সুজনবাবু
একুশের বিশে মার্চ কর্ণাটক থেকে কলকাতায় এসে করোনাময়ীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের দাপট টের পাওয়া গেল। আসার আগে পরিকল্পনা করেছিলাম এপ্রিলের এক তারিখে দু হপ্তার জন্য কার্শিয়াং, দার্জিলিং, রাবাংলা, নামচি যাবো এক অতীত বন্ধুর পুত্র তপুর সাথে। অরিজিনাল বন্ধুর সাথে সম্পর্ক এখন ভেজিটেটিভ স্টেটে। আমার থেকে সিকিশতাব্দী ছোট তপুই এখন আমার ভালো বন্ধু। কাকু ভাইপোতে কয়েকটি মুচমুচে দোকাকী ভ্রমণ হয়েছে। বাকেট লিষ্টে আগামীতে আরো কিছু আছে। কথায় বলে, মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। তরতাজা তপু কোভিডাক্রান্ত হয়ে অগুনতি বার পটি করে কাহিল। যাওয়ার আগের দিন, মুঠোফোনে শীতকালে বৃষ্টিভেজা বেড়ালছানার মতো ম্রিয়মাণ স্বরে বলে, কাকু ট্যূর ক্যানসেল করে দাও।
তবে তাতে অবশ্য শাপে বরই হোলো। কারণ মহামান্য সিকিম সরকার ৩১শে মার্চের আদেশে অন্য রাজ্য থেকে সিকিমে বেড়াতে আসা ভ্রামণিকদের ৭২ ঘন্টা আগে করানো কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট দেখানো বাধ্যতামূলক ঘোষণা করলো। শেষ মূহুর্তে তপুর বন্ধু সেটা হোয়াতে জানাতে আমরা বেঁচে গেলুম। নাহলে আমাদের দুবার কোভিড টেষ্ট করাতে হোতো। বেড়াতে গিয়ে এসব আপুদে হয়রানি ভালো লাগে না।
করোনাকালে দুরে না হোক, কাছেপিঠে কোথাও মৃদুমন্দ ভ্রমণ তো হতেই পারে। কর্ণাটক থেকে কলকাতায় আসার আগে তেমনই ব্যবস্থা করে এসেছি। কখনো চাক্ষুষ না দেখেও গত দু বছর ধরে কিছু দূরভাষে এবং বহু হোয়াচ্যাটের মাধ্যমে পরিচয় একটু দানা বেঁধেছিল ভদ্রেশ্বরের সুজনবাবুর সাথে। নরম মাটিতেই বিড়াল আঁচড়ায়। তাই করলুম এক আহ্লাদী অনুরোধ - আপনাদের ভদ্রেশ্বরের আশেপাশে একটু ঘুরে দেখতে চাই তবে সকালে গিয়ে বিকেলে ফেরা হুড়ুমতাল নাচানাচি নয়, রয়ে সয়ে। তাই অন্তত একটা রাত থাকতে চাই, নতুন জায়গাটির সকাল ও সন্ধ্যার স্বাদ নিতে। এক নয়, সুজনবাবুর সৌজন্যে তিনরাত চার দিন অবস্থানের বন্দোবস্ত হলো। ওনার মতে সাত পা পথ একসাথে হাঁটলেই বন্ধুত্ব হতে পারে বটে তবে কোথাও অন্ততঃ তেরাত্তির না থাকলে সে জায়গাটির কিছুই অনুভব করা যায় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন লজ্জা, ঘৃণা, ভয় - তিন থাকতে নয়। কী নয়? জীবের মুক্তি। মানুষের স্বভাবে ঐ বৈশিষ্ট্যগুলি পাশের মতো - বন্ধনসম - যেমন নাগপাশ। ঐগুলি ত্যাগ করতে না পারলে জীবের ঈশ্বরে লীন হওয়া অসম্ভব। আমার কাছে “জীবের মুক্তি” - “ঈশ্বরে লীন” এসব বিমূর্ত ধারণা। তার চেয়ে বেড়ানোর আনন্দ বোধগম্য এবং কাম্য। তার জন্য স্বভাবে ঐ অবাঞ্ছিত উপাদানগুলি ত্যাগ করতে না পারলে কাছে, দুরে বেড়ানোর সামান্যতম সম্ভাবনা থাকলেও তা বাস্তবায়িত করার পথে ঘোর অন্তরায়। তাই কেবলমাত্র হোয়াপরিচিতির সুবাদে সুজনবাবুর আতিথ্য গ্ৰহণের অযথা আব্দার। যারা বুদ্ধিমান তারা কায়দা করে পাশ কাটায়। সুজনের মতো সজ্জনরা সব বুঝেও উপরোধে ঢেঁকি গিলতে বাধ্য হন - চক্ষুলজ্জার খাতিরে - যেটা আমার না থাকলেও অনেকেরই থাকে।
আমি যে একটু বেলায় ঘুম থেকে উঠি তা সুজনবাবুর আমার সাথে নানা চ্যাটালাপে জানা ছিল। তবু বলেছিলেন, একদিন কিঞ্চিৎ ক্লেশ স্বীকার করে হাওড়া থেকে সাড়ে আটটার ব্যান্ডেল লোকালটা ধরে ওনার সাথে সাড়ে নটা নাগাদ প্রাতরাশে যোগ দিতে পারলে উনি খুশি হবেন। এভাবে তো কেউ ডাকে না আজকাল। তাই ভালোলাগার ওমে রাতে ভালো করে ঘুমই এলো না। তায় গত সন্ধ্যায় বৌমণি রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে পায়ে বেশ চোট পেয়েছে। শ্বশুরবাড়ির চারতলার ঘরের খাটে পাশবালিশ ছিল না। মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়ে আর দোতলার দেয়াল আলমারির তালা খুলে পাশবালিশ আনা পোষালো না।
গভীর রাতে ঘুমের ঘোরে বৌমণির ব্যাথাতুর দক্ষিণাপদ স্বস্তির খোঁজে পাশবালিশ ভেবে থিতু হয় আমার কোমরে। আমার ঘুম পাতলা। বিছানায় শুয়ে জাগ্ৰত অবস্থায় আদর টাদর ঠিক আছে কিন্তু ঘুমের সময় সদ্য বিয়ের পরেও বৌমণির হাত, পা গায়ে ঠেকলে ঘুম ভেঙে যেতো। তাই শৈশবে প্রজাপতি ধরার মতো সন্তর্পণে কোমর থেকে বিছানায় নামিয়ে দিলুম অর্ধাঙ্গিনীর শ্রীচরণখানি। আবার কখন দেখি ঘুমের মাঝে সেটি উঠে এসেছে আমার কোমরে। আবার তাকে সযত্নে নামালুম। এভাবে রাতে কয়েক দফা স্ত্রী-চরণের বেভুলে আমার কোমরে ওঠা এবং আমার আলতো করে সেটি বিছানায় নামানোর প্রয়াসে আমার ঘুমের দফা রফা। তিনি ঔষধ খেয়ে ঘুমোচ্ছেন অঘোরে। তাই ভোরে এ্যালার্ম বাজার আগেই ঘুম ভেঙে, আর ঘুমোনোর বৃথা চেষ্টা না করে উঠে পড়লাম। হিসেব গুলিয়ে, সাড়ে আটটার বদলে সাড়ে সাতটার ট্রেন ধরে ভদ্রেশ্বর স্টেশনে হাজির হলুম সোয়া আটটায়।
