জাতি ও ধর্মের নামে বিভেদ, অত্যাচার আর নৃশংসতা মানব সভ্যতার ইতিহাসে কোনো নতুন কথা নয়। এরই এক জ্বলজ্যান্ত নজির স্থাপন করেছে মিয়ানমার (সাবেক বার্মা)। সংখ্যাগরিষ্ঠ এই বৌদ্ধ রাষ্ট্র থেকে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঝেঁটিয়ে খেদানোর বর্বরতাও কোনো বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। এর মূল প্রোথিত আছে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিগত বেশ কয়েক দশকের রাষ্ট্রীয় দমন, বৈষম্য এবং সহিংসতার প্রলম্বিত ইতিবৃত্তে। সর্বহারা রোহিঙ্গাদের পরভূমে পলায়নের সুদীর্ঘ সময়চক্রের ঐতিহাসিক পযালোচনা বড়োই মর্মন্তুদ, বড়োই আতঙ্কময় এবং হতাশাব্যঞ্জক। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার বর্তমান দশা জানতে গেলে সেই ইতিহাস পর্যালোচনা না করলেই নয়।
মিয়ানমার থেকে সবচেয়ে বড় সংখ্যায় রোহিঙ্গা প্রস্থানের মর্মান্তিক ঘটনাটি ২০১৭ সালে সংঘটিত হয়েছিল যখন এক ধাক্কায় ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল, কিন্তু সেটা আরাকান রাজ্য থেকে ১৯৭৮ সালে শুরু হওয়া উদ্বাস্তু অনুপ্রবেশের ধারাবাহিকতাকেই মাত্র চিহ্নিত করে, যখন সামরিক অধিকর্তা জেনারেল নে উইনের সমাজতান্ত্রিক শাসনের সময় উত্তর আরাকানে তাতমাদো সর্ব প্রথম ‘’অপারেশন ড্রাগন কিং’’ ওরফে ''অপারেশন নাগা মিন'' শুরু করে।
১৯৮২-তে নে উইন জাতিসত্তার ভিত্তিতে এক নতুন নাগরিকত্ব আইন প্রচলন করেন যেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে, বৈষম্যমূলক পদ্ধতিতে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বাদ দেওয়া হয়। সেই আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে মিয়ানমার সরকার। ফলস্বরূপ রোহিঙ্গারা কার্যত রাষ্ট্রহীন হয়ে যায়; নাগরিকত্বহীনতার কারণে তারা জাতীয় সুরক্ষা ও হারায়।
১৯৯১-তে সামরিক জান্তার অধীনস্থ রাজ্য আইন ও শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার কাউন্সিল (স্টেট ল এন্ড অর্ডার রেস্টোরেশন কাউন্সিল- SLOC) আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর রাখাইন রাজ্যে ''অপারেশন ক্লিন অ্যান্ড বিউটিফুল নেশন'' ওরফে ''অপারেশন পাই থায়া'' চালু করে । রোহিঙ্গা সংহতি সংস্থার (RSO) সামরিক সম্প্রসারণের প্রতিক্রিয়া হিসাবেই মূলত তাতমাদো* র এই ব্যাপক সহিংস সামরিক অভিযান সংঘটিত হয়। বাধ্যতামূলক কাজ, জোরপূর্বক স্থানান্তর, ধর্ষণ, কথায় কথায় মৃত্যুদণ্ড এবং নির্যাতনের শিকার হতে হয় রোহিঙ্গাদের। ফলস্বরূপ, ১৯৯১ এবং ১৯৯২ সালের মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এদের মধ্যে ১৯৯২ সালে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন করে। রোহিঙ্গারা ফিরে আসতে শুরু করলে, রোহিঙ্গাদের হয়রানি ও নিপীড়নের জন্য সরকার ''নাসাকা'' নামে একটি বিশেষ সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী তৈরি করে। জোরপূর্বক শ্রম, বিবাহ নিষেধাজ্ঞা, জমি দখল এবং শারীরিক নির্যাতন সবই রাখাইন রাজ্যের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে।
২০১২ সালের মাঝামাঝি- ২৮ শে মে, সেই ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনাটা ঘটে যখন একজন বৌদ্ধ মহিলাকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে তিনজন রোহিঙ্গা পুরুষকে দায়ী করা হয়। বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে, এই ঘটনার প্রতিশোধ নেয়। মুসলিম বিরোধী সহিংসতা শুরু হয়, রোহিঙ্গা ও জাতিগত বৌদ্ধ রাখাইনদের মধ্যকার সহজীবী সম্পর্ক ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়, যখন কর্তৃপক্ষ শত শত রোহিঙ্গাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যেতে নিষেধ করে, শান্তি.বজায় রাখার নামে যা ছিল জাতিগত বিচ্ছিন্নতা মদত দেওয়ার একটি আরোপিত ব্যবস্থাগত অংশ। বস্তুত সেদিন থেকেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আগুন ধূমায়িত হতে শুরু করে। সঙ্গবদ্ধ সন্ত্রাসের পরিকল্পনা তলে তলে দানা বাঁধতে শুরু করে। রাজ্যের উচ্চ শিক্ষায়তন, সিত্তওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়–একমাত্র যেটি রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীদের গ্রহণ করত, সেটিকে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবশ্য সিত্তওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া নিষেধ করার অনেক আগে থেকেই রোহিঙ্গাদের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডাক্তারি সহ কিছু বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনে রীতিমতো বাধা দিয়ে এসেছে মিয়ানমার সরকার। তার উপর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য ভ্রমণের অনুমতি পাওয়াই অনেক রোহিঙ্গার জন্য অসম্ভব হয়ে উঠেছিল । আর কে না জানে শিক্ষায় অগ্রগতির অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া মানেই একটা জাতির সার্বিক উন্নতির মুলে কুঠারাঘাত করা! রাখাইন রাজ্য অশান্ত হয়ে ওঠে। রোহিঙ্গাদের পুরনো পরিচয়পত্রগুলো ফেরত নিয়ে সেগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়, সনাক্তকরণের নতুন কাগজ চালু করা হয় যেখানে স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের প্রবেশাধিকার মারাত্মকভাবে সীমিত করে দেওয়া হয়। শুধু এতেই থেমে থাকেনি সরকারি অত্যাচার– দেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের চলাচল সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা হয় । বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জায়গা নির্দিষ্ট হয় সিত্তওয়ে শহরের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে। সেখানে কাঁটাতারের বেড়া এবং সামরিক চেকপয়েন্ট দিয়ে সিল করে দেওয়া ২৪ টি বিক্ষিপ্ত অস্থায়ী তাঁবু ওরফে ক্যাম্পে (থেত কায়ে পাইন, বাসরা, অহন তাও জিয়া, খাউং ডোকে খার ইত্যাদি) বস্তুত বন্দী করে রাখার ব্যবস্থা করা হলো রোহিঙ্গাদের; ৩৬,৭৬২ বর্গ কিলোমিটারের রাখাইন রাজ্যের বাকি জনসংখ্যা থেকেও জোরপূর্বক তাদের আলাদা করে দেওয়া হলো। এ যেন এক নতুন কায়দার গ্রামীণ ঘেটো, এই ছিটমহলের বাইরে বেরোবার সবরকম স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হলো রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে। রোহিঙ্গাদের চলাচল সীমিত করার জন্য কর্তৃপক্ষ একযোগে অগুনতি চাপ আরোপ করে - কারফিউ, কঠোর অনুমতি পদ্ধতি, পুলিশ এসকর্ট, হয়রানি–কিচ্ছু বাদ থাকে না। সারা দেশে একরকমের আইন, আর রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা সব স্থানীয় আদেশ, বিধিনিষেধ; এর উপর কর্তাব্যক্তিদের মর্জিমাফিক অনুযায়ী যখন তখন চাঁদাবাজি, ঘুষ, নতুন নতুন হুমকি আর যথেচ্ছ খুনখারাবি– এইভাবেই জীবন্মৃত অবস্থায় স্বেচ্ছাচারী সরকারের বৈষম্যমূলক, বর্ণবাদ-দুষ্ট নিয়মকানুনের ঘেরাটোপে বন্দিশিবিরে রোহিঙ্গারা তাদের দিন গুজরান করছিল।
২০১৬ সালের ৯-ই অক্টোবর রোহিঙ্গা পুরুষদের একটি ছোট দল (যা পরে ARSA নামে পরিচিত হয়) রাখাইন রাজ্যে বার্মিজ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তিনটি পুলিশ ফাঁড়িতে, গৃহস্থালি ছুরি, পাথর এবং ঘরে তৈরি বিস্ফোরক ইত্যাদি নিয়ে সেই প্রথম এক সমন্বিত হামলা চালায়; নয়জন বার্মিজ অফিসার তাতে মারা যায়। এর জবাবে, ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী "ক্লিয়ারেন্স অপারেশন" নাম দিয়ে উত্তর রাখাইনের এক ব্যাপক সহিংস প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করে। এক হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বেসামরিক লোক নিহত হয়। প্রায় ৮৬,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আর যারা থেকে যায় তাদের ওপর মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী খড়গহস্ত হয়ে ওঠে।
২০১৭ সালের শুরু থেকেই, বিদ্রোহী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে ছেঁড়া ছেঁড়া সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। ঘটনা চূড়ান্তে পৌঁছায় ২৫ আগস্ট, ২০১৭,যখন রাখাইন রাজ্যের ২৪টি পুলিশ পোস্ট এবং ৫৫২ তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন সেনা ঘাঁটিতে ১৫০ জন আরসা র মিলিত আক্রমণ ঘটে। এই আক্রমণগুলির ফলস্বরূপ মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্য জুড়ে রোহিঙ্গাদের উপর পরিকল্পিত দ্বিতীয় "ক্লিয়ারেন্স অপারেশন" টি চালু করে। নারীপুরুষ নির্বিচারে গণহত্যা, নারীদের ধর্ষণ, পিতামাতার সামনে শিশুদের হত্যা এবং উত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গা বাড়িঘর, গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দেওয়া, স্কুল, মসজিদ ধ্বংস করা - কী না করেছে ঘাতকরা! এককথায় রাখাইন বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের প্রজন্মের সমস্ত প্রমাণই নিশ্চিহ্ন করে দেয় মিয়ানমার সরকার। সেই ভয়ঙ্কর নৃশংস ক্র্যাকডাউনের সম্মুখীন হয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে গণ পলায়ন ঘটে। ২০১৬ ও ২০১৭ সালের 'ক্লিয়ারেন্স অপারেশন' দুটি প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গাকে তাদের মাতৃভূমি থেকে বহিষ্কার করেছে।
এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, রোহিঙ্গা জনগণের দুর্দশার কথা সাধারণ জনগণ এখন প্রায় ভুলতে বসেছেন। অবশ্য এতে খুব বেশি আশ্চর্য্য হবার কথাও নয়। একে তো আমজনতার স্মৃতি বেশ দুর্বল, তার উপর এত নতুন নতুন সমস্যা পৃথিবীর বুকে অবিরাম আছড়ে পড়ছে, যে পুরোনো সমস্যাগুলোর উপর সহজেই বিস্মৃতির পলি চাপা পড়ছে। চলুন একটু দেখে নিই কী সেইসব কারণ যেগুলোর জন্য রোহিঙ্গা-সঙ্কট অন্যান্য বৈশ্বিক সমস্যাগুলির মতো এখন আর ততটা মনোযোগ পাচ্ছে না।
