গুণা থেকে ভীড়ে ঠাসা প্রাইভেট বাসটা চান্দেরীতে এলো নির্দিষ্ট সময়ে - বেলা একটায়। কিছু লোক নামতে বুকে পিঠে দুটো স্যাক নিয়ে গুঁতোগুঁতি করে উঠে ভাগ্যক্রমে একটা সীটও পেয়ে গেলাম। দশ মিনিট পরেই ছেড়ে দিলো বাসটা। পথে আর কোথাও না থেমে ৩৮ কিমি দুরে জেলা সদর ললিতপুর বাস টার্মিনাসে পৌঁছালো বেলা দুটোয়। ভালোই টানলো। মধ্যপ্রদেশের প্রাইভেট বাস সার্ভিস আমার কম খরচে একাকী ভ্রমণে বহুবার বরদান স্বরূপ বলে মনে হয়েছে।
ললিতপুরে নেমে বাসস্ট্যান্ডের চাওলাকে শুধোই, দেবগড়ের বাস কোথায় আসবে ভাই? তার তর্জনী নির্দেশ বোঝায় - ওখানেই। কখন আসবে? জড়ো করা পাঁচ আঙুল ইংগিত করে - এই এলো বলে। চায়ের দাম? ছড়ানো পাঁচ আঙ্গুল জানায় - পাঁচ টাকা। মুখে তার গুটখা ঠোসা বলে। তাই মনে হয় কথা কইছে তার আঙ্গুল। সবে চায়ে দুটো চুমুক দিয়েছি দুরের গেট দিয়ে বড় বাসস্ট্যান্ড চত্বরে ঢুকে একটা ঝড়ঝড়ে বাস ঝড়ের গতিতে বোঁ করে টার্ন মেরে ওখানেই এসে ঝরাং করে ব্রেক কষে দাঁড়ায়। পত্রপাঠ খর্বকায় চালক লাফিয়ে নেমে ‘জাখলোন', ‘জাখলোন’ বলে এপাশ ওপাশ ঘুরে ঘুরে লোক ডাকতে থাকে। অর্থাৎ স্ট্যান্ডে এলে তার ভূমিকা হয়ে যায় সারথী থেকে সংগ্ৰাহকের।
কিছু যাত্রী ছোটে সেদিকে। আমার চুমুক চালু থাকে চায়ে। এক জায়গায় অন্য বাসও তো আসে। মুখে ঠোসা গুটখা ফেলে চাওলা বলে, বাবুজী আপনি এতেই জাখলোন চলে যান। সেখান থেকে দেবগড়ের শেয়ার ট্যাক্সি পাবেন। দেবগড়ের সরকারি বাস আসবে চারটেয়। অতক্ষণ খামোখা ইন্তেজার করবেন কেন? হক কথা। কিন্তু পরোপকার করতে গিয়ে বেচারার আধ খাওয়া গুঠখা ফেলা গেল। বুকে পিঠে স্যাক, হাতে চায়ের কাপ নিয়ে এগোই। কিন্তু একটা হ্যান্ডেল ধরে উঠতে পারি না। পাদানি বেশ উঁচুতে। আমার অবস্থা দেখে চালক কাপটা আমার হাত থেকে নেয়। দু হাতে হ্যান্ডেল ধরে উঠে জানলার পাশে সীটে বসে বাইরে হাত বাড়াই। লক্ষ্মীট্যারা চোখে সরল হেসে এঁঠো কাপটা ফেরৎ দেয় সে। চালকের ‘একই অঙ্গে এতো রূপে’ বিমুগ্ধ হয়ে শুধোই, ভাই, জাখলোনে দেবগড়ের শেয়ার ট্যাক্সি পাবো তো? কয়েকবার ধোঁকা খেয়ে কিছু তথ্য দুবার যাচাই করার অভ্যাস হয়ে গেছে। সে বলে, অবশ্যই। আমার বাড়িও দেবগড়ে। 'লাশ টিপ' মেরে আমিও ওতেই যাই। এবার নিশ্চিন্ত বোধ করি।
ললিতপুরে লেদিয়ে শিক্ষা হয়েছে। তাই জাখলোনে বাস থেকে নেমেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অটোয় উঠতে যাই। কলকাতায় যাকে আমরা অটো বলি, সেটাই ওখানে 'ট্যাক্সি'। পরদেশী বুঝে চালক শুধোয়, দেবগড়? সায় পেয়ে বলে, 'তো উস ট্যাক্সিমে যাইয়ে'। তো সেই 'উস ট্যাক্সি' দাঁড়িয়ে প্রায় দুশো মিটার দুরে। স্থানীয় দেবগড় যাত্রীরা জানে বলে বাস থেকে নেমেই ছুটেছে ‘উস ট্যাক্সির’ পানে। আবারও খেলাম ধোঁকা। হাঁকপাঁকিয়ে গিয়ে ‘ট্যাক্সি’ চালকের ডাইনে অন্তিম সীট পাই। না পেলে পরের ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করো। নয়তো দেড়শো টাকায় রিজার্ভ করে চলো।
একানে সীটে চালক সহ চারজন বসবে! তিনজন অবধি দেখেছি। ভাবি এতে চারজন কীভাবে বসবে রে ভাই! সেটা বোঝা গেল ট্যাক্সি চলতে শুরু করায়। চলন্ত ট্যাক্সিতে দুই প্রান্তের যাত্রীর পঞ্চাশভাগ পশ্চাদ্দেশ ঝুলে রইলো সীটের বাইরে মহাশূন্যে। তৃতীয় যাত্রীটি চিমসে। সে বইয়ের তাকে দুটি গোবদা অভিধানের মাঝে চিঁড়েচ্যাপ্টা বর্ণপরিচয় হয়ে চললো। বার্থডে কেকের স্লাইস সদৃশ সীটের চিলতে অংশে ঠেকনো দিয়ে দিব্যি চালাচ্ছে ছিপছিপে চালক রামু। আমার বড় স্যাকটা ছাদে। বুকের স্যাকটা পিছলে পড়ে যেতে চাইছে। সেটা সামলাতে গিয়ে আমারও পড়ে যাওয়ার দশা।