কিছুদিন আগে উনি হোয়াতে মেয়ের বিয়ের কার্ড পাঠিয়েছিলেন আমায়। তাতে বাড়ির ঠিকানা ছিল। ভাবলাম গুগল ম্যাপ দেখে ঠিকানা খুঁজে গিয়ে 'বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাকো' স্টাইলে কলিং বেল টিপে অবাক করে দেবো। তা আর হলো না। হাওড়ায় ট্রেনে উঠে হোয়াতে মেসেজ করেছিলাম। শহরতলীর ট্রেন নির্ভর জনগণের জীবনযাত্রা ট্রেনের সময়সারণীর ছন্দে বাঁধা। মুখ ফিরিয়ে দেখি সাদা পাজামা-বাঙালি পরা এক ছিপছিপে ভদ্রলোক চুপটি করে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে অমায়িক ভঙ্গিতে মিটিমিটি হাসছেন। জরিপ করছেন আমার মানচিত্র জ্ঞানের বহর। সুজনবাবু আমার তৎপরতায় বিষ্মিত। তখনো বাড়িতে লুচির ময়দা মাখাই শুরু হয়নি।
অনেকে তাদের হোয়া ডিপি ছবি হিসেবে ফুল, ওঁং, পোষ্য কুকুর ইত্যাদি দিয়ে থাকে যা থেকে মানুষটিকে চেনা যায় না। তখন আমার হোয়া ডিপি সাম্প্রতিক চশমা ছাড়া বদনের ক্লোজআপ। এখনো তাই। বলে নাকি মুখ মনের দর্পন। তাতে চক্ষুদুটি প্রধান উপাদান। যদি কারুর ফেস রিডিংয়ের ক্ষমতা থাকে আমার ডিপি দেখে আমায় পড়া জলভাত। তাই আগে কখনো না দেখেও আমার ডিপির দৌলতে প্রথম দেখাতেও আমায় চিনতে পারা শক্ত নয়।
কিন্তু তখন হোয়াতে সুজনবাবুর ডিপি ছবিটি ছিল হয়তো একযুগ আগের। আন্দাজ দশ ফুট দুর থেকে টোটোর পিছনে বসা অবস্থায় তোলা। বড় একটা ব্যাগ নিয়ে পড়া বলতে না পারা স্কুলবয়ের মতো গোবেচারা ভঙ্গিতে বসে আছেন তিনি। রাতের বেলা ফ্ল্যাশ দিয়ে তোলা। ছবিটা উঠেছে একটু ঝাপসা, চশমার কাঁচে ফ্ল্যাশের রিফ্লেকশন। শুধু মুখ নয়, গোটা শরীর, পাশে রাখা দুম্বো ব্যাগ, টোটোর পশ্চাৎদ্দেশ, রাস্তার দুপাশে লোকজনও ছিল ওনার ডিপিতে। ঐ অতীত ডিপি দেখে বাস্তবে বর্তমান ওনাকে চিনতে শার্লক হোমসের চোখ দরকার। বলেওছিলাম ডিপি ছবিটা পাল্টে দিন, যাতে ব্যাগের নামের থেকেও আপনার মুখটা পষ্ট বোঝা যায়। শোনেন নি আমার শলা। হয়তো ছবিটা ওনার পছন্দের বা ওতে জড়িয়ে আছে বিশেষ কোনো মধূর স্মৃতি। বা হয়তো ওনার বিশ্বাস "What's in a DP?"
