“Such is the way of all superstitions, whether in astrology, dreams, omens, divine judgments, or the like; wherein men, having a delight in such vanities, mark the events where they are fulfilled, but where they fail, though this happens much oftener, neglect and pass them by.”
– Francis Bacon (Novum Organum)
“For is ‘doublethink’ not the natural state of mind/s of most of us who live in today’s confusing and contradictory world? In the metropolis, we are exposed to an ever-increasing variety of systems of knowledge and belief brought to our doors, or more likely to our computers, by the forces of globalisation and capitalist marketing: we move between them,…”
– Alison Gwendy Bird (Astrology in Education: An Ethnography)
একখানা সাত-বাসি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। রাজা যাবেন যুদ্ধে। রণসজ্জা প্রস্তুত। কিন্তু বাদ সেধেছেন রাজজ্যোতিষী। রণক্ষেত্রে রাজার সাক্ষাৎ মৃত্যুযোগ নাকি দেখতে পাচ্ছেন তিনি! রাজজ্যোতিষীর গণনাকে রাজা অব্যর্থ বলে ভাবেন। সব কাজেই নেন তাঁর পরামর্শ। এবারেও তাঁর সাবধানবাণী ফেলতে পারছেন না। এদিকে সেনাপতি রেগে কাঁই। সৈন্যসামন্ত, অস্ত্রশস্ত্র, রণকৌশল – সব কিছুতেই প্রতিপক্ষের চেয়ে কয়েক গুণ এগিয়ে থেকেও এভাবে রণে ভঙ্গ দিতে তাঁর বেজায় আপত্তি। রাজজ্যোতিষীর ডাক পড়ল রাজসভায়। আবারও রাজার মৃত্যুযোগ ঘোষণা করে সর্বসমক্ষে তিনি সগর্বে জানান যে, তাঁর গণনা কখনও ভুল হয় না। “বটে!”, সেনাপতি শুধোন, “তা আপনার নিজের মৃত্যু বিষয়ে কোষ্ঠীতে কিছু লেখেনি?” রাজজ্যোতিষী ঝটপট উত্তর দেন, “লিখেছে বই-কি, সেনাপতি! গণনা করে দেখেছি যে, বাঁচব আরও বহু বছর। থুত্থুড়ে বুড়ো হয়েই মরব আমি।” সেনাপতি মৃদু হেসে বলেন, “না গো মাননীয় মহাশয়, আপনি আর এক মুহূর্তও বাঁচবেন না”, এবং কথাটা শেষ হওয়ার আগেই চকিতে কোমরে গোঁজা তরোয়ালটা খাপ থেকে বের করেই রাজজ্যোতিষীর কাঁধ লক্ষ্য করে চালিয়ে দেন নিখুঁত নিশানায়। ঘচাং করে ধড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা হয়ে যায়..
গল্পটা সেকেলে হলেও এর নৈতিক উপদেশটুকুর প্রয়োজন এখনও ফুরোয়নি, অন্তত সাম্প্রতিক কিছু সমীক্ষার খবর তেমনই ভাবাচ্ছে। গোড়াতেই সেগুলো একটু দেখে নিলে মন্দ হয় না। ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে জ্যোতিষ-বাণিজ্যের মোট বহরটা ছিল প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মাপে এবং তা বার্ষিক প্রায় ৬ শতাংশ হারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। জন্মছক দেখে ভাগ্যগণনা ছাড়াও এই সওদার মধ্যে আছে নিউমেরোলজি, পামিস্ট্রি, ট্যারট কার্ড গণনা, বাস্তুশাস্ত্র ইত্যাদির পরামর্শ-খরচ এবং মহার্ঘ গ্রহরত্নের বিক্রিবাটার হিসেব। জ্যোতিষশাস্ত্রের এই বিপুল বাজারে প্রতি বছর যুক্ত হচ্ছেন গড়ে লাখখানেক করে নতুন জ্যোতিষী [Allied Market Research 2023]। ২০১৮ সালের এক সমীক্ষায় বিশ্বখ্যাত পিউ ফোরাম জানিয়েছিল যে, মার্কিন মুলুকে প্রায় ২৯ শতাংশ মানুষ জ্যোতিষে ঘোর বিশ্বাসী [Gecewicz 2018]। ব্রিটেনে এই বিশ্বাস কিছুটা কম (১৯%) হলেও ইউরোপের অনেক দেশেই জ্যোতিষে আস্থাশীল মানুষের শতকরা হিসেব মার্কিনীদের মতোই, কোথাও কোথাও তার চেয়েও বেশি। যেমন, স্পেন, পর্তুগাল, বেলজিয়ামে তা ৩০ শতাংশের ওপরে। ইউরোপের অনেক দেশেই প্রতি তিনজনের একজন মানুষ ভাগ্যে বিশ্বাস করেন [PEW Research Center 2018: 135]। ভারতের চিত্র অবশ্য আরও ভয়াবহ। ২০২১ সালের পিউ-সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে, এদেশে ভাগ্যবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা ৭০ শতাংশ এবং জ্যোতিষে বিশ্বাস করেন শতকরা ৪৪ জন ভারতীয় [Sahgal et al 2021: 206]। আরও একটি পরিসংখ্যান তাৎপর্যপূর্ণ যে, কোভিড অতিমারির পর থেকে জ্যোতিষে বিশ্বাস ও জ্যোতিষ ব্যবসার পালে যেন একটা ধাক্কা লেগেছে, ধাক্কাটা এসেছে প্রধানত জ্যোতিষের অনলাইন বাজারের হাত ধরে। কাজেই, বিষয়টিকে নিয়ে একটু চর্চা করার দরকার আছে।
‘জ্যোতিষশাস্ত্র’ (astrology) শব্দটার গায়ে বেশ-একটা জ্যোতির্বিজ্ঞানের (astronomy) গন্ধ মাখানো আছে! অনেকেই দুটোকে এক বলে ভাবেন। এ হেন ভ্রান্তিকে গোড়াতেই শুধরে নেওয়া দরকার। তবে কেবল এটুকু হলেই হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও যখন বিষয়টিকে চর্চার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে, তখন বিজ্ঞান না-হোক, যে কোনও প্রকারের জ্ঞানচর্চার দিক থেকেও এর আদৌ কোনও মূল্য আছে কিনা, খতিয়ে দেখা দরকার তা-ও। এরই সঙ্গে, ফলিত জ্যোতিষ আদৌ ফলে কিনা, তার উত্তরও আমাদের পেতে হবে। আধুনিক মানবসমাজে এর টিঁকে থাকার গলিঘুঁজিটা খুঁজব সবার শেষে।
সাত দুগুণে চোদ্দ, বয়স ছাব্বিশ ইঞ্চি: জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্রের সম্পর্ক বিষয়ে
আকাশে জ্যোতিষ্কদের অবস্থান ও গতিবিধি নজর করে জ্যোতিষশাস্ত্র ভবিষ্যদ্বাণী করে। হাজার চারেক বছর আগে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল আকাশের দিকে তাকিয়ে শুভ-অশুভ লক্ষণ খোঁজার মধ্য দিয়ে। কতকটা খনার বচনের মতো করে সেগুলো বলা হত। ব্যক্তিগত ভাগ্যের ধারণা সেখানে ততটা ছিল না। জন্মছক দেখে ব্যক্তিগত ভাগ্যগণনার সূত্রপাত ঘটে অনেক পরে, খ্রি. পূ. চতুর্থ শতকের গ্রিসে। আকাশের প্রতি মানুষের টান কতকটা স্বাভাবিক। কেবল তারকাখচিত আকাশের সৌন্দর্যই নয়; দিন-রাত, ঋতু পরিবর্তন, জোয়ারভাটা ইত্যাদির পর্যাবৃত্তির সঙ্গে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রদের চলাফেরার সম্পর্ক খুব সহজেই নজরে আসে। মিশরীয়রা খেয়াল করেছিল যে, ভোরবেলা পুবের আকাশে সূর্যের প্রভায় অদৃশ্যমান হওয়ার আগে রাতের আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র লুব্ধকের (Sirius) প্রথম উদয় ঘটার দিন কয়েকের মধ্যেই নীলনদে কুখ্যাত বন্যার সূত্রপাত হয়। এটা তাদের বীজ বপনের সময়। বস্তুত, ফসল ফলাতে হলে, শিকারে সাফল্য পেতে চাইলে কিংবা পশুপালনের জন্য ন্যূনতম জ্ঞান হিসেবে তাদের প্রজনন সময়ের হদিশ পাওয়ার জন্য ক্যালেন্ডার চাই। আর আকাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকলে ক্যালেন্ডার বানানো কোনওদিনই সম্ভব হত না। এর জন্য দরকার সূর্য ও চন্দ্রের উদয় ও অস্ত নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা। চন্দ্র-সূর্যই আকাশের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক এবং সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য জ্যোতিষ্কদের তুলনায় এদের অবস্থান পরিবর্তনও দ্রুততর। এদের গতিপথ মোটামুটি এক এবং বিভিন্ন নক্ষত্রের প্রেক্ষাপটে এই দুটি জ্যোতিষ্কের চলন সহজেই মানুষের আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল। এই গতিপথকে ঘিরে একটা ১৬-১৮ ডিগ্রি চওড়া বলয় কল্পনা করে শুরু হয়েছিল পর্যবেক্ষণ করা। এই বলয়টাকে বলা হয় রাশিচক্র (zodiac), যা বারোটি রাশি (constellation) দিয়ে তৈরি। প্রতিটি রাশি কমবেশি তিরিশ ডিগ্রি করে জায়গা নিয়েছে। রাশি বলতে বোঝানো হয়েছে একাধিক নক্ষত্র দিয়ে গড়া এক-একটা জটলাকে, যে নক্ষত্রগুলিকে পৃথিবী থেকে দেখলে কাছাকাছি অবস্থিত ও পরস্পর-সংযুক্ত বলে মনে হয় এবং একটু কল্পনাশক্তি কাজে লাগালে যা বিশেষ বিশেষ বস্তুর অবয়বে আমাদের কাছে ধরা দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, চারটি উজ্জ্বল ও আরও কয়েকটি নক্ষত্র নিয়ে যে নক্ষত্রমণ্ডলীটি মানুষের কল্পনায় ভেড়ার অবয়ব ধারণ করেছে, রাশিচক্রে তাকে ‘মেষ (Aries)’ নামে ডাকা হয়। কিন্তু পৃথিবীকে ঘিরে থাকা গোটা আকাশটাকে যদি একটা বুদবুদের মতো করে ভাবা যায়, তাহলে রাশিচক্রের এই বলয়টুকুর বাইরেও অনেক নক্ষত্রের জটলা আছে। বর্তমানে মোট ৮৮টি নক্ষত্রমণ্ডলীর হদিশ পাওয়া গেছে। আমাদের অতিপরিচিত সপ্তর্ষিমণ্ডল যেমন এই রাশিচক্রে অবস্থিত নয়। বলে রাখা দরকার যে, জ্যোতিষের কারবার কিন্তু কেবল ওই রাশিচক্রের বারোটি রাশিকে ঘিরে।
জ্যোতিষ্কদের চলাফেরার গতি বিচার করে গ্রহ ও নক্ষত্রদের আলাদা করা হয়েছিল। যাদের অবস্থান দ্রুত বদলায়, সেইসব জ্যোতিষ্করা হল গ্রহ। বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, মঙ্গল ও শনির পাশাপাশি, তাই, চাঁদ ও সূর্যকেও গ্রহ হিসেবে ভাবা হয়েছিল। উপরন্তু, যে কোনও জড়বস্তুর মধ্যে প্রাণসত্তা আরোপের প্রচলিত পদ্ধতিটি (animism) আকাশের ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হয়। এভাবে গ্রহগুলি হয়ে ওঠে শুভ-অশুভের দ্যোতক। লাল-রঙা মঙ্গল রক্তপাত ও যুদ্ধবিগ্রহের সংকেতবাহী হয়ে ওঠে। শনিও এর অদ্ভুত বলয় থাকার জন্য অশুভ বলে বিবেচিত হয়। সূর্যের নৈকট্যের জন্য বুধকে ভালো করে দেখাই যায় না, এই রহস্যময়তার জন্য তা-ও অশুভ। বিপরীতে, বহস্পতি ও শুক্র এদের ঔজ্জ্বল্যের কারণে উপকারী গ্রহ বলে চিহ্নিত হয়। শুক্র হল রোমক প্রেমের দেবতা ভেনাস (Venus)। কিন্তু যে গ্রহের রং প্রচুর কার্বন ডাইঅক্সাইডের উপস্থিতি আর অত্যন্ত বেশি তাপমাত্রার কারণে সাদা; কাছে গেলেই টের পাওয়া যাবে যে, সেখানে প্রেমের নয় নিশ্চিতভাবেই পাতা আছে মৃত্যুর ফাঁদ! আর সূর্য-চন্দ্র তো নানা জাগতিক কারণেই উপকারী। ব্যক্তিগত ভাগ্যগণনার সূচনায় আকাশের দ্যুতিময় জ্যোতিষ্কদের ঈশ্বরের সেনানী বলে বিবেচনা করা হয়েছিল, যারা ঈশ্বরের নির্দেশ মেনে জাতকের জন্মমুহূর্তে বিশেষ বিশেষ অবস্থান পরিগ্রহ করে তার ভাগ্য নির্ধারণ করেন।
পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে গোটা রাশিচক্রটি দিনে একবার ঘুরে আসে, অবশ্য বার্ষিক গতির কারণে সূর্যের সাপেক্ষে প্রতিদিন তা ১ ডিগ্রি করে পুবদিকে সরে যায়। অর্থাৎ, যেহেতু প্রতিটি রাশির ব্যাপ্তি ৩০ ডিগ্রি, এক মাসে সূর্যের সাপেক্ষে তা মোটামুটি একই অবস্থানে থাকে। অন্যদিকে চাঁদের পূর্ণিমা-অমাবস্যার যে চক্র, তা প্রায় ২৯ দিনে সম্পূর্ণ হয়। কাজেই, প্রতিটি নতুন পূর্ণিমায় চাঁদকে পরবর্তী রাশিতে উদিত হতে দেখা যায়, এবং, এভাবে, ভারতীয় মাসের নামগুলি সংশ্লিষ্ট রাশিতে অবস্থিত কোনও নক্ষত্রের নাম দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন, বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ মাসের নামটি আহরণ করা। জ্যোতিষীয় পদ্ধতিতে ভাগ্যবিচারের মূলত দু-রকমের পদ্ধতি প্রচলিত। পাশ্চাত্যের জ্যোতিষীরা প্রধানত জাতকের জন্ম মুহূর্তে সূর্যের অবস্থান দেখে (sun sign) ভাগ্যগণনা করেন, কিন্তু প্রাচ্যে চন্দ্রের অবস্থান (moon sign) গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, আমাদের দেশে জন্মের সময় চাঁদের অবস্থান দেখে জাতকের জন্মরাশি নির্ণয় করা হয়। এবং, একই সময়ে অন্যান্য গ্রহগুলি কোন কোন রাশি ও নক্ষত্রে অবস্থান করছে, তা দিয়ে গড়ে ওঠে জাতকের জন্মছক। তারপর গ্রহগুলিতে আরোপিত শুভ-অশুভের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে ও গ্রহদের পারস্পরিক মনগড়া সম্পর্কের ভিত্তিতে জাতকের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জ্যোতিষীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেন।
খ্রি. পূ. ৩য় শতকে ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিদ ও জ্যোতিষী বেরোসাস জ্যোতিষশাস্ত্র শেখানোর জন্য এক স্কুল খুলে ফেলেন। তাঁর লেখাপত্র গ্রিসেও সমাদৃত হয়েছিল বলে জানা যায়। জ্যোতিষীদের প্রথম কয়েকটি প্রজন্ম ‘রাজজ্যোতিষী’ হিসেবে বিভিন্ন রাজসভায় উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেন। তাঁদের কাজ ছিল রাজার ভাগ্য গণনা করে যুদ্ধবিগ্রহ, রাজ্য পরিচালনা ইত্যাদি কাজে মন্ত্রণা দান। গ্রিসের হাত ধরে প্রাচীন ভারতে যখন জ্যোতিষের আমদানি ঘটল, তখনও জ্যোতিষীদের প্রতি রাজানুগ্রহের কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি। ওই সময়ের সবচেয়ে চর্চিত জ্যোতিষী বরাহমিহির নবরত্নের অন্যতম হিসেবে উজ্জয়িনীর রাজসভায় জায়গা পেয়েছেন। লক্ষণীয় যে, এভাবে ধীরে ধীরে আকাশ-চর্চাকারীদের একটা অংশ জ্যোতিষ্কদের চলাচলের নিয়ম খোঁজার কষ্টসাধ্য রাস্তা থেকে সরে গিয়ে জ্যোতিষ্কদের দ্বারা ব্যক্তিগত ভাগ্য নির্ধারণের রহস্যজনক ব্যাপারস্যাপার চর্চায় মেতে ওঠেন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার বিজ্ঞানসম্মত ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তবে বিজ্ঞান ও অবিজ্ঞানের বিযুক্তিকরণের এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে সময় লেগেছিল। চতুর্দশ শতকের গোড়ায় দান্তে রচিত লা দিভিনা কোম্মেদিয়া-য় চিত্রিত ব্রহ্মাণ্ড পরিকল্পনার দিকে তাকালে দেখব যে, স্থাণু পৃথিবীকে ঘিরে থাকা দশটি গোলকে গোটা ব্রহ্মাণ্ড বিভক্ত। প্রথম আটটি গোলকে যথাক্রমে চাঁদ, বুধ, শুক্র, সূর্য, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি ও ধ্রুবতারা ইত্যাদি নক্ষত্র অবস্থিত। নবম গোলকটি থেকে এদের গতি উৎসারিত হয়। আর দশম গোলকটিতে স্বয়ং দেবতাদের অধিষ্ঠান, যারা পরী, দেবদূত ইত্যাদির সাহায্যে জ্যোতিষ্কদের গতিশীল রাখেন। পৃথিবীকে ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে বসিয়েই আকাশ সংক্রান্ত গবেষণার সূত্রপাত হয়েছিল। অবোধ্য বিষয়গুলিকে ব্যাখ্যা করার জন্য অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কল্পনা করতে হয়েছিল। আবার, ওই ভূ-কেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বই ছিল জ্যোতিষের তাত্ত্বিক আধার। যখন থেকে অবোধ্য বিষয়গুলি ধীরে ধীরে বোধগম্য হয়ে উঠতে থাকল, ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র থেকে পৃথিবীকে সরে যেতে হল। কিন্তু জ্যোতিষের পক্ষে এই নতুন বিশ্বতত্ত্ব গ্রহণ করা সম্ভব হল না। কারণ, মানুষ ও তার বাসস্থানকে ঘিরে ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত না হলে, জ্যোতিষের তাৎপর্যটাই মূল্যহীন হয়ে যায়। কাজেই, বিজ্ঞানসম্মত জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে জ্যোতিষের ফাটল ধরল, এবং এই ফাটল ক্রমশ চওড়া হয়ে দুয়ের মধ্যে এক অলঙ্ঘনীয দূরত্ব গড়ে দিল। আজকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের আধুনিক চর্চাকারীদের মধ্যে কোনও জ্যোতিষীকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু প্রাচীন বিজ্ঞানে এরকম দৃষ্টান্তের অভাব নেই। বস্তুত, নিউটনের পূর্ববর্তী প্রায় সমস্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীই গ্রহ-নক্ষত্রের চলনের বিজ্ঞানসম্মত কারণ অন্বেষণের পাশাপাশি জ্যোতিষের চর্চাও করেছেন। টাইকো ব্রাহে, কেপলার, গ্যালিলিও সকলেই এই দলে পড়েন। সম্ভবত, এ ব্যাপারে কোপারনিকাস খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি।
মুশকিলটা হচ্ছে এই যে, গ্রিকরা মানব সভ্যতার যে পর্বে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাদের দেবতাকে দেখতে পেত, জ্যোতির্বিজ্ঞান সে পর্বকে অনেক কাল আগেই পেছনে ফেলে এসেছে। কিন্তু জ্যোতিষশাস্ত্র নিজেকে পালটায়নি একটুকুও। পৃথিবীর অয়নচলনের (precession) দিক থেকে এর সবচেয়ে জুতসই উদাহরণ দেওয়া যায়। পৃথিবী কেবল তার অক্ষকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে না, তার ওই ঘূর্ণন অক্ষটাও ঘুরন্ত লাট্টুর ঘূর্ণন অক্ষের মতো কাঁপতে কাঁপতে ঘুরে চলেছে। একেই বলে অয়নচলন। গ্রিক যুগেই কিন্তু হিপার্কাস এটি বুঝতে পেরেছিলেন। অয়নচলনের ফলে রাশিচক্রে বিভিন্ন রাশিতে সূর্যের উদয়ের জন্য যে সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা দু-হাজার বছর আগে ঠিক থাকলেও এখন আর একেবারেই মিলবে না। যেমন, ২১ মার্চ থেকে ১৯ এপ্রিল তারিখের মধ্যে মেষ (Aries) রাশিতে সূর্যের উদয় ঘটার কথা। পৃথিবীর অয়নচলনের জন্য বর্তমানে পরিবর্তন এতখানি ঘটেছে যে, উপরিউক্ত সময়কালের অধিকাংশ সময়েই সূর্যের উদয় ঘটছে মীন (Pieces) রাশিতে! কিন্তু জন্ম তারিখ ধরে জন্মছক বানানোর সময় জ্যোতিষীরা এখনও সময়কাল-রাশির পুরোনো তালিকা মেনে কাজ করে চলেছেন। খালি চোখে দেখা যায় না, পরে আবিষ্কৃত এরকম দুটি গ্রহ ইউরেনাস ও নেপচুনকেও তাঁরা এখনও গ্রহের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে উঠতে পারেননি। আবিষ্কারের আগে এই গ্রহ দুটির অস্তিত্ব নিয়েও তাঁরা কোনও ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেননি। রাশিচক্রেও খানিকটা অদলবদল হয়েছে। ‘অফিউকাস’, বাংলায় যার অর্থ সর্প-বাহক, নামক অন্তত আরও একটি রাশিকে সেখানে (বৃশ্চিক ও ধনু রাশির মাঝখানে) অন্তর্ভুক্ত না করে উপায় নেই। তবে এইসব নতুন নতুন তথ্যকে অন্তর্ভুক্ত করলেও সমস্যা কিছু কমবে না। যদিও আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের এইসব খুঁটিনাটি জ্যোতিষীরা আদৌ বোঝেন না, তবুও, গোরুর গাড়িতে রকেটের ইঞ্জিন জুতে দিলেই সেটা রকেট হয়ে উঠবে না, সেটা জ্যোতিষীরাও খুব ভালোই বোঝেন! ফলে তাঁরা রক্ষণশীল ও অনমনীয় অবস্থানে থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে করেন। প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্যভট্ট রাহু ও কেতুর ধারণাকে বর্জন করে গ্রহণের ব্যাখ্যা হাজির করে বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত ও ভাস্করাচার্যের রোষের মুখে পড়েছিলেন। এর কারণ হল, ভারতীয় জ্যোতিষচর্চায় পৌরাণিক কাহিনিনির্ভর ওই অস্তিত্বহীন ‘গ্রহ’ দুটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। কাজেই, যা দাঁড়াচ্ছে তা হল, আকাশ সম্পর্কিত প্রাচীন, অসম্পূর্ণ ও ভুল দৃষ্টিভঙ্গি সম্বল করে এবং মহাকাশ সম্পর্কিত সত্যিকারের তথ্যকে অবজ্ঞা করে জ্যোতিষশাস্ত্র ভবিষ্যদ্বাণী করে চলেছে।
জ্যোতিষশাস্ত্রের বিপক্ষে উত্থাপিত কোনও প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর জ্যোতিষীরা দিতে পারবেন না। ভূকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বকে মেনে চলার ভুল, খোদ পৃথিবীকেই গ্রহ হিসেবে বুঝতে না পারার ভুল, সৌরজগতের ভেতরকার অনেক মহাজাগতিক বস্তুকেই উপেক্ষা করার ভুল, দৃশ্যমান তারার সংখ্যাই যেখানে বারো হাজার সেখানে মাত্র ২৭টি নক্ষত্রের প্রভাব বিচার করার ভুল, কয়েকশো আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত তারাদেরও একই নক্ষত্রমণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত করা তথা রাশি নামক অর্থহীন বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবার ভুল, প্রাচীন অ্যানিমিজ়ম ও অনুকৃতিমূলক জাদুকে (imitative magic) অনুসরণ করে শুভ-অশুভ বিচার করার ভুল – জ্যোতিষের ভুলের কোনও সীমাপরিসীমা নেই। কাজেই, ছক কাটা আর অঙ্ক কষার ঘনঘটা সত্ত্বেও, জ্যোতিষ ‘বিজ্ঞান’ তো নয়ই, বরং যে কোনও রকম জ্ঞানের দিক থেকেও তা চর্চার অযোগ্য। কারণ, প্রকৃত তথ্য ও যুক্তি ছাড়া কোনও জ্ঞানই ‘জ্ঞান’ পদবাচ্য হয়ে ওঠে না। কাজেই, ভারতে যখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষশাস্ত্র পড়ানোর জন্য সওয়াল করে, তখন তারা এক অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে এবং সমাজের পক্ষে এক অত্যন্ত হানিকর মিথ্যাকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রয়োগ করতে চায়। অবশ্য জ্যোতিষে বিশ্বাস কীভাবে মানুষের জীবন ও সমাজকে বিপন্ন করে তুলছে, তা নিজ গুণেই সমাজবিদ্যাচর্চার বিষয় হয়ে উঠতে পারে!
