২২শে জানুয়ারী, ১৯৯৯। স্থান, ওড়িশার মনোহরপুর। সময় মাঝ রাত। প্রচণ্ড শীতের রাতে গাড়ির মধ্যেই ঘুমিয়ে এক পিতা সাথে দুই শিশু পুত্র, বয়েস ১০ ও ৬ বছর, স্কুলের ছুটিতে বাবার কাছে এসেছিল। ৫০ জনের এক গুন্ডা বাহিনী আক্রমণ করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় গাড়ি। পরে ময়না তদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা যায় গ্রাহাম স্টেন এবং দুই শিশু পালানোর চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু ওই ৫০ এর বাহিনীর বাধায় গাড়ি থেকে বেরোতে পারেন নি। পরবর্তী কালে বজরং দলের এক কর্মী দারা সিং এর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ২০২৪ এ এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ২৫ বছর পূর্ণ হল। স্বভাবতই স্মৃতির ঝুল ঝেড়ে আবার আলোচনায় উঠে আসে ১৯৯৯ এর ঘটনা। একটি WA গ্রুপে এক বন্ধুবরকে দেখেছিলাম এমনই এক আলোচনায় নির্দ্বিধায় ওই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সমর্থনে কথা বলতে। সেই বন্ধুই এখন আর জি করের নৃশংস ধর্ষণ ও খুন নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে জবরদস্ত আন্দোলনে সামিল। আর জি করের ঘটনা এত বীভৎস, এতো নৃশংস, এত পৈশাচিক যে রাস্তার মিছিলে অংশ নিলেও এই নিয়ে কিছু লেখার কথা ভাবতে পারছিলাম না। বলতে পারেন, বন্ধুবরের দুটি ভিন্ন প্রতিক্রিয়া আর তার সাথে আরও কিছু মানুষের কৃত্রিম শোক আর অকৃত্রিম ধান্দাবাজী বাধ্য করল, কিছু কথা বলতে। আঁধার শুধু তো আর জি কর জুড়ে নয়, তার ব্যাপ্তি গোটা সমাজ জুড়ে।
সমাজ মাধ্যম। অধিকাংশ মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখেই বোঝা যায়, তাঁরা কি সাংঘাতিক রকম হতাশা, রাগ, ক্ষোভে ফুটছেন। তাঁদের যন্ত্রণা, তাঁদের সহমর্মিতা, ওনাদের লেখাতেই পরিষ্কার। কিন্তু সবাই তাঁদের মত নন। কিছু মানুষ শোক প্রকাশ করেছেন নির্যাতিতার ছবি পোস্ট করে। এনাদের পোস্ট পড়ে মনে হয় এক একজন ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন গুলে খেয়েছেন। তাঁরা কি জানেন না যে ধর্ষিতার নাম বা পরিচয় প্রকাশ করাও একটা অপরাধ এবং এর জন্য দুই বছর অবধি জেল হতে পারে? জানেন ।অবশ্যই জানেন। তাঁদের ওয়ালেই অন্যরা লিখেছেন এই জাতীয় পোস্ট বেআইনি, অনুরোধ করেছেন ছবি ও নাম সরাবার জন্য। পোস্ট দাতা অবশ্যই কর্ণপাত করেন নি। করবেন কেন? তাঁর পোস্ট তো, রাগ, শোক, ক্ষোভ, অসহায়তা, সহমর্মিতার প্রকাশ নয়, ওটা তো লাইক গোনার জন্য করা পোস্ট। পাচ্ছেন ও লাইক প্রচুর। এমনকি মৃতদেহের ছবি নিয়ে রিল বানিয়ে শেয়ার করতেও পিছুপা হননি বেশ কিছু মানুষ। নিশ্চিত বলতে পারব না, কিন্তু মনে হয়েছে যাঁরা ছবি শেয়ার করছিলেন এবং যাঁরা গোগ্রাসে সেই ছবি দেখেছেন তাঁদের দৃষ্টি আর মননের সাথে ধর্ষকদের দৃষ্টি আর মননের কোন তফাৎ নেই। নজর কাড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও তাঁদের অন্ধ ভক্তদের তৎপরতাও। এই সব মানুষেরা কিন্তু উন্নাও, কাঠুয়া, হাথরাস, বিলকিস বানুর ঘটনায় নীরব ছিলেন। তখন নীরব থাকা মানে আজ প্রতিবাদ করতে পারবেন না এটা একদমই বলছিনা। এইরকম এঁড়ে যুক্তির পেটেন্ট তো তেনারা কবেই নিয়ে রেখেছেন। সেই তেনারা, যাঁরা আপনি যদি শ্যামবাবুর শরীর খারাপের সময় শ্যামবাবুকে দেখতে যান এবং শ্যামবাবু তেনাদের আমচে চামচে না হন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে দাঁত খিঁচিয়ে লেজ তুলে হুপ হাপ শব্দ করে, আপনার ওপরে এসে পড়বেন – “যখন রামবাবুর জ্বর হয়েছিল তখন কি আপনি তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন, আজ যে শ্যামবাবুর বাড়ি যাচ্ছেন?” আমার বক্তব্য এইটুকুই, যাঁরা আজ “সামাজিক” তাঁরা এটা বলছেন তো – “আগে বলিনি বা বলতে পারিনি, কিন্তু সিঙ্গুর, উন্নাও, কাঠুয়া, নির্ভয়া (দিল্লি), হাথরাস, সুটিয়া (২০০০-২০০২), বিলকিস বানু, এই সব ঘটনার নৃশংসতা কোন মাত্রাতেই আর জি করের ঘটনার চেয়ে কম নয়। প্রশাসনিক ব্যর্থতাও সব ক্ষেত্রেই প্রকট। প্রতিবাদ তখন করিনি কিন্তু আজ সবকটা নৃশংসতার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করছি।“ আবার যাঁরা শুধুমাত্র সিঙ্গুর, উন্নাও, কাঠুয়া, নির্ভয়া (দিল্লি), সুটিয়া (২০০০-২০০২), বিলকিস বানুর স্মরণ নিচ্ছেন, তাঁরা একই ভাবে বলছেন তো কামদুনি, বরুণ বিশ্বাস, সন্দেশখালির কথা। এই গোত্রের মানুষেরা, একটি অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঘের মত গর্জন করছেন আবার একই রকম অত্যাচারের অন্য আর একটি ঘটনায় এঁদের মুখ নীরবতার কারাগারে বন্দী। এই “বাঘ বন্দী” খেলোয়াড়ের দল যাঁরা selective dementia রোগে ভুগে শুধু একমাত্রিক দৃষ্টিতে ঘটনা প্রবাহ ব্যাখ্যা করছেন, হয়ত তাঁরা ধর্ষকের সমতুল্য না, কিন্তু কোনোমতেই এঁরা ধর্ষণের বিরোধীও নন। নেতাই হন বা নেতার চামচে, চিন্তাশীল মানুষ হন বা ঘিলু বন্ধক রাখা অনুগামী, ধর্ষণ – খুন এনাদের কাছে নিজস্ব এজেন্ডা পরিপূরণের সোপান মাত্র। এঁদের রাগ, শোক সব মেকি। এঁদের চিনে না রাখলে সাধারন মানুষের সব প্রয়াস চূড়ান্ত ব্যর্থ হবে, নেপোয় খাবে দই। যাবতীয় প্রচেষ্টা করছেন যাঁরা “শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়”।
