিস না। এখনো সাত প‍্যাকেট আছে। ভুলে যাস না  আমি চাকরি করি, মাইনে যদিও সাতশো টাকা, তবু তোদের মতো নির্ভেজাল বেকার ন‌ই। তুই বরং একটা গোটা প‍্যাকেট‌ই রাখ।"

    সিগারেট‌টা ঠোঁটে নিয়ে ঈশুর আর দেশলাই‌য়ের তর সয় না। সুমনের ঠোঁটে জ্বলা সিগারেট থেকে‌ই ধরানোর জন‍্য ঝুঁকে আসে। শিউরে ওঠে সুমন। ধারালো কাঁচের মতো মেয়েরা কেন যে এসব করে! এমন নৈকট্যে মিষ্টি পারফিউমের সুবাসে যে মন উতলা হয়ে উঠতে পারে তা কি বোঝে না ওরা?

    পারফিউম ব‍্যবহার করা ঈশুর শখ। ও বলে তাতে নাকি ওর মন ভালো থাকে। কিন্তু ও জানে না, তাতে কখনো অন‍্যের‌ মন খারাপ‌ও হয়ে যেতে পারে। তখন শুশুনিয়া পাহাড়ের রেখা ছাড়িয়ে চাঁদের আভা ক্রমশ বাড়ছে। চাঁদ অবশ‍্য তখনো পাহাড়ের আড়ালে। কাল দোল পূর্ণিমা।
     
     কয়েকটা সুখটান মেরে ঈশু বলে - "না রে, তার চেয়ে এই ভালো। যখন ইচ্ছে হবে তোর কাছে চাইবো।"

    -"কী?" জেনে বুঝে ন‍্যাকা সাজে সুমন।

    -"কী মানে? সিগারেট। আবার কী?" 

    -"ও তাই বল, আমি ভাবলাম বুঝি ..."

    -"জেঠু, ইউ আর জাস্ট ইনকরিজিবল, এমন ইন্সট‍্যান্ট ফিচলেমি তোর মাথায় আসে কী করে বলতো?" বলার ভঙ্গিতে মনে হয় চোখ পাকিয়ে তাকালো। পাহাড় চোঁয়ানো হালকা জ‍্যোৎস্নার পেলব আলো পড়েছে মুখে, চোখে তখনও আলোছায়া।

    নারীবাদীকে নাড়িয়ে

    - "এই, তোরা দুজনে মিলে হুইসপারিং গেম খেলছিস নাকি রে?" তুলি এসে বসে ওদের পাশে। গৌরব কোথায় ঘুরছে কে জানে। বরুণ, চিতা আর দুটো নতুন ছেলে মোমবাতি জ্বালিয়ে বারান্দায় তাস খেলতে বসেছে। ইনস্ট্রাক্টররা নিজেদের মধ‍্যে পাহাড়ের গল্প করছেন। 
    এক‌ই দলের মধ‍্যে তৈরী হয়েছে কয়েকটি ছোট ছোট উপদল। যেন মেঝেতে পড়া ফোঁটা ফোঁটা গুড়ের পাশে জমা হ‌ওয়া পিঁপড়ে‌। চুনিও এসে যোগ দেয় ওদের উপদলে। কিছু করার নেই বলে সুমন ভাবে ঈশুকে একটু নাড়িয়ে দেখা যাক।

    - "আচ্ছা ঈশু, এই যে তুই নিজেকে ফেমিনিস্ট বলিস, এটা তো একটা মতবাদ। এ বিষয়ে কিছু বল না শুনি।"

    - "আগে বল, তুই কী জানিস।"

    - "কিছুই না। তবে আন্দাজে মনে হয় ফেমিনিজম মুভমেন্টের মূলে আছে সমাজে মহিলা‌দের প্রাপ‍্য স্বীকৃতি ও অধিকার আদায়ের লড়াই। যেহেতু সারা পৃথিবীতেই সমাজের নানান একপেশে নিয়মকানুন মূলত পুরুষদের দ্বারা‌ই তৈরী ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে তাই আমার অনুমান প্রতিবাদ হিসেবে ফেমিনিস্ট আন্দোলনের সূত্রপাত‌‌ হয়তো হয়েছে মহিলা‌দের দ্বারা‌ই। আর কিছু বলতে পারবো না।"