রামুকে ট্যাক্সি থামাতে বলে স্যাকের হ্যান্ডেলে দড়ি বেঁধে সেটা ঝুলিয়ে দিই ছাদের রডে। এসব অবস্থার জন্য বাতিল জুতোর দুটো বড়, মজবুত লেস সর্বদা স্যাকের সামনের পকেটে ফার্স্ট এড বক্সের পিছন থাকে। চলন্ত ট্যাক্সিতে ন্যাপস্যাকটা ঝুমকো দুলের মতো দুলতে থাকে কানের পাশে। তা দুলুক, পড়ে আর যাবে না। আমি দুহাতে দুপাশের রড ধরে এবার নিশ্চিন্ত হয়ে বসি। পিছনে মুরগি-ঠাসা হয়ে বসা ছজন স্থানীয় যাত্রী নির্বিকার। এমন দৃশ্য বাস্তবিকই স্থৈর্যবর্ধক। মসৃণ রাস্তায় দশটি মানুষ, পিছনের সীটের পিছনে দুশো লিটারের ড্রাম, ছাদে তিনটে বড় বস্তা ও আমার গোব্দা স্যাক নিয়ে রামুর নতুন ইতালিয়ান পিয়াজ্জিও 'ট্যাক্সি' চলছে গড়গড়িয়ে। বিমুগ্ধ হয়ে বলি, এতো কিছু নিয়ে বেশ যাচ্ছে তো! ওর 'ট্যাক্সির' তারিফে শোলের ধন্নু গরবিনী বসন্তীর মতো তৃপ্ত হাসে রামু।
চলন্ত অটোয় অল্পস্বল্প গল্পের ফাঁকে রামু মিনমিন করে বলে, বাবুজী, ছাদে রাখা আপনার ব্যাগটা বেশ বড়। ওটার জন্য পাঁচ টাকা ‘এসট্রা’ লাগবে কিন্তু। জাখলোন থেকে বারো কিমি দুরে দেবগড়ের পনেরো টাকা ভাড়াই আমার যথেষ্ট কম লেগেছিল। তাই পাঁচ টাকা ‘এসট্রা’ মোটেও গায়ে লাগে না বরং ওর বলার ভঙ্গিতে মায়া লাগে। প্রত্যাশা কত সীমিত! হেসে নিশ্চিন্ত করি ওকে। হয়তো ঐ পাঁচ টাকা এক্সট্রা নিয়েও পঞ্চায়েতি করে স্থানীয়রা। তাই হয়তো কুণ্ঠিত হয়ে বলছিল রামু।
দেবগড়ে জৈন ধর্মশালা আমার গন্তব্য। দেখা গেল ওটাই রামুরও অন্তিম গন্তব্য। ওখানেই নামে ডিজেলের ড্রাম। দেবগড় উত্তরপ্রদেশের ললিতপুর জেলার ছোট্ট একটি গ্ৰাম। ওখানে পেট্রলপাম্প নেই। তাই ধর্মশালার ম্যানেজারই স্থানীয়দের জন্য পেট্রল, ডিজেল ও কিরানা (মুদী) সামান বেচেন। ছাদের বস্তাগুলো ওনার দোকানের মাল। ঐ সব মাল আনার ভাড়াও পায় রামু। নয়তো নয় জন যাত্রীর জন্য স্রেফ ১৩৫ টাকা ভাড়ায় জাখলোন দেবগড় খেপ খাটা পড়তায় পোষায় না।
ধর্মশালায় গোটা ত্রিশেক ঘর তখন বেবাক খালি। জৈন উৎসবের সময় ছাড়া খালিই থাকে। দোতলায় দ্বিশয্যার বাথরুম সমেত পরিচ্ছন্ন একটা ঘর পাই। পিছনের জানলা খুলতে দিগন্ত বিস্তারিত সবুজ প্রশান্তির চামর বোলায় মনে। পড়ন্ত সূর্যের সোনালী রোদে সবুজ ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে সরু মেঠো পথে দৌড়ে আসছে লাল ফ্রক পড়া একটি বালিকা। খিলখিলিয়ে হাসছে। হাওয়ায় উড়ছে চুল। ওকে তাড়া করে আসছে এক বালক। সেও কীসব বলে খুব হাসছে। হয়তো ওর ভাই। দৃশ্যটি মনের পর্দায় ফ্রীজ শট হয়ে যায়।
দেবগড় পর্যটকবিরল জায়গা। তাই শাপে বর হিসেবে আধুনিকতার নানা উৎকট অনুষঙ্গ - ভীড়, জঞ্জাল, ডিজের শব্দদূষণ, দোকানের ছড়াছড়ি অনুপস্থিত। শান্ত, সুন্দর গ্ৰামীণ পরিবেশ। তবে যাত্রী সমাগম কম হয় বলে একটা খাবার হোটেলও নেই। ধর্মশালার এক কর্মী সপরিবারে থাকেন। বললে তাঁরাই খাবার বানিয়ে দেন। পঞ্চাশ টাকা থালি। ফ্রেশ হয়ে বাইরে গাছতলায় ছোট্ট চায়ের দোকানে এসে বসি। দুরে কয়েকটি শিশু নিজেদের মধ্যে হুটোপুটি করে খেলছে। একটা মোষ গাছতলায় বসে চোখ বুঁজে জাবর কাটছে। কান নাড়িয়ে মাছি তাড়ানোয় গলায় বাঁধা ঘন্টার মৃদু ডুংডুং ঘুমপাড়ানি আওয়াজে শৈশবে পিসিমার অজগাঁয়ের বাড়িতে কাটানো কিছু বাল্যস্মৃতি উসকে ওঠে।
