ছবি: রমিত
সল্টলেকের বাড়ি - পর্ব ২
দিন যায়। খোকন ওর সংসার নিয়ে আলাদা হয়ে দোতলায় স্থিতু হয়েছে।
ইতিমধ্যে নিমুর বিয়ে হয়েছে। মা নিমু-রত্নাকে বড় ঘরটাতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। চিমু কলকাতায় চাকরি নিয়ে এসেছে। চিমু-তপতি থাকে অন্য একটা ঘরে। কোন ঘর আর খালি নেই। অনু ও আমার অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না। কলকাতায় গেলে থাকার সমস্যা। আমাদের কোন থাকার ঘর নেই। বেচারা অনু, ওর কোন ঘর নেই, বিছানা নেই। ছেলেরা যেখানে সেখানে থাকতে পারে, মেয়েদের জন্য বোধহয় একটা নিজস্ব ঘর লাগে; একটু আব্রুর প্রয়োজন থাকে। অথচ এর সব কিছুই ওর আর আমার কষ্ট করা উপার্জনের টাকায়। বুঝতে পারতাম অনুর অসুবিধা হচ্ছে। অথচ আমি কোনদিন ওর মুখে কোন অভিযোগ শুনিনি। সর্বদাই অল্পতেই তুষ্ট। প্রতি বছর বড় বড় স্যুটকেস ভর্তি করে সকলের জন্য উপহার নিয়ে যেত। লন্ডনে ফিরে আবার সারা বছর ধরে উপহার কিনত পরের বছরের জন্য। আমার মাঝে মাঝে আবাক লাগত, গ্রহীতা উপর তলায় বহাল তবিয়তে সৌখিন আশ্রয়ে আসীন, আর দাতা নীচের তলায় ঘর হারা, সেই আগের মতই যাযাবর। আমার পরিকল্পনায় এমনটি ছিল না। কেমন যেন সব উলট পালট হয়ে গেল!
তবু দেশের যাওয়ার জন্য সারা বছর দিন গুনতাম। দেশে যেতে ভাল লাগত। খোকনের সঙ্গে উপরে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতাম। সেই একই গল্প, পুরানো গল্প, আমাদের পুরানো দিনের কষ্টকর জীবন যুদ্ধ, বর্তমানের গল্প, ভবিষ্যতের আশা ইত্যাদি নিয়ে। একই গল্প বার বার। অনু ঠাট্টা করে বলত, “তোমাদের গল্পগুলো আমার সব মুখস্ত হয়ে গিয়েছে। আর ভাল লাগে না। এবার নতুন কিছু বল।” খোকনকে আমি অসম্ভব ভালবাসতাম। আমাদের একটা আলাদা রকমের বিশেষ আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। ওর উপর আমার পক্ষপাতিত্ব ছিল যা দেখে অনেকে কটাক্ষ করত। ও যখন হার্টের অসুখে কষ্ট পাচ্ছিল তখন আমি অত্যন্ত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, চিন্তিত হয়ে পড়ে ছিলাম। দু’বার ওর হার্ট বাইপাস অপারেশন হল; আমি আমার সাধ্যমত অর্থ সাহায্য করেছিলাম।
আমরা গেলে সবাই আসত দেখা করতে। খুকু-দিলীপ, দিল্লী থেকে হাঁদি-স্বপ্না, চিমু-তপতী, খোকন-ইলা তো ছিলই। অনুর ভাইঝি শুক্লা আর মাঝে মাঝে ওর ভাই বোনের ছেলে মেয়েরাও আসত। আর অনেক আত্মীয় স্বজনও। পরের প্রজন্মের ছেলে মেয়েরাও আসত। হাঁদির ছেলে-বৌ জোজো-মৌ, খুকুর মেয়ে মাম, চিমুর মেয়ে তুলি, চিমুর ছেলে অয়ন। আড্ডা, হই চই হত খুব। ছোটোরা আলাদা করে গল্প করত, আড্ডা দিত। আমার দেখে খুব ভাল লাগত। খোকনের ছেলে ছোটন কখনো কখনো যোগ দিত কিন্তু খোকনের মেয়ে পিউকে কখনো এমন আড্ডায় যোগ দিতে দেখিনি। অন্তত একদিন বা দুদিন খুব বড় করে ভূরিভোজনের ব্যবস্থা হত। কখনো কখনো প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ জন হয়ে যেত। সকলে মিলে হল ঘরে মেঝেতে বসে একসঙ্গে খেতাম। কি ভাল যে লাগত! সে গুলো বড় আনন্দের দিন ছিল।
অনু আছে যেখানে সেখানে গানের আসর বসবে না এমন হয় না। ও লন্ডনের মত করে গানের আসরের ব্যবস্থা করত। কিন্তু লন্ডনের মত তেমন জমত না। বোধহয় দুটি কারণে: রাত্রে কলকাতায় যানবাহনের অসুবিধা, সন্ধ্যা নটার মধ্যেই অতিথি ও শিল্পীরা উঠি উঠি করতে শুরু করত। লন্ডনে এ সমস্যা ছিল না, সবারই নিজস্ব বাহন ছিল, সুতরাং আসর সমাপ্তির আগে উঠে পড়ার তাগিদ থাকত না। আর একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছিলাম – কলকাতায় মধ্য রাত্র পার করে গান শোনার মত উৎসাহী শ্রোতার সংখ্যার অভাব ছিল। তবু দু-চারটে আসর হয়েছিল অনেক রাত্রি ধরে।