যেমন আমার থেকে দেড় দশক কনিষ্ঠ এক ডাক্তার বন্ধুর ডিপি হঠাৎ একদিন দেখি কুচকুচে কালো বৃত্ত হয়ে গেছে। তার আছে আকাশ দেখার নেশা। তাই লিখলাম, টেলিলেন্সে ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলে ওটাই করেছেন নাকি আপনার ডিপি? হোয়াতে একরাশ ইমোজিক্যালি হেসে জানালেন, না, না, এমনিই। ফেলুদা অবশ্য তোপশেকে বলেছিলেন, এমনিই বলে কিছু হয় না। আমাদের প্রতিটি কাজ বা কথার পিছনে থাকে কোনো না কোনো কারণ। হয় আমরা লুকোতে চাই বা বুঝতে পারি না, তাই বলি 'এমনিই'।
অমলবাবু
ভদ্রেশ্বর ভ্রমণে সুজনবাবু আমায় তেরাত্তির কাটানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন অমলবাবুর গৃহে। তিনিও অতি সজ্জন মানুষ। মাত্র পাঁচ সপ্তাহ আগে সেই বছরই সরস্বতী পুজোর সময় দূরারোগ্য ব্যাধিতে দীর্ঘদিন ভুগে তাঁর পত্নী মারা গেছেন। তবু তাঁর আচরণ সমাহিত লাগলো। '(অমোঘ) সত্যরে লও সহজে' গোছের মানসিকতা হলে বা চেষ্টা করেও কিছুটা রপ্ত করতে পারলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে না। বর্তমানে তিনি তাঁর দোতলা বাড়ির পাঁচটি ঘরে নটি শয্যার একটিতে একা রাত্রিবাস করেন। ফলে আমার আগমনে তাঁর কোনো অসুবিধা তো হলোই না বরং একটু মানুষিক সঙ্গ পেলেন।
আমার ঠাঁই হোলো একতলার ছাদের ওপর বাথরুম সংলগ্ন বিশাল শেডের নীচে দ্বিশয্যার খাটে। ঐ শেডের তলায় অন্ততঃ বিশজন মাটিতে ঢালাও বিছানা পেতে শুয়ে গড়িয়ে দিতে পারে চুটিয়ে আড্ডা। আহা, কতদিন যে হয়নি অমন!
আরণ্যকের রাজু পাঁড়ে লবটুলিয়া নাড়া বৈহারের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে নির্জন সরস্বতী কুণ্ডের পারে মনের আনন্দে গাছ লাগিয়ে বেড়াতো। অমলবাবু সারদা পল্লীর রাস্তার দুপাশে, বেওয়ারিশ জমিতে এবং দীর্ঘ দিনের জন্য তাঁর জিম্মায় ছেড়ে যাওয়া বন্ধুর বাড়ির জমিতে গাছপালা লাগিয়ে বেড়ান। সন্ধ্যায় জল দেন। বৃক্ষ মানুষের মতো অকৃতজ্ঞ নয়। তাই কোভিডের তাড়নায় অনেকে যখন অক্সিজেনের অভাবে খাবি খাচ্ছে অমলবাবুর লাগানো গাছগুলি ওনাকে অকাতরে বিলিয়ে যাচ্ছে অম্লজান। একজনের জন্য যথেষ্ট। অমলবাবু তাই অতিমারীতেও দিব্যি সুস্থ আছেন।
সারদাপল্লীর ভেতরে নিজ গৃহের সামনে পথে দাঁড়িয়ে অমলবাবু। দুপাশের গাছগুলি তাঁরই লাগানো। দুরে ওনার বাড়ির সামনে রাস্তায় শুয়ে আছে দুটি সাদাকালো পথকুকুর। ওনার আশ্রিত, খেতে পায়, রোদ চড়লে ওনার গ্যারেজের পাশে ছায়ায় এসে শোয়। একাকী অমলবাবুর নামানুষী সঙ্গী ওরা। তবে তারা এতই ভদ্র ও বন্ধুভাবাপন্ন যে রাতে অচেনা কেউ এলেও চ্যাঁচায় না, উল্টে ল্যাজ নাড়ে।