এই কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে: সীমিত মিডিয়া কভারেজ, ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনা, সহানুভূতি ক্লান্তি, অধিগমনের বিধিনিষেধ, এবং প্রতিযোগিতামূলক সংকট। কারণগুলো তাহলে ছোট ক'রে ছুঁয়ে যাওয়া যাক ।
মিডিয়া কভারেজ: ২০১২ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আন্তঃসাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয়, ব্যাপকভাবে বাস্তুচ্যুত হয় রোহিঙ্গারা এবং তাদের মানবাধিকার ভয়ঙ্করভাবে লঙ্ঘিত হয় । সমস্ত সংবাদ মাধ্যমগুলো এই ঘটনার প্রতিবাদে সরব হয়ে ওঠে এবং বিশ্ব এ ব্যাপারে সচেতন হয়। এরপর ২০১৬ সালের অক্টোবরে, রোহিঙ্গা জঙ্গিদল আরসা (ARSA) রাখাইন রাজ্যের সীমান্ত রক্ষী চৌকিতে একের পর এক আক্রমণ করে, ফলস্বরূপ মিয়ানমার সেনাবাহিনী এক হিংস্র সামরিক ক্র্যাকডাউন শুরু করে। এই ক্র্যাকডাউনের ফলে হত্যা, ধর্ষণ এবং রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া সহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। আসন্ন মানবিক সঙ্কট এবং রোহিঙ্গা জনগণের ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি আবারও মিডিয়ার দারুণ মনোযোগ পায়। ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা এক্সোডাস নিয়ে মিডিয়া কভারেজের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটে যখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা জঙ্গিদের আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় বড় আকারের ক্র্যাকডাউন শুরু করেছিল। জাতিসংঘ এবং অন্যান্যদের দ্বারা জাতিগত নির্মূল হিসাবে চিহ্নিত এই ক্র্যাকডাউনটি প্রতিবেশী বাংলাদেশে সাত লাখের উপর রোহিঙ্গা শরণার্থীর ব্যাপক অভিবাসনের দিকে পরিচালিত করে। বাস্তুচ্যুতি, সহিংসতা এবং দুর্ভোগের বেদনাদায়ক গল্প এবং চিত্রগুলি বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং বিশ্বজুড়ে ক্ষোভের জন্ম দেয়। ২০১৮ সালে, জাতিসংঘের একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন উপসংহারে পৌঁছায় যে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পদক্ষেপ গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের সমান। এই প্রতিবেদনটি রোহিঙ্গা-সঙ্কটের আন্তর্জাতিক পর্যালোচনা এবং মিডিয়া কভারেজকে পুনরুজ্জীবিত করে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা জনসংখ্যার বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার আইনি ও জবাবদিহিতার দিকগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এরপর ২০১৯ সালের নভেম্বরে, রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা, যৌন সহিংসতা এবং গ্রাম ধ্বংস সহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার অভিযোগ এনে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (ICJ) একটি মামলা দায়ের করে গাম্বিয়া অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি)। এই মামলাটিও রোহিঙ্গাদের দুর্দশার প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন মোকাবেলায় মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। শুনলে অবাক হয়ে যাবেন যে, বিশ্বের চোখে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের একজন চ্যাম্পিয়ন হিসাবে বিখ্যাত, অং সান সু চি কিন্তু আদালতের সামনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকেই সমর্থন করেন, সংখ্যালঘু হতভাগ্য রোহিঙ্গাদের নয়। সু চি যুক্তি দেন যে ২০১৭-র সেই সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন—নির্লজ্জতার বুঝি কোনো সীমা থাকতে নেই! জানুয়ারী ২০২০-তে, আদালত একটি প্রাথমিক রায় জারি করে, যেখানে বার্মাকে ভবিষৎ গণহত্যার প্রতিরোধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়, তবে, এবিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আদালতের অনেক বছরই সময় লেগে যেতে পারে।
উপরের আলোচনা থেকে এটা খুব পরিষ্কার যে ২০১২-২০২০ উল্লেখযোগ্য মিডিয়া কভারেজ পাওয়ার কারণে রোহিঙ্গা সংকট সারা বিশ্বের মাথাব্যথার একটা বড়ো কারণ হয়ে ওঠে, কিন্তু পরবর্তীতে এটা আর মিডিয়া কভারেজের স্পটলাইটে ছিল না।
ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনা: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের সঙ্গে মিয়ানমার তার সীমান্ত ভাগাভাগি করে। এই নিকটবর্তী প্রতিবেশী দেশগুলি মধ্যে রয়েছে: উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশ ও ভারত, উত্তর-পূর্বে চীন, পূর্বে লাওস আর দক্ষিণ-পূর্বে থাইল্যান্ড। রোহিঙ্গা সংকট এক জটিল ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতাকে জড়িত করে, যার মধ্যে রয়েছে মিয়ানমার ও এই প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক, সেইসাথে বৈশ্বিক শক্তির সম্পৃক্ততা। এই দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশের নাম তো আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া অতিথি দেশ হিসেবে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা জনসংখ্যাকে মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। নিজস্ব সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ দশ লাখের উপর রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে এবং সাহায্য ও সহায়তা প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সাথে কাজ করছে। অন্যদিকে, সামগ্রিকভাবে, লাওস এবং থাইল্যান্ড রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় সক্রিয়ভাবে জড়িত নয়। কিন্তু আশ্চর্যের এবং গভীর দুঃখের কথা হলো এই যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত ও চীন তেমন কোনো সক্রিয় ভূমিকা নেয়নি, অথচ এই দুই দেশই এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গতিশীলতা ও বৈশ্বিক বিষয় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই দুটি প্রতিবেশী দেশের অসহযোগিতা জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে কূটনৈতিক ও মানবিক উভয় পর্যায়ে কার্যকরভাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের প্রচেষ্টাকে দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে, ফলস্বরূপ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত হয়ে চলেছে।
যদিও এটা প্রসঙ্গান্তর, তবু, এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশের নাম এখানে না নিলেই নয়, যারা রোহিঙ্গাদের সমর্থন করেছে, রোহিঙ্গা জনগণের জন্য উদ্বেগ প্রকাশে সোচ্চার হয়েছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তা দিয়েছে, ও রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে। এরা হলো গিয়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক। এই দেশগুলোর মতো সোচ্চার না হলেও, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তা দিয়েছে এবং মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দারিদ্র্য এবং উন্নয়নের অভাবের মতো সংকটের মূল কারণগুলি মোকাবেলার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছে ৷
রাজনৈতিক স্বার্থ কখনও কখনও মানবিক উদ্বেগকে ছাপিয়ে যেতে পারে, যার ফলে সংকটের দিকে মনোযোগ কম হয়। এই কথাটা চীন ও ভারত দুই শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের জন্য প্রযোজ্য যারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বিশেষভাবে সমর্থন করেনি কিন্তু মিয়ানমার সরকারের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। উভয় দেশেরই মিয়ানমারের প্রতি কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে এবং তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি বার্মিজ সরকারের আচরণের সোচ্চার সমালোচক নয়। চীন মিয়ানমারের অবকাঠামো ও প্রাকৃতিক সম্পদে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে এবং প্রায়ই আন্তর্জাতিক সমালোচনা থেকে মিয়ানমারকে রক্ষা করেছে, বিশেষ করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে। মায়ানমারে ভারতের কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে, বিশেষ করে তাদের অভিন্ন সীমান্ত বরাবর নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে। ভারত ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের প্রতি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখেছে, মানবাধিকার ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি সরকারের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখেছে।
সহানুভূতি ক্লান্তি: যে মানবিক সমস্যা বহুকাল ধরে ঘটেই চলেছে এবং আপাতদৃষ্টিতে যার কোনো স্পষ্ট সমাধান চোখে পড়ে না, তার প্রতি মানুষের সংবেদনশীলতা হারিয়ে যায় –রোহিঙ্গা সমস্যা এর এক জ্বলজ্বলে উদাহরণ, ছয় পার করে সাত বছরে পড়েছে এই সমস্যা, যা দিনকে দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমার ফিরিয়ে নেয়নি, না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে মনুষ্যেতর প্রাণীর মতো জীবন কাটাচ্ছে রোহিঙ্গারা।
অধিগমনের বিধিনিষেধ: রোহিঙ্গা সমস্যার শুরু থেকে মিয়ানমার সরকার সাংবাদিক, মানবিক সংস্থা এবং তদন্তকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রবেশ সীমিত করে দিয়েছে, তাছাড়া তারা আকছার তথ্য লোপাট করছে। তার ফলে পরিস্থিতির সম্পূর্ণ নথিপত্র এবং প্রতিবেদন তৈরি করা কঠিন হচ্ছে। সীমিত অধিগমনের জন্য জনসাধারণের কাছে রোহিঙ্গা সংকট বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা সাংঘাতিকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
