আচ্ছা এটা কি লক্ষ করেছেন যে, পৃথিবীর কোথায় কোথায় যুদ্ধ-বিগ্রহ চলছে, আপনি যখনই তার তত্ত্বতালাশ করতে বসেন, তখনই সেই তালিকায় আফ্রিকার কোনো না কোনো একটা দেশের নাম ঠিকই উঠে আসে? না, না একটুও বাড়িয়ে বলছি না, এ এক ভয়ঙ্কর নিখাদ সত্য । ধরুন না, এই এক্ষুনি, যখন এই লেখাটা লিখতে বসেছি, সেন্টার ফর প্রিভেন্টিভ অ্যাকশন অ্যাট ফরেন রিলেশনস কাউন্সিল-এর ইন্টারেক্টিভ গ্লোবাল কনফ্লিক্ট ট্র্যাকার ম্যাপ তখন আফ্রিকার আট-টা হটস্পটের উপর জ্বলজ্বল করছে । শুনবেন সেই সংঘাতময় রাজনৈতিক অঙ্গনগুলোর নাম? লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ, সাহেলে সহিংস চরমপন্থা, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে সংঘাত, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গোতে (ডিআরসি) ২৩ মার্চ মুভমেন্ট (এম টোয়েন্টি থ্রি ) বিদ্রোহীদের হিংসাকাণ্ড, সুদানে গৃহযুদ্ধ, দক্ষিণ সুদানে অস্থিতিশীলতা, ইথিওপিয়ায় সংঘাত, সোমালিয়ায় আল-শাবাবের সাথে সংঘাত। এগুলোর কোনোটাই কিন্তু ভুঁইফোড় গজিয়ে ওঠা দ্বন্দ্ব নয়, সবই একেকটা জটিল, চলমান সমস্যা যার মূল প্রোথিত রয়েছে ইতিহাসের অনেক গভীর কন্দরে ।
উদাহরণস্বরূপ চলুন দেখে নিই ডিআরসিতে কঙ্গোলিজ সৈন্যদের সাথে এম টোয়েন্টি থ্রি’র বর্তমান অশান্তির ভিতরের কথা । ইতিহাস বলে যে, ১৯৯৪তে, রুয়ান্ডায় রক্তঝরা গৃহযুদ্ধের সময়, হুতু রাজনৈতিক ও সামরিক চরমপন্থীরা ডিআরসি’র পূর্ব সীমানার নিকটবর্তী পশ্চিম রুয়ান্ডায় টুটসি উপজাতির বিরুদ্ধে নারকীয় গণহত্যা চালিয়েছিল । এ ঘটনা বহু পুরানো, কিন্তু তার জের কি মিটে গেছে? নাহ, তাই যদি হবে, তো গত ৩০ বছরে ওই একই অঞ্চলে হিংসাত্মক সংঘাতের দাবানল স্তিমিত হয়নি কেন? আজকে কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলিতে এম টোয়েন্টি থ্রি উত্তেজনার কেন্দ্রে যারা রয়েছে দক্ষিণ কিভুর বাসিন্দা সেই বানিয়ামুলেঞ্জ আর উত্তর কিভু'র বানিয়ারওয়ান্ডারা তো আদতে রুয়ান্ডার সমর্থন প্রাপ্ত জাতিগত সংখ্যালঘু বিদ্রোহী কঙ্গোলিজ টুটসি সম্প্রদায় । বেশ কিছু শান্তি চুক্তি (সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে ১৯৯৯র লুসাকা চুক্তি, ২০০২ প্রিটোরিয়া চুক্তি, ২০০২ লুয়ান্ডা চুক্তি, এবং ২০০৩ সান সিটি চুক্তি) হাওয়া সত্ত্বেও এই অঞ্চলে সক্রিয় সংঘাত চলছে এবং বিগত তিন দশক ধরে, কোনো স্থায়ী শান্তি স্থাপিত হয়নি ।
প্রশ্ন জাগে মনে, আফ্রিকা জুড়ে কেন এই যুদ্ধের ঢল? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই আমাদের নজর গিয়ে ঠেকে এই মহাদেশটার বিশালতা দিকে । আফ্রিকার মোট আয়তন ৩০.৪ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার, এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ৫৪টি রাষ্ট্র । জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীর অন্য মহাদেশগুলোর তুলনায় এই রাষ্ট্র-সংখ্যা সর্বোচ্চ । দেশটার জাতিগত গঠনও কম বিচিত্র নয়। সমগ্র আফ্রিকাতে ৩,০০০ টিরও বেশি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী রয়েছে এবং তারা ২,১০০ টিরও বেশি বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে; খ্রিস্টান, ইসলাম, ইহুদি, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছাড়াও, বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠী তাদের নির্দিষ্ট ঐতিহ্যবাহী ধর্ম পালন করে। ভাবছেন তবে কি এই ভিন্নধর্মী জাতিগত পরিচয়ই সে দেশের মানুষে মানুষে ঘৃণা এবং তার ফলস্বরূপ সহিংস সংঘাতের জন্ম দেয়? উত্তরটা শুনলে হয়তো অনেকেই অবাক হবেন। ১৯৬০-১৯৯৯ সালের মধ্যে ১৬১টি দেশে গৃহযুদ্ধের সামগ্রিক ব্যাপকতার সাম্প্রতিক মডেল ব্যবহার করে আমরা আফ্রিকার সম্বন্ধে একটা বিশেষ তথ্যে উপনীত হই, যা দেখায় যে আফ্রিকায় যুদ্ধের তুলনামূলকভাবে উচ্চতর প্রাদুর্ভাব যতটা না তার দেশগুলির জাতি, ভাষা, ধর্ম-গত বিভাজনের কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি নিদারুণ দারিদ্র্য, ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা সৃষ্ট স্বেচ্ছাচারী সীমানা নির্ধারণ, ব্যর্থ রাজনৈতিক নেতৃত্ব, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন,বহিরাগত ঋণের বোঝা, ছোট অস্ত্রের বিস্তার এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অর্থনৈতিক নির্ভরতার কারণে।