    - "সাধে কী আর তোকে আমরা জেঠু বলি"। ট্রেনে বলা তুলির কথাটা ঈশু‌ও পুনরাবৃত্তি করে। "কিছু না জেনেও তুই আন্দাজে‌ বুলস আইতে হিট করেছিস।" ঈশু সুমনের পিঠটা একটু চাপড়ে দেয়। তুলি সুমনের কলারটা তুলে নাচিয়ে দেয় কয়েকবার। 

    ঈশু বলে, "পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মহিলা‌রা চিরকাল পুরুষের নিয়ন্ত্রণ ও দমনের শিকার। তাই ফেমিনিস্ট আন্দোলনের মূলে আছে, যা তুই বললি, সমাজে পুরুষের সাথে মহিলা‌দের সমান অধিকারের দাবিতে লড়াই। কর্মক্ষেত্রে সুযোগ, অর্থ‌নৈতিক মুক্তি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা,  জীবনের নানান ব‍্যক্তিগত ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমানাধিকার, সামাজিক ন‍্যায়বিচার ইত‍্যাদির জন‍্য জনসচেতনতা গড়ে তোলা। এবং তা শুধু মহিলাদের মধ‍্যে নয়, পুরুষ‌দের মধ‍্যেও"। 

    তুলি বলে, "কেন? পুরুষ যদি মেয়েদের ওপর অধিকার কায়েম রাখতে চায়, তাহলে পুরুষ‌রা মহিলা‌দের থেকে এসব কথা শুনতে চাইবে কেন?"

    ঈশু বলে, "কারণ প্রকৃতি‌গতভাবে দূর্বল নারী, পুরুষের বিরূদ্ধে গলাবাজি, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, প্রত‍্যাখ‍্যান, সমালোচনা করে তাদের মূল লক্ষ্যে বেশিদূর এগোতে পারবে না। সমাজে এবং ব‍্যক্তিগত পরিসরে‌ও নারী‌র উন্নতি ও সুষ্ঠু জীবনযাপনের  জন‍্য পুরুষকে তার পাশে পাওয়া জরুরি। নারী ও পুরুষ যে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, পরিপূরক, এই ধারণার সার্বিক মান‍্যতা প্রতিষ্ঠা না করে পুরুষের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ফেমিনিস্ট‌রা কোনো বৃহত্তর সাফল‍্য পাবে বলে মনে হয় না। পুরুষদের বোঝাতে হবে যে পোষা কুকুরের মুখে ছুঁড়ে দেওয়া রুটি‌র টুকরো‌র মতো যুগ যুগান্ত ধরে মেয়েদের পুরুষের দিকে ভিক্ষের ঝুলি হাতে তাকিয়ে থাকতে বাধ‍্য করা আসলে পৌরুষের‌ই অপমান।" 

    চুনি বলে, "ঠিক বলেছিস। শুধু‌ই পুরুষের বিরোধিতা নয়, ওদের বোঝা‌তে হবে। ওদের এটা অনুভব করতে প্রভাবিত করতে হবে"।

    ঈশু বলে, "সৌভাগ্যের কথা অনেক পুরুষ‌ই হীনমন্য, সঙ্কীর্ণ‌মনা, কুচুটে বা মেনীমুখো ধরণের নয়। অনেক পুরুষের মধ‍্যে‌ই কাজ করে মেল ইগো - মানে হিমালয়ের মতো চিন্তার মহানতা, সমূদ্রে‌র মতো দরাজ হৃদয় হবার প্রবণতা। এটা তাদের মেল সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স। এহেন উদারমনস্কতার ফলে তারা যদি মহিলা‌দের প্রতি অবিচার করার আগে দুবার ভাবে বা করে ফেললেও আত্মগ্লানি‌তে ভোগে তাও আখেরে মহিলা‌দের পক্ষে মঙ্গল‌জনক। তাই পুরুষ‌রা মহিলা‌দের ওপর দীর্ঘদিন ধরে অবিচার করে এসেছে বলে মহিলা‌রা‌ও যদি নিয়ত পুরুষদের সর্বসমক্ষে তুলোধোনা করতে থাকে তাহলে ব‍্যাপার‌টা এক‍‌ই ভুলের অন‍্যরকম পুনরাবৃত্তি হয়ে যাবে। বরং পুরুষ‌দের সেই উচ্চমন‍্যতা বোধ জাগিয়ে তুলে তাদেরকে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে যে তারা যা করছে সেটা ঠিক নয়। এটা মোটে‌ও সহজ কাজ নয়। চটজলদি সমাধান তো নয়‌ই।"
     