মিয়ানমার সরকারের নেতিবাচক ভূমিকা: যদিও অনেক পর্যবেক্ষকের মধ্যেই মিয়ানমারে গণহত্যা হয়েছে বলে একটি দৃঢ় ঐকমত্য রয়েছে, তবু, গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে কিনা তা নির্ধারণের জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত এবং আইনি বিশ্লেষণ প্রয়োজন, যা জটিল এবং অনেক সময় ব্যাখ্যার বিষয়ও হতে পারে। গণহত্যার আইনি শ্রেণীবিভাগ যেমন আন্তর্জাতিক আইনে বর্ণিত নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসারে হয়ে থাকে, গণহত্যার অপরাধের প্রতিরোধ ও শাস্তি কনভেনশন দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সবথেকে বড়ো সমস্যা হচ্ছে যে বিশ্বজুড়ে প্রমাণ এবং ব্যাপক নিন্দা সত্ত্বেও, মিয়ানমার সরকার ধারাবাহিকভাবে গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং সহিংসতার স্বাধীন তদন্তের অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছে। রোহিঙ্গাদের দুর্দশাও তাই শুধু একটা অস্বাভাবিক মানবিক সঙ্কট হিসাবেই রয়ে গেছে।
প্রতিযোগিতামূলক সংকট: রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল কারণগুলির মীমাংসা এবং রোহিঙ্গা জনগণের ন্যায়বিচারের জন্য মিয়ানমার সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বজায় রাখা এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ভাগ্যবশত বসুন্ধরা প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানবিক সংকট আর সংঘাতের মধ্য দিয়ে পথ হাঁটছে। সংকটের তীব্রতা, ভৌগলিক নৈকট্যের মতো কারণের উপর ভিত্তি করেও সংকটের প্রতি বিশ্বের মনোযোগ স্থানান্তরিত হয় । এ ব্যাপারে একটু আলোকপাত করা বিশেষ প্রয়োজনীয়।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে কোভিড মহামারী শুরু হওয়া মাত্রই তা আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মিডিয়ার প্রাথমিক ফোকাসে পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো অন্যান্য মানবিক সংকটকে ছাপিয়ে কোভিড-১৯ ভাইরাসকে ঠেকানো এবং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর এর প্রভাব প্রশমিত করার কাজেই তখন সারা পৃথিবী তাদের মনোযোগ, তহবিল এবং সম্পদ বরাদ্দ করায় সচেষ্ট হয়ে ওঠে।
২০২০ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য ১০০ কোটি ডলারের তহবিলের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সঙ্গে এক ভার্চুয়াল সম্মেলনের আয়োজন করে। কিন্তু এর অর্ধেক অর্থ ও জোগাড় হয়ে ওঠেনি । ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কোভিড পৃথিবীর সমস্ত দেশকে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে রাখে; বিশ্বব্যাপী মন্দা, জীবিকা হ্রাস এবং বাজেটের সীমাবদ্ধতা লক্ষিত হয় । খুব স্বাভাবিকভাবেই, রোহিঙ্গাদের মানবিক সংকটের আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য উপলব্ধ আর্থিক সংস্থান এই রোগ-দুর্ভোগের সময়কালে হ্রাস পায়।
কোভিড শেষ হতে না হতেই ২০২২-এর চৌঠা মার্চ বসুন্ধরার বুকে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে; রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। ইউক্রেনের সংঘাত রাশিয়া এবং পশ্চিমা দেশগুলির মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি করে, যার ফলে আন্তর্জাতিক মনোযোগ এবং সংস্থানগুলি আরও একবার রোহিঙ্গাদের থেকে ইউরোপের সংঘাতের দিকে ঘুরে যায়। যুদ্ধের বিস্তৃত ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব, কূটনৈতিক উত্তেজনা এবং প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক অগ্রাধিকারের যাঁতাকলে প'ড়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক চাহিদা পূরণের আশা ম্লান হয়ে যায়।
মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতোই ২০২৩ সালের অক্টবর নাগাদ হামাস এবং ইসরায়েলের মধ্যে সাম্প্রতিকতম যুদ্ধটি শুরু হয়েছে আর তা এখনও পুরোদমে অব্যাহত রয়েছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই যুদ্ধের পরোক্ষ ফল হিসাবে রোহিঙ্গা সমস্যা আন্তর্জাতিক জনমনে আরও খানিকটা বিস্মৃতির প্রান্তদেশে সরে গিয়েছে।