আমাদের বাড়িটা ছিল সি-এফ (CF 231) ব্লকে। পাড়াতে মাকে সকলে চেনে, সকলের সঙ্গে মায়ের সদ্ভাব। প্রয়োজনে মা সকলের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। খোকনও সি-এফ ব্লকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে। অনেক বন্ধু বান্ধব ও গুণগ্রাহী হয়েছে। আমাকে কেউ চেনে না, আমার কোন অস্তিত্ব নেই। সি-এফ ব্লকের কমিউনিটি কমিটির সদস্য খোকন। কিছুদিন পরে সি-এফ ব্লক কমিউনিটি কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্টের পদে মনোনীত হল খোকন। সামাজিক পরিচয়ে এক সম্মানিত নাগরিক। সি-এফ ব্লকের পত্রিকায় সি-এফ ২৩১ নম্বর বাড়ির কলামে নাম শ্রী বিমলেন্দু বিশ্বাস (খোকন)। আমার অবাক লেগেছিল। আমি যে সময়ের কথা বলছি সে সময় সময় খোকনকে আমি জমি দান করিনি সুতরাং সল্টলেকে বা সি-এফ ব্লকে ও কোন জমির মালিক নয়। এবং জমির মালিক না হলে কমুউনিটি কমিটির সদস্য হওয়া যায় না। সুতরাং সে সময় খোকন ওই কমিটির সদ্স্য হতে পারত না, ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়া তো দূরের কথা। আমি তখন কলকাতায় কম যেতাম। মা ভাই বোনদের সঙ্গে গল্প করে আড্ডা দিয়ে আনন্দে দিন কাটাতাম, অন্য কিছুতে চোখ দিতাম না, ইচ্ছাও ছিল না। এত কিছু জানতাম না। পরে অনুসন্ধিৎসু হয়ে খোঁজখবর নিয়ে সব জেনেছিলাম।
তখন আমি এত নিয়ম কানুন কিছুই জানতাম না। একদিন মাকে কথায় কথায় বলে ছিলাম – আমি বাড়ি করেছিলাম বলেই তো খোকনের এতো প্রতিপত্তি। খোকন সে কথা শুনেছিল। দাদার কাছ থেকে এমন কথা শুনে খোকন কষ্ট পেয়েছিল ও কান্নাকাটি করেছিল। দেবরের মনঃকষ্ট ও কান্না অনুর ভাল লাগেনি। আমাকে খুব বকাবকি করে বলেছিল, “এমনি করে তুমি বলেছ কেন।” আমি কোনদিন আর এ নিয়ে কথা তুলিনি।
বাড়িটা যে আমার তা ব্লকের লোকেরা জানত না। সকলেই অনুমান করে নিয়েছিল যে বাড়িটা বিমলেন্দু বিশ্বাসের। মা অবশ্য সুযোগ পেলে বলত, “খোকা আমাকে বাড়ি করে দিয়েছে।” কিন্তু অন্য কারো সে নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। দুটি ঘটনা আমাকে খুব পীড়িত করেছিল। একবার আমি বসার ঘরে বসে আছি, পাড়ার এক ভদ্রলোক এসে বললেন তিনি বিমলেন্দু বাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আমি খোকনকে ডেকে পাঠালাম। যথারীতি কুশল বিনিময় সারা হলে ভদ্রলোক সবিনয়ে নিবেদন করলেন যে তার পুত্রের বিবাহ। পাড়া পড়শীদের নিমন্ত্রণ করতে বেরিয়েছেন। তাই খোকনকে নিমন্ত্রণ করলেন, খোকন যেন অবশ্যই তাঁকে বাধিত করে। আমার সামনে খোকন নিমন্ত্রণ পত্র গ্রহণ করল বাড়ির প্রধান হিসেবে। সেদিন আমার মনে লেগেছিল কিন্তু দার্শনিকের মত পার্থিব জগতের এসব ক্ষুদ্র ঘটনাকে তুচ্ছ ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম। খোকন একবারও বলল না– ইনি আমার দাদা, এ বাড়ি ওঁর। এ নিমন্ত্রণ ওঁরই প্রাপ্য।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল অনেক দিন পর। খোকন তথন উপরের ফ্ল্যাটে আলাদা হয়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু নীচের বসার ঘরটিও নিজের কাজে পুরোপুরি ব্যবহার করত এবং সেইভাবে নতুন সোফাসেটি দিয়ে সাজিয়ে রেখেছিল। যদিও এ ঘর সকলেই ব্যবহার করত কিন্তু ওর অগ্রাধিকার ছিল। একদিন সে ঘরে মধ্যাহ্ন ভোজনের পর বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। দিবানিদ্রাটা বেশ জমেছে এমন সময় খোকন এসে বলল, “দাদা, ওঠো। আমার একটা মিটিং আছে। এখুনি ক্লায়েন্টরা আসবে।” আমার বাড়িতে আমারই ঘরে নিদ্রা ভঙ্গ করে উঠে আসতে হবে এমন কখনো ভাবিনি।