    মুগ্ধ হয়ে ওরা শুনছিল ঈশিতার কথা। মনে হচ্ছিল শুশুনিয়ায় কোলেবাংলোর সিঁড়িতে তিন বন্ধু‌র সাথে নয় যেন কোনো অডিটোরিয়ামের পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে কিছু মনযোগী শ্রোতা‌র সামনে বক্তব্য পেশ করছে ঈশু। সুমন বলেই ফ‍্যালে, "ঈশু, তুই কিন্তু খুব ভালো বক্তা।"

    - "আসলে তুই আমার একটা প‍্যাশনেট জায়গায় টাচ করেছি‌স। তোরা মন দিয়ে শুনছিস বলে আমার‌ও বলতে ইচ্ছে করছে। তোরা‌ নিজেরা  কনভিন্স‌ড হলে, হয়তো এমন কথা কখোনো অন‍্য কোথাও বলবি। তোদের কথা শুনে‌ আরো কিছু মানুষ অনুপ্রাণিত হবে, হয়তো তাদের‌ ভাবনা চিন্তা‌য় প্রভাব পড়বে, আচরণ বদলাবে। এভাবেই ধীরে ধীরে আসে সামাজিক পরিবর্তন। বহুশতাব্দী প্রাচীন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, অভ‍্যাস তো আর কয়েক দশকে বদলাতে পারে না।"

    - "ঠিক বলেছিস। তোর যা বলতে ইচ্ছে করছে বল। আমরা শুনতে চাই। কী তাই তো?" সুমন তুলি আর চুনির দিকে তাকায়। ওরাও মনোযোগ দিয়ে শুনছি‌ল ঈশিতার কথা। সুমন কেবল সূত্রধরের কাজটা করছিল। দুজনেই একযোগে সম্মতি‌সূচক মাথা নাড়ে। 

    - "আচ্ছা, শোন তাহলে। মাতৃত্বেই যদি নারীত্বের সম্পূর্ণ‌তা হয় তাহলে সন্তানধারনের ক্ষেত্রে মহিলা‌দের সম্পূর্ণ না হলেও সামান‍্য ইচ্ছার‌ও মূল‍্য থাকে না কেন? অনেক মহিলা কেবল স্বামী‌র অতিরিক্ত শরীরের ক্ষুধার প্রতিবাদ না করতে পেরে অগুনতি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে‌ই অকালে ফুরিয়ে যায়। যেমন ধর খুররম আর আর্জুমান্দ বানুর কথা।"

    অমর প্রেমের অন্তরালে

    - "খুররম! আর্জুমান্দ বানু! তাঁরা আবার কে? বলে‌ই ফ‍্যালে সুমন। মুখ দেখে বোঝা যায় চুনি, তুলি‌ও জানেনা।

    - "মহান মূঘল সম্রাট শাহজাহান ও তাঁর  প্রিয় পত্নী মুমতাজ মহল। শাহজাহান তো একটা রাজকীয় উপাধি, মানে জগতসম্রাট, যেমন ঔরঙজেব নিয়েছিলেন, আলমগীর। যেমন জাহাঙ্গীর পত্নী ও শাহজাহানের বিমাতা অপূর্ব সুন্দরী মেহেরুন্নিসা বেগম অধিক পরিচিত ছিলেন নূরজাহান বা জগতের আলো নামে, সেই রকম।" 

    - "ওমা তাই নাকি, এটা তো জানতাম না" বলে তুলি।

    ঈশু বলে, "শাহজাহানের জন্মনাম ছিল - শাহাবুদ্দীন মহম্মদ খুররম। আর মূমতাজের আর্জুমান্দ বানু। তো যা বলছিলাম, শাহজাহানের অনন‍্য পত্নীপ্রেমের নিদর্শন তাজমহল, এক অসাধারন স্মৃতি‌সৌধ, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি, এসব‌ তো অনেকেই জানে। তবে উনিশ বছর দাম্পত্য জীবনে চতুর্দশতম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে বুরহানপুর কেল্লায় তিরিশ ঘন্টা গর্ভযন্ত্রনা ভোগ করে মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে যে মুমতাজের জীবনদীপ নিভে গেল - এটা হয়তো অনেকেই জানে না।"