এতক্ষণ আমরা সবিস্তারে আলোচনা করলাম যে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বিশ্ববাসীর চিন্তাভাবনা কেন ঝিমিয়ে পড়েছে, এবার চলুন দেখে নেওয়া যাক, সমস্যাটা এখন ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে আর বাপ পিতামহের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা পরদেশে কেমনভাবেই বা দিনাতিপাত করছে ।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত অন্যতম দরিদ্র জেলা কক্সবাজার, সেখানেই রয়েছে অন্তহীন এক বস্তি-সাম্রাজ্য-ভূগোল বইয়ে যার নাম কুতুপালং–বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির, দশ লাখের উপর রোহিঙ্গা বসবাস করে এই অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে। একসময় যা ছিল ঘন জঙ্গল, এখন তা নেড়া পার্বত্যভূমি –যত দূর চোখ যায়, খাড়া পাহাড়ের ঢালে বাঁশ এবং প্লাস্টিকের ত্রিপল দিয়ে নির্মিত, সারি সারি, ঠাসাঠাসি, ঘিঞ্জি ঝুপড়ি আর ঝুপড়ি - মস্ত একটা হাঁ করে আকাশ, মাটি, গাছপালা-সবই যেন গিলে খেয়েছে। মাত্র ১৩.৪ বর্গ কিলোমিটার উঁচুনিচু এলাকায় গজিয়ে ওঠা, ভূমিতে ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর। দাঁড়ালে মাথা ছুঁয়ে দেওয়া ছোট্ট কুঠুরির মতো একেকটি ঘরে সাত আটজন করে মানুষ, কোথাও কোথাও সেই সংখ্যাটা ১২-১৫ জনে গিয়ে ঠেকেছে। কুতুপালংয়ে মোট ৩৩টি ক্যাম্প রয়েছে, যেখানে জনপ্রতি ১৫ বর্গ মিটারেরও কম জায়গা বরাদ্দ, এই রকম একটা জনসংখ্যার ঘনত্বে বাস করা শরণার্থীদের জীবনধারণ যে প্রতি পদক্ষেপে সংগ্রামময়, তা সহজেই অনুমেয়।
সত্যি কথা বলতে কী, শরণার্থীদের জন্য এ এক প্রতিকূল ভূখণ্ড। এই কমজোরি শিবিরগুলি বন্যা এবং ভূমিধ্বসের ঝুঁকিতে রয়েছে, বিশেষ করে বর্ষাকালে। জনাকীর্ণ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে আগুন লাগাও একটা অতি সাধারণ ঘটনা, বিশেষ করে নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত, কারণ তখন মৌসুম শুষ্ক থাকে। বাঁশ আর প্লাস্টিকের ত্রিপল দিয়ে তৈরি গাদাগাদি করে থাকা ওই ঝুপড়িগুলোর কোনো একটায় আগুন লাগলে কী ঘটতে পারে তা ভাবতেই বুক শিউরে ওঠে! আর সেরকমটাই ঘটেছে কুতুপালংয়ে। ২০২১ সালের মার্চ মাসে একটি বিশাল দাবানলে কমপক্ষে ১৫ জন শরণার্থী নিহত হয়েছিল এবং ১০,০০০ এরও বেশি ঘর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আবার, ২০২৩ সালেও এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে– প্রায় ২,৮০০ আশ্রয়কেন্দ্র এবং হাসপাতাল ও শিক্ষাকেন্দ্র সহ ৯০ টিরও বেশি সুবিধা-কেন্দ্র আগুনে ধ্বংস হয়, প্রায় ১২,০০০ উদ্বাস্তু গৃহহীন হয়ে পড়ে।
মনে প্রশ্ন আসে বাংলাদেশ কী ভাবছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে?
২০১৬-২০১৭ সালে, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যখন প্রথম আসে, তখন তাদের পরম উষ্ণতায় স্বাগত জানিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই থেকে ছয় বছরের বেশি সময় কেটে গেছে, তবু, আজ ২০২৪ সালেও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের আশা যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী বসতিতে বসবাসকারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দারুণ এক অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশু নিজ দেশ থেকে নির্বাসিত জীবনযাপন করছে, এর মধ্যে অনেকে আবার এই অচলাবস্থার মধ্যেই জন্মগ্রহণ করেছে। ওদিকে, লাখ লাখ শরণার্থীর চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের মতো একটা গরিব দেশের সম্পদ, অবকাঠামো ও অর্থনীতির ওপর ক্রমবর্ধমান চাপের সৃষ্টি হয়েছে।
এখানে আরও কথা আছে: এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে উল্লেখযোগ্য বোঝা নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে রাজি হয়েছিল, তার পিছনে ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দরাজ পিঠ চাপড়ানি ও সাহায্যের গালভরা প্রতিশ্রুতি। কিন্তু এখন বাংলাদেশ প্রায়শই অনুভব করছে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা মানবিক সংকট মোকাবিলায় পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদান করেনি। ওদিকে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নানা রকমের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যেমন অপহরণ, মানুষ পাচার, মাদক চোরাচালান, খুনোখুনি ইত্যাদি ঘটনা দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। ক্যাম্প অঞ্চলগুলোতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য মিয়ানমার জান্তা বিরোধী রোহিঙ্গা সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরসা এবং আরএসও-র মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সন্ত্রাসের কারণে শরণার্থী এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। সীমান্ত এলাকায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উপস্থিতির কারণে বাংলাদেশের পক্ষে নিরাপত্তায় ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে এবং এই বিষয়ে, বিশেষ করে, উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ এখন যারপরনাই বিরক্ত। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোজাসুজি বলেই দেন যে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় বোঝা এবং তাদেরকে নিজেদের পুরানো দেশেই ফিরে যেতে হবে।
এভাবেই, অনিশ্চয়তার কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের মুখ দেখে প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গে রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও পুরুষদের; তারা মিয়ানমারে তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে মরিয়া হয়ে ওঠে, কিন্তু ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পরে, মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখনও তাদের ফিরে যাওয়ার অনুকূল নয়, পরিবর্তে শরণার্থী শিবিরের অত্যন্ত জনাকীর্ণ এবং কখনও কখনও বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যেই আরেকটা দিন কাটাবার জন্য নিজেদের মনকে বুঝ দেয় তারা। আপামর দুনিয়ার দয়াপ্রার্থী হয়েই, ধুঁকে ধুঁকে পরভূমে তাদের দিন গুজরান করছে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা শিশুরা রোগের প্রাদুর্ভাব, অপুষ্টি এবং শিক্ষার সুযোগের অভাবসহ বিভিন্ন ঝুঁকির নিত্যি মুখোমুখি হচ্ছে। এর শেষ কোথায় জানতে চাইলে তার কিন্তু কোনো সদুত্তর মেলে না।
এবার সময় আরেক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া এবং সেটা হলো এই যে, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় পর্যাপ্ত অর্থ মিলছে না। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। বাংলাদেশের ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাসিক খাদ্য রেশনে প্রথম হ্রাস টা লাগু হয় ২০২৩ সালের মার্চ মাসে। জনপ্রতি ১২ মার্কিন ডলার থেকে রাতারাতি তা নেমে আসে ১০ মার্কিন ডলারে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা জানান যে, ৫৬ মিলিয়ন ডলার তহবিল ঘাটতির কারণে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এই কাটছাঁট কার্যকর করতে বাধ্য হয়েছে। এর তিন মাসের মধ্যেই আবার ফের ঝটকা আসে ২০২৩ সালের ১ জুনে, যখন খাদ্য রেশনের দ্বিতীয় দফার হ্রাস চালু হয়, মাসিক রেশন আরো কমে এসে দাঁড়ায় মাথাপিছু মাত্র আট মার্কিন ডলার।**
এই রেশন হ্রাসের পরিণতি কতটা বিধ্বংসী হবে তা অনুমান করা কারুর পক্ষেই কষ্টসাপেক্ষ নয়। তবু আসুন শুনে নিই তিন বিশেষজ্ঞের মতামত। এঁরা হলেন থমাস অ্যান্ড্রুজ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষ দূত; মাইকেল ফাখরি (লেবানন) খাদ্যের অধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত; এবং অধ্যাপক অলিভিয়ার ডি শুটার (বেলজিয়াম) চরম দারিদ্র্য ও মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত। তো তাঁরা বলছেন খাদ্যের অপ্রতুলতার কারণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে তীব্র অপুষ্টি, শিশুমৃত্যু, সহিংসতা এবং সাধারণ মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাবে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা হ্রাস পাবে। কিছু রোহিঙ্গা হয়তো সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে, শিবিরে ক্ষুধা ও মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে পাচারকারী ও চোরাচালানকারীর জীবন বেছে নেওয়াই ভালো, অথবা অজানা সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য, জীবনের ঝুঁকি নেওয়া আরও ভালো। এসবই গেল খাদ্যের অপ্রতুলতার তাৎক্ষণিক ফলাফল; কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবগুলো হবে মারাত্মক। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটা শিশুদের বিকাশ ব্যাহত করবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আশাকে ম্লান করে দেবে। গর্ভবতী ও বুকের দুধ খাওয়ানো নারী, কিশোরী এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুসহ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী এই খাদ্য রেশন কাটছাঁটের শিকার হবে এবং শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হবে।
এখানে মনে রাখা দরকার যে প্রথম দফা রেশন কাটার আগেও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বাস্থ্য সূচক ছিল ভয়াবহ। ৪৫ শতাংশ রোহিঙ্গা পরিবার পর্যাপ্ত খাবার খেতে পায় না। রোহিঙ্গা শিশুদের ৪০ শতাংশের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং অর্ধেকের বেশি রক্তশূন্যতায় ভুগছে।
গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতোই ১৪ মে, ২০২৩ পশ্চিম মিয়ানমারে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় মোচা বাংলাদেশে প্রায় ৪০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীর আশ্রয়স্থল ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করেছে, দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে, এই অবস্থায় তাদের জন্য আরো বেশি অর্থ বাজেটে বরাদ্দ করা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
কিন্তু চাইলেই কি আর অর্থ মেলে? জাতিসংঘ এবং এর অংশীদারদের হিসেবনিকেশে গত বছর স্থির হয়েছিল যে, কক্সবাজার ক্যাম্প ও ভাসান চর*** দ্বীপের প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে এবং প্রায় সাড়ে-তিন লাখ আয়োজক সম্প্রদায়ের লোকদের খাদ্য, আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা, পানীয় জল, সুরক্ষা পরিষেবা, শিক্ষা এবং অন্যান্য সহায়তার জন্য ৮৭৬ মিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন। এই অর্থ প্রদানের জন্য সদস্য দেশগুলিকে সেই মতো অনুরোধ করা হয়েছিল, কিন্তু সর্বশেষ খবর অনুযায়ী (মার্চ ১৩, ২০২৪), মাত্র ৪৪০ মিলিয়ন ডলার অর্থই এযাবৎ সংগ্রহ করা গেছে। ধনী দেশগুলোর সরকারসহ আরও অনেক দেশের সরকারই রোহিঙ্গাদের জন্য জোরালো বাগাড়ম্বরপূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশে রোহিঙ্গা মানবিক ত্রাণ খাতে তারা এখনও কোনো অর্থই দিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে ৮৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রোহিঙ্গা মানবিক সহায়তা যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনাটি মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত রয়ে গেছে এবং অর্থায়ন কবে লক্ষমাত্রায় পৌঁছবে তা, এখনও অনেকটাই অনিশ্চিত ।
একটা কথা খুব ভালোভাবে আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে নেওয়া দরকার: স্বেচ্ছায় নয়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যার কারণেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত পরিমাণে খাদ্য সরবরাহ করায় ব্যর্থতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষে খুবই লজ্জাজনক বিষয়। যারা রোহিঙ্গাদের খাতে তহবিল কমানোর কথা বলছেন বা ভাবছেন তারা ঠিক করছেন না। জাতিসংঘের যেসব সদস্য রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিয়েও এখনো রোহিঙ্গাদের আর্থিক সহায়তা দেয়নি, আর দেরি না করে তাদের তা করা উচিত।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চলমান দুর্ভোগ ও দুর্বলতা স্বীকার করা এবং তাদের অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদার জন্য কাজ চালিয়ে যাওয়া বিশ্ববাসীর জন্য অপরিহার্য। সংকটের মূল কারণগুলোর মোকাবিলা, মিয়ানমার সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং রোহিঙ্গা জনগণের অধিকার ও কল্যাণ সমুন্নত রাখতে স্থায়ী ও টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা এই হোক আমাদের সকলের একমাত্র উদ্দেশ্য । আর এই কাজ হাসিল করার জন্য আন্তর্জাতিক মনোযোগ, সংহতি এবং সম্মিলিত পদক্ষেপের আশু প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র:
1. Conflict in Rakhine State (2016–present). Wikipedia.
2. UN cuts food aid to Rohingya refugees. Peoples Dispatch. February 28, 2023.
3. UNHCR partners seek $876m for Rohingya refugees facing 'chilling fog of uncertainty' and for Bangladeshi hosts. Press briefing notes at the Palais des Nations in Geneva March 4, 2023.
5. UN agencies face funding challenges in feeding Rohingya refugees in Bangladesh, official says. Associated Press. May 29, 2023.
6. Bangladesh: UN experts decry devastating second round of rations cuts for Rohingya refugees. OHCHR. June 01, 2023.
7. Food Rations for Each Rohingya Refugee Drops to $8 Per Month. Shaikh Azizur Rahman. Voice of America. June 05, 2023.
8. ‘There Is No Hope’: Death and Desperation Take Over the World’s Largest Refugee Camp. Charlie Campbell, Time. September 26, 2023.
9. Competing armed groups pose new threat to Rohingya in Bangladesh. IISS, The Myanmar Conflict Map. 11 December 2023.
টিকা-টিপ্পনি:
*তাতমাদো- মিয়ানমার সরকারী সশস্ত্র সেনাবাহিনী
**এই প্রতিবেদনটি যখন লিখছি, তখনই একটা আশার খবর পেলাম: অনুকূল তহবিলের জন্য, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে শরণার্থীদের মাসিক খাদ্য রেশন ৮ মার্কিন ডলার থেকে বাড়িয়ে আবার ১০ মার্কিন ডলার করতে সক্ষম হয়েছে ডব্লিউএফপি । উপরন্তু, পুষ্টির পর্যাপ্ততা বাড়াতে এবং অপুষ্টির উদ্বেগ মোকাবিলায় শরণার্থীদের খাদ্য তালিকায় এই প্রথম উন্নত পুষ্টির চালও চালু করা হয়েছে (WFP Bangladesh Country Brief, March 2024. Situation Report. Source: WFP. Posted 25 Apr 2024, Originally published. 25 Apr 2024)।
***মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা বাংলাদেশের একটি ছোট্ট দ্বীপ ভাসান চর। কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে স্থান সংকুলান না হওয়ায়, কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ভাসান চরে পাঠানো হয়েছে । এখনও পর্যন্ত (২০২৪-এর ফেব্রুয়ারি) ৩৩,৮৯৩ জন রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।