খোকন সংসার নিয়ে উপরে উঠে যাওয়ার পরেও সংসারে অশান্তি ঘোচেনি। জল, ইলেক্ট্রিক বিল, ছোটখাট মেরামতি কাজ ইত্যাদি নিয়ে একটা না একটা কিছু লেগেই থাকত। বাড়ির কিছু অংশ ওকে লিখে দেয়ার পর অনেক দিন থেকেই লক্ষ করছিলাম খোকনের আচার, ব্যবহার, আমার সঙ্গে কথা বলার সুর ক্রমশ পাল্টে যাছে। আগের মত ভালবাসা শ্রদ্ধা আন্তরিকতার রেশ নেই আর। কেমন যেন একমন্যতা, স্বার্থপরতা, ক্ষুদ্রতার আভাষ পাচ্ছি ওর আচরণে, ভাবভঙ্গিতে। আমাদের অভাবের দিনের সেই একান্নবর্তী পরিবারের সকলে সকলকে জড়িয়ে ধরে একে-অন্যকে সাহায্য করার মনোবৃত্তি নেই আর। স্বার্থ ও ক্ষুদ্রতা গ্রাস করেছে মনের মূলধনকে। মনের পবিত্রতা হারালে মানুষ নিঃস্ব হয়ে যায়- দেউলিয়া হয়ে যায় নিজের কাছে। দেউলিয়া মন দুষ্কৃতির শিকার হয়। আমার ভয় করতে লাগল- খোকন কি ধীরে ধীরে সেই পথেই হাঁটছে?
কথায় কথায় আইন দেখাতে লাগল। বলতে লাগল, ‘আমি co-owner, অর্থাৎ এ বাড়িতে তোমার যা অধিকার আমারও সেই অধিকার।’ আমি যখন ওকে বাড়ির অংশ দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলাম তখন এত সব কথা ভাবিনি। ভেবেছিলাম, ওর থাকার অসুবিধা হচ্ছে, আমি ওর একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিই। আমরা এক সঙ্গে থাকব। সব কিছু এই রকমই থাকবে। এখন ভাবি, আমি কী মুর্খ, কী শিশু সুলভ সারল্যে দেখেছিলাম সব। বাস্তব বড় নিষ্ঠুর!
খোকন মেধাবী ছাত্র ছিল। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করেছিল এবং স্কলারশিপ পেয়েছিল। খোকন আমাদের গর্ব। আমি ওর মেধাকে শ্রদ্ধা করতাম। সব কাজেই ও সর্বদা আমার পাশে থাকত। সল্টলেকে বাড়ি করার সময়েও খোকন আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে – ভাই ভাইকে যেমন করে। ওর সাহায্য না পেলে আমায় প্রচুর অসুবিধায় পড়তে হত। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লালফিতের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে হত। কত কাগজে,কত ফর্মে যে সই করতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। অনেক কাজেই ও মাকে সাহায্য করেছে, অবশ্য সব ভাই বোনেরাই সাহায্য করেছে। আমি শুধু অর্থের যোগান দিয়েছি, অন্যান্য সব কাজ মা ও ভাইরা করেছে। যদিও বাড়ি নির্মাণের দায়িত্ব ছিল এক আর্কিটেক্ট ফার্মের উপর।
খোকনরা উপরে উঠে যাওয়ার পর আমার দেশে য়াওয়া হয়নি অনেক দিন। কিন্তু আমরা ফোনে নিয়মিত কথা বলতাম। বলতে বলতে কিভাবে যে সময় কেটে যেত তার খেয়াল থাকত না। তাছাড়া প্রায়ই খোকন লম্বা লম্বা চিঠি লিখত। সে সব অনেক চিঠি হারিয়ে গিয়েছে। তবু এখনো যত চিঠি আমার ফাইলে যত্ন করে রাখা আছে তার সংখ্যা কম নয়। সেদিন একটা চিঠি পড়ছিলাম– পাঁচ পাতা। তার থেকে কয়েকটা লাইন তুলে দিলাম। সে চিঠিতে খোকনের সেই সময়ের মনের কথা ফুটে উঠেছে।
খোকনের (বিমলেন্দুর) একটা চিঠির অংশ
চিঠির হাইলাইটেড অংশ –