আজ চান্দেরীতে দশ কিমি হেঁটে ঘুরেছি। তারপর তিন খেপে ৭৩ কিমি এসেছি। বাড়ি থেকে বেরিয়েছি বিশদিন আগে। বয়সও উনষাট হতে চললো। একটু ক্লান্তই লাগছিল। তবু নির্জন পরিবেশে চায়ে কয়েক চুমুক দিয়ে মন প্রসন্ন হয়ে যায়। সামনে বসা শক্তপোক্ত চেহারার স্থানীয় লোকটি নিজে থেকে আলাপ করেন। বললেন উনি ইউপি ট্যূরিজমের রাহি ট্যূরিস্ট লজের কেয়ারটেকার। সংস্কার চলছে বলে এখন লজ বন্ধ। নাম বললেন, মালখান সিং। বলি, ঐ নামের একজন তো এককালে পুলিশকে ঘোল খাইয়ে চম্বলের বেহড় কাঁপিয়ে বেড়াতো! মালখান হাসেন। বলেন, চম্বলের বাগীদের সেই রোয়াবের জমানা আর নেই। আমার হেঁটে ঘোরা পছন্দ শুনে মালখান কাগজে লাইন স্কেচ করে পথ বাতলে দেন। ললিতপুর থেকে আসা পিচরাস্তাটা ধরমশালাতেই শেষ। তার আগে মেঠো পথ চাষের ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে দুরে বেতয়া নদীর পারে। ঐ নদীটাই এখানে মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের সীমানা। ধরমশালাকে ডানদিকে রেখে বাঁদিকে দেবগড় পাহাড়ে উঠেছে সরু পিচরাস্তা। দু’কিমি গিয়ে জৈনমন্দিরে শেষ হয়েছে সেটা। ইতস্ততঃ কিছু ভাঙা দেওয়াল ছাড়া দেবগড় কেল্লার আর কিছু অবশিষ্ট নেই এখন। মালখানের স্কেচ অনুযায়ী পুরাতাত্ত্বিক স্থানগুলি দেখতে হাতিগেটের কাছে রাস্তা ছেড়ে বনপথে যেতে হবে। সেটাও ঘুরপথে গিয়ে মিলেছে জৈনমন্দিরের গেটে।
পাহাড়তলে ধর্মশালা থেকে শুরু করে বনপথে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখে পরিক্রমা করে জৈন মন্দির দেখে নেমে আসলে পাঁচ কিমি হাঁটতে হবে। তবে বৌধগুফা গেলে হাঁটতে হবে দশ কিমি। বলি, আচ্ছা মালখানভাই, এই জঙ্গল তো মহাবীরস্বামী অভয়ারণ্যের অন্তর্গত। নেটে পড়লাম এখানে নেকড়ে, হায়েনা, লেপার্ড আছে। একা ঘোরা নিরাপদ তো? মালখান বলেন, সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ১২৪১ হেক্টরের অভয়ারণ্যের ৫৪১ হেক্টর কোর এরিয়া। পাঁচ কিমি পরিক্রমা পথ বাফার এলাকায়। বিগত ত্রিশ বছরে এদিকে লেপার্ড দেখা যায় নি। তাই ভয়ের কিছু নেই। তবে বৌধগুফা জঙ্গলের গভীরে। ওখানে একা না যাওয়াই ভালো।
মালখানের সাথে আলাপের মাঝে ললিতপুরে আমার এঁটো চায়ের কাপ ধরে বাসে উঠতে সাহায্য করা সেই লক্ষ্মীট্যারা বাসচালক এসে চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে। মানে ওর আজকের 'লাশ টিপ' হয়ে গেছে। নাম জানতে চাইলে বলে শিশুপাল। দোকানীকে বলি ওকেও চা দিতে। সে জোড়হস্তে বারণ করে। কিঞ্চিৎ টলমলো অবস্থা দেখে বুঝি তার আপত্তির কারণ - সে তখন মজে আছে অন্য রসে। শিশু বলে, বলেছিলাম না বাবুজী, ঠিক পৌঁছে যাবেন। বলি, বহোত সুক্রিয়া শিশুভাই, লেকিন বুরা না মানে তো, এক বাত পুছু? শিশু বলে, বেঝিঝক পুছিয়ে। হাত তুলে বুড়ো আঙুল উল্টো করে গলায় ঢালার ভঙ্গি করে বলি, বাস চালানোর সময়ও এসব চলে নাকি? বড় করে জিভ কেটে শিশু বলে, না, না, বাবুজী, গুরুর বারণ আছে। তখন পাবলিকের জান আমার হাতে। শুধু ডিউটির শেষে, সারাদিনের ধকলের পর একটু… বোঝেনই তো। বুঝি আমি, এটুকু ওর লাশ টিপের পর রিক্রিয়েশন। ট্যারা চোখের অনাবিল হাসিতে শিশুকে আমার প্রথম দর্শনেই ভালো লেগেছিল, ওর অকপট স্বীকারোক্তিতে সেটা গাঢ় হয়।
পরদিন সকালে সেই পরিবারটির কাছে পঁয়ত্রিশ টাকায় পোহা, চা দিয়ে নাস্তা সেরে চল্লুম ন্যাপস্যাক নিয়ে হালকা চালে পাহাড় পানে। কিছুটা উঠে ডানদিকে একটা হালকা পায়ে চলা পথের চিহ্ন চোখে পড়ে। কিন্তু হাতিগেট তো ছার একটা ভাঙা পিলারও নেই! উল্টো দিক থেকে একটি স্থানীয় লোক আসছিলেন। জিজ্ঞাসা করতে বলেন ওটাই পরিক্রমা পথ। বিমূঢ় হয়ে বলি, আর হাতি গেট? রাস্তা ছেড়ে সেই মেঠো পথে নামেন তিনি। একটু এগিয়ে জঙ্গলাকীর্ণ একটা তোরণের ভগ্নাবশেষ দেখিয়ে বলেন, এটাই হাতি গেট। মুখভাবে যেন উহ্য বক্তব্য, পিচরাস্তায় দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোলে হবে কত্তা! একটু আশপাশে নজর করে দেখতে হবেনি? বোকা হেসে বনপথে এগোই।
একে একে আসে পরিক্রমা পথের দ্রষ্টব্যগুলি - বারাহী মন্দির, সিদ্ধগুফা, রাজঘাট, নাহারঘাট। অরণ্যের নিস্তব্ধতা স্থানমাহাত্ম্যের মাধুর্যে যোগ করেছে অপরূপ মাত্রা। বেতয়ার পাথুরে ঘাটে বসে থাকি। লম্বা লেজ নিয়ে উড়ে যায় ময়ুর। আমার কাছে বিরল দৃশ্য। অচেনা নানা কাকলীর মাঝে ময়ুরের তীব্র - ক্রেয়া, ক্রেয়া - ধ্বনি ছড়িয়ে যায় দূরে। অনেক নীচে বেতয়ার পেলব শরীরে মেদুর বাঁক। মানবসভ্যতায় নদীর ভূমিকা মায়ের মতো। অধিকাংশ প্রাচীন জনপদের পত্তন হয়েছিল নদীর কাছাকাছি - নীল, সিন্ধু, গঙ্গা, ইউফ্রেটিস। আসন্ন চৈত্রে নদীর তৃষ্ণার্ত বুকেও জেগেছে মানুষের জন্য উপকারী চর, চলছে সাময়িক চাষাবাদ। ঘাটের পাথরে বেশ ওপর অবধি জলের দাগ দেখে বোঝা যায় বর্ষায় বেতয়া হয়ে যায় বেগবতী উগ্ৰচণ্ডিকা। তখন মিলিয়ে যায় তার বুকে স্নেহের চর, তার রোষে তখন প্লাবিত হয় চরাচর।
নদীর ওপারে আদিগন্ত শষ্যখেত। ওপারে তীরের কাছে একটি নৌকায় রাখা পাম্পসেট থেকে আসছে মৃদু, ঘুমপাড়ানি আওয়াজ - ডিব্-ডিব্ - ডিব্-ডিব্…। এছাড়া কাছে দুরে মনুষ্য অস্তিত্বের আর কোনো শ্রাব্য লক্ষণ নেই। সেই ঝিম ধরানো মায়াবী নির্জনতায় বেশ কিছুক্ষণ সিঁড়ির ধাপে চুপচাপ বসে থাকি। এমন মুহূর্তগুলি আমার কাছে একাকী ভ্রমণের মণিমুক্তোসম প্রাপ্তি। এসব সময় পরিচিত, অপরিচিত যে কোনো সান্নিধ্য, অহেতুক কথাবার্তা - অবাঞ্ছিত লাগে। সত্তায় শুষে নিতে ইচ্ছে করে অতীন্দ্রিয় নিস্তব্ধতা।
বনপথ ধরে এগোতে আসে একটা কংক্রিটের ওয়াচ টাওয়ার। সূর্য তখন মধ্যগগনে। টাওয়ারের তিন তলায় উঠে প্লাস্টিক বিছিয়ে শুয়ে পড়ি। কোথাও মওকা পেলে একটু গড়িয়ে নেওয়া একাকী ভ্রমণে আমার প্রিয় বিলাস। সেদিন অরণ্যের ঝিমঝিমে আবেশে ঘুমিয়েই পড়ি ঘন্টা দেড়েক। নির্জন প্রকৃতির কোলে সামান্য বিশ্রামেই বেশ তরতাজা লাগে। নেমে কিছুটা হাঁটতেই চোখে পড়ে বেশ বড় জৈনমন্দির চত্বরের পিছনের গেট। এখানে রয়েছে অষ্টম থেকে সপ্তদশ শতকে তৈরি ৪১টি মন্দির ও একটি গোলাকার মানস্তম্ভ। জৈন দর্শনে মন্দির কমপ্লেক্সের সামনে সহজেই চোখে পড়ার মতো স্থানে মানস্তম্ভ নির্মাণের একটি কারণ আছে। এটি ভক্তদের মনে করিয়ে দেয় মন্দিরে প্রবেশের আগে তারা যেন তাদের ‘মান’ বা অহং বিসর্জন করে আসে। পার্শ্বনাথ মন্দিরটি আকারে সর্ববৃহৎ। তাতে পাথরের কাজ সুন্দর। এসব ভারতীয় পূরাতত্ব বিভাগের অধীনে। তবে জৈন সম্প্রদায়ের পূজারী নিয়মিত পূজার্চনাও করেন। জৈন উৎসবে বহু ভক্ত সমাগম হয়। ঘন্টাখানেক ধরে ঘুরে ঘুরে দেখি। ততক্ষণ আর কেউ আসেনা সেখানে।
মন্দির পরিসরের একপাশে ASI এর গুদাম। সেখানে কিছু ছোটখাটো মূর্তি রাখা আছে। তবে তখন সেটা তালাবন্ধ। বাইরে রয়েছে কিছু বড় মূর্তি। ঘুরে ঘুরে সেসব দেখছি। একটি শীর্ণকায় লোকের সাথে দেখা হয়। জানা গেল সে ঐ গুদামের চৌকিদার। আমি একটা পদ্মাসনে ধ্যানমগ্ন মূর্তি দেখিয়ে জানতে চাই, এটা কার মূর্তি বলতে পারেন? লোকটি কাছে এসে মূর্তির বেসটা দেখে বলে - এটা মহাবীরস্বামীর মূর্তি। অতীতে আমি অনেক বিখ্যাত জৈন তীর্থে গেছি - পরেশনাথ, গিরনার, পালিতানা, দিলওয়াড়া, ওশিয়া ...। সেবারের ভ্রমণেও দেবগড়ে আসার আগে ছয়টি জৈন তীর্থে গেছি - থেকেছি তার মধ্যে চার জায়গায়। তবে আমার কাছে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় সব তীর্থঙ্করদের মূর্তি একই রকম লাগে। লেখা না থাকলে দেখে বোঝা মুশকিল মূর্তিটি কার - আদিনাথ, শীতলনাথ, মল্লিনাথ, চন্দ্রপ্রভুজী, বাসুপূজ্যজী বা অন্য কারুর। এখানে কিছু লেখা ছিল না। তাহলে চৌকিদার মূর্তির বেসে কী দেখে বললো ওটা মহাবীরস্বামীর?
সেই কথাই শুধোই তাকে। সে বলে, বাবুজী, জৈন ধর্মমতে চব্বিশজন জৈন তীর্থঙ্করের প্রত্যেকের জন্য একটি নির্দিষ্ট চিহ্ন ধার্য করা আছে। মূর্তিকার তো জানে সে কার মূর্তি বানাচ্ছে তাই মূর্তির নীচে বেসে সেই চিহ্নটি সে খোদাই করে দেয়। সেই চিহ্ন নষ্ট হয়ে গেলে পণ্ডিতজন হয়তো আরো কিছু অনুষঙ্গ দেখে বুঝতে পারতেও পারেন ওটি কার মূর্তি তবে সাধারণের পক্ষে বোঝা মূশকিল। এখানে দেখুন মূর্তির বেসে একটা ছোট্ট সিংহ খোদাই করা আছে। সিংহ মহাবীরস্বামীর চিহ্ন। আমি জৈন নই। তবে এতোদিন ধরে এখানে আছি বলে এই চিহ্নর ব্যাপারটি জানতাম, তাই বলতে পারলাম। ঐ চিহ্নটা ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে গেলে বলা সম্ভব ছিল না।
আমি এক সাধারণ মনমৌজী ভ্রামণিক। আমায় মূলতঃ আকর্ষণ করে কোনো জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নির্জনতা। ঈশ্বর বিশ্বাসী না হয়েও নানা ধর্মীয় স্থানে যেতে ইচ্ছে করে নানা মানুষের আগমনে সেখানকার আবহের (vibe) টানে। তাই বৈষ্ণো দেবী, তিরুপতি, কাশী বিশ্বনাথ করিডর, উজ্জয়িনীতে মহাকাল করিডরে গিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি পর্যটকদের মতো - কিন্তু দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে বিগ্ৰহ দর্শনে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হয়নি। এছাড়া আমায় আকর্ষণ করে পুরাতাত্ত্বিক স্থান। তবে ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা, ইতিহাস, পূরাণ, প্রত্নতত্ত্ব এসব বিষয়ে আমার জ্ঞানের পরিধি খুবই সীমিত। আমার ভালোলাগার আবেশ চাক্ষিক। ভ্রমণকালে কিছু স্থানীয় আকর্ষণীয় মানুষের সাথে আলাপচারিতা বোনাস। কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে জায়গাটি সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নিই মাত্র। কিন্তু তা নিয়ে বিশেষ পড়াশোনা করা বৌদ্ধিক পর্যটক আমি নই। তাই আমার ভ্রমণবৃত্তান্তে স্থানমাহাত্ম্য, ইতিহাস সম্পর্কে তথ্যসমৃদ্ধ বর্ণনা পাওয়া যাবে না। তা কেবল এক ব্যক্তির ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। তবে জায়গাটি সম্পর্কে কিছু পরিচিতি থাকে। আগ্ৰহী পাঠক চাইলে বিশদ তথ্য নেটসমূদ্রে আহরণ করতে পারেন।
দেবগড় পাহাড়ে ASI গুদামের সেই চৌকিদার। ভ্রমণ পথে এমন বহু সাধারণ মানুষ আমায় নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন
এতোদিন ধরে বেশ কিছু জৈনতীর্থে গেছি কিন্তু দেবগড়ে ASI গুদামের সেই চৌকিদারটির কথায় আমার অনেকদিনের ধাঁধা কেটে গেল। এবার কোনো জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তির বেসে চিহ্নটি দেখলে তার ভিত্তিতে বুঝতে পারবো মূর্তিটি কার। তাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে ওখানেই বসে নেটে একটু সার্চ করতে পেয়ে গেলাম চব্বিশজন তীর্থঙ্করের চিহ্নের তালিকা। আবার ফিরে গেলাম মন্দির কমপ্লেক্সে। সেখানে এক জায়গায় চব্বিশজন তীর্থঙ্করের মূর্তি রাখা আছে। এবার প্রতিটি মূর্তির ওপরে লেখা নাম ও মূর্তির বেসে চিহ্ন মিলিয়ে দেখলাম - দিব্যি মিলে যাচ্ছে।
যেমন অজিতনাথজীর চিহ্ন হাতি বা মহাবীরস্বামীর মূর্তির বেসে রয়েছে সিংহ ঐ চিহ্নের ফর্মূলা ধরে - নাম লেখা না থাকলেও - বোঝা গেল মূর্তির বেসে গণ্ডার আছে মানে এটি শ্রেয়াংসনাথজীর মূর্তি বা ঘোড়ার চিহ্ন আছে মানে এটি সম্ভাবনাথজীর মূর্তি অথবা বৃষ চিহ্ন আছে মানে এটি প্রথম তীর্থঙ্কর আদিনাথজী বা ঋষভনাথজী যাঁকে জৈন ধর্মাবলম্বীরা বড়েবাবাও বলে থাকেন ওখানে পূজারীজীকে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা তীর্থঙ্করদের চিহ্নের তালিকায় দেখছি শুকরও রয়েছে। সচরাচর আমরা গরু, লক্ষ্মী প্যাঁচা ইত্যাদি পবিত্র প্রাণী হিসেবে ভেবে থাকি এবং শুকরকে একটি অপরিস্কার নিম্ন গোত্রের প্রাণী হিসেবে দেখে থাকি। তাহলে তীর্থঙ্করের চিহ্ন হিসেবে শুকর কেন রাখা হয়েছে? পূজারীজী খুব সুন্দর জবাব দিলেন। উনি বললেন, দেখুন মানুষই শিবের বাহন হিসেবে বৃষ, কার্তিকের বাহন হিসেবে ময়ুর বা সরস্বতীর বাহন হিসেবে রাজহংস ইত্যাদি প্রাণীকে পবিত্র এবং কাক, শকুন, শুকর, কুকুর ইত্যাদি প্রাণীদের নিম্ন গোত্রের বা অপবিত্র ভেবেছে। মানুষ তার স্বজাতির মধ্যেও দলিত, হরিজন, শূদ্র, কায়স্থ, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ এহেন বর্ণাশ্রম প্রথার প্রচলন করেছে। কিন্তু প্রকৃতির কাছে তো সব প্রাণীই সমান। তাই তো হিন্দু ধর্মে বিষ্ণুর দশাবতার রূপের মধ্যে মৎস, কূর্ম, বরাহও রয়েছে। জৈন বিশ্বাসেও তাই শুকর অপবিত্র প্রাণী নয়।