পেশায় আবহাওয়াবিদ তখন সাতষট্টি বছরের অবসরপ্রাপ্ত মানুষটি মিতভাষী। কিন্তু অতিথির প্রতি যত্নবান। বেড়াতে বেরিয়ে নীরবে পর্যবেক্ষণ করেন বহু কিছু খুঁটিয়ে। পরে সেসব লেখেন বিশদে। সাথে নানা প্রেক্ষাপট, ইতিহাস সংযুক্ত হয়ে লেখাটি হয় বেশ তথ্যসমৃদ্ধ। এসব নিয়ে ওনার বেশ পড়াশোনা আছে। সাত বছর আগে চাকরিতে অবসর নিয়ে এখনও আবহাওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ওনাদের পেশার কিছু মানুষের হোয়া গ্ৰুপে যুক্ত আছেন। আকাশবাণীতে সান্ধ্য সমীক্ষায় মাঝে মাঝে পঠিত হয় তাঁর আবহাওয়া সংক্রান্ত নিবন্ধ। তাঁর পোষ্ট দেখে কেউ আমন্ত্রণ জানান কোনো কলেজে ঐ বিষয়ে বক্তব্য রাখতে।
শহরে হাইরাইজ কালচারে একই টাওয়ারে একই তলে কয়েকটি দরজার তফাতে বহুকাল থেকে, বহুবার একসাথে লিফ্টে ওঠানামা করেও অনেকের মধ্যেই পরিচিতির গণ্ডি মুখচেনার বেশী আর এগোয় না। তবে শহরতলিতে অনেকদিন থাকলে সচরাচর অনেকের সাথেই ভালো পরিচিতি তৈরী হয়। তাই কখনো পল্লীর লোক রাস্তায় দেখলে জানতে চায়, দাদা, গরম কবে কমবে? অমলদা এবার তো কালবৈশাখী এখনো এলো না? বা বর্ষা কবে আসবে কাকু? হাসিমুখে জবাব দেন আবহাওয়াবিদ অমলবাবু। রাস্তায় বসে ঝিমোনো কুকুর তাঁকে দেখে চনমনিয়ে উঠে কাছে এগিয়ে আসে, কারণ ওনার থেকে নিয়মিত বিস্কুট পায় তারা। একদা গ্যাংটকে থাকতে সস্ত্রীক প্রাতঃভ্রমণে বেরোলে ওনার স্ত্রী সাথে বিস্কুট নিয়ে যেতেন রাস্তার কুকুরদের খাওয়ানোর জন্য। সম্প্রতি স্ত্রী চলে গেছেন কিন্তু অভ্যাসটা দিয়ে গেছেন স্বামীকে।
সারদাপল্লী
ভদ্রেশ্বরে গিয়ে প্রথম ভালো লাগার আবেশ পেলাম পরিকল্পিত সারদা পল্লীর সবুজ, সুন্দর, শান্ত পরিবেশে। শুনলাম ১৯৫৩ সালে রামকৃষ্ণ মিশন ঐ বিশাল জমিটি দান হিসেবে পেয়ে এক টাকা কাঠা দরে চার কাঠার প্লট করে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরণার্থীদের বিলি করেছিল। সে জমির বর্তমান বাজারদর কাঠাপ্রতি পাঁচলাখ। শর্ত ছিল জমি পেয়ে ফেলে রাখা যাবেনা, সামর্থ্য অনুযায়ী বাসস্থান বানাতে হবে এবং কিছুটা জমি ছেড়ে গাছপালা লাগাতে হবে। দুটি শর্তই পালিত হওয়ায় ভদ্রেশ্বর স্টেশনের পূব দিকটা একটু সংকীর্ণ হলেও পশ্চিমে সারদাপল্লী যেন মরুদ্যান।