দেখুন, যুদ্ধ-বিগ্রহের ব্যাপার আফ্রিকায় কোনো নতুন কথা নয় । ১৯৪৫ সাল থেকে শুরু হলেও মোটামুটি ১৯৬০ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসন বা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল আফ্রিকা মহাদেশ। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই আফ্রিকার দেশগুলো যেন গৃহযুদ্ধ এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘর্ষের জন্য পাল্লা দিয়ে বাজি ধরেছিল । হাড়-হিম করা ভয়াবহ সব সংঘর্ষ: চাদ (১৯৬৫-৮৫), অ্যাঙ্গোলা (১৯৭৪ সাল থেকে), লাইবেরিয়া (১৯৮০-২০০৩), নাইজেরিয়ান সিভিল ওয়ার (১৯৬৭), উগান্ডার দা লর্ড’স রেসিসটেন্স আর্মি ইন্সার্জেন্স (এলআরএ) (১৯৮৭), লাইবেরিয়া সিভিল ওয়ার (১৯৮৯), সোমালি সিভিল ওয়ার (১৯৯১), সিয়েরা লিওন সিভিল ওয়ার (১৯৯১), রুয়ান্ডান জেনোসাইড (১৯৯৪), রিপাবলিক অফ দা কঙ্গো সিভিল ওয়ার (১৯৯৭–১৯৯৯), এরিট্রিয়ান-ইথিওপিয়ান ওয়ার (১৯৯৮), – আর কত নাম নেব?
এই সব যুদ্ধের ইতিহাস খুঁটিয়ে দেখলে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, গত কয়েক দশকে আফ্রিকার যুদ্ধের প্রকৃতি ও পদ্ধতি উল্লেখযোগ্যভাবে পাল্টে গেছে। "পুরানো বা ঐতিহ্যগত যুদ্ধ’’ এবং "নতুন যুদ্ধ" এ দুইয়ের মধ্যে স্বতন্ত্র পার্থক্য ধরা পড়ে । তবে সব সময় এই বিভাজনের সীমারেখা টানা অত সোজা নয়, কোনো কোনো যুদ্ধে এই দুয়েরই প্রভাব দেখা যায়, সেই যুদ্ধকে তখন ‘’মিশ্র প্রকৃতির (Hybrid)’’ বলে সাব্যস্ত করা হয় । ব্যাপারটা তাহলে একটু খতিয়ে দেখা যাক ।
আফ্রিকার পুরোনো বিপ্লবগুলোর শিকড় গাঁথা থাকত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সব ঘটনার মধ্যে । ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার এবং সীমান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করেই মূলত আন্তঃরাজ্য দ্বন্দ্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠত । প্রথাগত এই যুদ্ধগুলো প্রায়শই মতাদর্শের লড়াই থেকে জন্মাত, সংঘর্ষগুলো ছিল তুলনামূলকভাবে স্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং সর্বসম্মত; সেগুলোর পিছনে থাকত ন্যায়সঙ্গত এবং মহৎ কারণ যেমন সামাজিক পরিবর্তন, উপনিবেশবাদ, বা বর্ণবাদের বিলুপ্তি ইত্যাদি । প্রচলিত এই লড়াইগুলো সাধারণত পূর্ব পরিকল্পিত হতো; যুযুধমান প্রতিটি পক্ষের সৈন্যবাহিনী ভালভাবে সংজ্ঞায়িত থাকত; রাজ্যের স্থায়ী ও নিয়মিত সশস্ত্র যোদ্ধা দ্বারা সংঘটিত সেনাবাহিনীকেই যুদ্ধে নিয়োগ করা হতো; সর্বজন স্বীকৃত, নির্দিষ্ট নিয়ম দ্বারা যুদ্ধ পরিচালিত হতো । যুদ্ধ হতো একটা বিরোধী সামরিক বাহিনী এবং তার সরকারের সঙ্গে, বেসামরিক জনসংখ্যা শুধুমাত্র সামরিক বিজয়ের প্রধান লক্ষ্যের গৌণ ফলাফল হিসাবেই প্রভাবিত হতো; প্রাথমিকভাবে যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের সামরিক বাহিনীকে লক্ষ্য করেই অস্ত্র ব্যবহার করা হতো, অসামরিক মানুষজনের উপর নয়। যুদ্ধকালে, শত্রুর উপর প্রায়ই প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্র যেমন ভারী, মোটর চালিত অস্ত্র ব্যবস্থা, ইলেকট্রনিক টার্গেটিং সিস্টেম এবং গাইডেড মিসাইল ইত্যাদি প্রয়োগ করা হতো, রাসায়নিক, জৈবিক, রেডিওলজিক্যাল বা পারমাণবিক অস্ত্র অন্তর্ভুক্ত থাকত না। যুদ্ধের প্রাথমিক উদ্দেশ্য প্রায়ই হতো সশস্ত্র শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করা এবং নির্দিষ্ট অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ দখল । কয়েকটা পুরোনো যুদ্ধের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে: ১৯১৯ সালের মিশরীয় বিপ্লব, আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৯৫৪-১৯৬২), অ্যাঙ্গোলা’র স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৯৬১-৭৪), ইথিওপিয়ান-ইরিত্রিয়ান যুদ্ধ (১৯৯৮-২০০০), প্রভৃতি ।