একটু আগেই কতগুলো পরিচিত নাম লিখলাম – সিঙ্গুর, উন্নাও, কাঠুয়া, নির্ভয়া (দিল্লি), সুটিয়া, বিলকিস বানু, কামদুনি, বরুণ বিশ্বাস। সময়ের সরণি বেয়ে কিছু বছর বা দশকের ইতিহাস যদি খুঁজি তাহলে খুব সহজেই দেখব আর জি করের আগে আরও অনেক এরকম নৃশংস ঘটনার বলি হয়েছেন বহু নারী, কিশোরী, শিশু – এই নামগুলো তার দগদগে স্মৃতি। এই রকম কয়েকটা নৃশংসতা আজ মনে করতেই হবে, নইলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
সুটিয়া, পশ্চিম বঙ্গ, ২০০০ -২০০২
১৯৯০ এর দশকের শেষ ভাগ থেকে সুটিয়া ও তাঁর পার্শ্ববর্তী ৬ টি গ্রামের প্রান্তিক পরিবারের মেয়েদের গণধর্ষিত হওয়া বা খুন হয়ে যাওয়া ছিল এক নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। শুধুমাত্র ২০০০ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে ওই অঞ্চলে ৩৩ টি ধর্ষণ ও ১২ টি খুনের ঘটনা ঘটে। বহু সময়ে সুশান্ত চৌধুরী আর তার বাহিনী এক এক পরিবারের শিশু থেকে বৃদ্ধা সব মহিলাকেই, একযোগে, পরিবারের বাকি সদস্যদের সামনে ধর্ষণ করত। প্রশাসন দেখেও কিছু দেখত না, শুনেও কিছু শুনত না। এই প্রেক্ষিতেই ২০০০ সালে স্থানীয় মানুষ সংঘবদ্ধ হন, প্রতিষ্ঠা হয় “সুটিয়া গণধর্ষণ প্রতিবাদ মঞ্চ”। ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা থেকে সুটিয়ার দুরত্ব মাত্র ৫০/৬০ কিলোমিটার, সেইখানেই একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই নামের এক সংগঠন গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছিলেন স্থানীয় মানুষ! ২৮ বছরের এক যুবক, নাম বরুণ বিশ্বাস, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম এ, মিত্র ইন্সটিটিউশনের শিক্ষক, মঞ্চের একজন অগ্রণী সংগঠক। মানুষের গণ আন্দোলনের ফলে সুশান্ত চৌধুরী আর তার তিন সাকরেদ জেলে যায়, এলাকায় শান্তি নামে এক দশক পর। মানুষ রাস্তায় নামার আগে অবধি প্রশাসন কিন্তু পুরো বোবা কালা হয়ে বসেছিল। এই সংগ্রামে নেতৃত্বে দেওয়ার মুল্য বরুণ চুকিয়েছিলেন আর ১০ বছর পরে, যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ২০১২ র ৫ই জুলাই, সুটিয়া গ্যাং এর হাতে নিহত হন। ভাড়াটে খুনি ধরা পরে, কিন্তু সুশান্ত চৌধুরী ছাড়া, তার পিছনে আরো কোন বড় মাথা ছিল কিনা, তা আজ অবধি অজানা। [তথ্যসুত্রঃ Times of India 12.07.2012 এবং wikipedia]
সিঙ্গুর, পশ্চিমবঙ্গ, ২০০৬
সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো গাড়ির কারখানার জন্য সরকারের জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে রাজ্য উত্তাল। সিঙ্গুর কৃষি জমি রক্ষা কমিটির নেতৃত্বে চলছে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এক অষ্টাদশী সেই সংগ্রামের এক সৈনিক। আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ১৮ই ডিসেম্বর, ২০০৬ এর ভোরে সেই অষ্টাদশীর অর্ধদগ্ধ শরীর পাওয়া যায় নির্মীয়মাণ কারখানার মধ্যের এক গর্তে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জানায় কিশোরীকে আগে ধর্ষণ করে তারপর খুন করা হয়। তারপর মৃতদেহ পুড়িয়ে গর্তে ফেলা হয়। সিবিআই তদন্তের পর জেলা আদালত তৎকালীন শাসক দলের দুই নেতা, সুহৃদ দত্ত ও দেবু মালিককে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি দেয়। পরে অবশ্য এই ঘটনাই নাটকীয় মোড় নেয়। সিবিআই এর তদন্তকারি অফিসার ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়েন সিবিআই এর হাতে। সুহৃদ দত্ত ও দেবু মালিক পরে কলকাতা আদালত থেকে জামিন পান। মামলার নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। ইতমধ্যে সুহৃদ দত্ত মারা গেছেন ২০২৩ সালে।
মৃতদেহ আবিষ্কার হবার পরেই একদল মানুষ কিন্তু পুরো দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছিলেন নিহত কিশোরীর বাবা ও ভাই এর ওপর। স্বাভাবিক যে তাদের আমচে চামচেরাও একই ধুনো ধরেছিলেন, যেমনটা ঠিক ধরার কথা। [তথ্যসুত্রঃ Times of India, 12.02.2009]
দিল্লি, ২০১২
১৬ই ডিসেম্বর, ২০১২, শীতের রাত, কাজ সেরে বাসে করে বাড়ি ফিরছিলেন ২২ বছরের এক তরুণী ফিজিওথেরাপিস্ট সাথে একজন পুরুষ সঙ্গী। সেই বাসে ছিল ৬ জন পিশাচ, ৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, ড্রাইভার ও কন্ডাক্টর সমেত, আর একজন স্কুল সার্টিফিকেট অনুযায়ী সাড়ে ১৭ বছরের নাবালক। এরা পুরুষ সঙ্গীকে প্রথমে মারধর করে তারপর বেঁধে রেখে, গণধর্ষণ আর পৈশাচিক অত্যাচার চালায় তরুণীর ওপর। নির্যাতিতাকে প্রথমে ভর্তি করা হয় সফদরজং হাসপাতালে। চিকিৎসায় সাড়া না মেলায় বায়ু সেনার বিমানে নিয়ে যাওয়া হয় সিঙ্গাপুরে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। ৬ জনই গ্রেফতার হয় অতি দ্রুত, তার মধ্যে ৪ জন গ্রেফতার হয় ২৪ ঘন্টার মধ্যে। গ্রেফতার করা হয় দিল্লি, বিহার, উত্তর প্রদেশ ও রাজাস্থান থেকে। রাম সিং, যে ছিল বাসের ড্রাইভার, সে জেলে আত্মহত্যা করে। বিচারের পর, বাকি চার জন অর্থাৎ মুকেশ সিং, বিনয় শর্মা, অক্ষয় ঠাকুর এবং পবন গুপ্তার ফাঁসী হয় ২০২০ সালে। নাবালকটির ৩ বছরের সাজা হয়, সে জেল থেকে মুক্তি পায় ২০১৫ সালে।