সুজনবাবু সেদিন সন্ধ্যায় আমায় অমলবাবুর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় বলেছিলেন - আপনার নানা লেখা পড়ে মনে হয়েছে আপনি নির্জনতাপ্রিয়। দেখবেন, সারদা পল্লী আপনার বেশ লাগবে। একদম হক কথা। মনে হয়েছে যেন শিমূলতলার মতো কোথাও চেঞ্জে গেছি। শীতকাল হলে অমলবাবুর ছাদের কোনে চেয়ারে বসে চারপাশে অবাধ সবুজ, পাখিদের ডাকের মাঝে বই পড়েই দিব্যি কদিন ছুটির মেজাজে কাটিয়ে দেওয়া যায়।
অমলবাবুর ছাদ থেকে দেখা খোলামেলা সারদাপল্লী - ওনার ঐ লাল গাড়িটা করেই দ্বিতীয় দিন গেছিলাম বাঁশবেড়িয়া, ব্যান্ডেল, হুগলী ইমামবাড়া
অমলবাবুর বাড়ির কাছেই মা সারদা শিশু উদ্যান। এখানে সান্ধ্য আড্ডা বসতো ওনাদের। তখন অতিমারীর কারণে বন্ধ ছিল শিশু উদ্যানের লাগোয়া বড় লম্বাটে দিঘী। বাঁধানো ঘাট। চারপাশে ছোট বড় গাছ, বসার জায়গা, বেশ সুন্দর পরিবেশ
পুকুরের পূব দিকে প্রাচীন সারদাপল্লী বিবেকানন্দ পাঠাগার। পাশেই শ্রী রামকৃষ্ণ জন্মোৎসব সমিতির ভবনশীর্ষের মাঝে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতীক - গোলাকার সর্পের মাঝে সাগর তটে কমলে স্থিত পরমহংস, পিছনে উদীয়মান সূর্য। 'যত মত, তত পথ' প্রবক্তার মতাদর্শে ভবনের শিরে দুপাশে মসজিদের গম্বুজ ও চার্চের ক্রশ চোখে পড়লো। এমন সম্প্রীতি কেবল নিস্প্রাণ প্রতীকের বদলে সমাজে সমষ্টির জীবনাচরণে দেখলে ভালো লাগে।
সন্ধ্যায় চপ, মুড়ি, চা সহযোগে সুজনবাবু ও অমলবাবুর স্থানীয় বন্ধুদের সাথে নানা জমাট আড্ডা হোলো। বেশ লাগলো। আমার কাছে ওনারা শুনতে চাইলেন আমার একাকী ভ্রমণের কিছু অভিজ্ঞতা। প্রথম দিনটা সকাল থেকে রাত নটা অবধি আড্ডা মেরেই কেটে গেল। মাঝে সুজনবাবুর বাড়িতে স্বাদু মধ্যাহ্নভোজন সেরে একটু দিবানিদ্রার বিরতি নিয়েছি। সুজনবাবুর সে বালাই নেই। তাই আমার থেকে বছর কয়েকের ছোট সুজনবাবুর চেহারাটি ছিপছিপে, কর্মঠ। সুজনবাবুর দ্বিতল বাড়িটি ছিমছাম। সর্বত্র পরিচ্ছন্নতা ও রুচির ছাপ। ছাদটা ফুরফুরে। এখানেও আশপাশে নানা গাছ। এমন পরিবেশ শ্বাসরোধকারী ঘিঞ্জি শহরজীবনে পাওয়া যাবে না।
অমলবাবুর সাথে আশেপাশে
দ্বিতীয় দিন অমলবাবু আমায় লোকাল ট্রেন, বাস, ট্রেকার, টোটোয় করে ঘুরিয়ে আনলেন তারকেশ্বর লাইনে হরিপাল হয়ে আঁটপুর রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে। ওখানে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সাত গুরুভাইয়ের সাথে ১৮৮৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাতে ধুনি জ্বালিয়ে আজীবন সন্ন্যাসজীবন যাপনের শপথ গ্ৰহণ করেছিলেন। জায়গাটি বেশ লাগলো। শীতকাল হলে আরো ভালো লাগতো। করোনার কারণে তেরো মাস ঘরবন্দি থেকে সেদিন আন্দাজ তিন কিমি হেঁটে ঘুরেই বেশ ক্লান্ত লাগলো। গরমও লাগলো বেশ।