অপরদিকে বেশিরভাগ ‘নতুন যুদ্ধের’ বিশিষ্টতা হচ্ছে যে অন্য রাজ্যের সাথে যুদ্ধের পরিবর্তে একই রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্বই সেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে আর এই বিদ্রোহগুলো হয় বিচ্ছিন্ন, অসমমিত এবং স্বায়ত্তশাসিত। অপরাধমূলক এবং সাধারণ ব্যক্তিগত লাভ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় বলে' লোভ এবং লুটের কারণকার্য এই ছোট যুদ্ধগুলোতে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয় । বিশেষজ্ঞরা নতুন যুদ্ধ সম্পর্কে বেশ কয়েকটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন:
আইডেন্টিটি পলিটিক্স: এই দ্বন্দ্বগুলো প্রায়ই স্পষ্ট আদর্শগত লক্ষ্যের পরিবর্তে জাতিগত, ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পরিচয় দ্বারা চালিত হয়। নন-স্টেট অ্যাক্টরস: বিদ্রোহী গোষ্ঠী, মিলিশিয়া এবং যুদ্ধবাজদের মতো নন-স্টেট অ্যাক্টরদের জড়িত হওয়া। অপ্রতিসম যুদ্ধ: এই সংঘাতগুলোতে গেরিলা যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ এবং শিশু সৈন্যদের ব্যবহার সহ অনিয়মিত কৌশলের প্রয়োগ জড়িত। অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য: নতুন যুদ্ধগুলোর প্রায়ই উল্লেখযোগ্য একটা আর্থিক দিক থাকে, যেমন, সংঘাতের অর্থায়নের জন্য মূল্যবান সম্পদের (হীরা, তেল, কাঠ) উপর নিয়ন্ত্রণ বা অর্থনৈতিক শোষণ । উদাহরণস্বরূপ, সিয়েরা লিওনের সংঘাতের সময় সরকার এবং বিদ্রোহীরা উভয়ই তাদের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে বিভিন্ন উপায়ে অর্থায়নের জন্য হীরা ব্যবহার করেছিল । একইভাবে, প্রাকৃতিক সম্পদে ধনী ডিআরসি’র খনিজ সম্পদের (হীরা, সোনা, তামা, কোবাল্ট, ক্যাসিটেরাইট (টিনের আকরিক) এবং কোল্টান) উপর নিয়ন্ত্রণ কয়েক দশক ধরে সংঘাত ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেসামরিক লক্ষ্যবস্তু: ব্যাপক নৃশংসতা, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি এবং গণহত্যা সহ বেসামরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বড় বড় ঘটনা রয়েছে । বেসামরিক নাগরিকদের উপর প্রভাব: নতুন যুদ্ধ বেসামরিক জনগণের উপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধের (১৯৯৮-২০০৩) ফলে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, যার বেশিরভাগই রোগ এবং অনাহারের কারণে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সবচেয়ে মারাত্মক সংঘাতগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে এটা। বৈশ্বিক প্রভাব: নতুন যুদ্ধগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ, অস্ত্র পাচার এবং শান্তিরক্ষী বাহিনীর আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ সহ বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের সাথে আরও বেশি সংযুক্ত। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শান্তিরক্ষা মিশন, আন্তর্জাতিক অপরাধমূলক বিচার, এবং মানবিক হস্তক্ষেপ সহ বিভিন্ন কৌশল সহ নতুন যুদ্ধে সাড়া দিয়েছে। জাতিসংঘ এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির ভূমিকা এই দ্বন্দ্বগুলো পরিচালনা ও সমাধান করার প্রচেষ্টায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উপরে একটু আগেই আমরা দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধ ও সিয়েরা লিওনের সংঘাতের কথা জেনেছি। আসুন, জেনে নিই আরও ক’টা ''নতুন যুদ্ধের" উদাহরণ: ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া, প্রথম