ঘটনা সামনে আসার পর দেশ জুড়ে বিক্ষোভের ঝড় ওঠে। কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল দিল্লি। হাজারো মানুষ বসে পড়েন ইন্ডিয়া গেটের সামনে। বহু জায়গায় পুলিশ লাঠি, কাঁদানে গ্যাস ও জল কামান ব্যাবহার করে। দিল্লি মেট্রো বন্ধ করা হয়, ১৪৪ ধারা জারি হয় যাতে মানুষ ইন্ডিয়া গেটের সামনে ধর্নাস্থলে পৌঁছাতে না পারে। সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। একজন কনস্টেবল মারা যান। কিন্তু আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলতে কোন শীর্ষ স্থানীয় নেতা একবারও ইন্ডিয়া গেটে আসেন নি। তবে শাসক দলের প্রধান হাসপাতালে নির্যাতিতাকে দেখতে গিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর ছেলে অভিজিত মুখার্জী এক সাক্ষাতকারে বলেন “এই আন্দোলন অনেকটাই ইজিপ্টের পিঙ্ক বিপ্লবের মত যার সাথে মাটির কোন যোগাযোগ নেই। আমি অনেক রং চং মাখা (highly dented-painted) সুন্দরী মহিলাদের দেখছি প্রতিবাদ করছেন, এরা ছাত্র নয়, ছেলে মেয়ে নিয়ে ছবি তুলতে এসেছেন”। যদিও অভিজিতের বাবা ও বোন এই বক্তব্যের সমালোচনা করেন। [তথ্যসুত্র: Times of India, 27.12.2012 ও Wikipedia, সমস্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কাগজের বিস্তারিত রেফারেন্স ওখানেই পাওয়া যাবে]
উন্নাও, উত্তর প্রদেশ, ২০১৭
২০১৭ সালের জুন মাসের ৪ তারিখে ১৬ বছরের এক কিশোরী চাকরির আবেদন নিয়ে দেখা করে স্থানীয় এমএলএ কুলদীপ সিং সেঙ্গারের সঙ্গে। ওখানেই ধর্ষিত হয় কিশোরী। পুলিশ কেস হয়, কিন্তু পরের ১০ মাসে কেউ গ্রেফতার হয় না। বিচার চেয়ে কিশোরী আর তার পরিবারের লোকজন বোধহয় একটু বেশী সরব ছিলেন। ফলত ৩রা এপ্রিল ২০১৮, অনামা গুণ্ডাদের হাতে আক্রান্ত হন কিশোরীর বাবা। গুন্ডাদের গ্রেফতার করার বদলে কিশোরীর বাবাকেই গ্রেফতার করে পুলিশ, বেআইনি অস্ত্র রাখার অভিযোগে। ৮ই এপ্রিল নির্যাতিতা লখনোউ এ, মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের সামনে গায়ে আগুন দেবার চেষ্টা করে। সে বেঁচে গেলে্ জেল হেফাজতে তার বাবার মৃত্যু হয় পরের দিন অর্থাৎ ৯ই এপ্রিল। ১০ই এপ্রিল রাজ্য সরকার কেসটি তুলে দেন সিবিআই এর হাতে। তারপর মহামান্য এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশে গ্রেফতার হয় সেঙ্গার। তার আগে অবশ্য সেঙ্গার ২০ টি গাড়ির কনভয় নিয়ে লখনৌ শহরে পুলিশ প্রধানের বাড়ির সামনে টিভি ক্যামেরার সামনে ভাষণ দেয়। পরের দিন গ্রেফতার হয় শশী সিং, সেঙ্গারের মহিলা সহযোগী। ২২শে নভেম্বর ২০১৮, কিশোরীর কাকা যিনি তাঁর ভাইঝি ও দাদার হয়ে আওয়াজ তুলছিলেন তিনি গ্রেফতার হন রাজ্য পুলিশের হাতে, ১৮ বছর আগে দায়ের করা - এক গুলি চালানোর অভিযোগে। এই গ্রেফতারের নির্দেশ এসেছিলি Additional District Judge, Fast Track Court 1 থেকে। সিবিআই দুটি চার্জশিট ফাইল করে। প্রথমটি ছিলি সেঙ্গার ও তার এক মহিলা সহযোগীর বিরুদ্ধে – অভিযোগ ধর্ষণ। দ্বিতিয়টি ছিল কিশোরীর বাবাকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর জন্য সেঙ্গার, তার ভাই, তিনজন পুলিশ অফিসার ও আরও পাঁচ জনের বিরুদ্ধে। ১১ই জুলাই ২০১৯, সিবিআই চার্জশিট ফাইল করে। ১৭ই জুলাই কিশোরী আর তার পরিবার একটি চিঠি লেখেন সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য বিচারপতিকে, বিষয় সেঙ্গারের চ্যালা চামুণ্ডারা তাঁদের হুমকি দিচ্ছে প্রাণে মারার। চিঠিটি আদালতের নজরে আসার আগেই ২৮শে জুলাই একটি ট্রাক হাইওয়েতে ধাক্কা মারে একটি গাড়িতে, যেখানে সফর করছিলেন নির্যাতিতা, তাঁর দুই আত্মীয়া ও নির্যাতিতার উকিল। এনারা আদালতে সাক্ষী দিতে যাচ্ছিলেন। অকুস্থলেই দুই আত্মীয়া মারা যান। নির্যাতিতা ও উকিল দুইজন গুরুতর আহত হলেও তার পর হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মীদের সৌজন্যে প্রাণে বেঁচে যান। ট্রাকের নম্বর প্লেট কালো কালিতে লেপা ছিল। যে পুলিশ কর্মীদের নিয়োগ করা হয়েছিল কিশোরীকে নিরাপত্তা দেবার জন্য তাঁদের কেউ গাড়িতে ছিলেন না। তাঁদের বক্তব্য গাড়িতে জায়গা ছিল না। পুলিশ একটি মামলা দায়ের করে পরের দিন। ৩১শে জুলাই সুপ্রিম কোর্টের নজরে আসে নির্যাতিতার চিঠি। কেন চিঠিটি আসতে এত দেরি হল তার কারণ জানতে চায় আদালত। ফৌজদারি মামলাটি উত্তর প্রদেশ থেকে বদলি করে দেওয়া হয়, দিল্লির তিস হাজারি আদালতে এবং নির্দেশ যায় ৪৫ দিনের মধ্যে মামলার নিস্পত্তি করতে হবে। নির্যাতিতাকে লখনউ এর কিংস জর্জ মেডিকেল কলেজ থেকে আকাশ পথে নিয়ে আশা হয় দিল্লির এইমস হাসপাতালে। ৫ই আগস্ট মামলা শুরু হয়। নির্যাতিতার জবানবন্দী নেওয়া হয় সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখে, তার জন্য বিশেষ আদালত বসে এইমসে। নির্যাতিতা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান ২৫শে সেপ্টেম্বর। ২০১৯ এর ২০শে ডিসেম্বর আদালত যাবাজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় সেঙ্গারকে। ছাড়া পান সেঙ্গারের সহ অভিযুক্ত শশী সিং। দুই বছরের মধ্যেই মামলার নিস্পত্তি হয় শীর্ষ আদালতের হস্তক্ষেপে। [তথ্যসুত্র: Wikipedia, সমস্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কাগজের বিস্তারিত রেফারেন্স ওখানেই পাওয়া যাবে ]