“আমরা আজকে যে অবস্থাতেই এসে থাকি, তুমি না হলে সেটা অসম্ভব হত। খুব সৌভাগ্য না হলে এরকম দাদা আর বৌদি একসঙ্গে লোকে পায় না। দাদা না হয়, নিজের মায়ের পেটের ভাই, বৌদি ত পরের বাড়ির মেয়ে, সেই বা কি করে এককম হয়। ...।”
“... তবে দাদা তোমরা Dinosaur-এর মত dying creed. এরকম আর হবে না। এখনকার প্রজন্ম আর ভবিষ্যতের প্রজন্ম এসব comprehend করতে পারবে না।”
সেই খোকন, আমি দানপত্রে সই করার কিছুদিন পর থেকে আমার সঙ্গে ওর আচার ব্যবহার, কথাবার্তার রূপ বদলে গেল। ও আমার সমকক্ষ, আমার মত ও-ও এ বাড়ির মালিক। এ বাড়িতে কিছু করতে চাইলে ওর সম্মতি নিতে হবে, তা সে নতুন ইলেকট্রিক লাইন হোক বা এয়ারকন্ডিশন মেশিন বসানো হোক। আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। এ কি হল? আমি আর এ বাড়ির একক মালিক নই? বাড়ির বাসিন্দারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। চিমু দিল্লীতে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছে। সুতরাং ওদের ঘরটা খালি। আমি উপরের অসমাপ্ত ঘরদুটো বাসযোগ্য করে দোতলায় উঠে গেছি। কয়েক বছর হল মা ধরাধাম ত্যাগ করেছে। মা আর নেই।
নীচের তলায় এখন শুধু নিমু আর রত্না থাকে অয়নকে নিয়ে। আমরা বছরে চার সপ্তাহ মত থাকি। এককালে দেশে গেলে যে বাড়িতে আমাদের থাকার জায়গা হত না সে বাড়ি এখন প্রায় ফাঁকা --- থাকার লোক নেই। সল্টলেকে বাড়ি রাখা প্রায় সাদা হাতি পোষার খরচের মত, খরচের অন্ত নেই। ভাবলাম, অন্তত দুটো ঘর ভাড়া দিয়ে দিই, বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের খরচটা উঠে আসবে। কিন্তু খোকন বাদ সাধল। ভাড়া দিতে গেলে ওর অনুমতি নিতে হবে। আর ভাড়ার পঁচিশ শতাংশ ওকে দিতে হবে। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। ও তো বাড়ির প্রায় তিরিশ শতাংশ অধিকার করেই আছে। আমার অংশ নিয়ে আমি কি করি না করি তা নিয়ে আবার ওর মাথাব্যথা কেন? ওকে আমার উপার্জনের ভাগ দিতে হবে কেন? ও আইনের কথা বলল। বাইরের লোক থাকলে ওর পরিবারের নিরাপত্তার ব্যাঘাত হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। খোকন ক্রমশ অসম্ভব অযৌক্তিক হয়ে উঠল।
একবার এক আজব ঘটনা ঘটেছিল। হাঁদির শ্যালিকার মেয়ে মৌ সল্টলেকের আই টি সেক্টর-এ চাকরি পেয়েছিল। হাঁদি আমাকে জিগ্যেস করল, “দাদা, তোমার তো নীচে একটা ঘর খালি আছে। তুমি ওকে একটা ঘরে থাকতে দিতে পারবে? ও তোমাকে ভাড়া দেবে।” আমি রাজী হলাম। মৌ বাড়ির মেয়ের মত বাড়িতে থাকতে শুরু করল। প্রথমে নিজে আলাদা রান্না করে খাওয়াদাওয়া করত কিন্তু পরে রত্নার সংসারের শরিক হয়ে রত্নার কাছেই খাওয়াদাওয়া শুরু করল। এমনি চলছিল। প্রায় বছর দুই পরে, ঠিক মনে নেই কতদিন পরে, হঠাৎ একদিন খোকন হাঁদিকে এক চিঠি লিখল এবং আমাকে তার কপি দিল। চিঠির সারমর্ম এইরকম: সল্টলেকের নিয়ম অনুযায়ী মৌ দাদাকে যে ভাড়া দেয় তার পঁচিশ শতাংশ ওর প্রাপ্য। খোকন হিসাব করে দেখেছে যে সল্টলেকের ওই রকম একটা ঘরের যা ভাড়া তাতে এতদিনে ওর পাওনা চার লক্ষ টাকা। হাঁদি যেহেতু middleman or broker সেহেতু টাকাটা যেন হাঁদি ওকে দিয়ে দেয়। অন্য অর্থে আমি যেন টাকাটা ওকে দিই। হাঁদি ও আমি দুজনেই অবাক হয়ে গেলাম। কি অসাধারণ যুক্তি! সন্দেহ হল ওর মস্তিষ্ক সুস্থ আছে কিনা। এ নিয়ে খোকন ও হাঁদির মধ্যে কয়েকটি চিঠির আদানপ্রদান হয়েছিল। বলা বাহুল্য, হাঁদি কোন টাকা দেয় নি। আমিও না। কিন্তু ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল- ভবিষ্যতে কি অপেক্ষা করে আছে!
আটের দশকের শেষ দিকে আমি চাকরি ছেড়ে কম্পিউটার সংক্রান্ত ব্যবসা শুরু করি। সে কথা অন্যত্র বলব। পরের কুড়ি পঁচিশ বছর কম্পিউটার কন্সালটান্সি ও ব্যবসা করেছি কলকাতা এবং লন্ডনে। সল্টলেকে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে খোকনের সঙ্গে অনেক গল্পের মধ্যে আমার ব্যবসার কথাও হচ্ছিল। তখন ব্যবসায় আমার এক পার্টনারের সঙ্গে যৌথ ব্যবসায় ভাল চলছিল না। ভাবছিলাম নতুন কিছু একটা করব। খোকন স্বতঃস্ফুর্তভাবে বলল ওর এক সহকর্মী বন্ধু, ভট্টাচার্য, ইন্ডিয়ান এল্যুমিনিয়াম কোম্পানির ডাইরেক্টর। সে হয়ত কোন সাহায্য করতে পারে। বলল, “ চল, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব।” খোকনের এই আন্তরিকতা আমার ভাল লাগল। আমরা গেলাম ভট্টাচার্যের নিউ আলিপুরের কোয়ার্টারে দেখা করতে। ভট্টাচার্য বেশ ভদ্র মানুষ, খোকনেরই বয়সী, আমার সঙ্গে সহজ ভাবে কথা বললেন, কোন আত্মম্ভরিতা আছে বলে মনে হল না। বললেন, “এখন তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। দু-এক দিন সময় দিন। ভেবে দেখি। পরের সপ্তাহে আসুন।”
আবার গেলাম। ভট্টাচার্য বললেন, “একটা সম্ভাবনা আছে। আমরা ব্যাঙ্গালোরের কাছে একটা প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ডের (Printed Circuit Board or PCB) ফ্যাক্টরি খুলেছি। তার ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মিঃ সারেঙ্গী। উনি লন্ডনে একজন প্রতিনিধি বা এজেন্ট খুঁজছেন। ওঁর সঙ্গে দেখা করুন। দেখুন কি হয়।” ভট্টাচার্য মিঃ সারেঙ্গীর ঠিকানা লিখে দিলেন এবং কেমন করে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে হবে তা বলে দিলেন। আমি আর খোকন গেলাম মিঃ সারেঙ্গীর সঙ্গে দেখা করতে। মিঃ সারেঙ্গী অতি ভদ্রলোক। ওঁর প্রশ্নের উত্তরে আমি আমার কেরিয়ারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলাম। মুখ দেখে মনে হল উনি কৌতূহলী হয়েছেন। আমার সঙ্গে বেশ সমীহ করে কথা বলতে শুরু করলেন। মনে নেই কতগুলো ইন্টারভিউ হয়েছিল তাঁর ও তাঁদের অন্যান্য ম্যানেজারের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত মিঃ সারেঙ্গী আমাকে মনোনীত করেছিলেন। কোন কন্ট্রাক্ট বা চুক্তিপত্র হল না, তবে তিনি একটা পত্রে লিখে দিলেন, গ্রেট ব্রিটেনে ওদের পি সি বি (PCB) একমাত্র আমার কোম্পানির মাধ্যমেই বিক্রীত হবে এবং আমার কোম্পানি একটা নির্ধারিত কমিশন বা পারিশ্রমিক পাবে। আমি খুশী হলাম, খোকনও। কিছু না বললেও ওর চোখ মুখ দেখে মনে হল ও যেন বলতে চাইছে, “দেখো, আমার জন্য তোমার কিছু হল।”
লন্ডনে ফিরে এলাম। কাগজটা পড়ে ছিল অনেকদিন, কিছু করিনি। পি সি বি সম্বন্ধে আমি কিছু জানিনা। ইংল্যান্ডে কে বা কারা তার ক্রেতা, এর বাজার কত বড়, চাহিদা কেমন ইত্যাদি কিছুই জানি না। পড়াশুনা করতে শুরু করলাম পি সি বি নিয়ে ও সেই সঙ্গে এর বাজার নিয়ে গবেষণা। মিঃ সারেঙ্গীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম। প্রায়ই ফোন করতাম, কেমন করে শুরু করব তা নিয়ে পরামর্শ করতাম। উনি বললেন, “ব্যাঙ্গালোরে চলে আসুন, ইঞ্জিনীয়ারদের সঙ্গে কথা বলুন, দেখুন কিভাবে পি সি বি তৈরি হয়।” আমি ওঁর প্রস্তাব মেনে নিলাম। ব্যাঙ্গালোরে গেলাম; অবশ্যই আমার খরচেই। কিন্তু ওঁর কোম্পানি আমাকে ভিআইপি-র মত অভ্যর্থনা ও যত্ন করেছিল। পাঁচতারা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা, উচ্চমানের রেস্টুরেন্টে ডিনার, পার্টি ইত্যাদি তো ছিলই। এরকম আপ্যায়ন শুধু প্রথমবারই নয়, যতবার ব্যাঙ্গালোরে গেছি এমনি অভ্যর্থনা ও যত্ন পেয়েছি। ফ্যাক্টরিতে ওদের উৎপাদন পদ্ধতি দেখলাম, ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে আলোচনা করলাম। অনেক কিছু শিখলাম। পি সি বি সম্বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান হল। ওঁরাই আমাকে ওদের পণ্যের নিয়মিত ক্রেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমার নিজের একক চেষ্টাতেও আমি নতুন ক্রেতা পেয়েছিলাম। নতুন ক্রেতারা বাঙ্গালোরের ফ্যাক্টরি দেখতে চাইত। এরা সবাই কোম্পানি ডায়রেক্টর বা মালিক। এদের নিয়ে আমাকে বাঙ্গালোরে যেতে হতো।
আমার অফিস ছিল আমার বাড়িতেই। সুতরাং অতিকায় টেলিফোন বিল ছাড়া অফিসের কোন খরচ ছিল না। আমার সবচেয়ে বড় খরচ ছিল ক্রেতা কোম্পানির বড় কর্তাদের বিনোদন এবং আমার ভ্রমণ- গ্রেট ব্রিটেনে ক্রেতাদের অফিসে এবং মাঝে মাঝে বাঙ্গালোরে। আমি শুরু করার কিছুদিন পরেই মিঃ সারেঙ্গী অবসর নিলেন। নতুন ডিরেক্টর এক বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার– গৌতম মুখার্জী। মিঃ মুখার্জির সঙ্গে আমার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছাড়িয়ে সখ্যতায় পরিণত হয়েছিল। সস্ত্রীক উনি আমাদের বাড়ি আসতেন ও আমরা কলকাতায় গেলে অনু ও আমাকে নিমন্ত্রণ করতেন। লন্ডনে আমাদের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল আর এক পি সি বি ম্যানুফাকচারার- ক্যামট্রনিক্স। এরা আমাদের বড় বড় অর্ডার দিত এবং এদের সঙ্গে আমার এক বিশেষ সম্পর্ক স্তাপিত হয়েছিল।
এক স্মরণীয় দিনের কথা মনে পড়ছে। ক্যামট্রনিক্সের ডাইরেক্টর আমাকে ও মিঃ মুখার্জীকে লর্ডসে ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড টেস্ট খেলা দেখতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। লর্ডসে ওঁদের কর্পোরেট বক্স ছিল। গ্যালারির উপরে একটি ঘেরা জায়গায় আটটি আসন, তার পিছনে একটি ঘর। সেই ঘরে সোফাসেট ও ডাইনিং টেবিল, এবং সংলগ্ন একটি রান্না ঘর। টেবিলে পর্যাপ্ত স্ন্যাক্স ও নানা রকমের পানীয় সাজানো। মাঝে মাঝে শ্যাম্পেন সহ নানা জাতীয় পানীয় ও স্ন্যাক্স পরিবেশিত হচ্ছে। লাঞ্চের সময়ে নিজস্ব শেফের তৈরি উৎকৃষ্ট ভোজ। রাজকীয় আয়োজন। আমি অভিভূত, এমন অভিজ্ঞতা ছিল না আমার। আমরা শ্যাম্পেনে চুমুক দিতে দিতে সৌরভ গাঙ্গুলির সেঞ্চুরি দেখলাম। সে স্মৃতি আমার মনে এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে।
ক্রমে ক্রমে ব্যবসা পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলতে থাকল। কিন্তু সুখ বেশীদিন সইল না। ব্যাঙ্গালোরের ফ্যাক্টরি ঠিক সময়মত পণ্য পাঠাতে সফল হত না। প্রায়ই দেরী করত। ক্রেতারা ক্রমশ অধৈর্য হয়ে পড়ল এবং আস্তে আস্তে অর্ডার দেওয়া বন্ধ করে দিল। পণ্যের গুনমানও সব সময় গ্রহণযোগ্য হত না। একবার আমার সবচেয়ে বড় ক্রেতা ক্যামট্রনিক্সের বহু কোটি টাকা মূল্যের পণ্য নিম্ন গুণমানের জন্য বাতিল হয়ে গেল। অনেকদিন থেকেই ওরা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছিল। এই ঘটনার পর ক্যামট্রনিক্স আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিল। আমার ব্যবসায় মন্দা দেখা দিল।
প্রায় এমনি সময় বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মত খোকনের কাছ থেকে এক চিঠি এল। লিখল, ও আমাকে এই ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছে। সুতরাং আমি যেন ওকে প্রতিমাসে আমার কমিশনের পঞ্চাশ শতাংশ দিই। আমি হতবাক। আমি আমার পরিশ্রম, অধ্যবসায়, দক্ষতা ও মূলধন দিয়ে একে গড়ে তুলেছি। প্রতিদিন ভারত ও ইংল্যান্ড, দুই দেশের সময় ব্যবধানকে বজায় রেখে প্রায় ষোল-আঠারো ঘণ্টা কাজ করে একে চলমান রেখেছি। আর ও এক মুহুর্ত সময় বা এক কপর্দকও খরচ না করে সারা জীবন ধরে আমার উপার্জনের অর্ধেক নিয়ে যাবে! মানলাম, ও আমাকে ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিচয় না করে দিলে এ ব্যবসা হত না। তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ এবং তার জন্য ও টাকা চাইতেই পারে এবং তার জন্য আমি খোকনকে টাকা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু সেটা হবে যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার (Introduction Fee) জন্য এককালীন প্রাপ্য। সার জীবন ধরে দিতে হবে কেন?
এই দাবী কি ও ওর বন্ধু ভট্টাচার্যকে বলেছে? ও কি ভট্টাচার্যকে এর অংশ দেবে? সেই ভদ্রলোকই তো এই স্রোতস্বিনীর মূল উৎস। প্রাপ্য যদি কারো থাকে তবে তার সিংহ ভাগ তো ভট্টাচার্যের। এতকাল খোকন যা বলেছে তা সব শুনেছি, যা চেয়েছে তা-ই দিয়েছি। আর না। আমি ওর এই দাবী মানতে পারলাম না। পরিবর্তে আমি ওর সাহায্যকে স্বীকার করে এক হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড পাঠালাম। কিন্তু এতে ও খুশী নয়। কিছুদিন পরে হাঁদিকে ও অনেককে বলে বেড়াতে লাগল, “দাদা আমাকে আমার পাওনা টাকা দেয়নি।” হাঁদির কাছ থেকে আমি একথা শুনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে আমি ওকে কড়া করে চিঠি লিখলাম- যদি ও আমার নামে এমন মিথ্যা রটনা করতে থাকে আমি আইনের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হব। এর পর আমি আর খোকনের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোন কথা শুনি নি। আমার পি সি বি-র ব্যবসা আর ভাল চলছিল না। ইতিমধ্যে ইন্ডিয়ান এল্যুমিনিয়াম কোম্পানি সিদ্ধান্ত নিল যে ওরা আর ইলেক্ট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিতে থাকবে না। কয়েক মাসের মধ্যে ব্যাঙ্গালোরের ফ্যাক্টরি এক স্যুইস কোম্পানিকে বিক্রি করে দিল। আমার পি সি বি-র ব্যবসা শেষ হয়ে গেল।
একদিন খবর এলো মায়ের শরীর ভালো নেই। হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। তাড়াতাড়ি দেশে এলাম। হাসপাতালে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। মা আমাকে ভাল করে চিনতে পারল না। মার সঙ্গে কথা বলতে পারলাম না। আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। হাসপাতাল থেকে মাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হল। আমিও লন্ডনে ফিরে এলাম। বোধ হয় সপ্তাহ দুই পরে ৩০ এপ্রিল ২০০৩ খবর পেলাম মায়ের দেহবসান হয়েছে। আমরা আবার সকলে সল্ট লেকে গেলাম।
মা আর নেই। আমার জীবনটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল। আমার জীবনের দুই অনন্যা প্রেরণাদাত্রী নারীর একজন চলে গেল।
মায়ের অশৌচে আমরা পাঁচ ভাই। আমি, খোকন, হাঁদি, চিমু ও নিমু।
হাঁদি ও আমার অর্থ সাহায্যে নিমু ও রত্না একটা ফ্ল্যাট কিনে চলে গিয়েছে। খোকনের সঙ্গে অনেক বাক বিতণ্ডার পর আমি নীচের একটা ঘর ভাড়া দিয়েছি। এমন সময় হঠাৎ এক মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের সকলকে বিমুড় করে দিল। হার্ট ফেল করে নিমু মারা গেছে। আমি কখনো কাঁদি না। শেষ কবে কেঁদেছিলাম মনে পড়ে না। সেদিন নিমুর মৃত্যুর খবর শুনে আমি অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছিলাম।
রত্না অয়নকে নিয়ে একা। খুকুরা সবাই মিলে রত্নাকে সল্টলেকের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। অনু চায় রত্না সল্টলেকের বাড়িতেই থাকে। আমিও তাই চাই। অনু রত্নাকে বলল ওর ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে রত্না এখন থেকে সল্টলেকের বাড়িতেই থাকুক।
খুকুর মুখে শুনেছি খোকন-ইলা নাকি চায়নি রত্না আবার এ বাড়িতে এসে থাকে। মনে নেই কত বছর, তবে কয়েক বছর থাকার পর রত্না সিদ্ধান্ত নিল ও ওর ফ্ল্যাট চলে যাবে, অয়নের তখন পড়াশুনা শেষ হয়ে গিয়েছিল। রত্না চলে গেল। নীচের তলা এখন ফাঁকা। খোকনের সঙ্গে আমার সদ্ভাব আগের মত আছে। অতীতের অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো সব ভুলে গেছি। সেই আগের মতই ওর সঙ্গে চা খেতে খেতে গল্প আড্ডা হয়। সল্টলেকের অত বড় বাড়ি রেখে কি করব ভাবছিলাম। দেশে একেবারে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা নেই আর। বছরে হয়ত চার সপ্তাহ থাকি, তার জন্য একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে রাখলেই চলবে।
সল্টলেকে বাড়ি করার যে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সেটা সফল হয়েছে। মা ও নাবালক ভাই বোনদের জন্য একটা বাসস্থানের প্রয়োজন ছিল। সে প্রয়োজন মিটেছে, এখন আর তার দরকার নেই। ভাড়া দেওয়া যায়, কিন্তু তাতে আবার সেই পুরনো সমস্যাগুলো দেখা দেবে। আমার আর ও সব ভাল লাগে না, আমি একটু শান্তিতে থাকতে চাই। ঠিক করলাম, আমি আমার অংশটা বিক্রি করে দেব। যেমন করেই হোক এবাড়ির একটা বিহিত করে যেতে হবে আমার জীবদ্দশাতেই। বুবাই গৌতম দেশে এসে এমন জটিল ও দুরূহ কাজ করতে পারবে না, খোকনের সহায়তা ছাড়া। আর খোকন যে সহায়তা করবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আমি মনস্থির করে ফেললাম এবং খোকনকে জানালাম আমি আমার অংশটা বিক্রি করে দেব। খোকনের মত নেই। বার বার অনুরোধ করার পর একদিন এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে রাজী হল।
তখন হাঁদি সল্টলেকে। হাঁদির সামনে খোকনকে প্রস্তাব দিলাম- আমি ওকে এক কোটি টাকা দেব, ও ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিক। খোকন একটু ভাবল, তারপর বলল, “ঠিক আছে। আমি রাজী। তোমরা বস, আমি উপরে ওদের সঙ্গে কথা বলে আসি।” সেটা ২০১৬ সাল। এক কোটি টাকায় সল্টলেকে তখন উচ্চমানের ভাল ফ্ল্যাট পাওয়া যেত। তবে অবশ্য এত বড় বাড়ি একা একা ভোগ করার স্বাধীনতা পাওয়া যেত না। কিছুক্ষণ পরে খোকন ফিরে এল। বলল, “না, আমি আমার অংশ বিক্রি করব না।” (হাস্যকর, তাই না? আমারই বাড়ি, আমি যতটুকু দান করেছিলাম সেই টুকুই ন্যায্য মূল্য দিয়ে কিনতে চাইছি। বললে ভুল হবে না যে, প্রায় ভিক্ষা চাইছি।) বুঝলাম ওর উদ্দেশ্য অন্য; ও আমাকে বিক্রি করতে দেবে না। সল্টলেকের নিয়ম অনুযায়ী এক অংশীদার আপত্তি করলে অন্য অংশীদার তার অংশ বিক্রি করতে পারে না। তবে কোন কোন বিশেষ অবস্থায় কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিতে পারে। আমি হতাশ হলাম না। হতাশ হওয়া আমার চরিত্রে নেই। আমি চেষ্টা করতে থাকলাম।
ক্রমশঃ