লাইবেরিয়ান গৃহযুদ্ধকেই কোল্ড ওয়ার পরবর্তী আফ্রিকার প্রথম ফুল-স্কেল "নতুন যুদ্ধের" ক্লাসিক উদাহরণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সরকারী ক্ষমতা এবং সম্পদ দখলের জন্য চার্লস টেলরের নেতৃত্বে ন্যাশনাল প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট অফ লাইবেরিয়া (NPFL), লাইবেরিয়ার তদানীন্তন রাষ্ট্রপ্রধান প্রেসিডেন্ট স্যামুয়েল ডো’কে উৎখাত করার জন্য আইভরি কোস্ট থেকে লাইবেরিয়া আক্রমণ করে। ১৯৯৭ পর্যন্ত এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়, যুদ্ধের ফলে ১৫০,০০০ থেকে ২০০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং জনসংখ্যার বেশিরভাগই বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। এ ছাড়াও রয়েছে রুয়ান্ডার গণহত্যা (১৯৯৪), উগান্ডায় জোসেফ কোনি’র লর্ডস রেজিস্ট্যান্স আর্মি’র (এলআরএ) লড়াই (.২০০২- ২০০৫), সুদানে দারফুর দ্বন্দ্ব (২০০৩-বর্তমান), সিয়েরা লিওন গৃহযুদ্ধ (১৯৯১- ২০০২), সুন্নি ইসলামপন্থী সামরিক ও রাজনৈতিক সংগঠন আল-শাবাবের সাথে জড়িত সোমালিয়ায় চলমান সংঘাত । নাইজেরিয়ার কথাটাও এখানে উল্লেখ করা দরকার, একাধিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আজ দেশটা, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বে নাছোড়বান্দা ইসলামি জিহাদি দল বোকো হারাম বিদ্রোহ এবং নাইজার ডেল্টায় দীর্ঘদিন ধরে চলমান অসন্তোষ এবং জঙ্গিবাদ। বোকো হারাম ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া দুই গোষ্ঠী JAS (Jama’tu Ahlis Sunna Lidda’awati wal-Jihad)এবং ISWAP (Islamic State West Africa Province) এই মুহূর্তে নিজেদের মধ্যে মরণঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হলেও নাইজেরিয়া এবং চাদ অববাহিকায় অন্যান্য রাজ্যের নাগরিকদের জন্য তারা এক বিশাল হুমকি ছাড়া আর কিছুই নয়।
পুরোনো আর নতুন যুদ্ধর মাঝামাঝি রয়েছে হাইব্রিড বা মিশ্র প্রকৃতির যুদ্ধ যেখানে দুইয়েরই প্রভাব লক্ষিত হয়। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। উগান্ডায় মিল্টন ওবোতে এবং টিটো ওকেল্লো'র কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটানোর জন্য ১৯৮১তে উগান্ডার শীর্ষ গেরিলা যোদ্ধা ইয়োভেরি মুসেভেনির সশস্ত্র বিদ্রোহী অভিযান 'ন্যাশনাল রেসিস্টেন্স মুভমেন্টকে' (NRM) একটা মিশ্র যুদ্ধ হিসাবে দেখা যেতে পারে, যেখানে আফ্রিকান যুদ্ধের পুরানো এবং নতুন উভয় শৈলীর উপাদানই বিদ্যমান। মতাদর্শগত অনুপ্রেরণা এবং গেরিলা কৌশল ব্যবহার করার কারণে এই যুদ্ধ পুরানো যুদ্ধের সাথে তুলনীয়, অন্যদিকে যখন এই যুদ্ধের আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রকৃতি, যুদ্ধে অ-রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ এবং যুদ্ধের উদ্দেশ্যের (শাসন সংস্কার) উপর ফোকাস করা হয়, তখন এই সংঘর্ষ নতুন যুদ্ধ কাঠামোর সাথে শ্রেণীবদ্ধ হতে পারে।
যুদ্ধের শ্রেণীবিভাগ আর তার গতিপ্রকৃতি নিয়ে তো এতক্ষণ অনেক কচকচানি হলো, কিন্তু আসল প্রশ্নটা হলো একবিংশ শতকের এই যুদ্ধবাজ দলপতিরা কী চায়? রাজধানীর অধিকার আদায় করা? বড় বড় শহরগুলো দখল করা? নাহ, সেরকম কোনো ইচ্ছে তাদের আছে বলে তো মনে হয় না, বরঞ্চ বন জঙ্গল, ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থেকে চোরাগোপ্তা খুনখারাবি, জখমলুণ্ঠন ক'রে নির্বাধায় উধাও হয়ে যাওয়াই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে এ যাবৎ মালুম হয়েছে।
আমাদের জানতে ইচ্ছে করতেই পারে, পুরোনো থেকে নতুন যুদ্ধে কেন এই স্থানান্তর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বমঞ্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র নেতৃস্থানীয় শক্তি ছিল না; সোভিয়েত ইউনিয়নও এই শক্তির জন্য নতুন এক প্রতিযোগী ছিল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই দুই শক্তির মধ্যে যে চাপা উত্তেজনা স্থায়ী ছিল তা ''কোল্ড ওয়ার'' নামে পরিচিত । এই দুই শক্তিই আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিযোগিতা করেছিল, আফ্রিকান দেশগুলিকে পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য করেছিল। এই সময়কালটিকে "প্রক্সি কোল্ড ওয়ার" বা "আফ্রিকার জন্য দ্বিতীয় স্ক্র্যাম্বল" বলা হয়।
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এই দুই প্রধান শক্তির মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক শত্রুতা এবং প্রতিযোগিতা অনেকাংশেই সাব-সাহারান আফ্রিকায় যুদ্ধ-বিগ্রহের গতিপ্রকৃতির উপর ছায়া ফেলেছে । আফ্রিকার পুরোনো থেকে নতুন যুদ্ধে স্থানান্তর এই শক্তিগুলির মধ্যে কোল্ড ওয়ার-পরবর্তী সংঘাত-প্রকৃতির বৈশ্বিক পরিবর্তনকেই প্রতিফলিত করে।
দেখুন, পুরোনোই হোক অথবা নতুন, যুদ্ধ মানেই ধ্বংসের তান্ডব, কারুরই কাম্য নয় তা, সবাই তার সমাপ্তি প্রার্থনা করে; তবু এই দুইয়ের মধ্যে যদি তুলনা করলে একটা সত্য বেরিয়েই আসে যে, নতুন ঢঙের যুদ্ধগুলোর মধ্যে বেশ কিছু সবথেকে নৃশংস, সবচেয়ে রক্তাক্ত সংঘর্ষ মনে হচ্ছে কখনই শেষ হবে না । ভাবছেন কেন এরকম বলছি? কারণ সেগুলো আসলে কোনো যুদ্ধই নয়; অন্তত প্রথাগত অর্থে নয় । কি মানছেন না তো? তাহলে শুনুন: অতীতে আমরা আফ্রিকার মুক্তি আন্দোলনের যে রূপ দেখেছি, তা হলো শাসকশ্রেণীর যথেচ্ছ অত্যাচার, বর্ণবাদ, বা ঔপনিবেশিকতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষ মরিয়া হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে, অজস্র রক্ত ঝরেছে, কিন্তু তার পিছনে ছিল যৌক্তিকতা, সেগুলো ছিল আদর্শের লড়াই, স্বাধীনতার লড়াই, মানুষের যোগ্য মর্যাদা আদায়ের সংগ্রাম, কিন্তু আজ সেখানে যা হচ্ছে তার নৃশংসতা, অমানবিকতা আর হিংস্রতা দেখেশুনে আমাদের হাড়হিম হয়ে যাচ্ছে । পুরানো ক্লাসিক আফ্রিকান লিবারেশন আন্দোলনের পতন হয়েছে এবং তার বদলে সাংঘাতিক কিছু বর্বরতা, কিছু উন্মত্ততার চাষাবাদ চলেছে । একটা উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাপারটা আরও খোলসা করে বলা যাক । আচ্ছা আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, উগান্ডার দুজন নেতার মধ্যে কাকে আপনি বেছে নেবেন? ইয়োভেরি মুসেভেনি, নাকি জোসেফ কোনি? কী হলো, কপালে অতগুলো ভাঁজ পড়ল কেন? ঠিক ধরেছি, নামগুলো চেনা চেনা ঠেকছে, কিন্তু তাদের ঘিরে, বিশদ ঘটনাগুলো মনে আসছে না? চিন্তিত হবেন না, সূত্রগুলো এক্ষুনি ধরিয়ে দিচ্ছি ।
১৯৮০ সাল থেকে উগান্ডা সরকারের সশস্ত্র শাখা বাহিনী--উগান্ডা ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (ইউএনএলএ) বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় । এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো উগান্ডার শীর্ষ গেরিলা যোদ্ধা মুসেভেনির 'ন্যাশনাল রেসিস্টেন্স মুভমেন্ট' (NRM) । শুরু হয় উগান্ডা গৃহযুদ্ধ । মুসেভেনি তাঁর অধীনে বিরোধীদের ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স আর্মিতে (এনআরএ) একত্রিত করে’যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং ১৯৮৬ সালে তিনি ক্ষমতায় আসেন । সেই থেকে আজ অবধি তিনি উগান্ডার প্রেসিডেন্ট পদেi অধিষ্ঠিত রয়েছেন । বহু বছরের সংঘাতের পর উগান্ডায় অনেকটা স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনেন তিনি । অবশ্য, এ কথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই যে, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অভিযোগে তাঁর শাসনকাল মসীলিপ্ত।
এবার আসি, উত্তর উগান্ডার কুখ্যাত লর্ডস রেজিস্ট্যান্স আর্মি’র (এলআরএ) বিদ্রোহী গোষ্ঠীনেতা জোসেফ কোনি’র প্রসঙ্গে । টেন কমান্ডমেন্টসের নাম দিয়ে ধর্মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি লড়াই শুরু করেন । কোনি এবং এলআরএ’র লড়াইয়ের নৃশংস কৌশলের মধ্যে ছিল ৩০,০০০ টিরও বেশি শিশুর অপহরণ । অপহৃত ছেলেগুলোর হাতে কালাশনিকভ বা কুড়ুল ধরিয়ে দিয়ে, তাদের সৈনিক আখ্যা দিয়ে নিরপরাধ মানুষদেরকে নির্বিচারে হত্যা করতে, আর মেয়েগুলোকে যৌনদাসীতে পরিণত হতে বাধ্য করানো হতো । এলআর-এর অপরাধের তালিকায় এছাড়াও ছিল বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, এবং অঙ্গচ্ছেদ । জুলাই ২০০২ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০০৫ এর মধ্যে সংঘটিত ৩৬টি মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নারকীয় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে এলআর’র বিরুদ্ধে। কোনির অত্যাচারে প্রতিবেশী দেশগুলিতে কয়েক দশক ধরে ব্যাপক দুর্ভোগ, কুড়ি লক্ষ মানুষের বাস্তুচ্যুতি ও আতঙ্কের পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয়েছিল।
জানি এবার আপনি নির্ঘাত চেঁচিয়ে বলে উঠবেন, ‘কিসের মধ্যে কি পান্তা ভাতে ঘি’; এদের দুজনের মধ্যে মধ্যে কি কোনো তুলনা হতে পারে? হ্যাঁ, এবার এক্কেবারে ঠিক কথা বলেছেন । এই দুজনের লড়াইয়ের নীতিপদ্ধতিতে বিস্তর ফারাক আর সে সম্বন্ধে আমরা একটু আগেই জেনেছি । সবচেয়ে বড়ো কথা মুসেভেনি একজন দেশপ্রধান আর কোনি কেবলমাত্র একজন যুদ্ধবাজ জঙ্গি । আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ২০০৫ সালে কোনির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উগান্ডা দুই দেশই ২০১২ সাল থেকে ফেরারি কোনিকে ধরবার তালে ছিল । এপ্রিল ২০১৭, নাগাদ কোনি তখনও টিকে ছিল, কিন্তু এলআরএ’র সৈন্যসংখ্যা ৩,০০০ থেকে কমতে কমতে আনুমানিক মাত্র একশতে এসে ঠেকেছে বলে জানা গিয়েছিল । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উগান্ডা উভয়ই তখন কোনি এবং এলআরএ’র খোঁজে ক্ষান্তি দেয়, কারণ তারা বুঝেছিল যে, উগান্ডার নিরাপত্তার জন্য এলআরএ আর উল্লেখযোগ্য কোনো ঝুঁকি ছিল না।
আফ্রিকার যুদ্ধের সময়রেখা অনুসরণ করতে করতে আমরা তার সাম্প্রতিক রূপান্তরের বিস্তারিত পরিচয়ও পাচ্ছি । সাব-সাহারান আফ্রিকা জুড়ে রাষ্ট্র-ভিত্তিক সশস্ত্র সংঘাতের গতিশীলতায় ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় সহিংসতার আস্ফালন এক উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে । অনেকেই হয়তো এই মুহূর্তে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করবেন, যে, তবে কি আফ্রিকার লম্বা যুদ্ধ ইতিহাসে ধর্মীয় উপাদান ছিল না? উত্তরটা হলো, হ্যাঁ, সেই প্রাক-ঔপনিবেশিক সময় থেকেই আফ্রিকার অনেক সংঘাতে তার উপস্থিতি দেখেছি আমরা । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ১৯ শতকের শেষের দিকে এবং ২০ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতা যে প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল তা আংশিকভাবে ধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল - সে প্রথাগত ধর্মই হয়ে থাকুক বা ইসলাম । স্বাধীনতার পর থেকে, বিভিন্ন সশস্ত্র সংঘর্ষেও ধর্মগুলো ভূমিকা পালন করেছে, যেমন পশ্চিম আফ্রিকায়। কিন্তু এখানে একটা কথা আছে: প্রারম্ভিক আফ্রিকান যুদ্ধগুলিতে, ধর্ম প্রায়শই সহিংসতাকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে এবং আধ্যাত্মিক আচার-অনুষ্ঠান এবং বিশ্বাসগুলি সরাসরি যুদ্ধের কৌশলগুলিকে প্রভাবিত করে যুদ্ধের বুননে গভীরভাবে একীভূত হয়েছে, অথচ বর্তমান আফ্রিকান দ্বন্দ্বগুলোতে, ধর্ম প্রায়ই রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা সমর্থন জোগাড় করা এবং সহিংসতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য একটা হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে । সংঘর্ষের আসল উদ্দেশ্য থাকে সাধারণত জাতিগত, সম্পদ নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ের মতো জটিল সমস্যা, ধর্মীয় উত্তেজনাকে সেখানে একটি গৌণ কারণ হিসাবে উপলব্ধ করা হয় । ২০১০ সাল থেকে, বিভিন্ন সক্রিয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেমন আল শাবাব (সোমালিয়া এবং পূর্ব আফ্রিকার অন্যত্র), বোকো হারাম (আফ্রিকার লেক চাদ অঞ্চল যেমন নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, চাদ এবং নাইজার), এবং আল-কায়েদা ইন দ্য ইসলামিক মাগরেব (AQIM) (মালি সহ আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল) তাদের জঙ্গিবাদকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ইসলামী ধর্মতত্ত্বের একটি বিকৃত সংস্করণকে সমর্থন করে আফ্রিকার সংঘাতের পটভূমিকায় আরও বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে। এই যুদ্ধবাজেরা মহাদেশটার সহিংস চরমপন্থার ক্রমবর্ধমান মাত্রাকে তীব্র করেছে, বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকা, সাহেল এবং হর্ন অফ আফ্রিকা জুড়ে।
এখানেই শেষ নয়, গত এক দশকে, আফ্রিকা জুড়ে হামলাকারীদের মধ্যে রিমোট ভায়োলেন্সের ব্যবহার দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে, ২০০৫ সালে রেকর্ড করা সশস্ত্র সংঘাতগুলোর মাত্র ০.৯৫ শতাংশের জন্য তা দায়ী ছিল, কিন্তু ২০১৪ সালে, এই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ৮.৯৩ শতাংশ। আরও চিন্তার কথা হলো, নন-স্টেট বিদ্রোহীরা আজকাল হামলার সময় বিভিন্ন ধরনের আইইডি (ইম্প্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) এবং আত্মঘাতী বোমা (সুইসাইড বম্ব) কৌশল ব্যবহারের প্রবণতাও একইভাবে ক্রমশ বেড়ে চলেছে । শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় ১৬টি আফ্রিকান দেশের সুইসাইড বম্বিং-এর ঘটনা তালিকাভুক্ত করে' একটা ডাটাবেস সংকলিত করেছে । সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, প্রথম ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল সেই ১৯৯৫ সালে। তারপর থেকে, ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত আফ্রিকাতে রেকর্ড করা ৪৮৩টি আত্মঘাতী হামলার মধ্যে ৪৬৫টিই শুরু হয়েছে ২০০৭ সাল থেকে । 4,৮২২ জন তাতে নিহত হয়েছে এবং ৯,০০০-এর বেশি আহত । যে ছটি আফ্রিকান দেশ এই ধরনের অসমমিতিক কৌশলের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—সেগুলো হলো আলজেরিয়া, মিশর, লিবিয়া, মালি, নাইজেরিয়া এবং সোমালিয়া ।
গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতোই আফ্রিকা অতি দ্রুত একটা হাইব্রিড ওয়ারফেয়ারের রঙ্গমঞ্চ হয়ে উঠছে যেখানে রাজনৈতিক যুদ্ধ, অনিয়মিত যুদ্ধ এবং অন্যান্য পদ্ধতি যেমন ভুয়া খবর, কূটনীতি এবং বিদেশী নির্বাচনী হস্তক্ষেপের মিশ্রণ জড়িত থাকে । এ এমন এক ভয়াল সামরিক কৌশল যা সমাজকে অস্থিতিশীল করার জন্য, যা যুদ্ধ এবং শান্তির মধ্যে পার্থক্যকে অস্পষ্ট করার জন্য সন্ত্রাস সহ প্রচলিত এবং অপ্রচলিত কৌশলগুলোকে একাট্টা করে। সাইবার আক্রমণ, তথ্য অপারেশন, মনস্তাত্ত্বিক অপারেশন, অর্থনৈতিক আক্রমণ এবং প্রক্সির ব্যবহার, এ সবই এর অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। মালিতে বিভেদ বিচ্ছিন্নতা আরও একটু উস্কে দেবার জন্য পরিকল্পিত রাষ্ট্র-সমর্থিত তথ্য প্রচারের অভিযোগ এবং রেড ক্রসের ইন্টারন্যাশনাল কমিটি (ICRC) এর মতো মানবিক ত্রাণ সংস্থার উপর জানুয়ারি ২০২২ সাইবার হামলা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। হর্ন অফ আফ্রিকা, সাহেল এবং মোজাম্বিকে সহিংস সশস্ত্র গোষ্ঠী, স্টেট্ এক্টর্স বা তাদের প্রক্সিদের দ্বারা অস্ত্র হিসাবে ড্রোনের ব্যবহারও এই উদীয়মান প্রবণতাকে নির্দেশ করে ৷ আফ্রিকার ক্ষেত্রে, দুর্বল শাসনব্যবস্থা এবং ব্যাপক দুর্নীতির কারণে, হাইব্রিড যুদ্ধের নাটুয়ারা আন্তঃজাতিক সংগঠিত অপরাধী গোষ্ঠীগুলির সাথে আরও গভীরভাবে জড়িত থাকে, এবং তাতে দুই পক্ষেরই দায়মুক্তভাবে দুষ্কার্য করার ক্ষমতা বেড়ে যায় এবং হাইব্রিড অভিযান থেকে লাভের বখরা হাসিল হয় ।
প্রশ্ন হলো তবে এর সমাধানটা কোথায়?
আফ্রিকার প্রথাগত, রাষ্ট্র-ভিত্তিক দ্বন্দ্ব থেকে আরও জটিল, অনিয়মিত যুদ্ধে সরে আসার এই প্রবণতা গভীর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানবিক পরিবর্তনের প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়। যতক্ষণ না নীতিনির্ধারকেরা আফ্রিকা জুড়ে সশস্ত্র সংঘাতের বিবর্তনশীল চরিত্র ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছেন এবং তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাঁদের শান্তি স্থাপন এবং শান্তিরক্ষার জন্য কার্যকর কৌশল প্রকল্প চালু করতে পারছেন, ততক্ষন অবধি এই অঞ্চলে "সাইলেন্স দা গানস”-এর আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা অকার্যকরই থেকে যাবে।
মেটা, ইউটিউব টিকটক এবং অন্যান্য সামাজিক মিডিয়া প্লাটফর্মগুলোর উচিত আফ্রিকা এবং আফ্রিকান ভাষায় বিভ্রান্তি পর্যবেক্ষণ এবং মোকাবেলার জন্য তাদের সমস্ত সংস্থানগুলোকে বরাদ্দ করা, ঠিক যেমনটি তারা করেছিল ইউরোপের বেলায়-- খবরের সত্যাসত্য বিচার করা এবং গণতন্ত্র রক্ষায় জড়িত নাগরিক সমাজ সংস্থাগুলির সাথে মিলেমিশে কাজ করা ।
এই প্রতিবেদনটি লেখার সময়, ‘দ্য ব্লাড ডায়মন্ড’ সিনেমার কথা মনে আসছিল। সিয়েরা লিওন গৃহযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে ২০০৬ সালের এই সিনেমাটি তৈরি হয় । সিয়েরা লিওনের প্রাক্তন সেনাবাহিনীর কর্পোরাল ফোদায় সাঙ্কোহের নেতৃত্বে আরইউএফ (RUF) বিদ্রোহীরা জোসেফ মোমোহ সরকারকে উৎখাত করার প্রয়াসে সিয়েরা লিওনে আক্রমণ চালায় । প্রায় এগারো বছর স্থায়ী হয় এই দ্বন্দ্ব এবং এতে মোট হতাহতের সংখ্যা ছিল ৫০,০০০, ৭০,০০০ পর্যন্ত; সংঘাতের সময় আনুমানিক ২.৫ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল । শিশুদের অপহরণ করে’ তাদের সৈনিক হতে বাধ্য করা এবং সিয়েরা লিওনিয়ানদের দাসত্ব সহ যুদ্ধের নৃশংসতাকে চিত্রিত করার জন্য ছবিতে অনেকগুলো কাল্পনিক চরিত্র ব্যবহার করা হয়েছে । সিনেমাটিতে আরও দেখানো হয়েছে যে আরইউএফ কীভাবে হীরা খননের মাধ্যমে তাদের যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল অর্থ জোগাড়ের কাজটি রাষ্ট্র-বহির্ভূত উৎস থেকেই করেছিল । সিনেমায় অভিনেতা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও এক জায়গায় বলছেন,“মাঝে মাঝে আমি ভাবি, আমরা একে অপরের সাথে যা করেছি তার জন্য ঈশ্বর কি আমাদের ক্ষমা করবেন? তারপর আমি চারপাশে তাকাই এবং বুঝতে পারি, ঈশ্বর অনেক দিন আগেই এই জায়গা ছেড়ে চলে গেছেন" । আফ্রিকার বর্তমান পরিস্থিতির সাথে এই কথাগুলো যেন খাপে খাপ মিলে যায় ।