যদিও দেশ এবং দেশের সীমানা ছাড়িয়েও সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পরেছিলেন, একটি বিশেষ প্রজাতির মানুষ যারা খুব সঙ্গত কারণেই আজ খুব সোচ্চার, সেইদিন কিন্তু পাথরের মত নির্বাক ছিলেন।
কাঠুয়া, জম্মু ও কাশ্মীর, ২০১৮
সিঙ্গুর এর নারকীয় ঘটনার ঠিক একযুগ পরে জানুয়ারী ২০১৮ তে জম্মুর কাঠুয়া অঞ্চলের রসনা গ্রামে কিছু অমানুষ মিলে একটি নয় বছরের শিশু কে সাতদিন ধরে গণ ধর্ষণ করে খুন করে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে এই শিশুটিকে ঘুমের ওষুধ গিলিয়ে অচেতন করে রাখা হত, আর তার মধ্যেই ওই নরপিশাচরা পালা করে ধর্ষণ করে। ১০ই জানুয়ারি থেকে ১৭ই জানুয়ারী শিশুটির মৃতদেহ উদ্ধার হওয়া অবধি তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল এক উপাসনালয়ের মধ্যে। শিশুটির পরিবারের লোকেরা যখন সব জায়গায় শিশুটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল তখন শিশুটিকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ওই উপাসনাগৃহে আটকে রেখে গণ ধর্ষণ করে চলেছিল কয়েকজন নরপিশাচ। তবে আটক এই শিশুটি একটি মারাত্মক অপরাধে দুষ্ট ছিল। সে ছিল বাকরওয়াল নামের এক যাযাবর সম্প্রদায়ের কন্যা। ৬/৭ দিন গণধর্ষণের পর গলা টিপে, মাথা পাথর দিয়ে থেঁতলে মারা হয় শিশুটিকে। আট জন মানুষ গ্রেপ্তার হয় তার মধ্যে একজন ছিল নাবালক। দ্রুত বিচারের পরে তিনজনের আজীবন কারাদণ্ড হয়, সাঞ্জি রাম, দীপক কাজুরিয়া এবং প্রভেশ কুমার। এরা ছিল মুল অভিযুক্ত। সাঞ্জি রাম ছিল যে উপসনাগৃহে শিশুটিকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে নয় দিন ধরে একাধিক ব্যাক্তি টানা ধর্ষণ করেছিল, সেই উপাসনা গৃহের পুরোহিত ও অন্যতম ধর্ষক। তিলক রাজ, আনন্দ দত্ত ও সুরেন্দার ভার্মার জেল হয় পাঁচ বছরের জন্য, এই গুণধরেরা প্রমান লোপাট করেছিল। এই তিন মূর্তিমানের দুইজন পুলিশ অফিসার একজন পুলিশ কনস্টেবল। ফরেন্সিক পরীক্ষার সব ফলাফল, সাজা প্রাপ্তরাই যে অপরাধ করেছিল তার অকাট্য প্রমাণ দেয়।
অপরাধ ধরা পড়ার পর এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থকরা অভিযুক্তদের সমর্থনে রীতিমত মিছিল বার করে। শিশুটির পরিবার চেয়েছিল তাদের কেনা এক জমিতে শিশুটিকে শেষ শয্যায় শায়িত করতে, কিন্তু সংখ্যা গরিষ্ঠ সম্প্রদায় ভুক্ত গুন্ডা বাহিনীর হুমকিতে তাঁদের কবর দেওয়ারা জায়গা পাল্টাতে হয়েছিলো। সেই সময়কার জম্মু কাশ্মীর সরকারের দুই মন্ত্রী চৌধুরী লাল সিং এবং চান্দের প্রকাশ গঙ্গার মন্ত্রীত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো, অপরাধীদের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে মিছিল করার জন্য। সারা দেশব্যাপী এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। [তথ্যসুত্র: Wikipedia, সমস্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কাগজের বিস্তারিত রেফারেন্স ওখানেই পাওয়া যাবে]
কাঠুয়ায় যারা ধর্ষকদের সমর্থন করেছিল, দেশের অন্যত্র তাদের ভাই বেরাদাররা ফিসফিস করে সমর্থন যুগিয়েছিল নরপিশাচগুলোকে।
হাথরাস, উত্তর প্রদেশ, ২০২০
১৪ই সেপ্টেম্বর ২০২০। ১৯ বছরের এক কিশোরী গরুর খাবার আনার জন্য একটি খামার বাড়িতে গিয়েছিলেন। অভিযোগ, সন্দীপ, রামু, লাভকুশ ও রভি এই চার বীরপুঙ্গব দোপাট্টা গলায় ফাঁস দিয়ে কিশোরীকে টেনে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে। সন্দীপ ও লাভকুশ বেশ কিছুদিন ধরেই কিশোরীকে উত্যক্ত করত, বলে মেয়েটির মা জানিয়েছিলেন। নির্যাতিতার মেরুদন্ডে মারাত্মক চোট লাগে, পঙ্গু হয়ে যান ঘটনাস্থলেই। এখানেই শেষ নয়, যেহেতু কিশোরী বীরপুরুষদের বাধা দিয়েছিলেন, তাঁর গলা এমনভাবে চেপে ধরা হয়েছিল যে জিভ কেটে টুকরো হয়ে যায়। কিশোরীর মা পরে তাঁকে উদ্ধার করেন। প্রথমে তাঁরা ছুটে যান চাঁদ পা পুলিশ থানায়। স্টেশন হাউস অফিসার মহামহিম ডি কে ভার্মা অভিযোগ নিতে অস্বীকার করেন। ভার্মা সাহেব শুধু অভিযোগ নিতে অস্বীকার করেই ক্ষান্ত দেন নি, রীতিমত অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন নির্যাতিতা ও তার পরিবারের সদস্যদের। শেষ পর্যন্ত ৬ দিন পরে ২০শে সেপ্টেম্বর পুলিশ অভিযোগ নেয়। ২২ তারিখ নির্যাতিতার বয়ান নথিবদ্ধ হয়। নির্যাতিতা জানান যে তিনি ধর্ষিত হয়েছেন এবং বাধা দিচ্ছিলেন বলে তাঁর গলা চেপে ধরা হয়েছিল। ১৪ তারিখেই আলিগড় মেডিকেল কলেজে ও হাসপাতালে নির্যাতিতাকে ভর্তি করা হয়, পরে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে। সেখানেই মেয়েটির জীবন যন্ত্রণা শেষ হয় ২৯শে সেপ্টেম্বর। ময়না তদন্তের রিপোর্টে বলা হয় ভোঁতা জিনিষ দিয়ে মেরুদন্ডে আঘাত করার জন্য নির্যাতিতা পঙ্গু হয়ে যান। তার পর তাঁকে ধর্ষণ করে, গলা চেপে মারার চেষ্টা করা হয়। সেই রাতে ২.