ঐতিহ্যবাহী আঁটপুর রাধাগোবিন্দ মন্দিরের টেরাকোটার কাজ দৃষ্টিনন্দন তৃতীয় দিন প্রথমার্ধে অমলবাবু ওনার গাড়িতে করে নিয়ে গেলেন বাঁশবেড়িয়া হংসেশ্বরী মন্দির। এই নামে নারায়ণ সান্যালের একটি অপূর্ব উপন্যাস পড়ার সুবাদে এটা দেখার অনেকদিনের বাসনা ছিল। ওনার সৌজন্যে পূর্ণ হোলো তা।
হংসেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে অনন্ত বাসুদেব মন্দির অনন্ত বাসুদেব মন্দিরে সূক্ষ্ম টেরাকোটার কাজ
বাঁশবেড়িয়া থেকে ফেরার সময় ব্যান্ডেল চার্চ দেখতে গিয়ে পথে পড়লো ১৯৩৬ সালে স্থাপিত অধূনা দীর্ঘদিন তালাবন্ধ এক ঐতিহ্যময় কারখানা - ভারতের প্রথম টায়ার ফ্যাক্টরি ডানলপ। আশি সালে একবার আমি আর প্রিয় বন্ধু উৎপল হাওড়া থেকে এসেছিলাম আমাদের বন্ধু অর্জুনের সাথে শাহাগঞ্জের ডানলপ কারখানায়। এক রাত ছিলাম ওখানকার স্টাফ কোয়ার্টারে। অর্জুনের জামাইবাবু তখন ডানলপে ভালো পদে ছিলেন। তখন আমি ও উৎপল ঘরে লুঙ্গি পরতাম, ওভাবেই কখনো রাস্তাতেও বেরিয়ে পড়তাম। সম্ভ্রান্ত ঘরের অর্জুন পরতো পাজামা। মনে আছে অর্জুন বলেছিল, তোরা ওখানে গিয়ে রাতে শোয়ার সময় লুঙ্গি পরলেও বাড়িতে অন্য সময় বা বাইরের লনে যেন লুঙ্গি পরে বেরিয়ে পড়িস না, তাহলে দিদি জামাইবাবুর সাথে আমারও প্রেস্টিজ পাংকচার হয়ে যাবে। তাই একসেট পাজামা নিয়ে গেছিলাম দুজনে। সেদিন ডানলপ কারখানার সীমানা প্রাচীরের তারকাঁটায় বুনো লতা, দেওয়ালে শ্যাওলা দেখে মনটা ভারী হয়ে গেল। চার দশক আগে এর যা রমরমা দেখেছিলাম এখন তা কল্পনাই করা যায় না।
করোনার জন্য ব্যান্ডেল চার্চে ঢোকা গেল না। পাশ দিয়ে হেঁটে পিছনে গেলাম। অমলবাবুও এখানে এলেন বহু বছর বাদে। অবাক হয়ে বললেন, গঙ্গা তো চড়া পড়ে প্রায় আধ কিমি পেছিয়ে গেছে! আগে যেখানে জল ছিল এখন সেখানে ফুটবল মাঠ। তবে ঘন সবুজ গাছপালা ঘেরা জায়গাটা কজনে বসে গজালি করার জন্য সুন্দর। আছেও বসে কিছু তরুণ ছেলে, যাদের এখন কাজকর্ম করার বয়স।
আসার পথে হুগলি ইমামবাড়া দর্শন আর এক প্রাপ্তি।
এটা দেখারও অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল। হাঁটুর ব্যাথায় মুখ কুঁচকেও অমলবাবু আমায় সঙ্গ দিতে খাড়া সিঁড়ি ধরে উঠলেন ১৫০ ফুট উঁচু ঘড়ি ঘর মিনারের টঙে
মিনারের ওপর থেকে যা দেখলাম, একদা পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম বলে চোখ জুড়িয়ে গেল। কেন? তাহলে একটু বিশদে বলতে হয়।
(ক্রমশ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।