দেবগড় অতীতে গুপ্ত, প্রতিহার, চান্দেলা, গোণ্ড রাজত্বের সাক্ষী। সব পূরাকীর্তির সময়কাল জানা যায়নি। দেবগড়ের উল্লেখযোগ্য পূরাকীর্তি পাহাড়ের নীচে ৫০০ খ্রীষ্টাব্দের গুপ্তকালীন দশাবতার মন্দির। হিন্দু মন্দির স্থাপত্যকলায় প্রচলিত ‘নাগর’ শৈলীতে নির্মিত মন্দিরে অর্ধমন্ডপ, মন্ডপ, মহামন্ডপ, অন্তরাল পেরিয়ে তবে গর্ভগৃহে বিগ্ৰহ দর্শন করতে হয়। গর্ভগৃহের উপর উচ্চ শিখর, তার ওপর ছাতার মতো অমালক, তারপর খাপুরি ও শিরে কলস। দূরত্বের ব্যবধান সত্ত্বেও পূরীর জগন্নাথদেব ও গুজরাটের দ্বারকাধীশ মন্দিরে এই শৈলী সুস্পষ্ট। পঞ্চায়তন শৈলীতে মূল মন্দিরের চার কোনে চারটি ছোট মন্দির থাকতো। খাজুরাহোর কান্ডারিয়া মহাদেব মন্দির নাগর ও পঞ্চায়তন শৈলীর সংমিশ্রণের নিদর্শন। দেবগড়ের দশাবতার মন্দির উত্তর মধ্য ভারতের প্রাচীনতম পঞ্চায়তন শৈলীর টিকে থাকা নিদর্শন। এখানে মূল মন্দিরের শিখরের সামান্য অবশেষ ছাড়া নাগর শৈলীর বাকি লক্ষণ লুপ্ত। তবে চারপাশে চারটি ছোট মন্দিরবেদী দৃশ্যমান।
নীচে এসে দেখি মালখান বসে আছে চায়ের দোকানে। লজ বন্ধ, তাই হয়তো ওখানেই অধিকাংশ সময় কাটায়। দোকানে বসে দুজনের জন্য চায়ের অর্ডার দিই। মালখান বলেন, কেমন ঘুরলেন? বলি, খুব সুন্দর। ও বলে, চলুন তাহলে, চা খেয়ে আপনাকে দশাবতার মন্দির দেখিয়ে আনি। ইউ পি ট্যূরিস্ট রেস্ট হাউসের উল্টোদিকে অনেকটা জায়গা নিয়ে দশাবতার মন্দির পরিসর। চারদিকে চারটি সিঁড়ি দিয়ে বেদীতে উঠে পশ্চিম দিকের উন্মুক্ত প্রবেশদ্বার দিয়ে সরাসরি গর্ভগৃহে প্রবেশ করা যায়। তবে গর্ভগৃহে এখন কোনো বিগ্ৰহ নেই। মন্দিরের তিন দিকে বহিরঙ্গে রয়েছে বাস রিলিফের কাজ। উত্তরে গজেন্দ্রমোক্ষ, পূবে নর-নারায়ন ও দক্ষিণে শেষনাগ বা অনন্তনাগের পাকানো দেহশয্যায়, সপ্তফনার ছত্রছায়ায় এলায়িত ভঙ্গিতে শায়িত বিষ্ণু। এই বিভঙ্গ শেষাশায়ী বিষ্ণু, অনন্তশায়ী বিষ্ণু বা Reclining Vishnu হিসেবে সুপরিচিত। বিষ্ণুর মুকুটে পাথরের কাজের সুক্ষতা বিষ্ময়কর। যেন দারুশিল্প।
পশ্চিমে বেদীতে ওঠার সিঁড়ির পাশে মালখান দেখায় - নন্দপত্নী যশোদা কৃষ্ণকে কোলে তুলে তাঁর সদ্যোজাত কন্যা যোগমায়াকে বসুদেবের হাতে তুলে দিয়েছেন। তিনি জানেন কংসের কারাগারে নিয়ে গেলেই তাকে দেবকী - বসুদেবের সন্তান ভেবে হত্যা করবেন কংস। যদিও কংস তাকে শেষবেশ বধ করতে পারবেন না। যোগবলে ফুরৎ করে আকাশে উড়ে গিয়ে যোগমায়া কংসকে শোনাবেন সেই বহুশ্রুত আকাশবাণী - তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে। তবে তখন তো নন্দপত্নী তা জানেন না। তাই সেই বিষাদ তাঁর মুখে সুস্পষ্ট। যেন পাথরের ক্যানভাসে ছেনি হাতুড়িতে আঁকা ছবি! তবে মালখান খুঁটিয়ে না দেখালে এসব আমার অজানাই রয়ে যেতো।
রাতে ধর্মশালায় সেই কর্মীর ঘরে খেতে যাই। গৃহিণী বারান্দায় আসন পেতে দেন। তাঁর ননদ উঠোনে কাঠের আঁচে রুটি সেঁকছেন। ঘরোয়া রান্না। একটি কিশোরী পড়া ছেড়ে উঠে এসে আমলকীর আচার দিয়ে যায়। বলি, যদি বড় দল আসে, তাদেরও খাওয়াতে পারবেন? গৃহিণী বলেন, তিরিশ জনের বাসপার্টিকেও আমরা এক ঘন্টার নোটিশে খাইয়েছি। বুঝি ওনার স্বামীর ধর্মশালার চাকরিতে মাইনে কম। তাই এমন সুযোগে বাড়ির সবাই মিলে লেগে পড়ে কিছু অতিরিক্ত উপার্জনের আশায়। যেমন ম্যানেজার চালান মুদী দোকান। গৃহিণী থেকে থেকে বলেন - 'ভাইসাব, আর একটু সবজি দিই? আর একটা রুটি নেবেন না?' এসব শুনে অর্থের বিনিময়ে আহারেও যেন মেলে আত্মীয়তার স্বাদ। রেস্টুরেন্টে এসব অমিল।
আমার সাথে আর একজন অতিথি নৈশাহার করলেন। আলাপ হোলো বছর পঞ্চান্নর রমেশ শর্মার সাথে। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি করেন রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা TCIL (Telecommunications Consultants India Ltd). পোস্টিং হায়দ্রাবাদ। পরিবার আছে গোয়ালিয়রে। সংস্থার কাজকর্ম কমে এসেছে। অনেককে এখানে ওখানে ডেপুটেশনে পাঠিয়ে দিয়েছে। কয়েকজনকে VRS ধরিয়েছে। স্বচ্ছ ভারত মিশনের আওতায় ভারতীয় পূরাতত্ব বিভাগের কিছু পুরাতাত্ত্বিক সাইটে শৌচাগার নির্মাণ চলছে। পরে ২০১৯এর মে মাসে উত্তরাখণ্ড ভ্রমণে গোপেশ্বরে গোপীনাথ মহাদেব মন্দিরেও দেখেছিলাম শৌচাগার, RO Water Plant তৈরী হচ্ছে। দেবগড় পর্যটকবিরল জায়গা হলেও দশাবতার মন্দির ও পাহাড়ের ওপর প্রাচীন জৈন মন্দিরের বেশ মান্যতা আছে। জৈন সমাজের উৎসবের সময় বহু মানুষ আসেন। তাই এখানেও চলছে শৌচাগার নির্মাণের কাজ। রমেশবাবু এখানে তিনমাসের ডেপুটেশনে এসেছেন সেই কাজ পরিদর্শনে। চাকরি বাঁচাতে মানুষকে কত কী করতে হয়, শৌচাগার নির্মাণ পরিদর্শন সে তুলনায় এমন কিছু নয়।
পরদিন সকালে ললিতপুর যাওয়ার সরকারি বাস বাতিল। বাইরে দুটো অটো দাঁড়িয়ে। ছাড়ার কোনো ঠিকানা নেই। অন্ততঃ ছজন যাত্রী হলে তবেই যাবে। জীবন মনে হয় এখানে ঘড়ির তালে চলে না। শক্তির কাব্যে মেঘ আকাশে অলস গাভীর মতো চরে। এখানে সময়েরও মনে হয় সেই দশা। তাড়া থাকলে দেড়শো টাকায় ট্যাক্সি রিজার্ভ করে যাও। আমার কাছাখোলা একাকী ভ্রমণে টাইম, শিডিউল মানার অতো তাড়না নেই। প্রথম অটোতে বড় স্যাক রেখে, চালককে ফোন-নম্বর দিয়ে চললুম শীতের সকালে বেতয়ার তীরে। ছাড়ার সময় হলে ডাকবে আমায়।
গতকাল বেতয়াকে দেখেছি পাহাড়ের ওপর থেকে। এখন দেখবো কাছে গিয়ে। মোড় ঘুরতেই দেখি একটা মামূলী ঘরের সামনে গোবর নিকানো উঠোনে দাঁড়িয়ে রামুর ঝকঝকে ট্যাক্সি UP-94T-6573। রামু আমায় দেখে অবাক হয়ে বলে, আপনি এদিকে? বলি, আজ সাতটার সরকারি বাস বাতিল। শেয়ার ট্যাক্সি কখন ছাড়বে ঠিক নেই। তাই যাচ্ছি একটু বেতয়ার পারে হাওয়া খেতে। রামু বলে, একটু দাঁড়ান, আমি আপনাকে জাখলোন ছেড়ে দেবো। অটোর সামনে জোড়হস্তে চোখ বুঁজে দাঁড়ায় রামু। নীরবে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে ওর বাহনের সামনে কয়েকবার ধূপকাঠি ঘুরিয়ে নমস্কার করে হ্যান্ডেলের সামনে ধূপকাঠিটা গুঁজে দেয়। ওটাই হয়তো ওর পুজো বা অন্নদাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন! রামুর অটোপূজো দেখে মনে পড়ে 'অযান্ত্রিক'-এ কালী ব্যানার্জীর অভিনয়। বিমলও জগদ্দলের সাথে কথা বলতো বন্ধুর মতো। রেডিয়টরে জল ঢাললে জগদ্দল মানুষের মতোই ঢকঢক আওয়াজ করে জল খেতো। তবে জগদ্দল ছিল ১৯২০ মডেলের এক ঢ্যাকারাম শেভ্রোলে। রামুর পিয়াজ্জিও নতুন ঝকঝকে তন্বী।
রামু বলে, চলুন। বলি, ট্যাক্সিতে সীট রাখলাম যে? ও বলে, ধুস, ওরা নটার আগে নড়বে না। বলি, রিজার্ভে কত লাগবে? রামু ওর ঠেট দেশোয়ালী বুলিতে বলে, কছু রিজাভ সিজাভ নেহি বাবুজী, আপ এক হি সওয়ারিকা কিরায়া দেনা। রাস্তেমে কোই মিল যায়ে তো মেরা নসীব। আমি হতবাক। যে রামু পরশু বড় স্যাকের জন্য পাঁচ টাকা 'এসট্রা' চায় সে আজ কুড়ি টাকায় 'ট্যাক্সি' ছোটাবে শুধু আমার জন্য! তেলের খরচও তো উঠবে না! পরশু সামান্য আলাপ হয়েছে ওর সাথে, একটা ছবি তুলেছি ওর, ব্যস, এটুকুই। এই যে আজ চলে যাবো, আর হয়তো কখোনো আসবো না এখানে, সেটা হয়তো রামুও বোঝে। তবু রামুর মতো নিম্নবিত্ত মানুষ হৃদয়ের এমন ঔদার্য দেখায় কীভাবে!
একটু যেতে দেখি শিশুপাল যাচ্ছে হেঁটে। রামু গতি কমায়। শিশু লাফিয়ে চড়ে অটোয়। বাস না আসায় সেও বারো কিমি হেঁটে জাখলোন গিয়ে 'ফাস টিপের' স্টিয়ারিং ধরবে। বলি, এতোটা পথ হেঁটে যাবে? শিশু নির্বিকারচিত্তে বলে - এ্যায়সা তো মাহিনে মে পাঁচ ছে বার হোতাই হ্যায়। শিশু জানে না যে '
এমনটা তো হয়েই থাকে' - এই মহাজন মুখনিঃসৃত ঐতিহাসিক সংলাপটি বাংলায় আইকনিক হয়ে রয়ে গেছে। আমি ভোপাল যাবো শুনে ও রামুকে বলে, তু বাবুজীকো 'টেশন' লেকে যা। অমৃতসর মুম্বাই হামেশা লেট আতি হ্যায়। শায়দ মিল যায়েগি। তব বাবুজিকো ললিতপুর যানে কা জরুরত নেহি পড়েগা। রামু শিশুর শলায় সায় দিয়ে ওর ধাতব ধন্নুর কান মুচড়োয়। আসার দিন অতো মালের ভারে বেচারি ছিল গজগামিনী। এখন ঝকঝকে সকালে তকতকে রাস্তায় চঞ্চলা হরিণীর মতো ছোটে সে। এক পরদেশীর কাছে মনিবের মান রাখতে হবে যে!
বাসস্ট্যান্ড থেকে স্টেশন আরো দু কিমি। মোড় ঘুরতে এক স্থানীয় মহিলা হাত দেখিয়ে ওঠেন। স্টেশন আসতে পাঁচ টাকা দিয়ে নেমে যান। এটুকুই জুটলো রামুর নসীবে। শিশুর থেকে রামু পয়সা নেয়নি। ভাই বেরাদারির ব্যাপার। আমি দৌড়ে যাই টিকিট কাউন্টারে। রামু দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেন চলে গেলে ও আবার আমায় ফেরত নিয়ে যাবে বাসস্ট্যান্ডে। ঠিকই বলেছে শিশু। ট্রেন লেট আছে। মিনিট দশেকের মধ্যে আসবে। টিকিট কেটে এসে রামুর হাতে দেড়শো টাকাই দিই। ও চায়নি। কিন্তু এটাই ওর উদারতার নায্য প্রতিদান। গ্ৰাম্য রামুর সরল মুখে খেলে যায় বিষ্ময়াবিষ্ট খুশির পরশ। তবে দেবগড়ে ওর দেওয়া প্রস্তাবে আমার বিষ্ময়ের নাগাল রামু পায়নি। শহুরে মুখের মলাটের আড়ালে থাকা মনোভাবের নাগাল পাওয়া গেঁয়ো রামুর কম্ম নয়। আমি এগোই। স্টেশনে ঢোকার আগে একবার পিছন ফিরে তাকাই। রামু দাঁড়িয়ে তখনও হাত নাড়ছে। মনের ফ্রেমে বন্দী হয়ে যায় এক দেবদূতসম মানুষের ছবি।
চিত্রাবলী:- (ছবিগুলি মোবাইলে তোলা। তাও ফাইল সাইজ কম রাখতে মূল ছবির বদলে স্ক্রিনশট নিয়ে এখানে রেখেছি)
সুন্দর জাখলোন - দেবগড় পথের একজায়গায় দুজন নামলো। আমার বড় স্যাক ছাতে। ডাইনে রড থেকে ঝুলছে ন্যাপস্যাক অবশেষে এসে গেলাম ধর্মশালায়। চালক রামুর একটা ছবি নিলাম। ঐ সীটে এসেছি রামু সহ চারজন মনোরম জৈন মন্দির সংলগ্ন ধরমশালা ধর্মশালার অবস্থানটি ভারি চমৎকার। কয়েকদিন আলস্যময় ছন্দে কাটানোর জন্য অনবদ্য। ঐ মেন গেট থেকে পথ চলে গেছে দেবগড় পাহাড়ে আমার মতো লো বাজেট সোলো ব্যাকপ্যাকার ভ্রামণিকের জন্য ম্যানেজার সাহেবের বদান্যতায় এই সুন্দর দ্বিশয্যার ঘরে দুরাত থাকলাম - মাত্র দুশো টাকায় ! দোতলার ঘরের জানলা খুলে দেখতে পেয়েছিলাম এই আদিগন্ত সবুজ। ঐ সরু পথ ধরে ছুটে আসছিল লাল ফ্রক পরা বালিকাটি। প্রথাগত পর্যটকদের জন্য UPT’র রাহী ট্যূরিস্ট লজ দেবগড় কেল্লার এমন কিছু আংশিক প্রাচীরই কেবল বর্তমানে টিকে আছে পর্যটকহীন এমন নির্জন বনপথে পরিক্রমার আনন্দ অনন্য - বাঁদিকে বয়ে চলেছে বেতয়া পরিক্রমা পথের প্রথমে এলো বারাহি মন্দির সেখানে দেখলুম এমন শঙ্খ লাগা সর্পযুগল - এর বৈশিষ্ট্য জানি না - কেউ আলোকপাত করলে জানবো নামলাম সিঁড়ি দিয়ে বেতয়ার পাশে সিদ্ধগুফায় - এখানে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম সিঁড়ির পাশে দেখলাম একটি সুন্দর ‘ভুতিয়া পেড়’ বা Ghost Tree (Sterculia urens) সিদ্ধগুফা - এখানে অতীতে নির্জনে তপস্যা করতেন সাধকজন ফাগুনের শেষে বেতয়ার বুকে জেগেছে বড় চর - চলছে সাময়িক চাষাবাদ ওয়াচ টাওয়ারটি হাতছানি দেয় - তেতলায় গিয়ে প্লাস্টিক পেতে খানিক গড়িয়ে নিই পরিক্রমা পথের শেষে আসে বেশ বড় দেবগড় জৈন মন্দির পরিসর - পার্শ্বনাথ ভগবান মন্দিরটি আকারে সবথেকে বড় - আছেও বেশ ভালো অবস্থায় মন্দির পরিসরের মাঝে মানস্তম্ভ পার্শ্বনাথ ভগবান মন্দিরে পাথরের ভব্য কারুকাজ পার্শ্বনাথ মন্দিরের শিখরটিও বেশ ঝকমকে পাহাড়তলে দশাবতার মন্দির মন্দিরগাত্রে অনন্তশায়ী বিষ্ণুর বাস রিলিফ মুকুট, হার, মালায় পাথরের বিষ্ময়কর সুক্ষ্ম কাজপরদিন ললিতপুরের সরকারি বাস বাতিল। তবু সকালের নরম আলোয় স্নাত চরাচরের মনোরম দৃশ্যে মন ভালো হয়ে যায়। ‘ঐ আঁকাবাঁকা যে পথ যায় সুদুরে’ - ট্যাক্সিতে বড় স্যাকটা রেখে, ভাবলুম বেতয়ার কাছ থেকে একটু ঘুরে আসি কিন্তু একটু যেতেই দেখা রামুর সাথে শিশুর পরামর্শে, রামুর সৌজন্যে জাখলোন থেকেই পেয়ে গেলাম লেট করে আসা অমৃতসর মুম্বাই এক্সপ্রেস - তাই যেতে হোলো না ললিতপুর। তাই এক রাত অহেতুক থাকতেও হোলো না আগে ঘোরা ভোপাল। ফলে বিকেল চারটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম পরবর্তী গন্তব্যে - সেও এক ভারি সুন্দর জায়গা - আসবে সে প্রসঙ্গ পরে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।