    - "এ্যাঁ, তাই নাকি?" চোখ গোল হয়ে যায় চুনি‌র। "এ তো আমি‌ও জানতাম না। সত‍্যি ইতিহাসের কত কী যে জানিনা। কিন্তু ঈশু, তুই তো ইংরেজি সাহিত‍্য নিয়ে পড়ছিস অথচ ইতিহাসেও তো তোর খুব দখল দেখছি।"

    ঈশু বলে, "সব পড়াশোনা‌ই তো পরীক্ষা পাশ করার জন‍্য নয়। এসব আমি পড়ি ভালো লাগে বলে। তো, যা বলছিলাম। রাজকীয় হেকিম সম্রাটকে আগাম সতর্ক করেছিলেন, মুমতাজের যা শরীরের অবস্থা পরবর্তী সন্তানের জন্ম দিতে গেলে ওনার জীবনসংশয় হতে পারে। শুনলেন সে কথা পত্নী‌প্রেমে গদগদ মহান পতি শাহজাহান? সম্রাটের নিত‍্য স্বাদবদলের জন‍্য মূঘল হারেমে বন্দিনী ছিল বহু সুন্দরী রমণী। মুমতাজ ছাড়াও তাঁর ছিল আরো চারটি বৈধ পত্নী ও বেশ কিছু উপপত্নী। তা স্বত্তেও দুর্বল, রক্তাল্পতায় ভোগা মুমতাজ‌কে মাত্রাতিরিক্ত উপভোগ ক‍রে  মাত্র সাঁইত্রিশ বছরে তার ভবলীলা সাঙ্গ করে মহান সম্রাট তাঁর অনন‍্য পত্নী‌প্রেমের ধ্বজা উড়িয়ে বেঁচে র‌ইলেন চুয়াত্তর বছর। কী আয়রনি বল তো!"

    - "এর নাম ভালো‌বাসা? পত্নী‌প্রেম?" তুলি রাগে গনগন করে। 

    ঈশু বলে, "না রে, শাহজাহান কিন্তু সত‍্যি‌ই মুমতাজকে খুব ভালোবাসতেন। তাই পত্নীর মৃত্যুতে তিনি শোকে এমনই মূহ‍্যমান হয়ে যান যে রাজকার্য শিকেয় তুলে বুরহানপুর কেল্লার একটি ঘরে সাতদিন দরজা বন্ধ করে বসেছিলেন। একমাত্র খাবার দেওয়ার জন‍্য খাস খিদমৎগার ছাড়া শোকার্ত সম্রাটের কাছে যাওয়ার হিম্মত আর কারুর হয়নি। সাতদিন পর তিনি যখন সে‌ই ঘর থেকে বেরোলেন তাঁর মাথার সব চুল পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে! সবাই হতবাক। তবে মুমতাজের যদি আর সন্তান‌ধারণে অনিচ্ছা প্রকাশের বৈধ অধিকার থাকতো তাহলে এহেন অকালমৃত্যু তাঁকে গ্ৰাস করতো না। তুলির মতে এটা ভালো‌বাসা না ছাই, নির্লজ্জ শরীরের ক্ষিধে। তুই কী বলবি জেঠু?'

    সুমন ম্রিয়মান কণ্ঠে বলে, "আমি কী বলবো বল? শাহজাহানের প্রতিনিধি না হলেও, স্রেফ পুরুষসমাজের একজন হয়ে‌ও তো এসব শুনে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। তুলির কথা তো ফেলে দেওয়ার নয়। রাজবৈদ‍্যর নিষেধ সত্ত্বেও এমন অবিবেচনা‌র কাজ করেন কী করে উনি? আর তুই যখন বললি সে ক্ষিধে মেটানোর আরো নানা উপায় ছিল তখন রুগ্ন মুমতাজকে রেহাই দিলেন না কেন সম্রাট? মুমতাজের প্রতি তাঁর যে কিংবদন্তী‌প্রায় প্রেমের কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচারিত হয় এতো দেখা যাছে তা মূলতঃ ইন্দ্রিয়াসক্তি। কতজন শিক্ষিত মানুষ এসব জানে জানি না তবে স্বীকার করছি আমি‌‌ও এ ঘটনা জানতাম না।" 

     ঈশু বলে, "ঠিক আছে, সাড়ে তিনশো বছর আগে শাহজাহানের অসংবেদনশীল‌তার জন‍্য তোর লজ্জিত হ‌ওয়ার  কোনো কারণ নেই। তাছাড়া, তখন অনেক মন্ত্রী, রাজকর্মচারী বা প্রজাদের‌ও মনে হয়েছিল  এটা শাহজাহানের চূড়ান্ত স্বার্থপর‌তার নিদর্শন। তিনি কেবল নিজেকে ভালোবাসেন। কিন্তু কেউ ভয়ে তাঁর সামনে মুখ খুলতে পারেনি।" 

    চিতার দৌলতে টি ব্রেক

    জল খেতে থামে ঈশিতা। একটু আগে এসেছিল চিতা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনে কপট বিষ্ময়ে বলে, "ওরে বাবা, তোরা তো হেব্বি সব টপিক নিয়ে কথা বলছিস! ওসব আমার মাথায় ঢুকবে না ভাই। আমি বরং তাস‌‌ই খেলি গিয়ে। তবে তোদের জন‍্য বলাইদাকে একটু চা বলে আসি। এ্যাতো গেরেমভারি আলোচনা কী চা ছাড়া জমে?" এই হচ্ছে টিপিক্যাল চিতা-সুলভ আচরণ। বন্ধুদের জন‍্য ওর মমতা অকৃত্রিম। কার কী দরকার সেসবের প্রতি তীক্ষ্ম নজর। চিতাকে বাদ দিয়ে তাই আউটিং জমে না। একটু বাদে চিতার বলে আসা চা কেটলি করে নিয়ে আসে বাবলু।

    ঈশিতা সুন্দর কথা বলছে। শুনলেই বোঝা যায় ওর অনেক পড়াশোনা। চিন্তার স্বচ্ছতা, বক্তব্যের সাবলীল‌তা‌ও প্রশংসনীয়। যেন ও এক অধ‍্যাপিকা আর ওরা ওর গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রী। এমনি‌তে ইয়ারকী ফাজলামি মারলেও এরকম সঙ্গী পেলে সিরিয়াস আলোচনাতেও সুমনের দারুণ উৎসাহ। কোনো বিষয়-ভিত্তিক আলোচনা‌য় নিজের জানাটুকু অন‍্যের কাছে সুষ্ঠুভাবে প্রকাশ করতে পারলে নিজের ধারণা আরো পরিষ্কার হয়। যা জানা নেই তা অন‍্যের কাছ থেকে জানা যায়। এভাবে‌‌ই জীবনে চলতে ফিরতে‌ও অনেক কিছু জানা যায়। শুধু জানার ইচ্ছা, বোঝার চেষ্টা, বিষয়ে‌র গভীরে গিয়ে ভাবনা চিন্তা করার আগ্ৰহটুকু থাকা চাই।
     
    চায়ের পর সিগারেট ছাড়া চলে না। ঈশুকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে সুমন বলে, "দিদিমণি, নাউ ইউ ডিজার্ভ ইট"। ঈশু ওর সুন্দর মুখে মুক্তোর মতো দন্তশোভার ঝিলিক তুলে লাজুক হাসে। বিরল উপহার। একটু আগে শাহজাহান-মুমতাজ কিসসা বলার সময় আবেগতাড়িত হয়ে ওকে একটু উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। এখন আবার স্বাভাবিক লাগছে।   সিগারেট‌টা ধরিয়ে ঈশু বলে, "চল না একটু পায়চারি ক‍রে আসা যাক। অনেকক্ষণ এক‌ জায়গায় বসে আছি।"
     
    চুনি‌ বলে, "ঈশু, শেষে একটু দিস, পুরো খাবো না। চা টা খুব ভালো বানিয়ে‌ছিলেন বলাইদা।" 
     
    নির্জন সন্ধ্যায় ফুটফুটে জোৎস্না‌য় ওরা ঝর্ণার দিকে হাঁটতে যায়। চাঁদ তখন পাহাড়ের রেখে ছাড়িয়ে সবে উঁকি দিয়েছে।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৫ এপ্রিল ২০২৪ | ৪৫৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন