সালটা তখন ১৯৬৮। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহর জুড়ে চলেছে গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন সংস্কারের দাবিতে জনগণের ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদের ঝড়। গোটা দেশটাই এক দারুণ রাজনৈতিক অস্থিরতার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। সে সময় গর্ভপাত আইন খতিয়ে দেখার এবং নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব ছিল রাজ্যগুলোর উপর, ফেডারেল সরকারের উপর নয়। মহিলাদের গর্ভপাতের অধিকার ছিল অত্যন্ত সীমিত, সে ব্যাপারে ছিল দারুণ আইনি কড়াকড়ি, ফলস্বরূপ বিপুল সংখ্যক অনিরাপদ, অবৈধ গর্ভপাত এবং অকাল প্রাণহানি --সব মিলেমিশে রাজ্যগুলো তাদের গর্ভপাত সম্বন্ধীয় আইন পরিবর্তনের জন্য দেশব্যাপী জনরোষের মুখে পড়েছিল।
এমনই এক দ্রোহকালে শিকাগো শহরতলির এক গর্ভবতী গৃহবধূ জয় তার স্বামী ও মেয়ের সাথে একটা সাধারণ জীবনযাপন করছিল। কিন্তু জয়ের এই দ্বিতীয় গর্ভাবস্থা তাকে একটু একটু ক’রে প্রাণঘাতী হৃদরোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, গর্ভপাত করানো ভিন্ন তার সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়াল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ অংশেই গর্ভপাত তখন অবৈধ, এবং জয়ের মামলা পর্যালোচনা করার জন্য পুরুষ ডাক্তারদের যে প্যানেল নিযুক্ত করা হয়েছিল তাঁরা কিছুতেই জয়ের গর্ভাবস্থার ইতি টানতে রাজি হন না, এমনকি তার জীবন বাঁচাবার জন্যও নয়। সমস্যার সমাধানের জন্য জয় যখন দৌড়াদৌড়ি করছে, তখনই "জেন কালেক্টিভ" ব’লে শিকাগোর এক গুপ্ত সংস্থার সাথে তার পরিচয় হয়, চেনা হয় দুই অসাধারণ মহিলার সাথে--ভার্জিনিয়া ও গোয়েন। ভার্জিনিয়া নারীর স্বাস্থ্যের প্রতি দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আর গোয়েন প্রতিনিয়ত এমন এক দিনের স্বপ্ন দেখেন যখন সমস্ত মহিলার গর্ভপাতের সুযোগ থাকবে, সে তাদের আর্থিক সামর্থ্য যাই হোক না কেন। ভার্জিনিয়াদের কর্মকান্ড জয়কে এতটাই অনুপ্রাণিত করে যে, নিজের জীবনকে সমস্ত রকম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়ে সে তাঁদের সাথে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই যে সিনেমাটার কথা এতক্ষণ বললাম, তার নাম "কল জেন''। ৬০-এর দশকের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পটভূমিকায়, মার্কিন মেয়েদের স্বাস্থ্যসেবার ধারণাটির পুনর্কল্পনা করার সাহস দেখানো একদল মহিলার গল্প।
ভাবছেন আজকের আলোচনায় কেন এই পুরোনো দিনের ছায়াছবির গল্পের অবতারণা?
অতীতের গর্ভেই বর্তমানের জন্ম, প্রতিটি ঘটনাই পূর্ববর্তী ঘটনার ফলস্বরূপ ঘটে এবং এটিই ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হয়, যা সময়ের একটি অবিচ্ছেদ্য প্রক্রিয়া। তাই, আমাদের আজকের আলোচনার প্রেক্ষাপটে এই সিনেমার রূপকল্প খুবই প্রাসঙ্গিক। ১৯৬৮ সাল ও তার পরবৰ্তী বছরগুলোতে সংঘটিত মার্কিন নারী মুক্তি আন্দোলনের চলমান বিক্ষোভ জনসাধারণ এবং রাষ্ট্রের আইনি দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়, এমন একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করে, যা আমেরিকান সুপ্রিম কোর্টের পক্ষেও বিষয়টিকে আর উপেক্ষা করা অসম্ভব করে তুলেছিল। এই যুগসন্ধিক্ষণে যে ঐতিহাসিক আইনি লড়াইটি সবার দৃষ্টি কেড়েছিল, তা দিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা শুরু হোক।
সেটা ছিল ১৯৭০ সালের মার্চ মাস। টেক্সাস নিবাসী গর্ভবতী নর্মা ম্যাককরভে ওরফে ছদ্মনাম্নী ''জেন রো'' টেক্সাসের গর্ভপাত আইনকে চ্যালেঞ্জ ক’রে ডালাস কাউন্টির জেলা অ্যাটর্নি হেনরি ওয়েডের বিরুদ্ধে একটা মামলা দায়ের করেন। বাদী রো তাঁর বক্তব্যে পেশ করেন যে, টেক্সাসের গর্ভপাত আইন যা একজন মহিলার জীবন বাঁচানো ছাড়া গর্ভপাতকে অবৈধ ঘোষণা করে, তা অসিদ্ধ কারণ সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর ''ডিউ প্রসেস ক্লজের'' ভিত্তিতে একজন মহিলার গর্ভপাতের গোপনীয়তার অধিকার আগে থেকেই ফেডারেল আইন দ্বারা সুরক্ষিত রয়েছে ।
প্রায় তিন বছরের টানাপোড়েনের পর, ১৯৭৩ সালে গর্ভপাতকে বৈধ ঘোষণা ক’রে, ৭-২ ভোটে জেন রো’র পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট তাদের যুগান্তকারী রায় জারি করে । এই রায়ের মাধ্যমে একদিকে যেমন গর্ভবতী মহিলার গোপনীয়তার অধিকার রক্ষিত হয়, অপরদিকে তেমনি মাতৃস্বাস্থ্য এবং ভ্রূণের জীবন রক্ষায় রাষ্ট্রের স্বার্থও বজায় থাকে। গর্ভপাতকে অপরাধের কালিমা থেকে মুক্ত করে এই রায়, এবং গর্ভপাত বিষয়ে রাজ্য আইন প্রণয়নের জন্য একটি ফেডারেল কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে।
নিজেদের শরীরের উপর স্বায়ত্তশাসন এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মার্কিন রমণীরা বিজয়োল্লাসে মেতে ওঠে, কিন্তু দক্ষিণ-পন্থী (রিপাবলিকান) ও ধর্মীয় রক্ষণশীলরা এই রায়ের কট্টর বিরোধিতা করে । গর্ভপাতের অধিকারের সীমাবদ্ধতা এবং শেষ পর্যন্ত তা রদ করার জন্য তাদের চিরাচরিত প্রচেষ্টা তারা চালু রাখে। এই প্রচেষ্টার মধ্যে ছিল রক্ষণশীল বিচারক নিয়োগ, রাজ্য-স্তরের বিধিনিষেধের জন্য চাপ দেওয়া এবং গর্ভপাতের সুযোগের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
এরপর ১৯৯২ সালের ''প্ল্যানড প্যারেন্টহুড বনাম কেসি'' মামলার সিদ্ধান্তটিও "রো বনাম ওয়েড" মামলার পথেই হাঁটে এবং দেশব্যাপী গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকারকে আরও একবার জোরদার করে তোলে। সত্যি বলতে কি "রো বনাম ওয়েড" লিঙ্গ সমতা এবং প্রজনন অধিকারের অগ্রগতির জন্য যেমন একটা মাইলফলকের ভূমিকা পালন করেছে, ঠিক তেমনি এটি আমেরিকান সমাজে গর্ভপাত নিয়ে চলমান বিতর্ককেও ক্রমাগত উস্কানি দিয়ে এসেছে।
এভাবেই চলল বেশ কিছু বছর। কিন্তু ২০১৮ সালের মার্চ মাসে, মিসিসিপি রাজ্য তাদের "গর্ভকালীন বয়স আইন" প্রণয়ন করে। এই আইনে বলা হয় যে, কেবলমাত্র চিকিৎসাগত জরুরি অবস্থা ব্যতিরেকে গর্ভধারণের ১৫ সপ্তাহের পরে সমস্ত রকমের গর্ভপাত মিসিসিপিতে নিষিদ্ধ। এই আইনকে কেন্দ্র করে আবার সমস্যার কালো ছায়া ঘনিয়ে আসে। জ্যাকসন শহরে অবস্থিত মিসিসিপির শেষ গর্ভপাত ক্লিনিক, "জ্যাকসন উইমেন্স হেলথ অর্গানাইজেশন" ওরফে "পিঙ্ক হাউস" এবং সেখানকার একজন ডাক্তার মিসিসিপির এই আইনকে চ্যালেঞ্জ ক’রে, মিসিসিপির তদানীন্তন রাজ্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তা টমাস ডবসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এই মামলাটি সকলের কাছে "ডবস বনাম জ্যাকসন উইমেন্স হেলথ অর্গানাইজেশন" নামে পরিচিতি পায় ।
প্রথমে মিসিসিপির দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা আদালত এবং পরে পঞ্চম সার্কিট কোর্ট অফ আপিল উভয়েই রায় দেয় যে মিসিসিপির ১৫ সপ্তাহের গর্ভপাত নিষেধাজ্ঞা অসাংবিধানিক কারণ এটা ''রো বনাম ওয়েড'' এবং ''প্ল্যানড প্যারেন্টহুড বনাম কেসি''র দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ভ্রূণের কার্যকারিতার (ফিটাল ভায়াবিলিটি) আগ পর্যন্ত মহিলাদের গর্ভপাতের অধিকারকে লঙ্ঘন করে। সুতরাং নিম্ন আদালতগুলো যে জ্যাকসন মহিলা স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষে ছিল তা বুঝতে অসুবিধা হয় না, এমনকি তারা মিসিসিপি রাজ্যকে এই আইন প্রয়োগ করা থেকে বিরত রাখার নির্দেশও দেয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও, ২০২১ সালের মে মাসে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে চলে যায়।
জনান্তিকে বলে রাখা ভালো যে, ১৯৮০ সাল থেকেই, দক্ষিণের বেশিরভাগ অংশের মতোই মিসিসিপি ব্যাপকভাবে রিপাবলিকান, গর্ভপাতের অধিকার সীমিত করার জন্য বহু বছর ধরেই রাজ্যকর্মকর্তারা ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন, যেন তেন প্রকারেণ "রো বনাম ওয়েড"কে নস্যাৎ করার জন্য ফন্দিফিকির খুঁজছিলেন। তাঁরা ভালো করেই জানতেন যে তাঁদের প্রণীত আইনটি অসংবিধানিক ছিল, কিন্তু ততদিনে সুপ্রিম কোর্টে একটা রক্ষণশীল বাতাবরণ কায়েম হয়েছিল আর মিসিসিপি অবিলম্বে ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছিল।
এর পরের চাঞ্চল্যকর ঘটনার সাক্ষী মহাকাল। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাদী বিবাদী দুইপক্ষের মৌখিক সওয়াল-জবাব উপস্থাপিত হয় এবং ২০২২ সালের ২৪শে জুন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে যে, মার্কিন সংবিধান মোটেই মহিলাদের গর্ভপাতের অধিকার প্রদান করে না। সুপ্রিম কোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে, ‘’রো বনাম ওয়েড’’ এবং প্ল্যানড প্যারেন্টহুড বনাম কেসির মামলা বাতিল করে দেয়। রাজ্য সরকারের হাতে গর্ভপাত নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই নতুন রায় মার্কিন রমনীদের প্রায় ৫ দশকের গর্ভপাতের সুরক্ষিত উত্তরাধিকার নিমেষেই ছিনিয়ে নিল। মহিলাদের শারীরিক স্বায়ত্তশাসন এবং গোপনীয়তার সাংবিধানিক অধিকার খর্ব হলো। নারী ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ক্ষতি করে এবং সম্ভাব্যভাবে সম্পর্কিত অন্যান্য স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবাতে সরকারের হস্তক্ষেপকে বস্তুত ব্যক্তিগত স্বাধীনতার লঙ্ঘন হিসাবে চিহ্নিত করাটা মোটেই অতিরঞ্জিত হবে না।
এই মামলার রায়ের শুনানির পরই আমেরিকার সর্বত্র ব্যাপক বিক্ষোভ, আইনি মোকাবিলা, গর্ভপাত নিষিদ্ধ বা কঠোরভাবে সীমাবদ্ধ করার জন্য রাজ্যগুলোর ভিতরে ইতোমধ্যেই বিদ্যমান গর্ভপাত আইনের জোড়াতালি দেওয়ার ধুম পড়ে যায়। এই সিদ্ধান্তের ফলে গর্ভপাত ক্লিনিকগুলি রাতারাতি তাদের ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়, হেলথ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো জটিল নতুন আইনের মারপ্যাঁচ সম্বন্ধে সড়গড় হওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে এবং গর্ভনিরোধ এবং আইভিএফের মতো অন্যান্য সহায়ক প্রজনন অধিকার সম্পর্কে জনগণের মাঝে এক দারুণ অনিশ্চয়তর সৃষ্টি হয়। মানুষের প্রতিক্রিয়াও নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় ---, গর্ভপাত অধিকার সমর্থকরা মহিলাদের বিশেষ করে প্রান্তিক সম্প্রদায়ের নারীদের স্বাস্থ্য এবং সমৃদ্ধির উপর এই মামলার অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, বিরোধীরা অবশ্য গর্ভপাতের ক্ষেত্রে ফেডারেল সুরক্ষার অবসানে যার-পর-নাই খুশি প্রকাশ করে।
‘’রো বনাম ওয়েডে’’র বাতিলের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, ২০২২-এর জুলাই এবং আগস্ট মাসে বাইডেন প্রশাসন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবার সুরক্ষা এবং সম্প্রসারণের জন্য বেশ কয়েকটি নির্বাহী আদেশ এবং নির্দেশিকা জারি করে। তার মধ্যে নির্বাহী আদেশ ১৪০৭৬ ও ১৪০৭৯ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৪০৭৬ আদেশটি গর্ভপাতের প্রচার ও তহবিল প্রদান এবং গর্ভপাত ক্লিনিক প্রবেশাধিকারের স্বাধীনতা আইন প্রয়োগের রাজনীতিকরণের জন্য একটি সম্পূর্ণ সরকারি প্রচেষ্টা আরোপ করে। আর ১৪০৭৯ গর্ভপাতকে "স্বাস্থ্যসেবা" হিসেবে পুনঃশ্রেণীবদ্ধ করেছে যাতে ঐচ্ছিক গর্ভপাতের জন্য করদাতাদের তহবিল প্রদান করা অনূদিত হয়।
‘’রো বনাম ওয়েড’’ মামলার পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজ্যভেদে গর্ভপাতের সুযোগের দৃশ্যপট উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। অনেক রাজ্যের আইনসভাই নতুন নতুন গর্ভপাত বিধিনিষেধ তৈরি করেছে এবং অনেকে আবার বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞাগুলি কার্যকর করতে শুরু করেছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, কিছু রাজ্য গর্ভপাত পুরোপুরি নিষিদ্ধ বা অত্যন্ত কঠোরভাবে সীমাবদ্ধ করেছে; আবার কিছু রাজ্যে গর্ভাবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে (৬, ১২, ১৮ সপ্তাহ বা ভ্রূণের প্রায় কার্যকর হওয়ার মতো সময় অর্থাৎ ২৪ সপ্তাহের কাছাকাছি) গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা হয়েছে, অন্যরা আবার গর্ভপাতের সুযোগ বজায় রেখেছে বা প্রসারিত করেছে। মোদ্দা কথা গর্ভপাতের জন্য নির্দিষ্ট গর্ভকালীন বয়সসীমা সম্পূর্ণরূপে সেই রাজ্যের উপর নির্ভর করে যেখানে এই প্রক্রিয়াটি চাওয়া হচ্ছে।
একটা ব্যাপার কিন্তু লক্ষণীয় যে, যখন ‘’রো বনাম ওয়েড’’ মামলাটি বাতিল করা হয়, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসাবে আসীন ছিলেন জো বাইডেন। ক্রমবর্ধমান প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সংকটের মধ্যেও মহিলাদের গর্ভনিরোধন ও গর্ভপাতের সুযোগ রক্ষার উপর বাইডেন প্রশাসনের যথেষ্ট দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল এবং তার জন্য যথোপযুক্ত নির্বাহী আদেশ বলবৎ ছিল । অথচ সেই জমানাতেই সুপ্রিম কোর্টের রায় দেশব্যাপী গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকারকে শেষ ক’রে দিতে সক্ষম হয়। অবাক হওয়ার মতো ঘটনাই বটে! আসলে এটা রিপাবলিকানদের দশকব্যাপী চাপের ফলাফল, যা শেষ পর্যন্ত বাইডেন প্রশাসনের আমলেই পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়।
প্রশ্ন জাগে কীভাবে হলো এই অঘটন? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের কাঠামো সম্বন্ধে দু চার কথা জেনে নেওয়া যাক। সুপ্রিম কোর্টে একজন প্রধান বিচারপতি এবং আটজন সহযোগী বিচারপতি থাকেন, প্রধান বিচারপতি আদালতের নেতৃত্ব দেন এবং ফেডারেল বিচার বিভাগে একটি অনন্য ভূমিকা পালন করেন; তবে মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নয়জন বিচারপতিরই সমান ভোটাধিকার থাকে। বিচারপতিরা প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত হন এবং সিনেট কর্তৃক অনুমোদিত হন, তারপর মৃত্যু, পদত্যাগ বা অভিশংসন পর্যন্ত তাদের পদে বহাল থাকেন। এখানে মনে রাখতে হবে যে, মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের গঠন পরিবর্তনশীল , যা কেবলমাত্র প্রেসিডেন্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না, প্রেসিডেন্ট এবং সিনেট উভয়ের যুগ্ম মনোনয়নই সেখানে প্রাধান্য পায়।
‘’ডবস বনাম জ্যাকসন’’মামলার সময় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন জন রবার্টস; সহযোগী বিচারপতি হিসাবে ছিলেন স্যামুয়েল আলিটো, ক্ল্যারেন্স থমাস, স্টিফেন ব্রেয়ার, সোনিয়া সোটোমায়র, এলেনা কাগান, নীল গোরসাচ, ব্রেট কাভানাঘ এবং অ্যামি কোনি ব্যারেট। ওই মামলায় গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার রহিত করার পক্ষে মতামত দেন পাঁচ জন বিচারক- গোরসাচ,কাভানাঘ, ব্যারেট- আলিটো, ও থমাস; আর বিপক্ষে ভোট দেন তিনজন- ব্রেয়ার, সোটোমায়র, এবং কাগান। প্রধান বিচারপতি রবার্টস মামলার পক্ষে থাকা পাঁচ বিচারপতির সিদ্ধান্তের সাথেই সহমত পোষণ ক’রে তাঁর মতামত লিপিবদ্ধ করেন। ফলস্বরূপ, ৬-৩ ব্যবধানে গোরসাচরা জয় লাভ করেন। সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীল বিচারপতিদের এই সংখ্যাগরিষ্ট হয়ে ওঠাটাই ছিল ‘’রো বনাম ওয়েড’’ মামলার পতনের কেন্দ্রীয় কারণ।
এই পরিকল্পনা রূপায়িত হওয়ার সময়রেখাটা কেমন ছিল, আসুন সেটা একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক। ২০১৬ সালের নভেম্বর নির্বাচনের সময়, রিপাবলিকান দলের মনোনীত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। ভোটের প্রচারাভিযানের সময় থেকেই ট্রাম্প ভোটারদের ক্রমাগত প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন যে, তাঁর দল ক্ষমতা জিতলে, প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি সুপ্রিম কোর্টে এমন বিচারক নিয়োগ করবেন যাঁরা 'রো বনাম ওয়েড' মামলাটি বাতিল করতে সফল হবেন।
ভোটে রিপাবলিকানদের জয় হয়, ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারিতে ৪৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প তাঁর প্রথমবারের শপথ গ্রহণ করেন। সকলের কাছে তখন থেকেই এটা পরিষ্কার হয়ে গেছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাতের আইনি অবস্থায় এবার একটা ভালোরকম পরিবর্তন আসতে চলেছে। কার্যভার গ্রহণ করার পর পরই, এপ্রিল ১০, ২০১৭-তে, ট্রাম্প রক্ষণশীল বিচারপতি নীল গোরসাচকে সুপ্রিম কোর্টে নিযুক্ত করেছিলেন। এরপর জুলাই, ২০১৮-তে ব্রেট কাভানা এবং সেপ্টেম্বর ২০২০-তে অ্যামি কোনি ব্যারেটের মনোনয়নও কার্যকরী করেন ট্রাম্প । ট্রাম্পের পছন্দের এই তিন বিচারপতি, আরও দুইজন রক্ষণশীল বিচারকের সাথে হাত মিলিয়ে, ''রো বনাম ওয়েড'' কে উৎখাতের পক্ষে ভোট দেন । সুতরাং ট্রাম্পের সহায়তাতেই যে ''রো বনাম ওয়েড'' মামলাটি নাটকীয়ভাবে বাতিল হলো, তা বুঝতে নিশ্চয়ই এখন আর কোনো সংশয় নেই। ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প সুযোগ পেলেই ''রো বনাম ওয়েড'' মামলাটি উল্টে দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর নিজের কৃতিত্ব সর্বসমক্ষে জাহির করেছেন। এখানে বিশেষ করে বলা জেতে পারে যে, ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা বিচারপতি মেরিক গারল্যান্ডকে সুপ্রিম কোর্টে আনতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা মিচ ম্যাককনেল ওবামার এই মনোনয়ন আটকে দেন এবং ২০২০ সালের নির্বাচনের ঠিক মুখটাতেই তড়িঘড়ি ক’রে ব্যারেটের নিয়োগ নিশ্চিত করেন।
২০১৭ সালে, রাষ্ট্রপতি হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলির মধ্যে একটি ছিল ‘’মেক্সিকো সিটি নীতি’’র পুনঃস্থাপন এবং সম্প্রসারণ। সমালোচকদের কাছে এটি "গ্লোবাল গ্যাগ রুল" নামে পরিচিত। এই নীতি পরিবর্তনের ফলে আইনি গর্ভপাত পরিষেবা প্রদানকারী, প্রচারকারী বা সমর্থনকারী আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলির জন্য মার্কিন বিশ্ব স্বাস্থ্য তহবিল বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি যদি সেই কার্যক্রমগুলি তাদের নিজস্ব, অ-মার্কিন অর্থ দ্বারাও পরিচালিত হয়ে থাকে।
‘’রো বনাম ওয়েড’’ মামলা বাতিলের সিদ্ধান্তের পর যেহেতু রাজ্য পর্যায়ে গর্ভপাত নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে, তাই অনেক রাজ্যই ভোটারদের মতামতের জন্য গর্ভপাতের বিষয়টিকে ব্যালটে জায়গা দিয়েছে। ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনের সময় ব্যালটে তাই শুধু দেশের রাষ্ট্রপতির পছন্দ নয়, গর্ভপাতের অধিকারও একটা অন্যতম গুরুত্বর্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ছিল। এই নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার সময় মহিলাদের প্রজনন অধিকারে বিশ্বাসী, ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কমলা হ্যারিস অঙ্গীকার করেছিলেন যে, নির্বাচিত হলে তিনি নারীর প্রজনন অধিকার রক্ষায় একটি জাতীয় আইন পাস করবেন। অন্যদিকে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প গর্ভপাতের বিষয়ে ভোট প্রচারণার সময় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রেখেছেন। যদিও তিনি বলেছিলেন যে গর্ভপাত বিষয়ে ফেডারেল নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তিনি ভেটো দেবেন, কিন্তু বিতর্কের সময় যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তার ডেস্কে এমন কোনো খসড়া পৌঁছালে তিনি তাতে স্বাক্ষর করবেন কিনা তখন তিনি প্রায়শই সরাসরি উত্তর দেওয়া এড়িয়ে যান। ঠিক একইভাবে, গর্ভপাতের ওষুধ মাইফেপ্রিস্টোনের অ্যাক্সেস এবং গর্ভপাতকারিনীদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়েও তিনি জনগণকে মিশ্র সংকেত দেন। ট্রাম্পের প্রাক-নির্বাচনী বার্তায় ধোঁয়াশা থাকলেও, তাঁর দলের গর্ভপাত বিরোধী কিছু কৌশলবিদ যে নতুন আইন ছাড়াই দেশব্যাপী গর্ভপাত কার্যকরভাবে নিষিদ্ধ করার জন্য ১৯ শতকের ‘’কমস্টক’’ আইন ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছিলেন, এ কথা কিন্তু আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের কাছে চাপা থাকেনি। ট্রাম্প শুধু প্রকাশ্যে এসব নথি থেকে নিজের দূরত্ব বজায় রেখে চলেছিলেন। আচ্ছা, গর্ভপাত বিষয়ে ট্রাম্পের সেই সময়কার ভাসা ভাসা উত্তরগুলো কি তাহলে সব লোক দেখানো, ভোটের প্রাক্কালে সংবেদনশীল বিষয় থেকে নাড়াঘাঁটা না করার অছিলা ছিল? কে জানে!
এর পরের ঘটনা আমরা সকলেই জানি। কমলা হ্যারিস নির্বাচনে হেরে যান। ট্রাম্প দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন এবং ২০ জানুয়ারী, ২০২৫ তারিখে দেশের ৪৭তম এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনরায় দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। সিংহাসনে বসেই, জানুয়ারির ২৪ তারিখে বাইডেনের ২০২২ সালের নির্বাহী আদেশ ১৪০৭৬ এবং ১৪০৭৯ কার্যকরভাবে বাতিল ক’রে ‘’এনফোর্সিং দ্য হাইড অ্যামেন্ডমেন্ট" শিরোনামে তাঁর কার্যনির্বাহী আদেশ' জারি করেন ট্রাম্প। ''হাইড অ্যামেন্ডমেন্ট'' ঐচ্ছিক গর্ভপাতের জন্য ফেডারেল করদাতাদের ডলার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। এই আইনটি কিন্তু নতুন কিছু নয়, ১৯৮০ সালে এটি প্রথম কার্যকর হয়েছিল। গর্ভপাতের অ্যাক্সেস সীমিত করার জন্য ট্রাম্প এই পুরোনো নীতিকে আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠা করলেন।
২০২৫ সালের শেষের দিকে, যে ১২টি রাজ্যে গর্ভপাত সম্পূর্ণরূপে, অথবা গর্ভকালীন ৬ সপ্তাহের কাছাকাছি গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলো হল এলাবামা, আরকানসাস, আইডাহো, কেনটাকি, লুইসিয়ানা, মিসিসিপি, ওকলাহোমা, নর্থ ডাকোটা, সাউথ ডাকোটা, টেনেসি, টেক্সাস এবং ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া। টিপ্পনি হিসাবে এখানে যোগ করা যেতে পারে যে, প্রায়শই, ছয় সপ্তাহের আগে, একজন নারী নিশ্চিতরূপে জানেন না যে তিনি গর্ভবতী হয়েছেন, এই রাজ্যগুলোতে গর্ভপাত নিয়ে যে খুব কড়াকড়ি আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সকলের মনেই এক বিশাল প্রশ্ন: ওয়াশিংটনে ক্ষমতায় আসা জিওপি গর্ভপাত সম্বন্ধে ঠিক কেমনতরো ভূমিকা পালন করতে চলেছে? বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, আগামী বছরগুলিতে গর্ভপাতের অ্যাক্সেসকে সরাসরি নিষিদ্ধ না করে জাতীয়ভাবে তা সীমাবদ্ধ করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো নতুন কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারেন । গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টির কার্যকলাপের দিকে চোখ রাখলেই হয়তো আমাদের প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যতে ঠিক সময়ে মিলে যাবে।
তথ্যসূত্র:
"The Post-Dobbs Dystopian Future Is Here". Nia-Malika Henderson. December 14, 2023. Bloomberg.
"Failed Virginia Bill Sparks National Debate About Abortion". Sarah McCammon. January 31, 2019. NPR, All Things Considered.
"Roe v Wade: a philosopher on the true meaning of ‘my body, my choice". Fiona Woollard. The Conversation. Com. July 1, 2022