আকাশেতে ঝুল ঝোলে, কাঠে তাই গর্ত: জ্যোতিষ নিয়ে গবেষণার হালহকিকত
জ্যোতিষীরা বলেন, আকাশের গ্রহ নক্ষত্ররা মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। কিন্তু, কীভাবে? তার কি কোনও ক্রিয়াপদ্ধতি জ্যোতিষীরা হাজির করেছেন? জ্যোতিষীরা বিজ্ঞের মতো বিস্তর মাথা খাটিয়ে মাধ্যাকর্ষণ, জোয়ারভাটা, তড়িচ্চুম্বকীয় বল, চৌম্বক ক্ষেত্র, অবপারমাণবিক কণিকার নিঃসরণ ইত্যাদি অনেক ‘বৈজ্ঞানিক’ তত্ত্ব পেশ করেছেন বটে, কিন্তু এ সমস্ত কীভাবে একজন মানুষের ‘ভাগ্য’-এর নিয়ামক হয়ে ওঠে, তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। রজার কালভার ও ফিলিপ ইয়ানা হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, ৩ কিলোগ্রাম ভরের একটি শিশুর ওপর ৫০ কিলোগ্রাম ভরের মায়ের মাধ্যাকর্ষণের টান মঙ্গল গ্রহের টানের তুলনায় অন্তত ২০ গুণ বেশি, হাসপাতাল বিল্ডিং ও সূর্যের টানের ক্ষেত্রে গুণকগুলি হবে যথাক্রমে ৫০০ ও ৮,৫৪,৫০০! একই শিশুর ওপর জোয়ার সংক্রান্ত বলের (tidal force) ক্ষেত্রে মায়ের অবদান মঙ্গলের তুলনায় ১০১৩ গুণ! তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তির কথা ধরলে একটি ২০০ ওয়াট ইলেকট্রিক বালব ২ মিটার দূর থেকে মঙ্গলের চেয়ে ৯০,০০,০০০ গুণ বেশি শক্তি শিশুর দিকে ছুঁড়ে দেয় [Culver & Ianna 1984: 105, 108, 110]! আবার, মজার কথা হল, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিয়ে তাঁদের বাগড়ম্বরের মধ্যে গ্রহ-নক্ষত্রের ভর, আকার-আকৃতি, পৃথিবী থেকে তাদের দূরত্ব, ঘূর্ণন, উপাদান ইত্যাদি বিচার্য বিষয় বলেই মনে হয়নি! কাজেই, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আউড়ানোর মধ্যে সমীহ আদায় করার চেষ্টাটুকুই সম্বল, যুক্তিটুক্তি বিশেষ নেই। রামেন্দ্রসুন্দরের ভাষায় বললে: “তাঁহারা [জ্যোতিষে অবিশ্বাসী] যতটুকু প্রমাণ চান ততটুকু তাঁহারা পান না। তার বদলে কু-যুক্তি পান – চন্দ্রের আকর্ষণে জোয়ার হয়, অমাবস্যা পূর্ণিমায় বাতের ব্যথা বাড়ে, ইত্যাদি যুক্তি। কালকার ঝড়ে আমার বাগানে কাঁঠালগাছ ভাঙিয়াছে, অতএব হরিচরণের কলেরা কেন না হইবে, এরূপ যুক্তি অবতারণায় বিশেষ লাভ নাই। গ্রহগুলা কি অকারণে এ-রাশি ও-রাশি ছুটিয়া বেড়াইতেছে – যদি উহাদের গতিবিধির সহিত আমার শুভাশুভের কোন সম্পর্কই না থাকিবে, এরূপ যুক্তি কু-যুক্তি।”
রামেন্দ্রসুন্দরের ‘অবিশ্বাসীরা’ অবশ্য, অত্যন্ত সঙ্গত কারণে, জ্যোতিষ কেন ফল দেয় তার ব্যাখ্যা খোঁজার চেয়ে জ্যোতিষ আদৌ ফল দেয় কিনা সেইটা জানতেই বেশি উৎসাহী। কিছু কাজ হয়, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পরেই না হয় তাঁরা কেন কাজ হয় তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন। জ্যোতিষীরা অদ্যাবধি এ নিয়ে বিশেষ মাথা না ঘামালেও বিজ্ঞানীরা কিন্তু নানা দিক থেকে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। রাশিগুলিতে আরোপিত বৈশিষ্ট্যগুলির সঙ্গে বাস্তবে জাতকের চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য মেলানোর চেষ্টা হয়েছে; অবিচ্ছিন্ন বৈবাহিক সম্পর্ক ও বিবাহবিচ্ছেদের সঙ্গে রাশির যোগাযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে; রক্তের গ্রুপ, চুলের রং, মাথায় চুলের ঘনত্ব, উচ্চতা, লিঙ্গ, ওজন ইত্যাদি শারীরিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে রাশির সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা হয়েছে; অ্যালার্জি, ডাউন’স সিনড্রোম, হার্ট অ্যাটাক, শিশুকালে মৃত্যু, লিউকিমিয়া, ফুসফুসের ক্যানসার ইত্যাদি স্বাস্থ্যাবস্থার সঙ্গে রাশির যোগসূত্র আছে কিনা দেখা হয়েছে; বিভিন্ন রাশির জাতকের মধ্যে ক্রোধ, উচ্চাশা, সৃষ্টিশীলতা, বুদ্ধিমত্তা, নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা ইত্যাদি মানবীয় বৈশিষ্ট্যের বিস্তার লক্ষ করা হয়েছে; জাতকের পেশার সঙ্গে রাশির সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা হয়েছে। একই স্থানে একই সময়ে জন্ম নেওয়া জাতকের (time twins) আচার-আচরণ, সক্ষমতা-অক্ষমতা, অন্তর্মুখীনতা-বহির্মুখীনতা, ব্যক্তিত্ব, পেশা ও শারীরিক বৈশিষ্ট্যের তুলনা করা হয়েছে। কোনও কিছুই জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষে যায়নি। এইসব পরীক্ষানিরীক্ষাগুলির মধ্যে অন্তত কয়েকটিকে নিয়ে একটু বিস্তারে বলার প্রয়োজন আছে।
কতকগুলি পরীক্ষার নকশা খুবই সহজ সরল। ১৯৭৭ সালে জিওফ্রে ডিন অন্তর্মুখীনতা-বহির্মুখীনতা সংক্রান্ত অনেকগুলি গবেষণার পর্যালোচনা করেছেন। ব্যাপারটা বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। মেষ রাশির জ্যোতিষ-আরোপিত বৈশিষ্ট্য হল এই যে, জাতক হবে সাহসী, দৃঢ়, আক্রমণাত্মক, আত্মবিশ্বাসী ও প্রত্যয়ী। স্বভাবত, মেষরাশির জাতকদের মধ্যে জ্যোতিষীয় বিচারে অন্তর্মুখী মানুষের তুলনায় বহির্মুখী স্বভাবের মানুষদেরই বেশি থাকার কথা। কোনও পরীক্ষায় কিন্তু কোনও রাশিরই এমন প্রভাব পাওয়া যায়নি [Hines 1988: 152-154]। এ পরীক্ষায় মেষ রাশির জাতকদের নমুনা হিসেবে নিয়ে তাদের ব্যক্তিগত স্বভাব বিচার করলেই ফলাফল পাওয়া যাবে। কিংবা ধরুন, ২০০৭ সালে ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির ডেভিড ভোয়াস ব্রিটেনে যে পরীক্ষাটি করেছিলেন তার কথা। সূর্যের অবস্থান নির্ভর রাশিব্যবস্থা (sun sign astrology) অনুযায়ী, সফল বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাশিচক্রে সবচেয়ে উপযুক্ত কোণ হচ্ছে ০ ডিগ্রি (যেমন, সিংহ রাশির সঙ্গে সিংহ রাশি), ৬০ ডিগ্রি (যেমন, সিংহ রাশির সঙ্গে তুলা বা মিথুন রাশি) এবং ১২০ ডিগ্রি (যেমন, সিংহ রাশির সঙ্গে ধনু বা মেষরাশি)। ভোয়াস জনগণনার তথ্য থেকে প্রায় ১ কোটি দম্পতির জন্ম-রাশি মেলান, কিন্তু ১৪৪টি সম্ভাব্য রাশি-জোড়ের মধ্যে সম্ভাব্যতার কোনও ফারাক দেখতে পাননি [Voas 2008: 52-55]। ‘কনে দেখা’ পর্বে ‘রাজ-যোটক’ খোঁজার ভারতীয় সংস্কৃতির কথা মাথায় রাখলে গবেষণাটির তাৎপর্য বোঝা যাবে। আজকাল বিভিন্ন ডেটিং-সাইটেও বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে।
কিন্তু যেসব পরীক্ষায় জাতকদের পাশাপাশি জ্যোতিষীদেরও যুক্ত করা হয়েছে, সেখানে অনেকখানি জটিল ও সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়েছে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, জ্যোতিষীয় বিচারের ক্ষেত্রে জ্যোতিষীরা নিজেরাই অনেক সময়েই ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পারেন না। কাজেই, খ্যাতনামা জ্যোতিষীদের যুক্ত করে তাঁদেরকে জ্যোতিষীয় অনুমান করার সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে গবেষণার নিরপেক্ষতা যেমন রক্ষিত হয়, তেমনি জ্যোতিষীয় মতপার্থক্যের মধ্য থেকে কোনও সত্য উঠে আসে কিনা তা দেখারও সুযোগ থাকে। এ ব্যাপারে সম্ভবত সবচেয়ে উঁচুমানের গবেষণাটি করেছেন শন কার্লসন। ১৯৮৫ সালে ‘নেচার’ পত্রিকায় এই ‘ডাবল ব্লাইন্ড ট্রায়াল’টি প্রকাশিত হয়। গবেষণার প্রথম ভাগে জ্যোতিষীরা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিযুক্ত ১৭৭ জন জাতকের জন্মছক প্রস্তুত করে সেগুলির জ্যোতিষীয় তাৎপর্য লিপিবদ্ধ করেন। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী জাতকদের প্রত্যেককে তিনটি করে এমন তাৎপর্য-লিখিত কাগজ দেওয়া হয়, যার মধ্যে তার নিজেরটিও আছে। এরপর তারা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নিজেদের জন্মছক থেকে প্রস্তুত আসল কাগজটিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। পরীক্ষার দ্বিতীয় ভাগে, ১১৬ জন জাতকের ব্যক্তিত্ব যাচাইকারী বহুল প্রচলিত ‘ক্যালিফোর্নিয়া সাইকোলজিক্যাল ইনভেন্টরি পার্সোনালিটি প্রোফাইল’ প্রস্তুত করা হয়। এরপর প্রত্যেক জ্যোতিষীকে জাতকের প্রকৃত জন্মছকের সাথে মোট তিনটি করে প্রোফাইল দেওয়া হয়, যার মধ্যে একটি প্রোফাইল ওই জাতকের। জ্যোতিষীকে এর মধ্যে থাকা প্রকৃত প্রোফাইলটিকে চিহ্নিত করতে বলা হয়। পরীক্ষার দুটি অংশের ফলাফলই জ্যোতিষশাস্ত্রের বিপক্ষে যায় [Carlson 1985: 419-425]। জ্যোতির্বিদ জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার, যুক্তিবাদী নরেন্দ্র দাভোলকর এবং তাঁদের সঙ্গীরা ভারতে জ্যোতিষীদের যুক্ত করে যে চমৎকার গবেষণাটি করেছিলেন, তা ২০০৯ সালে ‘কারেন্ট সায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গবেষকদের মধ্যে একজন ছিলেন অভিজ্ঞ জ্যোতিষী। মহারাষ্ট্রে ১০০ জন মেধাবী ও ১০০ জন মানসিক প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীর জন্মকালীন তথ্যের ভিত্তিতে জন্মছক প্রস্তুত করা হয়। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ৫১ জন জ্যোতিষীদের প্রত্যেককে যদৃচ্ছভাবে ৪০টি করে জন্মছক দেওয়া হয় এবং মানসিক প্রতিবন্ধী ও মেধাবীদের ছক পৃথক করতে বলা হয়। জ্যোতিষীদের মধ্যে ২৪ জন রণে ভঙ্গ দেন, ২৭ জন তাঁদের রিপোর্ট পাঠান। একই সাথে, ২০০টি জন্মছকের গোটা নমুনাকে পাঠানো হয় একটি জ্যোতিষ সংগঠনের সদস্যদের। তাঁদেরকেও একইভাবে দল-ভাগ করতে বলা হয়। দুটি ক্ষেত্রেই জ্যোতিষীরা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন [Narlikar et al 2009: 641-643]।
সময়-যমজদের (time twins) নিয়ে তুলনামূলক বিচার করে অনেকগুলি পরীক্ষার কথা জানা যায়। জ্যোতিষের কার্যকারিতার পরীক্ষায় সময়-যমজরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ জন্ম সময় ও জন্মের স্থান একই হওয়ার কারণে তাদের জন্ম-রাশি ও জন্ম-মুহূর্তে বিভিন্ন গ্রহের অবস্থান একই থাকে। কাজেই, জ্যোতিষীয় মতে এদের সকলের ‘ভাগ্য’ একই হওয়ার কথা। ২০০৩ সালে প্রকাশিত ইভান কেলি ও জিওফ্রে ডিন সংঘটিত পরীক্ষায় ব্রিটেনের ন্যাশনাল চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডি-র তথ্যভাণ্ডার থেকে ১৯৫৮ সালের ৩ থেকে ৯ মার্চের মধ্যে (রাশিচক্রে প্রতিটি রাশির ৩০ ডিগ্রি করে ব্যপ্তি আছে বলে এই দিনাঙ্কের মধ্যে জন্ম-সময়ের বিশেষ হেরফের না হলে জন্মছকের পরিবর্তন হবে না) লন্ডন ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করা ১৬,০০০ শিশুর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ৯২ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশুদের জন্ম সময়ের ফারাক ছিল পাঁচ মিনিটের মধ্যে, বাকিদের কিঞ্চিৎ বেশি। জাতকের ১১, ১৬ ও ২৩ বয়সে সংগৃহীত নানান শারীরিক বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিত্ব, পেশা, সক্ষমতা-অক্ষমতা, দুর্ঘটনা-প্রবণতা ইত্যাদি বিষয় জড়ো করে মোট ১১০ রকমের চলরাশি (variable) নির্ধারণ করা হয়। এরপর তাদের জন্মছকে চলরাশিগুলি যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তার সঙ্গে বাস্তবের তথ্য মিলিয়ে দেখা হয়। গবেষণাটি প্রকৃতপক্ষে একটি বিরাট মাপের প্রকল্পের চেহারা নেয় এবং বিপুল সংখ্যক তথ্য সংগ্রাহক-গবেষকের সাহায্যে সম্পূর্ণ হয়। এই বিপুলাকার গবেষণাটি ছিল জ্যোতিষশাস্ত্রের অভ্রান্ততার পক্ষে প্রমাণ পাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতি। কিন্তু জ্যোতিষীদের কাছে তা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো, কারণ ফলাফলের কোনও কিছুই তাঁদের পক্ষে যায়নি [Dean & Kelly 2003: 175-198]।
আরেকটি ভারতীয় গবেষণার কথা বলা দরকার। এতে অংশগ্রহণকারী চারজন গবেষকের মধ্যে দু-জন নিজেদেরকে জ্যোতিষ গবেষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ৬০ বছর বয়স হওয়ার আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন (২৫৪ জন) এবং ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত ক্যানসারে আক্রান্ত হননি (৪৯৮ জন) – এ রকম দু-দল মানুষের জন্মছক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলনা করা হয়েছে গবেষণাটিতে। জন্ম-মুহূর্তে প্রত্যেকটি রাশিতে (‘ঘর’) গ্রহের অবস্থানের প্রভাব ও তাদের পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক, এবং বিভিন্ন নক্ষত্রের অবস্থানের ভিত্তিতে শুভ ও অশুভ প্রভাব বিচার করা হয়েছে। চারটি তালিকায় এই শুভ ও অশুভ প্রভাবগুলি স্পষ্টভাবে উল্লিখিত আছে। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটির উল্লেখ করা যেতে পারে। শনি ও মঙ্গলের সঙ্গে একত্রে অবস্থান কোনও গ্রহের ক্ষেত্রে অশুভ, কোনও ‘ঘর’-এর বিপরীত ‘ঘর’-এ এদের দেখা গেলেও প্রভাব একই রকম। আবার ওই ‘দুষ্ট গ্রহ’ দুটির বদলে শুক্র বা বৃহস্পতি থাকলে প্রভাব শুভ হবে, ইত্যাদি। গাণিতিক হিসেবনিকেশের সাহায্যে গবেষকরা ক্যানসারের ওপর গোটা জন্মছকের প্রভাব খতিয়ে দেখেন এবং যথারীতি হতাশ হন। ভারতে ‘বৈদিক জ্যোতিষ’ হিসেবে প্রচলিত পদ্ধতির জন্মছক বিশ্লেষণের ২৭টি মূলগত নীতির কোনও যাথার্থ্য গবেষকরা খুঁজে পাননি [Rajopadhye et al 2021: 74-85]।
শোনা যায়, হিটলারকে তাঁর জ্যোতিষী এই বলে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, “With Libra rising you could find great satisfaction in your own home decorating business — or then again you may prefer to invade Poland.”। বস্তুত, এইসব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার কোনওটাই আদৌ জ্যোতিষীদের কুযুক্তি দর্শানোর থেকে বিরত করতে পারে না। কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁদের গণনার পদ্ধতি যেমন আলাদা আলাদা (সূর্য-ভিত্তিক গণনা, চন্দ্র-ভিত্তিক গণনা, নাক্ষত্রিক গণনা ইত্যাদি), তেমনি বিভিন্ন রাশিতে বিভিন্ন ‘গ্রহ’-এর অবস্থান ও তাদের আন্তঃসম্পর্কের নানান পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যান জ্যোতিষীয় ভবিষ্যদ্বাণীর এক অন্তহীন বৈচিত্রপূর্ণ সম্ভাব্যতার দুয়ারে আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে তাঁদের পক্ষে এক দুরধিগম্য ঢাল রচনা করে। ভবিষ্যদ্বাণী না মিললে গণনার ভ্রান্তিকে দায়ী করা হয়। বিভিন্ন খবরকাগজের পাতায় দৈনিক রাশিফলের প্রভেদ থেকে তা কিছুটা আন্দাজ করা যায়। কালভার ও ইয়ানা হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, জ্যোতিষীয় বিন্দু, গ্রহ, চিহ্ন, রাশি, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি মিলিয়ে সর্বমোট প্রায় ১০৩৫ রকমের জ্যোতিষীয় অনুমান সম্ভব, যেখানে আমাদের বাসযোগ্য গ্রহটিতে বালুকণার পরিমাণ কেবল ১০২৭ – পূর্বোক্ত সংখ্যাটির এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র [Culver & Ianna 1984: 150]! কাজেই, তাঁদের যুক্তি হচ্ছে এই যে, যতক্ষণ না পর্যন্ত পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে সমস্ত সম্ভাবনার মৃত্যু হচ্ছে, ততক্ষণ অবধি প্রতারণা করার ছাড়পত্রটি তাঁদের দিয়ে দিতে হবে! পৃথিবীর সমস্ত অপবিজ্ঞানের লক্ষণই বোধহয় এই এক বিন্দুতে এসে মিলে যায়।
হাতে আমার পষ্ট লেখা: বিশ্বাসের গলিঘুঁজি প্রসঙ্গে
জ্যোতিষ নিয়ে অনেকগুলি পরীক্ষানিরীক্ষায় নেতিবাচক ফলাফল পাওয়ার পর ১৯৫০-র দশকে ফরাসি মনোবিদ, সংখ্যাতাত্ত্বিক ও শখের জ্যোতিষচর্চাকারী মিশেল গকল্যাঁ (Michel Gauquelin) বিভিন্ন পেশায় সফলতার ভিত্তিতে ২০০০ জন ফরাসি ব্যক্তিত্বের জন্ম সময়ের সাথে গ্রহের অবস্থান খতিয়ে দেখে দাবি করেছিলেন যে, কোনও কোনও গ্রহ লক্ষণীয়ভাবে ওইসব ব্যক্তিত্বের জন্ম সময়ে আবির্ভূত হয়। যেমন, সফল ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের ক্ষেত্রে তিনি দাবি করেন যে, পূর্ব দিগন্তে মঙ্গল গ্রহের উদয়ের অল্পক্ষণ পরে অথবা ঠিক মধ্যাকাশে মঙ্গল গ্রহ পৌঁছনোর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওইসব ব্যক্তিত্বদের অধিকাংশের জন্ম হয়েছে। সফল বিজ্ঞানীদের বেলায় অনুরূপভাবে শনি গ্রহের প্রভাবকে চিহ্নিত করা হয়। বিষয়টি সামগ্রিকভাবে পরবর্তীকালে ‘মার্স এফেক্ট’ নামে আলোড়ন ফেলে। দীর্ঘ পরীক্ষানিরীক্ষা ও অনুসন্ধানের শেষে দেখা যায় যে, গকল্যাঁ তথ্য সংগ্রহ ও বাছাইয়ের ব্যাপারে নানাভাবে পক্ষপাতের সাহায্য নিয়েছেন (selective bias)। নিজের বিশ্বাসকে প্রমাণ করার জন্য যেমন সফলতার মনগড়া মাপকাঠি গ্রহণ করেছেন কিন্তু সবক্ষেত্রে ওই মাপকাঠিতে স্থির থাকতে পারেননি, তেমনি ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু তথ্য বাতিল বা গ্রহণ করেছেন [Kurtz, Nienhuys & Sandhu 1997: 19-39]। বিতর্কের এক বিরাট অধ্যায়ের সমাপ্তিতে ১৯৬৯ সালে তিনি এই উপলব্ধিতে পৌঁছন যে, "The signs in the sky which presided over our births have no power whatever to decide our fates [or] to affect our hereditary characteristics."। পরে তিনি নিজের সমস্ত ফাইলপত্র নষ্ট করার নির্দেশ দেন এবং ১৯৯১ সালে তীব্র মানসিক অবসাদে আত্মহত্যা করেন। মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও শখের জ্যোতিষচর্চাকারী মার্ক ম্যাকডোনো (Mark McDonough) মানবজীবনে গ্রহ-নক্ষত্র ও উল্কাসমূহের প্রভাব খতিয়ে দেখার জন্য ১৯৯৬ সালে জ্যোতিষীয় তথ্যভাণ্ডার থেকে ৩০,০০০ জনের জন্মকালীন তথ্য সংগ্রহ করেন এবং কমপিউটারের সাহায্যে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের নানা রকম বিন্যাসের প্রভাব বিচার করার চেষ্টা করেন। তিনি কয়েকটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল পেলেও সেগুলিকে পুনরুৎপাদিত করতে সক্ষম হননি। তীব্র হতাশা থেকে ম্যাকডোনো জ্যোতিষ পরিত্যাগ করেন। আরেক মার্কিন জ্যোতিষী কেইথ বার্ক মানব ব্যক্তিত্বের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যকে চন্দ্রভিত্তিক জ্যোতিষীয় গণনার সঙ্গে সম্পর্কিত করতে চেয়ে ব্যর্থ হন এবং ম্যাকডোনোর মতো তিনিও জ্যোতিষ থেকে দূরে সরে যান। জার্মান জ্যোতিষী ও মনোবিদ পিটার নাইহেঙ্কে (Peter Niehenke) সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার উৎসাহীর থেকে সাড়া পান। অতঃপর একটি ৪২৫-দফা প্রশ্নপত্রের সাহায্যে জ্যোতিষের সপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য ১৯৮৪ সালে এক বিপুলাকার প্রকল্প রচনা করেন। গবেষণা শেষে হতাশ নাইহেঙ্কে বিবৃতি দেন: “A world in which astrology exists is surely a more enjoyable world than one without it. The need that astrology be a reality is much stronger than all the rational demonstrations against it” [Dean 2016]।
অবশ্য জ্যোতিষীমাত্রেই ফল না পেলে যেমন জ্যোতিষচর্চা ছেড়ে দেবেন না, তেমনি জ্যোতিষ-বিশ্বাসীরাও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার ফলাফল নিয়ে বোধহয় ততটা উদ্বিগ্ন নন। তবে নাইহেঙ্কের উপলদ্ধিটি প্রণিধানযোগ্য। কেই-বা আর নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারে! ছাত্রাবস্থায় এক বন্ধুকে দেখতাম ‘হাত দেখতে জানে’ বলে মহিলারা অবলীলাক্রমে নিজের হাত দু-খানি তুলে দিচ্ছে তার হাতে এবং সে তাদের চরিত্রের অনেক অচেনা বিষয় উন্মোচন করে দেদার বাহবা কুড়োচ্ছে। কীভাবে যেন জ্যোতিষীদের কায়দাটা সে রপ্ত করে ফেলেছিল ওই বয়সেই! মার্কিন মনোবিদ বারট্রাম ফোরার কৃত চমৎকার পরীক্ষাটির কথা এখানে বলা যাক। ১৯৪৮ সালে ফোরার তাঁর ৩৯ জন ছাত্রছাত্রীর প্রত্যেকের হাতে একটি করে কাগজ তুলে দিয়ে বলেছিলেন যে, ওতে তাদের ব্যক্তিগত চরিত্রচিত্রণ করা হয়েছে। সকলকে বলা হল সেটি পড়ে মতামত জানাতে। ০ থেকে ৫ অবধি স্কেলে ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া রেটিং-এর গড় ছিল ৪.৩, অর্থাৎ, মোটের ওপর, সকলেই ফোরারের মূল্যায়নের সঙ্গে কমবেশি সহমত পোষণ করেছিল। বাস্তবে কিন্তু প্রত্যেকের কাগজে একই কথা লেখা ছিল। তোমার একটা আত্ম-সমালোচনা করার প্রবণতা আছে, তোমার অনেক সক্ষমতা থাকলেও তার অল্প অংশকেই তুমি কাজে লাগাতে পেরেছ, তুমি স্বাধীনভাবে চিন্তাভাবনা করতে পার এবং উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া অন্যের কথা সহজে মানতে পার না, নিরাপত্তা হল তোমার জীবনের অন্যতম লক্ষ্য – এরকম ১৩টি চারিত্রিক-বিবৃতি কাগজে লেখা ছিল। মজার ব্যাপার হল, ফোরার কথাগুলি সংগ্রহ করেছিলেন একটা জ্যোতিষ-পত্রিকা থেকে [Forer 1949: 118-123]। মনস্তত্ত্বে বিষয়টি ‘বার্নাম-ফোরার এফেক্ট (Barnum-Forer effect)’ নামে প্রসিদ্ধ। এ হল কোনও ব্যক্তি সম্পর্কে এক সাধারণ চরিত্রায়ন, যাকে ওই ব্যক্তি যথাযথ বলে ভাবেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, চারিত্রিক ওই বিবৃতিগুলি প্রায় সকল মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। জ্যোতিষের জনপ্রিয়তা ও তথাকথিত ‘সাফল্যের’ পেছনে বার্নাম-ফোরার এফেক্ট-এর ভূমিকা অনেকখানি, খদ্দেরকে প্রভাবিত করতে এ ধরনের কায়দা খুবই কার্যকর। মহিলামহলে আমার বন্ধুবরের জনপ্রিয়তার রহস্যও ছিল এটাই।
জ্যোতিষে বিশ্বাসের পেছনে নানা ধরনের বিষয় কাজ করে। যেমন, ধর্মবিশ্বাস ও নানা ধরনের কাল্ট-সংস্কৃতির সঙ্গে জ্যোতিষ সরাসরি জড়িত। ভারতীয় সমাজে অনুসৃত ধর্মগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশ্বাসগুলির দিকে তাকালে আমরা চমৎকারভাবে বিষয়টি বুঝতে পারব। বর্তমান প্রবন্ধের গোড়ায় ভারতীয় সমাজ নিয়ে পিউ ফোরামের যে গবেষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, তাতে উঠে এসেছে যে, এখানে ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে কর্মফল, জন্মান্তর ও ভাগ্যে বিশ্বাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জন্মান্তরবাদ ও ভাগ্যে বিশ্বাস হিন্দুদের মধ্যে কিঞ্চিৎ বেশি হলেও কর্মফলে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিরাট কিছু ফারাক নেই। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কার্য সমাধা করার জন্য সকলেই পাঁজি ঘেঁটে শুভলক্ষণযুক্ত দিনের খোঁজ করে। ভারতীয় সমাজে ‘মঙ্গলবারের প্রভাব’ খুবই প্রবল, দিনটি শুভত্বের ব্যঞ্জনায় পরিপূর্ণ। এছাড়া, শনি-বৃহস্পতিবারে আমিষ ত্যাজ্য, ক্ষৌরকর্মও নিষিদ্ধ। হাতে-খড়ি, মুখে-ভাত, বিবাহ, ব্যবসা বাণিজ্যের উদ্বোধন সবকিছুতেই তিথি নক্ষত্রের জয়জয়াকার। এমনকি, সিজ়ারিয়ান প্রসবের ক্ষেত্রেও শুভ দিন স্থির করে চিকিৎসকের কাছে ওই দিনে সন্তান ভূমিষ্ঠ করাবার আবদারও নতুন কিছু নয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এ পোড়া দেশে মহাকাশযান উৎক্ষেপণের জন্যও উপযুক্ত বার-তিথির খোঁজ করা হয়! প্রতি দশ জন হিন্দুর মধ্যে নয় জন এ ধরনের সংস্কৃতি মেনে চলেন। তবে অন্য ধর্মাবলম্বীরাও কমবেশি এসবে বিশ্বাস করেন। বৌদ্ধদের মধ্যে দিন-ক্ষণে বিশ্বাসীদের অনুপাতটা সবচেয়ে কম – প্রতি দু-জনে একজন। কাজেই, প্রত্যাশিতভাবেই, জ্যোতিষে বিশ্বাস হিন্দুদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি – প্রতি দু-জনের একজন হিন্দু জ্যোতিষে আস্থাশীল [Sahgal et al 2021: 44, 164, 197, 206]।
ভারতীয় সমাজে জ্যোতিষের প্রভাব নিয়ে চমৎকার সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা করেছেন সমাজতত্ত্ববিদ নুপূর্ণিমা যাদব। দিল্লি ও সন্নিহিত এলাকায় ক্ষেত্র সমীক্ষা চালিয়ে সমাজে জ্যোতিষের শিকড়ের গতিপ্রকৃতি বুঝতে চেয়েছেন তিনি। প্রধানত অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাকুরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের পরিবারে সমীক্ষা চালিয়ে তিনি দেখেছেন যে, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক সামাজিক সব ক্ষেত্রেই সেরা ‘ফায়দা’টুকু নিশ্চিত করতে নিত্যনৈমিত্তিকভাবে যে আচারঅনুষ্ঠানগুলি পালন করা হয়, তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে লেপটে থাকে জ্যোতিষ। বস্তুত, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার খাতিরে জ্যোতিষকে কাজে লাগানো হয়। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী জ্যোতিষে বিশ্বাসী প্রায় প্রতিটি ব্যবসায়ী শ্রেণির মানুষ তাঁদের সাফল্যের পেছনে জন্মছকে প্রতিফলিত গ্রহনক্ষত্রের প্রভাব ও জ্যোতিষীয় বিবেচনাকে দায়ি করেছেন। দিল্লি ও গুরুগ্রামে প্রায় প্রতিটি ‘মল কমপ্লেক্সের’ সঙ্গে অন্তত একটি করে জ্যোতিষীর চেম্বারের উপস্থিতি লক্ষ করেছেন নুপূর্ণিমা। চিন্তাচেতনার যৌক্তিক প্রক্রিয়ার বিপরীতে জ্যোতিষীয় অভিজ্ঞতা হল একান্তভাবেই ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং মধ্যবিত্ত পরিবারে তা নানান আচারঅনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। তবে কেবল আচারঅনুষ্ঠানের দিনক্ষণ স্থির করাই নয়, সামাজিক জীবনের অত্যন্ত গভীরে থাবা বসিয়েছে জ্যোতিষ। যেমন, ভারতে বিবাহের সঙ্গে পারিবারিক সম্মানের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ছেলেমেয়েদের বিয়ে অভিভাবকদের কাছে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভিন্ন জাতে বিবাহ, গোপনে পালিয়ে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ ইত্যাদি এড়াতে জ্যোতিষীয় পরামর্শ গ্রহণ, তাই, অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। পাত্রপাত্রীর জন্মছক মিলিয়ে ‘রাজযোটক’ খুঁজে বিবাহ প্রক্রিয়া নিষ্পন্ন করার মধ্য দিয়ে তা সম্পূর্ণ হয়। ভারতে জ্যোতিষশাস্ত্র ধর্ম দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত, আধ্যাত্মিকতা ও কর্মফলের ধারণা তার অন্যতম উপাদান। নুপূর্ণিমা দেখেছেন যে, তার সমীক্ষাক্ষেত্রে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের পরিচালক হিসেবে ‘পণ্ডিত’ ও জ্যোতিষীর ভূমিকা কখনও কখনও একে অন্যের বিকল্প হয়ে ওঠে। বিষয়টি সহজেই বোধগম্য, কারণ হিন্দুরা তাদের অগুনতি দেবদেবীর সাথে ‘নবগ্রহ’-কেও পুজো করে। ‘গ্রহশান্তি’র উদ্দেশ্যে পুজোপাঠের কথা সকলেই শুনে থাকবেন। পশ্চিমবঙ্গে যেমন ‘শনিঠাকুর’ হলেন ‘গ্রহদেবতা’, শনিগ্রহের কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য তাঁকে তুষ্ট করার আয়োজনই হল শনিপুজো। বস্তুত, জন্মছক গ্রহ সময় ভাগ্য ইত্যাদির ভাষ্য নির্মাণ করে জ্যোতিষীরা সযত্নে একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেন। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা ও দুশ্চিন্তা বিশ্বাসীদের টেনে আনে জ্যোতিষীর কাছে। এমনকি, নুপূর্ণিমা এও দেখেছেন যে, জ্যোতিষে বিশ্বাসহীনতার দাবি করেও কার্যক্ষেত্রে জ্যোতিষীয় শিলমোহরের সাহায্যে সাফল্য ‘দ্বি-গুণ’ নিশ্চিত করতে কেউ কেউ পিছপা হন না! জ্যোতিষ কেবল ভবিষ্যতই দেখায় না, গ্রহনক্ষত্রের প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলানোর নিদানও মেলে জ্যোতিষীদের কাছ থেকে। গ্রহরত্নের রমরমা বাজার তারই ইঙ্গিত দেয়। “নীলা সবাই সইতে পারে না, কিন্তু সইতে পারলে তার সৌভাগ্য আটকায় কে!” জাতীয় কথা জ্যোতিষ-বিশ্বাসী পরিমণ্ডলে কান পাতলে আকছার শোনা যায়। এই নীলা হল ব্লু স্যাফায়ার, যা শনি গ্রহের ‘প্রতিকারে’ ব্যবহৃত হয়। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী বিশ্বাসীরা নানা সমাজিক-পারিবারিক ব্যাপারে জ্যোতিষীয় পরামর্শ গ্রহণের পাশাপাশি সুরক্ষিত ও নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য গ্রহরত্নেরও কদর করে থাকেন। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলে দুর্মূল্য গ্রহরত্ন কেনার সামর্থ্য থাকে না, সেক্ষেত্রে সংশ্লেষিত রত্নপাথর-সদৃশ বস্তু ও শিকড়বাকড় জাতীয় সস্তার বিকল্প দেদার বিকোয় [Yadav 2022: 93-117, 144-156]।
ভারত বা চিনের মতো দেশে জ্যোতিষশাস্ত্র বহুকাল ধরেই সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে (আধুনিক চিনে অনেকই কম, যদিও)। কিন্তু আমেরিকা ও ইউরোপের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত দেশগুলোতেও ইদানীং জ্যোতিষ নিয়ে যে বাড়তি উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে, তার কারণ কী? অনেকই হয়তো জানেন যে, ১৯৩০ সালে বিট্রিশ সংবাদপত্র সানডে এক্সপ্রেস-এ প্রথম জ্যোতিষের কলম আত্মপ্রকাশ করেছিল। সময়টা ছিল তীব্র অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত, এবং তা ছিল অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতে ভবিষ্যৎ দর্শনের এক আকাঙ্খার প্রকাশ। ২০০৮ সালের স্টক মার্কেটের তীব্র পতনের সময়েও জ্যোতিষের কদর বাড়তে দেখা গিয়েছিল। সাম্প্রতিক কোভিড অতিমারিতেও জ্যোতিষীয় ভবিষ্যদ্বাণী করে এমন ওয়েবসাইটগুলির প্রচুর বাড়বৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। ভারতীয় কোম্পানি ‘অ্যাস্ট্রোটক’ ও ‘অ্যাস্ট্রোযোগী’ ওই সময়ে তাদের আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানিয়েছে। বিদেশি ওয়েবসাইটগুলির ক্ষেত্রেও প্রবণতা একই রকমের। অর্থাৎ, কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে জ্যোতিষ সমাজের একটা অংশের কাছে ক্রমশ গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে, জ্যোতিষের কোনও ভবিষ্যৎ-দর্শনের ক্ষমতা না থাকলেও কীভাবে তা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত দেশের মানুষের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠছে? বিশেষত, শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের কাছে এর এই জনপ্রিয়তার কারণ কী? এইসব দেশগুলিতে লোকে যে ধীরে ধীরে ধর্মবিশ্বাস মুক্ত হচ্ছেন, চলতি সহস্রাব্দের শুরুতে নানা সমীক্ষায় তা নিশ্চিতভাবেই উঠে এসেছে। কিন্তু জ্যোতিষশাস্ত্রের মতো অবৈজ্ঞানিক বিষয়ে কীভাবে তারা আস্থাশীল হয়ে উঠছেন? কাজেই, এ ব্যাপারে প্রথম সন্দেহ জাগে যে, যাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলা হয় তা দিয়ে কোনও কিছুকে যাচাই করার মতো শিক্ষা কি সকলে অর্জন করছেন? ১৯৯৭ সালে মার্টিন বাউয়ার ও জন ডুরান্ট ব্রিটেনের ক্ষেত্রে [Bauer & Durant 1997] এবং ২০১০ সালে নিক অ্যালাম সমগ্র ইউরোপের ক্ষেত্রে [Allum 2010] বিষয়টি খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করেছেন যে, সমাজের একটা বড়ো অংশই জ্যোতিষের সাথে বিজ্ঞানের কোনও বিরোধ আছে বলে মনেই করেন না। জ্যোতিষের সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানের তফাত করার জন্য যে ধরনের বৈজ্ঞানিক বোধ ও শিক্ষা লাগে, তা এদের নেই। বাওয়ার ও ডুরান্ট আরও লক্ষ করেছেন যে, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাস থেকে দূরে সরে গিয়ে অনেকেই এক ধরনের অস্থিরতা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়ে পড়ছেন এবং জ্যোতিষ নামক ‘বিকল্প’-এর খপ্পরে পড়ে যাচ্ছেন। বিষয়গুলি অনুধাবন করা প্রয়োজন।
এই প্রসঙ্গে বিগত শতাব্দীর শেষ ভাগে উঠে আসা কিছু বিজ্ঞানবিরোধী প্রবণতার কথা উল্লেখ করা দরকার। এদের অগ্রভাগে থাকবে উত্তরাধুনিকতার তত্ত্ব। উত্তরাধুনিকতা বা পোস্টমর্ডানিজ়ম অনুযায়ী, প্রাকৃতিক সত্য অন্বেষণের বৈজ্ঞানিক তাগিদের পেছনে আসলে লুকিয়ে আছে এক ‘ক্ষমতার দ্বন্দ্ব’। জগৎ ও জীবনকে জানার উপায়গুলির মধ্যে বিজ্ঞান এগিয়ে আছে তার পদ্ধতিগত শ্রেষ্ঠত্বের কারণে নয়, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তা অন্যান্য পদ্ধতিগুলির চেয়ে শক্তিশালী বলে। কাজেই, এই তত্ত্ব বিজ্ঞানের উৎকর্ষকে বিদ্রূপ করে এবং এর পাশাপাশি অন্যান্য ধারণাগুলিকেও একই রকম মান্যতা দেয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানের পাশাপাশি এভাবে জ্যোতিষশাস্ত্রও একটি ‘বিকল্প’ বিশ্বদর্শনের উপায় হিসেবে শিলমোহর পেয়ে যায়। এই সময়েই আমরা দেখতে পাই, আমেরিকার বিভিন্ন এলাকায় বিবর্তন তত্ত্বের পাশাপাশি ক্রিয়েশনিজ়ম পড়ানোর দাবি উঠতে থাকে। অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতিগুলিও আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার ‘বিকল্প’ ও ‘পরিপূরক’ হিসেবে নিজেদের উপস্থাপিত করতে থাকে। উত্তরাধুনিকতা এভাবে বিজ্ঞানকে কতকগুলি প্রতিযোগী ধারণার মধ্যে একটি ‘বিশ্বাস’ মাত্রে পর্যবসিত করে, এবং নৈর্ব্যক্তিক সত্যের অস্তিত্ব অস্বীকার ও যুক্তির প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে। এই সময় থেকেই আমরা ধীরে ধীরে এক অদৃষ্টপূর্ব ‘পোস্ট-ট্রুথ’ যুগে প্রবেশ করতে থাকি। অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০১৬ সালে ‘post-truth’ শব্দটিকে ‘word of the year’ ঘোষণা করে শব্দটির অর্থ হিসেবে লেখে “relating to or denoting circumstances in which objective facts are less influential in shaping public opinion than appeals to emotion and personal belief”। ‘পোস্ট-ট্রুথ’ যুগের আগমনের জন্য যেমন বিপুলভাবে দায়ী তথ্য চলাচলের বিপুল গতি সম্বলিত ইন্টারনেট, সোস্যাল মিডিয়া ইত্যাদি, তেমনি রয়েছে মিডিয়ায় সংবাদ পরিবেশনের ভঙ্গি এবং বিজ্ঞান আমাদের বিষাক্ত করছে, দমিয়ে রাখছে, সত্যের বৈধতার ঠিকাদার হয়ে উঠেছে ইত্যাদি উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। এভাবে সত্য-মিথ্যার মধ্যে, ফিকশন-ননফিকশনের মধ্যে ভেদাভেদ, সীমারেখাটাই বিলুপ্ত হতে বসে। বৈজ্ঞানিক যুক্তিনির্ভর পদ্ধতির বিপ্রতীপে ব্যক্তিগত আবেগ, বিচার, বিশ্বাস ইত্যাদি কোনও কিছু যাচাই করার প্রধান মানদণ্ড হয়ে ওঠে। নতুন প্রজন্ম এভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের কর্মকাণ্ডের প্রতি সমীহ বজায় রেখেই বিশ্বদর্শনের একটি ‘বিকল্প’ উপায় হিসেবে জ্যোতিষশাস্ত্রকেও মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
ইডা অ্যান্ডারসন ও তাঁর সঙ্গীরা দেখেছেন যে, আত্মমগ্নতা (তাঁরা ‘নার্সিসিজ়ম’ কথাটি ব্যবহার করেছেন) হল জ্যোতিষে বিশ্বাসের একটি অন্যতম নির্ণায়ক বিষয় এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে এই বিশ্বাসের সম্পর্ক বিপ্রতীপ [Anderson et al 2022]। অনেকেরই ধারণা, এই আত্মমগ্নতা ও নিঃসঙ্গতা একান্তভাবেই ইন্টারনেট-যুগের ফসল। অবশ্য কর্মক্ষেত্রের জটিলতা বৃদ্ধি, পুঁজিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নানা অন্তর্দন্দ্ব, আধুনিক সমাজজীবনের নানান জটিলতা ইত্যাদি বিষয়কেও এক্ষেত্রে কোনওভাবে হিসেবের বাইরে রাখা যায় না। এবং এই আত্মমগ্নতা সমাজজীবনে সত্যিই কতখানি থাবা বসিয়েছে, তা স্বতন্ত্র গবেষণার বিষয়। আজকের ‘ওয়েলনেস ইন্ডাস্ট্রি’-র মারকাটারি বাণিজ্যের উত্থান এই আত্মমগ্নতা ও নিঃসঙ্গতাকে ঘিরেই। জ্যোতিষে বিশ্বাস এই ‘ওয়েলনেস ইন্ডাস্ট্রি’-রই একটি অন্যতম উপাদান। জ্যোতিষ-সাইটগুলিতে জিজ্ঞাস্য প্রশ্নগুলি বিচার করলে দেখা যাবে, প্রধান সমস্যাগুলি হচ্ছে ভালোবাসা, পারস্পরিক সম্পর্ক ও কর্মক্ষেত্রের জটিলতাকে ঘিরে। জ্যোতিষশাস্ত্র জন্মছক বিচার করে কোন সম্পর্কটি সামঞ্জস্যপূর্ণ আর কোনটি নয়, তা জানিয়ে দেয়। কর্মক্ষেত্রের ধকল ও জটিলতা প্রশমিত করতে পরামর্শ দেয়। এই বিশ্বচরাচরে উপভোক্তার আত্মমগ্ন ও নিঃসঙ্গ অস্তিত্বকে জ্যোতিষ এক ছদ্ম-কুঠুরিতে স্থাপন করে, বারোটি খোপের মধ্যে সে কোনও একটি জন্ম-রাশির খোপের মধ্যে নিজেকে এঁটে নেয় এবং তৃপ্ত হয়। কাজেই, ইন্টারনেট-যুগে জ্যোতিষে বিশ্বাসকে হয়তো-বা ভাবা চলে এক সূচক বা ‘নির্দেশক’ হিসেবে, যা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং এর অন্তর্গত অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের মাত্রা নির্দেশ করে।