৩০ মিনিটে অভাগীর দেহ দাহ করে দেওয়া হয়, পরিবারের কারও উপস্থিতি ছাড়াই। পুরো গ্রাম ছিল পুলিশ দিয়ে ঘেরা, গ্রামের কাউকে ঘরের বাইরে আসতে দেওয়া হয় নি বলে অভিযোগ। পুলিশ জানায় যে ভিক্টিমের বাবাই নাকি প্রথমে বলেছিলেন দাহ দ্রুত করতে, তারপর তিনি নাকি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সাময়িক ভাবে নিখোঁজ হয়ে যান। কিশোরির শেষকৃত্য তাঁর নিজের ধর্ম, এক্ষেত্রে হিন্দু ধর্ম, অনুযায়ী হয় নি। নির্যাতিতার পরিবারের মহিলাদের অভিযোগ, তাঁরা পুলিশ অফিসারদের পায়ে ধরে অনুরোধ করেছিলেন যাতে মেয়েকে কিছুক্ষণ বরফে রাখা হয়, সে অনুরোধকেও পাত্তা দেওয়া হয় নি। বরফ তাঁরাই যোগাড় করেছিলেন। স্থানীয় লোকসভার সংসদ রাজভির দিলেরের অভিযোগ তাঁকেও গ্রামে ঢুকতে দেয় নি স্থানীয় প্রশাসন। এরপর এলাহাবাদ হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করেন। যখন ঘটনাটি প্রথম প্রকাশ্যে আসে, তখন আগ্রা পুলিশ, হাথরাসের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং রাজ্যের ইনফরমেশন অফিসার খবরটিকে ফেক নিউজ বলে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরে একজন বরিষ্ঠ পুলিশ আধিকারিক জানান ফরেন্সিক রিপোর্টে শুক্রাণু পাওয়া যায়নি, এবং ধর্ষণের মিথ্যে অভিযোগ আনা হয়েছে জাতি দাঙ্গা লাগানোর জন্য। এই আধিকারিকের কি মনে ছিল যে নির্যাতিতার ডাক্তারি পরীক্ষার হয়েছে ধর্ষণের সাত দিন পরে? ৩রা অক্টোবর এস পি সহ পাঁচ জন পুলিশ অফিসার সাসপেন্ড হন। মহামহিম ডি কে ভার্মা কে বদলি করা হয়। যদিও এই সময় অবধি স্বীকার করা হয় নি যে নির্যাতিতা ধর্ষিত হয়েছিলেন। পুলিশের তরফে সবসমেত ১৯ টি এফ আই আর দাখিল করা হয় যার মুল বিষয় ছিল পুরো ঘটনা এক আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, সরকারকে হেয় করা আর জাতি দাঙ্গা লাগানোর জন্য। রাজদ্রোহিতার অভিযোগও করা হয়। ঠিক তার পরেই ৪ঠা অক্টোবর রাজ্য সরকার তদন্তের ভার সিবিআই এর হাতে তুলে দেয়। সিবিআই তদন্ত শুরু করে ১০ তারিখ। ওই ৪ঠা অক্টোবর এই প্রাক্তন এম এল এ রাজভীর সিং পেহেলয়ান একটি সভা সংগঠিত করেন অভিযুক্তদের পক্ষে, সেখানে প্রায় ৫০০ মানুষ উপস্থিত ছিল। [Indian Express 05.09.2020]। ৫ই অক্টোবর হাথরাসে যাবার পথে, কেরালার সাংবাদিক, সিদ্দিক কাপ্পান ইউ এ পি এ আইনে গ্রেফতার হন, অভিযোগ ধর্মের নামে মানুষের মধ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে শত্রুতার পরিবেশ সৃষ্টি করা, ইচ্ছাকৃত ভাবে মানুষের ধর্মীয় আবেগে আঘাত দেওয়া ইত্যাদি। আরও অভিযোগ ছিল, কাপ্পান পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ার (PFI) সদস্য। দুই বছর পরে ২০২২ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর PFI কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। দুই বছর জেলে কাটিয়ে কাপ্পান জামিন পান ২৩শে ডিসেম্বর ২০২২। মধ্যেখানে অসুস্থ মায়ের সাথে দেখা করার জন্য ৭ দিন ছাড়া পেয়েছিলেন। পরে মা মারা যান যখন, তখন কাপ্পান জেলে। বিশ্বের বহু জায়গায় সুবিচারের দাবিতে আওয়াজ ওঠে। সিবিআই দ্রুত চার্জশীট পেশ করে - ১৯শে ডিসেম্বর। ২রা মার্চ আদালত সন্দীপকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়, বাকি তিনজন বেকসুর খালাস পায়। তাদের রিপোর্টে সিবিআই বলে স্থানীয় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং বিভিন্ন নমুনা এবং অন্যান্য প্রমাণ সংগ্রহে প্রচুর দেরি করার জন্য পুরো তদন্ত প্রক্রিয়াটি কলুষিত হয়ে যায়, যার ফল তিনজনের বেকসুর খালাস। [তথ্যসুত্র: Wikipedia, সমস্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কাগজের বিস্তারিত রেফারেন্স ওখানেই পাওয়া যাবে]
উন্নাও এর মতই হাথরাসের প্রসঙ্গত উঠলেই একটি বিশেষ প্রজাতির মানুষ হেঁচকি তুলতে শুরু করছেন, যদিও খুব সঙ্গত কারণেই আর জি কর নিয়ে তারা আজ খুব সোচ্চার।
গোধরা, গুজরাট, ২০২২ এবং দাহোদ, গুজরাট ২০২৩
২০২২ বা ২০২৩ সালে পৌঁছানোর আগে একবার মনে করতে হবে ২০০২ সালের কথা। ২৮শে ফেব্রুয়ারি, ২০০২, নিজের গ্রাম রাধিকাপুর থেকে পালালেন এক দরিদ্র পরিবারের বধূ, ২১ বছর বয়সের বিলকিস বানু, যিনি আবার সেই মুহূর্তে ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, সাথে তাঁর সাড়ে তিন বছরের মেয়ে সালেহা আর পরিবারের আরও ১৫ জন সদস্য। সব মিলিয়ে ১৭ জন। ঠিক তার আগের দিন, ২৭শে ফেব্রুয়ারি ঘটেছে নারকীয় গোধরা কান্ড। তারও কিছুদিন আগে ঘরে আগুন দিয়ে লুটপাট চলেছিল বিলকিসদের বাড়িতে। কাজেই গোধরা কাণ্ডের পর আর বাড়িতে থাকতে সাহস পাননি ওনারা। ৩রা মার্চ, ২০২০, টানা ৭২ ঘন্টা ধরে পালাতে পালাতে ১৭ জনের দল পৌঁছায় ছাপ্পারওয়ার গ্রামে। পালিয়ে বেড়ানোর এই অধ্যায়ের সমাপ্তি এখানেই। কারণ এখানেই তাঁদের ওপর আক্রমণ চালায় ২০/৩০ জনের একটি দল তাদের হাতে ছিল তরোয়াল, লোহার চেন এবং লাঠি। গণধর্ষণের স্বীকার হন বিলকিস, তাঁর মা এবং আরও ৩ জন মহিলা। তার সাথেই চলে অকথ্য নিপীড়ন। ১৭ জন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ৮ জন মারা যান, ৬ জন নিখোঁজ। বেঁচে থাকেন বিলকিস, একজন পুরুষ ও একটি ৩ বছরের বাচ্চা। এই বাচ্চাটি সালেহা নয়। সালেহাকে আছড়ে, মাথা পিষে মারা হয়েছিল। বিলকিসের জ্ঞান আসে ৩ ঘন্টা পর। তারপর এক আদিবাসী মহিলার কাছে কাপড় নিয়ে সেটা গায়ে জড়িয়ে থানায় অভিযোগ করেন তিনি। পরে সিবিআই বলে থানার হেড কনস্টেবল সোমভাই গিরি যা করেন তা আদতে "suppressed material facts and wrote a distorted and truncated version"। জানুয়ারি, ২০০৮, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, সুপ্রিম কোর্ট ও সিবিআই এর হাত ঘুরে মামলার নিষ্পত্তি হয় সিবিআই আদালতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ময়না তদন্ত ঠিক ভাবে হয় নি, এই সন্দেহে সিবিআই কবর থেকে মৃতদেহগুলি তুলে আবার ময়না তদন্ত করে। তখন দেখা যায় প্রতিটি দেহ মুন্ডহীন। খুনের পর মাথা কেটে নেওয়া হয়েছিল যাতে মৃতদেহ সনাক্ত না করা যায় - সিবিআই এর বক্তব্য। ১৯ জন অভিযুক্ত ছিলেন, যার মধ্যে ৬ জন পুলিশ আধিকারিক ও ১ জন ডাক্তার। এর মধ্যে বেকসুর খালাস পান ৮ জন আর বাকি ১১ জনের হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ৩ জন দণ্ডিত হন বিলকিসকে ধর্ষণের অপরাধে, ১ জন সালেহাকে থেঁতলে খুন করার জন্য,সোমভাই গিরি, সেই হেড কনস্টেবল, ভুল তথ্য নথিভুক্ত করার দায়ে। বাকি ৬ জন বেআইনি সমাবেশের জন্য দণ্ডিত হন। এই ৬ জন নিজেরা ধর্ষণ বা খুন করেছেন এমন প্রমান পাওয়া যায় নি, এনারা ওই আক্রমণকারী দলে ছিলেন এবং এই হত্যালীলা ও ধর্ষণ এর দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছিলেন। মে, ২০১৭, মুম্বাই আদালতের রায়ে ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল থাকে। ৮ জন, যারা বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন, তাদের পুনর্বিচারের আদেশ হয়। একজন অভিযুক্ত সিবিআই বিচার চলার সময়েই মারা যান। ২০১৯, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আসে বিলকিস বানুকে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ দেবার। আগস্ট, ২০২২। ১৪ বছর পর এনারা জেল থেকে মুক্তি পেলেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামিরা আগেও অনেকেই ১৪ বছরের পর মুক্তি পেয়েছেন। কখনো তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, কখনো হয়নি। কখনো বা বিতর্ক হয়েছে ১৪ বছর পরেও মুক্তি না দেওয়ার জন্য। [তথ্যসুত্র: Wikipedia, সমস্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কাগজের বিস্তারিত রেফারেন্স ওখানেই পাওয়া যাবে]
কিন্তু ২০২২ সালে ১৫ই আগস্ট জেল থেকে মুক্তি পাবার পর, গোধরায় এই মহামানবদের পা ছুঁয়ে, মালা পড়িয়ে প্রকাশ্যে সম্বর্ধনা দেয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। [তথ্যসুত্র: The Print, ২২.১০.২০২২]। পরবর্তী সময়ে শীর্ষ আদালতের নির্দেশে এই পরম পুজ্যদের আবার জেলে ঢুকতে হয়। কিন্তু জেলে যাবার আগে তাদের একজন, শৈলেশ ভাটকে দেখা যায় দাহোদে একটি জল সরবরাহ করার প্রকল্পের উদ্বোধনের মঞ্চে। তার ছবি সগর্বে সমাজ মাধ্যমে শেয়ার করেন একজন লোকসভার সাংসদ। [তথ্যসুত্র: Hindusthan Times, ২৭.০৩.২০২৩]।
আজ বেশ কিছু মানুষকে দেখছি যারা বেশ সেইদিন খুব ভক্তি ভরে ওই মহামানবদের মালা পড়া ছবি দেখে বিগলিত ছিলেন, আজ তারাও আর জি কর কাণ্ডে খুব সরব।
পশ্চিম বঙ্গ, কামদুনি, ২০১৩ / সন্দেশখালি বহুদিন ব্যাপী / আর জি কর
এই রাজ্যের ঘটনা, সবারই মনে আছে, তাই ঘটনার সংক্ষিপ্তসার দিলাম না। কিন্তু আশে পাশের অনেক মানুষ চোখে পরে, যাঁদের মুল প্রচেষ্টা কি ভাবে নারকীয় অপরাধগুলোকে হাল্কা করে দেখান যায় বা পারলে অপরাধ যে হয়েছে সেটাই অস্বীকার করা যায়। তার সাথে নিজের দলের নেতা বা কর্মীদের বাঁচানর আপ্রান চেষ্টা। তাঁদের যদি প্রশ্ন করেন, কেন কামদুনি প্রতিবাদের দুই মুখ, নির্যাতিতার ছোটবেলার দুই বন্ধু, টুম্পা ও মৌসুমি কয়ালকে মাওবাদি বলে দাগীয়ে দেওয়া হয়েছিল, দেখবেন তাঁদের মুখ ফেভিকলের আঠায় আটকে গেছে, সে আর খোলার নয়। কিন্তু কাঠুয়া, সুটিয়া, সিঙ্গুর, হাথরাস নিয়ে আলোচনার সময় তাঁদের লম্ফ ঝম্প আকাশ ছোঁয়া।
রেড করিডোর
বাম বিপ্লবীদের স্বপ্নের রেড করিডোরের দলমগুলোও কিছু অন্য চিত্র দেখায় বলে মনে হয় না। বিভিন্ন জায়গায় মাঝে মধ্যেই অভিযোগ এসেছে, প্রান্তিক পরিবারের মহিলারা যে লিঙ্গ নিরপেক্ষ সমাজের লড়াই এর স্বপ্ন নিয়ে মাওবাদীদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেরই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল পরে। শোভা মান্ডি ওরফে উমা ওরফে শিখা, আত্মসমর্পণের পর একটি বই লেখেন “এক মাওবাদী কি ডায়েরি”। সেই বইয়ে শোভা অভিযোগ করেছিলেন মহিলা ক্যাডাররা কিভাবে বাধ্য করা হয় অন্য পুরুষ ক্যাডার বা নেতাদের লালসা মেটাতে। এর কোন তদন্ত করেছেন মাওবাদীরা বা সেই তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশে করেছেন এরকম কোন তথ্য অন্তর্জালে নেই। আর গহীন জঙ্গলে কি ঘটছে, তার তদন্ত স্বাভাবিক পদ্ধতিতে হওয়া তো স্বম্ভব নয়। বিভিন্ন সময়ে মাওবাদীদের প্রেস রিলিজ যা সংবাদপত্রে আসে, সেখানেও এই সমস্যা নিয়ে কোন আলোচনা আজ অবধি চোখে পড়ে নি, এই অভিযোগ স্বীকার বা অস্বীকার কোনটাই করা হয় নি, একদম নীরবতা পালন করা হয়েছে। [তথ্যসুত্রঃ India Today, 09.06.2013]।
