ভাষাবিতর্ক নিয়ে তামিলনাড়ু বাদে আর যে দুটো রাজ্য হেডলাইনে আছে, তারা হল মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু কারণগুলো বিভিন্ন। তৃতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি চাপানোর প্রতিবাদের সাথে সাথে ব্যবসায়ীদেরকে মরাঠি বলতে বাধ্য করা, এই লম্ফঝম্ফ নতুন কিছু না, চক্রাকারে পরিবর্তিত হয়। নতুন যেটা হল, সেটা হচ্ছে বাংলা ভাষা শুনে বাংলাদেশী ছাপ দিয়ে ঠ্যাঙানো এবং সীমানার বাইরে বার করে দেওয়া। মহারাষ্ট্রে উত্তর ভারতীয় ঠ্যাঙানো, নতুন কিছু না। বাঙালি ঠেঙানো টাই নতুন। প্রায় সিকি - শতাব্দ মহারাষ্ট্রে কাটানো এক বঙ্গভাষী হিসেবে বোঝার চেষ্টা করছি এই নতুন উৎপাত কে।
"সত্য যুগের" কথা:
এটা আমার প্রজন্মের বঙ্গসন্তানদের বেড়ে ওঠার যুগের কথা, ষাটের দশক থেকে আশির দশক - আমি দেখিনি। সবই শোনা কথা। তখন দাদর এবং বৃহৎ বোম্বাই এ অনেক গুলি বাংলা স্কুল ছিল, সেখানে বাংলা ভাষা একটা অন্যতম বিষয় হিসেবে পড়ানো হতো, বাঙালি সংস্কৃতির অনুষ্ঠান গুলি, যেমন রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করা হতো। নাগপুরের দীননাথ স্কুল বাংলা ভাষার সিলেবাস, পরীক্ষা ইত্যাদির ব্যবস্থাপনায় অগ্রণী ছিল। আর মরাঠি ভাষা শিক্ষা? সেই যুগের অনেক বাবা মা খুব গর্ব করে বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা (অর্থাৎ বঙ্গ সন্তানেরা) সব সময় মরাঠিতে “ওদের” চেয়ে বেশি নম্বর পেতো! ধ্রুব সত্য না হলেও অবশ্যই অনেক ক্ষেত্রে সত্য। এই সব বাবা মার প্রজন্ম ও কিন্তু খুব সহজাত ভাবে মারাঠি শিখেছে দেখতে পাই। আরেকটা কারণ হয়ত, সেযুগের এলিট বাঙালি পুণে অঞ্চলে কাজ করত কারখানায়, অর্থাৎ ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে। "সাধারণ" মানুষের সাথে মিশতে বাধ্য হত। আর আমার ধারণা, এসব বাঙালি বাড়িতে কিন্তু মরাঠি সংস্কৃতি, পুজো আচ্চা সে ভাবে হত না।
"মধ্যযুগের" কথা:
আমি মহারাষ্ট্রে পা রেখেছি ২০০১ সালে। প্রথম বছর টা কেটেছে মুম্বাইতে। মরাঠি শব্দাবলী কানে বা চোখে আদৌ লাগেনি এই এক বছরে। পরের বছর থেকে পুণেতে। তখন পুণের অটোওয়ালারা মারাঠি বলতে না পারলে নানাভাবে উৎপীড়ন করত। কর্পোরেশন, ইলেকট্রিক সাপ্লাই ইত্যাদি অফিসে যারা মারাঠি বলতে পারেনা, তাদের নানা রকম অসহযোগিতার মুখোমুখি হতে হত। কিছু কিছু মরাঠি অবশ্যই বেশ প্রাদেশিক বোঝা যেত। যদিও এক হাতে তালি বাজে না কথাটা বলতে বাধ্য হব। বাঙালিরা পদে পদে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং অন্যদের সমালোচনা যে ভাবে করত, তাতে বাঙালি বিদ্বেষ না তৈরি হওয়াটাই অস্বাভাবিক।
আমরা তখন যারা শিশুদের অভিভাবক, হাতের কাছে যা ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুল পেয়েছি, বাচ্চাদের সেখানেই ভর্তি করেছি। বোর্ড নিয়ে মাথা ঘামাই নি। বাড়ির কাছে আন্তর্জাতিক স্কুল (ইন্টারন্যাশনাল স্কুল নয়, নানা দেশে শাখা সমৃদ্ধ), মধ্যবিত্ত পরিবেশ, মারাঠি বোর্ড। মেয়ে স্কুল জীবন সেখানে আনন্দেই কাটিয়েছে। কিন্তু ওই ১০ বছরে ভালো করে মরাঠি শেখেনি। মেয়ের কাছেই কারণ খানিকটা শুনতে পেয়েছি - ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল বলে এখানে নাকি মরাঠি বলা নিষিদ্ধ ছিল খেলার সময়। কিন্তু বাংলা বলা নিষিদ্ধ ছিল না!!! পরে খেয়াল করেছি, ছোটদের যেমন নানা রকম ছড়া শেখানো হয়, অন্যান্য স্কুলে ভালোই মারাঠি ছড়া শেখানো হতো। প্রতিবেশী শিশুরা বলতো। আমার মেয়ে ওদের চেয়ে একটু বড়। তাই পরে খেয়াল করেছি আমার মেয়ে ওই বয়সে মরাঠি ছড়া শেখেনি। মরাঠি যে ভালো করে শিখছে না সেটা বহুদিন খেয়াল ও হয়নি। তারপরে অষ্টম শ্রেণী নবম শ্রেণীতে দেখলাম ওর বাংলা ভাষার দখল মরাঠি থেকে বেশি ভালো। ভেবেছিলাম তাহলে দ্বিতীয় ভাষা বাংলা হিসেবেই ওকে মাধ্যমিক দেওয়াবো। কিন্তু পরে দেখলাম ব্যাপারটা ঠিক প্রাকটিক্যাল নাও হতে পারে। একটা মাত্র খাতা যদি কোথাও হারিয়ে যায়, পুরো মাধ্যমিক পস্তে যাবে। অগত্যা নানা টিউটর এর সহায়তায় মাধ্যমিক পার হল। ভাষা শিক্ষার পদ্ধতি যেটা দেখলাম, সেটা হল ডাইজেস্ট দিয়ে প্রশ্ন-উত্তর মুখস্ত করানো। জুনিয়র কলেজে গিয়ে এক ঝাঁক মরাঠি সহপাঠীর মধ্যে মেলামেশা করতেই এক মাসে মরাঠিতে সড়গড় হয়ে গেল, যা দশ বছরে হয় নি।
পুরো জিনিসটার মধ্যে কিন্তু পরে খেয়াল করলাম, একটা অদ্ভুত দ্বিচারিতা ছিল। ওই স্কুলে অভিভাবকদের সঙ্গে মিটিংয়ে কখনো কখনো শুধুই মরাঠিতে কথা হয়েছে । প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অভিভাবক মরাঠি নয়। আমি ইংরেজিতে কথা বলার দাবি তোলাতে পরে আমার কন্যাকে নানা অপমানজনক কথা বলেছিল কিছু শিক্ষক। প্রিন্সিপালেরা ওই দশ বছর কেউই মরাঠি ছিলেন না। কাজেই মেয়ের জন্য সুবিচার আদায় করতে অবশ্য অসুবিধে হয়নি।
ওই সময় আরো অনেক কিছু খেয়াল করতাম। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মরাঠি ভাষা নিয়ে লম্ফঝম্ফ চলতেই থাকত, আর আমি বিরক্ত হতাম এই ভেবে, এরকম ভাবে জোর করে ভাষা না চাপিয়ে কিভাবে সহজে ভাষাটা যারা জানে না তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় তার ব্যবস্থা করলে তো পারে! আবার মরাঠি অভিভাবক বেশ অনেককেই দেখতাম ধীরে ধীরে তাদের ছেলে মেয়েদের আইসিএসই বা সিবিএসই বোর্ডে ভর্তি করাচ্ছে। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা তে সাফল্যে সুবিধের কথা কিন্তু এরা বলেনি। চমকে গিয়েছিলাম শুনে "এত মরাঠি কে পড়াবে!" আর একজন মরাঠিকে বলতে শুনেছিলাম, "আমি মরাঠি টেক্সট বুকের বিন্দু বিসর্গ বুঝতে না পেরে আমার মাকে দেখালাম। মা বললেন, কোলহাপুরের ভাষা, নাগপুরের ভাষা, রত্নাগিরির ভাষা সবকিছু একসাথে জগাখিচুড়ি পাকালে সেই বইয়ের বিন্দু বিসর্গ বোঝা মুশকিল।" তাহলে কি এটাই দাঁড়ায়, শিক্ষা পদ্ধতি মরাঠি ভাষাকে মরাঠিভাষীর কাছেই অশিক্ষণীয় করে তুলেছে? এই একই সমস্যা তো খুব সম্ভব পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষীর ক্ষেত্রেও।
আমার লেখার বিষয়বস্তু যেহেতু বাংলা মরাঠি সমীকরণ নিয়ে, এই যুগটাতে লক্ষ্য করা আরো কিছু ঘটনার কথা না বললে চিত্র অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বাংলা বিখ্যাত রচনার মরাঠি অনুবাদ কিন্তু সেই সময় দোকানে দেখেছি, মুম্বাই এবং পুণের পাঠককে দেখেছি কাজের ফাঁকে ফাঁকে, যাত্রাপথে পড়তে। এরমধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং তসলিমা নাসরিনের নাম মনে পড়ছে। বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র এবং শরদিন্দু খুবই জনপ্রিয় ছিলেন বলে শুনেছি। বাদল সরকারের নাটক খুব জনপ্রিয় বিদগ্ধ মারাঠি দের কাছে। কন্যা স্কুল জীবনে বহুবার রবীন্দ্রনাথের বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে মারাঠি শিক্ষিকাদের কাছ থেকেই খুব প্রশংসা পেয়েছে। জেনারেশন এক্স এবং তাদের চেয়ে বড় যত শিক্ষিত মানুষকে দেখেছি বাংলার ভিতরে ও বাইরে, বেশিরভাগের মুখে একটা কথা শুনেছি , “আমি/ আমার ছেলে মেয়ে ছোট বেলায় টেগোর এর গান/ নাচ/ নাটক করেছি”. কারণ সাধারণতঃ, “পাড়ার সেই আন্টি শিখিয়ে ছিলেন”।
সাম্প্রতিক কালে, যে কোনো কারণেই হোক (হয়ত আরো বেশি সংখ্যায় শিক্ষিত, বিদগ্ধ উদারমনা মরাঠিদের সাহচর্য পাওয়ার ফলে), দেখছি অনেক মরাঠির ই কালজয়ী বাংলা সাহিত্যের দিকে উৎসাহ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অনেকে কবি লেখকের রচনা নিয়ে তারা অনুষ্ঠান করে। আর একটা কথা না বলে পারছি না, সেদিন একটা মরাঠি শর্ট ফিল্ম দেখলাম, “পুরণপোলি”, কোনো একটি প্রতিযোগিতায় প্রাইজ পাওয়া সিনেমা। পুরণপোলি এক রকম গুড়ভরা মিষ্টি রুটি - এখন দোকানে রোজ পাওয়া গেলেও পালপার্বণের সাথে এর যোগ আছে। প্রথম দু মিনিটেই মনে হল, গল্পটা খুব চেনা। চেনাই বটে- বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “তালনবমী”, প্রায় হুবহু এক, খালি তালের বড়ার জায়গায় পুরণপোলি ও তাল নবমীর জায়গায় দিওয়ালি। স্থান বাংলার জায়গায় বলাই বাহুল্য, মহারাষ্ট্র। টাইটেল কার্ড দু তিন বার দেখলাম, কোথাও বিভূতি ভূষণের নাম নেই। এতটা সমাপতন?
উল্টো দিকে বলবো, মহারাষ্ট্রে আসার আগে একজন মাত্র মরাঠি লেখক বা নাট্যকারের নাম শুনেছিলাম - বিজয় তেন্দুলকার। পুল দেশপান্ডের নামই শুনিনি। প্রশ্ন জাগে, কেন? মরাঠিদের দেখেছি একটু নিজেদের নিয়েই থাকতে। তাহলে কি তারা নিঃশব্দে অন্য সংস্কৃতি কে গ্রহণ করে, কিন্তু নিজেদের সংস্কৃতি অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে অপারগ? তবে হ্যাঁ, গোটা মহারাষ্ট্রে যত বাঙালি আছে, তার হাজার ভাগের এক ভাগের ও কম মরাঠি হয়তো আছে পশ্চিমবঙ্গে। তাই হয়তো প্রচার হয়নি।
"কলিযুগের" কথা
গত কয়েক বছর পশ্চিমবঙ্গে এলেই দেখছি বাংলা সংস্কৃতি মুছে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। খুব সচেতন ভাবে সরকারি পদগুলোতে এমন লোক বসানো হচ্ছে, যারা বাংলা জানে না, বোঝেনা, বা অন্যভাবে বলতে গেলে হিন্দি ছাড়া কোন ভাষা বোঝে না। এবং এদের সঙ্গে প্রাত্যহিক কাজকর্ম চালাতে শহুরে বাঙালির কাছে বিরক্তিকর হলেও গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে অসহায়তা। এখন শুনছি আগে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে কাজ করতে হলে স্থানীয় ভাষা শিখে আসতে হতো, এখন সেই বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করে কোন লাভ হয়নি। আশ্চর্য এটাই লাগে, যে মুখ্যমন্ত্রী বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষাই স্বচ্ছন্দ সুন্দরভাবে বলতে পারেন না, এবং তার ভাষাই হয়তো গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে ট্রাম্প কার্ড, সেখানে তিনি বাংলা ভাষার কোণঠাসা হয়ে যাওয়া সম্বন্ধে উদাসীন থাকেন কি করে!
যাইহোক, প্রতিটি রাজ্যে স্থানীয় ভাষা বাধ্যতামূলক হোক এটা আমার ও দাবি। সেই দাবিটা আরো জোর গলায় বলার জন্য ঠিক করলাম তেইশ বছর তো মরাঠি না শিখে চালিয়ে দিলাম, ঠিক করিনি। ভাষাটা এবার শিখি। একটা অ্যাপ দিয়ে শুরু করেছিলাম। বাজে বললে ভুল বলবো না। কিন্তু ১৫ দিন সেটা ব্যবহার করার পর ভাবলাম এবার ইউটিউবে মরাঠি শর্ট ফিল্ম দেখার চেষ্টা করি। তখনই এলো এক মনোরম চমক।
একটা আশ্চর্য জগতে পা রাখলাম বললে খুব একটা ভুল হবে না। কি সুন্দর সব বাস্তব গল্প, কোনটাই এক ঘেয়ে না। তরুণদের গল্প, প্রৌঢ়দের গল্প, বয়স্কদের গল্প, মাঝে মধ্যে দু একটা শিশু কিশোরদের গল্প ও। শহরের গল্প, গ্রামের গল্প। অফিসের গল্প, ইন্টারভিউয়ের গল্প। একেবারে ছিমছাম সুন্দর, বাড়াবাড়ি সেন্টিমেন্টের সুড়সুড়ি নেই, বাড়াবাড়ি রোমান্স নেই , আঁতলামি নেই, ছ্যাবলামি নেই , যৌনতা ও নেই। তার সঙ্গে খুলে গেল Zee Marathi বা Mirchi Marathi র মত চ্যানেলগুলো। ওমা! এখানে সিরিয়াল গুলোতে তো একান্নবর্তী পরিবারের পলিটিক্স, গুচ্ছ গুচ্ছ ভিলেন, একটা লোকের দুটো বউ, উগ্র মেকআপ ও সাজ পোশাক পুরোপুরি অনুপস্থিত। অনুপস্থিত হিন্দি গান, এবং যেখানে সেখানে পুজো। ওয়েব চ্যানেল গুলোতে রাজনীতি আলোচনার আলাদা অনুষ্ঠান আছে, প্রতিটি গল্পের মধ্যে শুধু শুধু রাজনীতি টানা নেই, ধর্মীয় বিভাজন নেই।
এর মধ্যে একটি চ্যানেলের নাম উল্লেখ করব, ভারতীয় ডিজিটাল পার্টি বা bhadipa। তারা খুব সচেতন এবং সুন্দরভাবে মরাঠি ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগ নিয়েছে। তার জন্য তাদের চ্যানেলে নিত্য নতুন সুন্দর সুন্দর ওয়েব সিরিজ তৈরি হয়। মহারাষ্ট্র যে একটা এত বড় রাজ্য, তার বিভিন্ন অঞ্চলের বৈচিত্র্য নিয়েও তারা মজার ওয়েব সিরিজ তৈরি করে। গ্রামের তরুণ তরুণীদের উদ্যোগী হওয়ার গল্প শোনায় এরা । এদের চ্যানেলেই দেখা দুটো শর্ট ফিল্ম এর কথা বলি: একটাতে দৃশ্যপট মুম্বাইয়ের লোকাল ট্রেন। দুজন যাত্রী নানা বিষয় গল্প করে যাচ্ছে হিন্দিতে। নামার সময় তারা পরস্পরের নাম জিজ্ঞেস করে। একজন খণ্ডেকর, অন্যজন ওয়াংখেড়ে। দুজনেই অবাক হয়ে ভাবছে দুজনেই তো মরাঠি, এতক্ষণ কেন হিন্দিতে গল্প করলাম তাহলে!
অন্য আরেকটিতে দেখলাম, তিন বন্ধুর একজন খুব উত্তেজিত বিরক্ত, কারণ সে একা “মরাঠি ভাষা দিন” উদযাপন নিয়ে ব্যস্ত, বাকি কারোর হেলদোল নেই। অকুস্থলে এক শ্বেতাঙ্গিনী আসে, এবং সে ঝরঝরে শুদ্ধ মরাঠি তে বুঝিয়ে দেয় যে ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে যেমন ইংরেজি শব্দ, কথ্য স্ল্যাং কেও রাখতে হবে, তেমনি শুদ্ধ মরাঠিকেও শুদ্ধ ভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বলে "মরাঠি ভাষা দিন" এর পোস্টার এ "দিন" শব্দে ভুল "দীন " বানান রয়েছে। এ দুটো গল্পই বুঝিয়ে দেয় যে মরাঠি ভাষা ও বাংলা ভাষার মতোই বিপন্ন। ঠাকরেদের লম্ফঝম্প সেই বিপদ কাটাতে পারবে না। কিন্তু এই সব সুন্দর সুন্দর ওয়েব সিরিজের বাস্তব গল্পের জনপ্রিয়তা ওদের মরাঠি অস্মিতাকে লালন করতে সাহায্য করবে।
শুধু নির্ভেজাল নির্মল বিনোদনের পাশে পাশে দেখলাম বহু মরাঠি জন নিজের নিজের চ্যানেল খুলে মরাঠি শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে। কোথাও মাধ্যম হিন্দি, কোথাও বা ইংরেজি আবার কোথাও একসাথে হিন্দি, ইংরেজি, মরাঠি শেখানো চলছে। রোজ নিয়ম করে এই রকম চ্যানেল গুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেই অনেক মরাঠি ভাষা শিখে যাওয়া যায়। এই বিনোদন এবং ভাষা শিক্ষা, দু ধরণের চ্যানেলেরই জনপ্রিয়তা প্রচুর। এর থেকে হয়ত প্রমাণ হয়, গত আট ন বছরে অনেক মরাঠিই নিজ উদ্যোগে, প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে নিজেদের মাতৃভাষা কে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় নেমে পড়েছে। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।
বাঙালির অস্মিতা ও সৃষ্টিশীলতার আকাল
আজ গ্রাম বাংলার ঘাড়ে ও হিন্দি আগ্রাসন চাপানো হচ্ছে, বাঙালি শ্রমিকদের বাংলাদেশী বলে অমানবিক অত্যাচার করা হচ্ছে, শহুরে বাঙালির এ নিয়ে কোন হেলদোল নেই। “আমি শিক্ষিত” এই শ্লাঘার বুলি কপ্চাতে কপ্চাতে মাথা গুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ছে। মহাত্মা গান্ধী যখন হিন্দিকে আন্তর্প্রদেশ যোগাযোগের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার কথা বলেন, রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন এটা প্র্যাকটিক্যাল। তাঁর বাংলা ভাষা নিয়ে সেই মুহূর্তে কোন ভয় ছিল না কারণ তিনি বলেছিলেন যতদিন বাঙালি সৃষ্টিশীল থাকবে ততদিন অন্য ভাষাভাষীরা যত্ন নিয়ে বাংলা শিখবে। তাঁর যুগে বাঙালির সৃষ্টিশীলতা নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিল না। শুধু তার যুগে কেন, তারপরে বেশ অনেকগুলো দশকেও বাঙালির সৃষ্টিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু এখন এসেছে।
বাঙালি নিজেই নিজের ভাষা নিয়ে বোধহয় লজ্জিত, মনে করে হিন্দি ভাষা বাংলার চেয়ে মহত্তর। এইতো সাম্প্রতিক চন্ডালিকা বিতর্কে দেখলাম বাঙালি মনে করছে রবীন্দ্রনাথের গানের চেয়েও বলিউডের হিন্দি গান মহত্তর। ব্যক্তিগতভাবে এই বিতর্ক আমার কাছে নতুন নয়। কয়েক বছর আগে কিছু কলকাতার ছাত্র-ছাত্রীকে দেখেছিলাম চন্ডালিকাকে নিজেদের মতো হিন্দি ভার্সন সর্বভারতীয় কনফারেন্সে উপস্থাপনা করছে। সর্বভারতীয় গুণীজন কিন্তু দেখলাম অনেকেই চন্ডালিকা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল এবং তারা বলল এইরকম ক্লাসিক রচনা অরিজিনাল রবীন্দ্রনাথের আসল রচনা হিসেবে ই উপস্থাপন করা উচিত। এদের মধ্যে অনেক মরাঠি ও ছিলেন। ছিলেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সাইন্সের প্রাক্তন অধ্যায় অধ্যক্ষ প্রখ্যাত বিজ্ঞানী গোবিন্দরাজন পদ্মনাভন, যিনি মৃণালিনী সারাভাই ইত্যাদি সুবিখ্যাত নৃত্যশিল্পী পরিবেশিত অরিজিনাল চণ্ডালিকা দেখেছেন একাধিকবার।
অস্মিতা শব্দটা বাংলার অভিধানে ছিল ব্যবহারে ছিল না। এই শব্দটা এখন মারাঠি দের মত বাংলার প্রতিদিনের শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঙালির অধিকার, বাংলা ভাষার অধিকার নিয়ে লড়াই অবশ্যই করা উচিত কিন্তু বাংলা ভাষাকে অশুদ্ধ থেকে অশুদ্ধতর করে আর সৃষ্টিশীলতা হারিয়ে এই লড়াই কত দিন টিকবে? "মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা" বলাটা যে প্রাদেশিকতা নয়, সেই বিশ্বাস টা কি সৃষ্টিশীল মরাঠিদের কাছ থেকে বাঙালি শিখতে পারে না?