বহু বহু বছর হয়ে গেছে টেলিভিশনের খবর দেখা বন্ধ করেছি। আর জি করের নৃশংস ঘটনার পর সমাজ মাধ্যমে কিছু ক্লিপিং দেখেছি, দেখতে হয়েছে। কি আছে সেগুলোতে? বেশ কিছু চ্যানেলে দেখি, একটা ডায়াস তার ওপর সঞ্চালক/ সঞ্চালিকা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে, লেজে আগুন লাগলে যেরকম দৌড়ানর কথা সেইরকম ভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার করে চলেছেন। এনারা সর্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, শুধু পরিষ্কার ভাবে বাংলা ভাষাটা বলতে পারেন না, এই যা। একটা এই মাপের ট্র্যাজেডির বর্ণনা দিচ্ছেন পিছনে ভ্যাঁপোর ভোঁ, ভ্যাঁপোর ভোঁ, নানা তালে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক চলছে। বলে চলছেন কিছু সত্যি, কিছু অর্ধ সত্যি আর কিছু সমাজ মাধ্যমে থেকে নেওয়া নির্ভেজাল মিথ্যে। “বিশ্বস্ত সুত্রে জানা” বা “নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিশেষজ্ঞ জানালেন” এই বলে শুরু করে যা বললে মানুষ খাবে, টি আর পি বাড়বে, সেই মন গড়া কথা বলে চলেছেন। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ – এরা আজ, একটি তরুণ সম্ভাবনাময় প্রাণের এই ট্র্যাজিক পরিণতিকে, শুধু নিজেদেরই পণ্যটা বাজারে বেশি বেশি করে বিক্রি করতে ব্যবহার করছে না কি? একজন সঞ্চালককেও দেখলাম না যাকে দেখে মনে হয়েছে তিনি বিন্দুমাত্র খারাপ আছেন – সেটাই স্বাভাবিক ব্যাবহার, একজন পেশাদার সঞ্চালকের। কিন্তু, আমরাই প্রথম এই করেছি, সেই করেছি, দেখতে থাকুন, সঙ্গে থাকুন বলে যাত্রা পালার সং এর মত আচরণটাও সভ্য দেশে আশা করা যায় না। একজায়গায় স্থির হয়ে বসে পরিষ্কার বাংলায় তথ্য ভিত্তিক সংবাদ পরিবেশন করা অর্থাৎ হনুমানোচিত লাফ ঝাঁপ না দিয়ে, বাজনা বাদ্যি ছাড়া, একজন পেশাদার সংবাদ পাঠক, যাঁর মান ও হুঁশ দুটোই আছে – তা বোধহয় আজ এক বিলুপ্ত প্রজাতি। এঁরা বোধহয় একবারের তরেও ভাবেন না, যে নির্যাতিতার বাবা, মা, অন্য প্রিয়জনেদের কিরকম লাগবে যখন তাঁরা এই নির্লজ্জ বিপণন দেখবেন, যার পণ্য হচ্ছে তাঁদের কন্যা। এই ভাবে এক নারকীয় অপরাধ যখন সেরা পণ্য হয়ে ওঠে, তখন তো মানতেই হবে, “অদ্ভূত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ।“
১৪ই আগস্ট ২০২৪। পশ্চিম বঙ্গের মানুষ সাক্ষী থাকলেন এক আক্ষরিক অর্থেই অভূতপূর্ব জন জাগরণের। এক অনামা অধ্যাপিকা সমাজ মাধ্যমে ডাক দিয়েছিলেন আসুন আমরা মহিলারা রাতের রাস্তার অধিকার নেই, কলকাতার তিন জায়গায় – যাদবপুর, একাডেমী আর শ্যামবাজারে। ক্ষোভে ফুটতে থাকা বাংলার মানুষ হাতে হাতে পৌঁছে দিলেন সেই ডাক লাখ লাখ বাড়িতে। তিন জায়গা থেকে হয়ে গেল কয়েকশ জায়গা, কলকাতা থেকে ডাক ছড়াল গোটা বাংলায়। শেষ মুহূর্ত অবধি মানুষ তাঁর নিজের মত করে নতুন নতুন জায়গায় জমায়েতের ব্যাবস্থা করে ফেললেন। বহুতল থেকে বস্তি, সরকারি আমলা থেকে পিওন, কর্পোরেটের উচ্চ পদাধিকারী থেকে পেট্রোল পাম্পের চাকরি করা মেয়ে, উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণী থেকে গৃহ পরিচারিকা, ফেমিনিস্ট থেকে গৃহবধূ, শহরের দামি ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রী থেকে মফস্বলের বাংলা মিডিয়ামে পড়া মুখচোরা মেয়ে, বড় ব্যবসার মালকিন থেকে রাস্তার সবজি বিক্রেতা মহিলা – সবাই মিলে গিয়েছিলেন সেই রাত দখলের আন্দোলনে। উচ্চবিত্ত পরিবারের গৃহিণী গৃহপরিচারিকার সাথে আলোচনা করেছেন কে কোন জমায়েতে যোগ দেবেন। যে স্ত্রী স্বামী ভগবানের অনুমতি ব্যাতিরেকে কখনও একটি সিদ্ধান্তও একক ভাবে, কখনও নিতে পারেন নি বা নিতে দেওয়া হয় নি, ১৪ই অগাস্টের রাতে সেই নারী শুধু “আমি যাচ্ছি” বলে, দরজা টেনে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, মিছিলে পা মেলাতে। বাড়ির পুরুষ সিংহ চুপটি করে বসে থেকেছেন, ট্যাঁ ফুঁ করার সাহস পাননি। বয়স্ক মানুষ এসেছেন, এমনকি তাঁরাও যাঁদের হাঁটতে বা দাঁড়াতে অসুবিধা হয়। সুদূর প্রবাসে থাকা সদ্য তরুণী, মনের মধ্যে রাগ জমা রেখে হাত কামড়েছে বাংলার মিছিলে পা না মেলাতে পারার জন্য। তাতে কি? তার কিশোর ভাই রাস্তায় তার দিদির জন্য, সব দিদির জন্য। তরুণ ছেলে ও মা এসেছেন একসাথে। কেউ এসেছেন সাধারণ জামা কাপড়ে, কেউ বা সেজে গুজে। এসেছেন প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার (LGBTQ) মানুষেরা। কেউ এসেছেন মুখে অসীম যন্ত্রণার ছাপ নিয়ে কেউ হাসি মুখে। এসেছেন নিজস্ব গাড়িতে কেউ বা অটো ধরে। এসেছেন কলকাতায়, এসেছেন মফস্বলে। নারীদের সংখ্যা বেশি কিন্তু এসেছেন পুরুষেরাও। এসেছেন সবাই, গোটা বাংলা জুড়ে।
জমায়েতগুলোয় পৌঁছানোর পর প্রায় সবাই ভাল করিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন কোন দিকের ভিড়টা রাজনৈতিক দলের মানুষদের, তারপর সেই জায়গা এড়িয়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন সেই জায়গায়, যেখান সাধারণ মানুষের ভিড়। কিছু জায়গা থেকে যখন মিছিল বের হল সেখানেও পা মেলালেন উপস্থিত সবাই। চোয়াল চাপা মানুষের হাতে হাতে পোস্টার, দাবি – আর জি কর কান্ডে সুবিচার, সমস্ত কর্মস্থলে মহিলাদের সুরক্ষা, বিশাখা কমিটির সুপারিশের বাস্তবায়ন, রাতের রাস্তায় মেয়েদের সুরক্ষা, সমস্ত ক্ষেত্রে মহিলা পুরুষের সম অধিকার। মিছিল থেকে কোনও রাজনৈতিক দলের শ্লোগান নেই, অমুককে বদলে তমুককে আনোর শ্লোগান নেই, আছে শুধু মানুষের শ্লোগান। জমায়েত বা মিছিলে নেই কোন অশ্লীল শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ জমায়েত ও মিছিল সারা বাংলা জুড়ে। রাত ১২ টা, ৭৭ বছর আগে দেশভাগের দগদগে ক্ষত বুকে নিয়ে, দাঙ্গা বিধ্বস্ত বাংলা ও কলকাতার কাছে নতুন এক সূর্যোদয়ের বার্তা ভেসে এসেছিল ইথার তরঙ্গে: "Long years ago we made a tryst with destiny, and now the time comes when we shall redeem our pledge, not wholly or in full measure, but very substantially. At the stroke of the midnight hour, when the world sleeps, India will awake to life and freedom. A moment comes, which comes but rarely in history, when we step out from the old to new, when an age ends, and when the soul of a nation, long suppressed, finds utterance.” ৭৭ বছর পরে সেই রাত ১২ টায় সারা বাংলা জুড়ে লক্ষ কন্ঠে গগনভেদী আওয়াজ তুলল, বিচার চাই বিচার দাও – আবার এক নতুন দিনের বার্তা নিয়ে। দূর মহাকাশে তারার দেশ থেকে হয়ত বা সেই সময় সব মিছিলের, সব সমাবেশের ওপর ভালবাসা ছড়িয়ে দিল কাঠুয়ার শিশু, সিঙ্গুরের কিশোরী, কামদুনির ছাত্রী, দিল্লির ফিজিওথেরাপিষ্ট, গোধরার সালেহা, আর জি করের তরুণী ডাক্তার, তার সাথে আরও অনেক নাম না জানা ফুলের মত মেয়ে।
ঘোলা জলে মাছ ধরার অন্ধকারের কারবারিরাও সেই রাতে ঘুমাচ্ছিল না। মিছিল শেষে মানুষ যখন সেই রাতে বাড়ি ফেরার পথে, কিছু দুষ্কৃতি হামলা চালায় আর জি করে।
নস্যি নিয়ে, নাকে চশমা এঁটে পন্ডিতরা শুরুতেই বিধান দিয়েছিলেন, এই হুজুগে বিশেষ কেউ আসবে না। ১৪ তারিখের পর বললেন এসব হল একদিনের বিপ্লব। মেয়েদের সুরক্ষা এক রাজনৈতিক দাবি, সেই দাবি নিয়ে লম্বা লড়াই লড়তে গেলে নাকি রাজনৈতিক দলের পতাকা লাগবেই। পন্ডিতদের মত, দলের পতাকা ছাড়া এসব শৌখিন আন্দোলন ওই একরাতেই ফুউউউউস। একদম ঠিক কথা, দাবি রাজনৈতিক, কিন্তু এক মাসের ওপর আন্দোলন চলছে, একই তীব্রতায় এবং সেটা রাজনৈতিক দলের পতাকা ছাড়াই। সব রাজনৈতিক দলের অধিকার আছে এই দাবিতে আন্দোলন করার, রাজনৈতিক দলের আন্দোলন হবে সেটাই স্বাভাবিক, সেটাই কাম্য, সেটা হচ্ছেও। কিন্তু এখনও অবধি আন্দোলনের মুল শাখা কোনও দলের পতাকার তলায় নয়। আমজনতা এখনো রাস্তায়। প্রতিদিন নিত্য নতুন মিছিল, নতুন মানুষ, রাস্তায় জ্যাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত একজনকেও পেলাম না, যিনি এই জ্যামে ন্যূনতম বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। এই প্রশ্ন সঙ্গত, যখন শীর্ষ আদালত তদন্তের ওপর নজর রাখছেন, সিবিআই তদন্ত করছে এবং সেই কাজ দ্রুতই এগোচ্ছে তখন “We want justice” শ্লোগান কতটা যুক্তিযুক্ত। ঠিক, যখন এই ব্যবস্থার মধ্যে বিচার চাওয়া হচ্ছে, তখন আইনের নিজস্ব পদ্ধতিতে ভরসা তো রাখতেই হবে। কিন্তু মানুষের দাবি এখন শুধু “Justice for R G Kar” এই সীমাবদ্ধ নেই। সর্বক্ষেত্রে সর্বসময় সব মহিলাদের সুরক্ষা, পুরুষতন্ত্রের জোয়াল থেকে মুক্তি, লিঙ্গ নিরপেক্ষ সমাজ, সৎ প্রশাসকদের হাতে স্বাস্থা ব্যাবস্থা, থ্রেট কালচারের বিসর্জন, দলের নেতা/দাদা/দিদিদের সর্বব্যাপী চুরির ওপর লাগাম, লুম্পেনদের দাপাদাপির ওপর নিয়ন্ত্রন, পরীক্ষায় গণ টোকাটুকি বন্ধ – দাবিগুলো উঠে আসছে। আন্দোলন তার পরিসর বাড়াচ্ছে এবং সেটা সাধারণ মানুষ নিজেরাই বাড়াচ্ছেন। ঘোলা জলে মাছ ধরার কারবারিরাও জাল নিয়ে ঘুরছেন অবশ্যই, সেটাই তো ওনাদের কাজ। এনারা অন্ধকারের জীব, যে আন্দোলন আলোর বন্যার আগমনী গাইছে, তা দল নিরপেক্ষ ভাবে এঁদের সবার জন্য বিসর্জনের বাজনা হয়ে উঠতে পারে, এটা তাঁদের থেকে ভাল কেউ জানে না। কাজেই তারা মাঠে নেমে পড়ে গণজাগরণ এর ঘাড়ে ওঠার চেষ্টা করছেন, তবে সেটা ভাল মতোই টের পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এখনও অব্দি, এক্ষেত্রেও মানুষ, সাধারণ মানুষ চোখ কান খোলা রেখেছেন, যাতে কিছুতেই এই অন্ধকারের জীবেরা আন্দোলনকে ভুল পথে চালিয়ে নিজেদের ফায়দা না ওঠাতে পারে।
এত মিছিল, সমাবেশ, ক্ষোভ, হতাশা, শ্লোগান, এত মানুষের এত পরিশ্রম, এবং আন্দোলনের পরিসরের বৃদ্ধি, কিছু কি পরিবর্তন হবে? লেখক জ্যোতিষ চর্চা করে না, কাজেই ভবিষ্যৎবাণী করতে পারবে না। এটুকু বলা যেতে পারে রাজনৈতিক দলের পতাকা ছাড়া এই মাপের গণ জাগরণ আমাদের প্রজন্ম দেখে নি এবং এই আন্দোলন এখনো জোরদার ভাবেই চলছে, চলছে মানুষের নিজস্ব দাবি নিয়েই। আজও যখন পাশের মেয়েটিকে দেখি, তার চোয়াল চাপা মুখ ভরসা দেয়। এই রাজ্যে বহু দশক জুড়ে এক বন্ধ্যা সময়ের মধ্যে জীবন পার করা, প্রায় ষাট ছোঁয়া লেখক কিন্তু আশা রাখছে: