ছবি: রমিত
ইংল্যান্ডের জীবন
বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি সারা হল। বেশি জিনিসপত্র নেওয়ার ইচ্ছা নেই – আমার কিছু নেইও। দু-একটা শীতের জামাকাপড় আর আমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। একটা বড় স্টিলের ট্রাঙ্ক আর আমার বন্ধুদের দেওয়া সেই স্যুটকেস। অনু বলল ওর হারমোনিয়াম আর তানপুরাও নিতে হবে। বুবাই তখন একেবারে শিশু। বললাম, এত সব আমি সামলাব কী করে? অনু বলল, তানপুরা আর হারমোনিয়াম না নিয়ে গেলে ও-ও যাবে না। বুঝলাম হারমোনিয়াম-তানপুরা ছাড়া ও স্বর্গে যেতেও রাজি নয়। সুতরাং একরাশি গানের খাতা, বই আর তানপুরা, হারমোনিয়ামও আমাদের সঙ্গী হল।
আমাদের জাহাজ ছাড়বে বোম্বের বন্দর থেকে। আমাদের তাই বোম্বে যেতে হবে। যাওয়ার দিন হাওড়া স্টেশনে অনেকে এসেছিল আমাদের বিদায় জানাতে। আত্মীয়স্বজন, ভাইবোন, বন্ধুরা। এদের সব ছেড়ে যেতে মনটা ভারী হয়ে উঠেছিল। চেনা পৃথিবী, আবাল্যের পরিচিত পরিজন, মা, ভাইবোন পরিত্যাগ করার বেদনা, অজানা পৃথিবী, নতুন পরিবেশ, নতুন জীবনের হাতছানি এবং অনিশ্চয়তা – সব চিন্তা একসঙ্গে মিলে মনটাকে তোলপাড় করছিল। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ছুটতে লাগল। আমি নিশ্চুপ। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। আমার ভাগ্যের গাড়ি চলতে শুরু করেছে।
ট্রেনে আমাদের কামরাতে এক সহযাত্রীর সঙ্গে আলাপ হলো। সে-ও আমারই মতো ইংল্যান্ডে যাচ্ছে সেই একই জাহাজে। সুতরাং একই পথের যাত্রী। অনেক দিন এক সঙ্গে কাটানো যাবে। সঙ্গে তার পিতৃদেবও যাচ্ছেন বন্দর পর্যন্ত, পুত্রকে জাহাজে তুলে দিতে। দুঃখের বিষয়, এই পিতা-পুত্রের নাম মনে নেই। জানলাম, এঁদের আদি বাস পূর্ববঙ্গে। দেশভাগের পর সর্বস্ব ত্যাগ করে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ শরণার্থী হয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। অনেক প্রতিকূল অবস্থা, অভাব-অনটনের মধ্যে থেকেও ছেলেকে ডাক্তারি পড়িয়েছেন। সেই ছেলে এখন বিলাত যাচ্ছে। পুত্র গর্বে পিতা গর্বিত। ডাক্তারও খুব সহজ, সরল ও মিশুকে মানুষ। মনে মনে ভাবলাম, আমাদের এই যাত্রা একেবারে নিঃসঙ্গ হবে না। বোম্বে এসে আরও কয়েকজন বাঙালি ছেলেমেয়ের সঙ্গে আলাপ হল। এরা সকলেই ইংল্যান্ডে যাচ্ছে এই জাহাজেই।
অনুর সঙ্গে ছিল কিছু সোনার গয়না। জাহাজে ওঠার সময় কয়েকজন সহযাত্রী আমাদের ভয় দেখাল, সোনার গয়না নিয়ে গেলে ওখানে কাস্টমস ডিউটি দিতে হবে। গয়না বিক্রি আর বন্ধক রেখে আমাদের জাহাজের টিকিট কেনা হয়েছে। বাকি যৎসামান্য যা ছিল তা-ই আনছিল অনু। ওই ওর শেষ সম্বল। ভারত সরকার মাত্র আমাকে তিন পাউন্ড আর অনুকে তিন পাউন্ড নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। সরকারের বিদেশি মুদ্রা সংকট। সুতরাং ডিউটি দেওয়ার মতো কোনো পাউন্ড আমাদের নেই। অনু কয়েকটা গয়না গায়ে পরে নিল আর বাকিগুলো এক থলি ভরে অতি সরল বিশ্বাসে ওই ডাক্তার ছেলের পিতার হাতে দিয়ে বলল, এই গয়নার থলিটা আপনি কলকাতায় নিয়ে যান। আমার দেওর এসে একদিন নিয়ে যাবে আমার শাশুড়ি মায়ের জন্য। আমি ওঁদের ঠিকানা নিয়ে নিলাম। আমাদের মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। এ নিয়ে চিন্তাও ছিল না।
আমার ভাই হাঁদি (নির্মলেন্দু) একদিন যাদবপুরের সেই ঠিকানায় গিয়ে হাজির হয়েছিল। যাদবপুরে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা বাস্তুহারা মানুষদের বসতি। চাঁচড়ির (বাঁশ আর মাটি দিয়ে গড়া) দেওয়াল, টিনের ছাউনি দেওয়া দুটি ঘর – হাঁদি বলেছিল। পরিচয় দিতে ভদ্রলোক হাসিমুখে হাঁদির হাতে গয়নার থলিটা দিয়ে দিলেন। অতীব সৎ ভদ্রলোক। এমন মানুষ আজকের পৃথিবীতে বিরল।
আবার অন্য চরিত্রও দেখেছি। জাহাজের টিকিট কেনার টাকা জোগাড় করতে আমরা অনেক ঘুরেছি। অনু ওর এক বান্ধবী নন্দার কাছে নিয়ে গেল আমাকে একদিন। অনু ওর গয়না বন্ধক রেখে ৫০০ টাকা নিয়েছিল নন্দার কাছ থেকে। পরে যখন আমাদের সামর্থ্য হল তখন টাকা নিয়ে নন্দার কাছে গিয়েছিলাম গয়নাগুলো ফেরত আনতে। নন্দা আর দেখা করেনি অনুর সঙ্গে।
আমরা একটা মালবাহী (Cargo Ship) জাহাজে আসছিলাম। নাম ‘ভিয়েতনাম’। এটা সুসজ্জিত যাত্রীবাহী জাহাজ নয়; সুতরাং যে গুটিকতক যাত্রী ছিল তাদের জন্য যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা বা আরামের ব্যবস্থা ছিল না। সমুদ্রযাত্রা আমাদের সুখপ্রদ হয়নি। আমরা দুজনেই ‘সি সিকনেস’-এ কষ্ট পাচ্ছিলাম। মাথা ঘুরত, কিছু গলাধঃকরণ করতে পারতাম না। সামান্য কিছু খেলেও তা বেরিয়ে আসত। তবুও যতটা পারি উপভোগ করছিলাম এই সমুদ্রযাত্রা।
জাহাজ ভিয়েতনামের ছবি
জাহাজ ভিয়েতনাম কার্ডের উল্টো দিক। কার্ডটা বোধহয় পোস্ট করা হয়নি শেষ পর্যন্ত।
একদিন জাহাজের ডেকে বসে এক টুকরো কাগজে লিখেছিলাম:
হঠাৎ কোনো খেয়ালে ভাসলাম, সাগর, হে মহাসাগর।
আমার মনের চঞ্চলতা তোমার উদ্বেল ঢেউয়ে ঢেউয়ে হারিয়ে যায়।
তোমার ঐ আদিগন্ত প্রসারিত নীল জল,
তোমার অসীম ব্যাপ্তি আমার সকল সত্তাকে আচ্ছন্ন করে।
হে মহাসাগর, তুমি জানো না
তোমার বহুরূপী মূর্তি আমার অনুভূতিকে কী প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়।
দিনে সূর্যের আলোয় তোমার চকমকে রূপ আমার চোখ ঝলসে দেয়,
রাতে লক্ষ তারার মালাপরা তোমার গাঢ় নীল সাজ আমাকে মাতিয়ে তোলে।
আর যখন এলোকেশী কালবৈশাখী ঝড় তোমাকে ক্ষেপিয়ে তোলে
তখন তোমার সে ভয়ঙ্কর রূপ আমাকে ভয়ে কুঁকড়ে দেয়।
তোমার বিশালত্ব আমার ক্ষুদ্রতাকে মহান করে তোলে:
আমি ভুলে যাই
আমার অতীত, আমার ভবিষ্যৎ, আমার উদ্দেশ্য –
শুধু বর্তমান আমার মিশে যায়
তোমার ঐ অপরূপ রত্নাকর গভীরে অণু-পরমাণু হয়ে।
কী অসীম দ্বিধাহীন ভরসায়
আমি আমাকে সঁপে দিয়েছি তোমার আশ্বাসের আঁচলে,
কী অবিচল বিশ্বাসে আমি তোমাকে আস্থা করেছি –
তুমি আমাকে পৌঁছে দেবে আমার আকাঙ্ক্ষার প্রান্তে।
তোমার করুণা, তোমার রোষ আমার ভূত, আমার ভবিষ্যৎ।।
সাগরজলে ভাসছি… যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু জল আর জল। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। সুয়েজ ক্যানেল দিয়ে যেতে যেতে দুকূলে আলোর মালা দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। ছোট ছোট নৌকো করে পসারীরা তাদের পণ্য নিয়ে জাহাজে আসত বিক্রি করতে। তাদের অনেকেই ছিল অসৎ। আমাদের কোনো টাকাকড়ি ছিল না, সুতরাং কিছু কেনার প্রশ্ন ছিল না। আমাদের এক সহযাত্রী এক ডজন জামা কিনেছিল। সুন্দরভাবে কার্ডবোর্ডের বাক্সে প্যাক করা। বিক্রি করে পসারী তীরে চলে গেল। আমাদের সহযাত্রী বাক্স খুলে জামাগুলো দেখে উচ্চস্বরে গালাগাল দিতে শুরু করল। মোটে একটিই সম্পূর্ণ জামা, যেটা উপরে ছিল। ভিতরে বাকিগুলো শুধু জামার কলার আর হাতা।
এটা এক ফরাসি জাহাজ কোম্পানি। এর যাত্রা শেষ ফ্রান্সের এক বন্দরে, মার্সেই-তে। এটা শীতকাল, বাইরে বেশ শীত। ভোরে জাহাজ এসে বন্দরে ভিড়ল। মার্সেই থেকে আমাদের ট্রেনে করে যেতে হবে ক্যালে। তারপর আরও এক ফেরি জাহাজে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ডোভার। ডোভার থেকে আবার ট্রেনে চেপে লন্ডন ভিক্টোরিয়া স্টেশনে। মার্সেই থেকে ভিক্টোরিয়া অনেক দূর, আরও অনেক ঘণ্টার পথ। মার্সেই-তে ট্রেনে উঠে বসেছি। অনু বলল, বুবাইয়ের খাবার সময় হয়েছে। ওর জন্য দুধ ও খাবার তৈরি করতে হবে। গরম জল লাগবে। আমি ফ্লাস্ক নিয়ে বের হলাম গরম জল আনতে।
শীতের সকাল। দু-একটা কাফে সবে খুলেছে। দেখলাম একটা কাফেতে মস্ত বড় কেটলিতে জল গরম হচ্ছে। আমি দোকানে গিয়ে ইংরেজিতে বললাম আমাকে একটু জল দিতে। দোকানি না বোঝার ভান করল। আমি আমার ফ্লাস্ক দেখিয়ে ওর গরম জলের কেটলির দিকে আঙুল দেখিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। কোনো ফল হল না। আরও দুটো দোকানে গিয়ে এমন করেই চাইলাম। একই ফল। হতাশ হয়ে ট্রেনে ফিরে এলাম। কামরায় এসে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম ফরাসি ভাষায় গরম জলকে কী বলে। একজন বলে দিল কী বলে এবং কেমন করে চাইতে হবে। আমি আবার ফ্লাস্ক হাতে করে সেই কাফেতে গেলাম। ফরাসি ভাষায় গরম জল চাইলাম। সেই দোকানিই একটু হেসে আমার ফ্লাস্কটাতে গরম জল ভরে দিল।
ফরাসিরা খুব গোঁড়া, গর্বিত জাতি। ইংরেজি জানলেও কিছুতেই বলতে বা বুঝতে চায় না। ষাটের দশকে আরও গোঁড়া ছিল। এখন অবশ্য কমন মার্কেট, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন পেরিয়ে এ গোঁড়ামি অনেকটা কমেছে।
অবশেষে ট্রেন আমাদের নিয়ে এলো লন্ডনের ভিক্টোরিয়া স্টেশনে। স্টেশনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন অনুর দাদা, অহিভূষণ। বিলাত যাত্রার খবর দিতে অনুর পিতৃদেবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখন তিনি বলেছিলেন – লন্ডনে আমার ছেলে বাড়ি কিনেছে। তোমরা সেখানে গিয়ে উঠবে। আমি লিখে দিচ্ছি।
আমিও অনুর দাদাকে লিখেছিলাম আমাদের লন্ডন আসার খবর জানিয়ে। ভিক্টোরিয়া স্টেশনে দাদা অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। স্টেশন থেকে বেরিয়ে আমরা একটা ট্যাক্সিতে, লন্ডনের বিখ্যাত ব্ল্যাক ক্যাবে উঠলাম। দেশ যখন ছেড়েছিলাম তখন ভারত সরকার মাথাপিছু মাত্র তিন পাউন্ড সঙ্গে আনার অনুমতি দিয়েছিল। অর্থাৎ আমাদের দুজনের জন্য ছয় পাউন্ড বরাদ্দ ছিল। সর্বসাকুল্যে আমার কাছে তাই ছয় পাউন্ড ছিল। সেই কালে ওই টাকা দিয়ে ট্যাক্সি করে এক মাইল পথও যাওয়া যেত না। আর আমাদের কাছে যত মালপত্তর ছিল তা নিয়ে ট্যাক্সি ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
লন্ডনের মধ্য দিয়ে ট্যাক্সি ছুটে চলল আমাদের গন্তব্যের দিকে। কিছুক্ষণ পরে ট্যাক্সি এসে থামল একটা বাড়ির সামনে। দরজা খুলে শান্তিদি আমাদের অভ্যর্থনা করল। শান্তিদি আমার মাসতুতো দিদি এবং অনুর বৌদি। দোতলায় একটা ঘরে আমাদের আশ্রয় হল। সেদিনের কথা ভুলব না কোনোদিন। ওঁদের দাক্ষিণ্য ও বদান্যতা নতুন দেশে আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। এঁদের কাছে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ ও চিরঋণী। এঁদের ঋণ আমি জীবনে পরিশোধ করতে পারব না।
যতদূর মনে পড়ছে সেদিনটা ছিল শনিবার। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ তায় আবার শীতকাল। এতদিনের সমুদ্রযাত্রা, ট্রেনযাত্রা শরীরটাকে ক্লান্ত করে দিয়েছে কিন্তু মনটা আশ্চর্য রকমের হালকা ও শান্ত। দুদিন বিশ্রাম নেওয়া যাক।
এটা একটা ছোট টেরাস্ট বাড়ি অর্থাৎ একসঙ্গে অনেকগুলো বাড়ি পাশাপাশি জুড়ে দেওয়া। দুপাশের বাড়ির সঙ্গে যৌথ দেওয়াল। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের উপর তৈরি হয়ে উঠেছিল নতুন লন্ডন শহর। সাধারণ মানুষের বসবাসের জন্য সরকারি উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল এই সব বাসস্থান। ব্রিটেনই একমাত্র দেশ যেখানে ষাট শতাংশেরও বেশি পরিবারের নিজস্ব বাড়ি ছিল।
দাদা এই বাড়িটা সদ্য কিনেছেন। নীচে দুটি ঘর ও রান্নাঘর। একটি বসার ঘর, বেশ ছিমছাম, রুচিসম্মতভাবে সাজানো-গোছানো। অন্যটি খাবার ঘর। উপরে দুটি শোবার ঘর ও একটি খুবই ছোট ঘর – জিনিসপত্র রাখার জন্য বা শিশুর বিছানার জন্য। আর অবশ্যই একটি স্নানের ঘর। শান্তিদি ও দাদা উপরের একটি ঘর আমাদের জন্য ছেড়ে দিলেন।
দুদিন বিশ্রামের পর শরীরের ক্লান্তি দূর হল। নিজেকেও নতুন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে নিলাম। আবার সব শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাকে টাকা পাঠাতে হবে। দেশে অর্থঋণ আছে, আমাকে ঋণমুক্ত হতে হবে। সরকারি সোশ্যাল সিকিউরিটি অফিসে রেজিস্ট্রি করলে বেকার ভাতা ও বাসস্থান পাওয়া যেতে পারে। আপাতত বাসস্থানের চিন্তা নেই আমার। পকেটে মোটে ছয় পাউন্ড আছে। সুতরাং অর্থের প্রয়োজন তাৎক্ষণিক। কিন্তু আমি শপথ নিয়েছিলাম অত্যন্ত নিরুপায় না হলে সরকারি সাহায্য নেব না।
দেশে থাকতে আমাদের আড্ডায় কবিতা, সাহিত্য, শিল্প, রাজনীতি ছাড়াও আরও একটা বিষয় আলোচনা হত – ক্রিকেট। রেডিওতে কান পেতে ধারা বিবরণী শুনতাম। ইডেনে টেস্ট খেলা দেখার জন্য পয়সা জমাতাম। কোনোকালেই পুরো টিকিট কাটার মতো পয়সা জমাতে পারিনি। তাই দু-তিন জন বন্ধু মিলে একটা টিকিট কিনতাম। তারপর লটারি করে ঠিক হত কে কোন দিন যাবে। ইডেনে কানহাইয়ের সেঞ্চুরি দেখতে দেখতে ভাবতাম – ওঃ লর্ডসে যদি কোনোদিন খেলা দেখতে পেতাম! লন্ডনে এসে সেই সাধ মেটালাম। ইংল্যান্ডের মাটিতে পা দেওয়ার কয়েকদিন পরেই লর্ডসে গেলাম খেলা দেখতে। এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট পাওয়া গেল – ঠেলাঠেলি নেই, ধাক্কাধাক্কি নেই, মাউন্টেড পুলিশ নেই। অবাক হয়েছিলাম। লাঞ্চের সময় ভাল করে লর্ডসের আবহাওয়া শুষে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ একজন আমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল – তার চোখে অবিশ্বাসের অভিব্যক্তি। “অমলেন্দু না?” ওর গলায় বিস্ময়ের সুর। আমি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে উচ্চস্বরে বলে উঠলাম, “আরে সুভাষ, তুই?”
সুভাষ আমার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের বন্ধু। আমি জানতাম সুভাষ ইংল্যান্ডে এসেছে। কিন্তু ও আসার পর আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি। আমিও জানতাম না ও কোথায় আছে, ওর ঠিকানা কী। দূর দেশে পুরনো বন্ধু পাওয়ার যে কী আনন্দ সেদিন তা উপলব্ধি করেছিলাম। সময় পেলে আমরা দুজনে দেখা করতাম, গল্প করতাম। আমি সদ্য এসেছি, সুভাষ অনেক দিন আছে এ দেশে। সুভাষ বিজ্ঞের মতো “দেশি” অমলেন্দুকে ইংল্যান্ডের জীবন সম্বন্ধে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মতো “জ্ঞান” দিতে শুরু করত – কী করা উচিত, কী করা উচিত না ইত্যাদি ইত্যাদি। সুভাষ আমাকে নিয়ে একেকদিন ওর লন্ডনের বাঙালি বন্ধুদের বাড়ি নিয়ে যেত ও আলাপ করিয়ে দিত। এরা সকলেই প্রায় ছাত্র। সে কালে বাঙালি ছাত্ররা একসঙ্গে এক জায়গায় অপেক্ষাকৃত কম খরচার বাসস্থানে দলবদ্ধ হয়ে থাকত। সুভাষ আমাকে একদিন ফিন্সবেরি পার্কের একটা বাড়িতে নিয়ে গেল। এটা একটা বড় তিনতলা বাড়ি। এখানে বিভিন্ন ঘরে প্রায় আট-দশজন বাঙালি ছাত্র থাকে, নানা বয়সের। শনি-রবিবারে এরা সকলে মিলে এক-একজনের ঘরে পালা করে রান্না করে, একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে। সারা সন্ধ্যায় আড্ডা হয় আর আড্ডা শেষে খাওয়া-দাওয়া। আজ আমি ও সুভাষ ওদের অতিথি। একটা বেশ বড় ঘর, সঙ্গে একটা ছোট রান্নাঘর। দেখলাম একটা বড় ডেকচিতে মাংস রান্না হচ্ছে – সারা ঘর মাংস রান্নার গন্ধে ম ম করছে। ঘরের মধ্যে দুই কোনে দু’দল তাস খেলছে – তিন পাত্তি। সুভাষ একে একে সকলের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিল। তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম তারা সবাই অবস্থাপন্ন ধনী পরিবারের ছেলে। প্রতি মাসে পিতৃদেবের কাছ থেকে টাকা আসে পড়াশোনা করার জন্য। আমার মতো ঋণ নিয়ে বিলেতে আসেনি, আমার মতো মাসে মাসে মাকে টাকা পাঠানোর দায় নেই কারো। সুভাষ বলে যাচ্ছে এ কস্টিং পড়ছে আজ ছ’বছর ধরে। কবে যে পাস করবে কেউ জানে না। কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে ছ-সাত বছর ধরে, কেউ বা ল। সকলেই বছরের পর বছর পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। সফল হয়েছে এমন কাউকে দেখলাম না। একটু হতাশ হয়ে ফিরে এলাম।
সুভাষ আমাকে ওর অনেক বন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। বলা বাহুল্য, কারো সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব হয়নি। সুভাষ কয়েক বছর ইংল্যান্ডে থেকে পেপার টেকনোলজি পড়তে সুইডেনে চলে যায়। পরে শুনেছি ও এক সুইডিশ মেয়েকে বিয়ে করে সুইডেনেই থেকে গিয়েছে।
লন্ডন ছেড়ে সুভাষ চলে গেলে ওর সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি।
আমরা যে বাড়িতে এসে উঠলাম সে বাড়িটা কিংসবেরিতে, অরচার্ড গ্রোভে। পাশেই বড় রাস্তা হানিপট লেন। এই রাস্তায় ও সংলগ্ন এলাকায় অনেক ছোট ছোট ফ্যাক্টরি ও ব্যবসায় ছিল সেকালে। আমি বেরিয়ে পড়লাম চারিদিকটা ঘুরে দেখতে। হানিপট লেনে সারি সারি ছোট ছোট ফ্যাক্টরি। সব ফ্যাক্টরির সামনে একটা নোটিস বোর্ড। তাতে লেখা সেখানে কোন কোন কাজের পদ এখন শূন্য আছে। এটা দেখে আমি অবাক হলাম। এ অভিজ্ঞতা আমার নতুন, দেশে এমন দেখিনি। আমি জানতাম দেশে স্ট্যাটিস্টিক্যাল কোয়ালিটি কন্ট্রোলের যে পদে আমি ছিলাম সেরকম উচ্চ পদের কাজ আমি এদেশে পাব না। তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি ছিল। মনে মনে আকাঙ্ক্ষা ছিল কম্পিউটার প্রযুক্তিতে কাজ করার। কিন্তু সেটা ছিল শুধুই স্বপ্ন। তাছাড়া সেই প্রথম দিনে নতুন দেশে কাজ শুরু করার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম একটা বোর্ডে লেখা আছে, ইন্সপেকশন ডিপার্টমেন্টে কাজের জন্য লোক চাই। আমার কৌতূহল হল। ভিতরে গিয়ে দেখা করলাম। ওরা আমাকে দু-একটা কাজের কথা জিজ্ঞেস করল। আমার উত্তরে নিশ্চয় খুশি হয়েছিল। বলল, “কবে থেকে শুরু করতে পারবে?”
ইংল্যান্ডে সেটাই আমার প্রথম কাজ। আমি দ্বিধা করিনি। স্বয়ংসিদ্ধ – আমাকে তো আর কারও অনুগ্রহ নিতে হবে না।
কিন্তু এদেশে তো আমি এর জন্য আসিনি। আমাকে আরও পড়াশোনা করতে হবে, আরও উন্নত জীবন পেতে হবে। ইচ্ছা কম্পিউটার প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করা। দেশে আমার সমস্যা ছিল সময় আর অর্থ। এখানেও সেই একই সমস্যা। তবে এদেশে ইচ্ছা আর উদ্যম থাকলে অনেক কিছু করা যায়। সে যুগে ইউনিভার্সিটি পড়াশোনায় বেশি অর্থের প্রয়োজন হত না। আমার সমস্যা ছিল সময়। কিন্তু লন্ডন ইউনিভার্সিটির একটি কলেজে সন্ধ্যায় ডিগ্রি কোর্স করা যায়। সেটা বারবেক কলেজ। সন্ধ্যায় ইউনিভার্সিটিতে পড়া যায় – এ তো আমার স্বপ্ন! কিন্তু আমি যে বিষয় নিয়ে পড়তে চাই সে বিষয় ওরা পড়ায় না। বারবেক কেন সারা ইংল্যান্ডের কোথাও শুধু কম্পিউটারের ডিগ্রি কোর্স ছিল না। মনে রাখতে হবে সেটা ১৯৬৭ সাল। কম্পিউটারের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কী করে অর্জন করলাম সে কথায় পরে আসছি।
যাই হোক আমার সময় বেশি নেই, তাই সময় নষ্ট করতে চাইছিলাম না। অর্থের জন্য কাজ করতে হবে। সুতরাং দিনের বেলায় কলেজ করতে পারব না। সন্ধ্যায় ডিগ্রি করা যায় একমাত্র বারবেক কলেজে। আমি বারবেকেই ভর্তি হলাম ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্স কোর্সে। অঙ্কে আমি কোনদিনই স্বচ্ছন্দ বোধ করিনি, তবু এটাই ছিল কম্পিউটারের কাছাকাছি। ক্লাস শুরু হবে সেপ্টেম্বরে। এখনও মাস ছয়েক দেরি আছে। ইতিমধ্যে আর কিছু করা যায় কিনা খোঁজ নিচ্ছিলাম। দেখলাম কয়েকটা বেসরকারি শিক্ষায়তন আছে যেখানে সন্ধ্যায় কম্পিউটার কোর্স করা যায়। এরকমই একটা ছয় মাসের কোর্সে আমি ভর্তি হয়ে গেলাম।
অনেক কাজ এবং দায়িত্ব একই সঙ্গে নিয়ে নিলাম। স্বভাবত আমি একটু অলস ও আরামপ্রিয়। আমার শরীরও খুব সবল নয় – দীর্ঘ সময় ধরে পরিশ্রম করার মতো শক্তিও আমার নেই। কিন্তু তখন আমার দেহে অসুরের মতো বল, মনে অর্জুনের মতো ধনুর্ভঙ্গ পণ। আমি সকালে কাজে যেতাম, কাজ সেরেই সন্ধ্যায় ক্লাস করতাম। রাত্রি নটা-দশটায় ফিরে এসে হোমওয়ার্ক শেষ করে বা চাকরির দরখাস্ত লিখে প্রায় রাত্রি একটা নাগাদ বিছানায় যেতাম। কী করে যে করেছি জানি না।
জীবনে এমন ছোট-বড় অনেক কোর্স করেছি। এবং অনেক শংসাপত্রও পেয়েছি। কিন্তু এই অধুনালুপ্ত শিক্ষায়তনের সান্ধ্য কোর্সের শংসাপত্র আমার কম্পিউটার কর্মজীবনের প্রবেশদ্বার খুলতে এমনভাবে সাহায্য করবে তা আমি ভাবতে পারিনি। আমাদের জীবনে কোনো এক মুহূর্তে নেওয়া এক নগণ্য সিদ্ধান্ত আমাদের জীবনের গতিপথ নির্ণয় করে দেয়। এক অতি সামান্য শংসাপত্র অসামান্য স্মৃতিফলক হয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে আমার জীবনে।
প্রথম দিনের কাজটা দু-সপ্তাহের বেশি করিনি। আসলে আমার চরিত্রে একটা চঞ্চলতা আছে। কোনো কাজই আমি দীর্ঘ দিন ধরে করতে পারি না এবং জীবনে কখনো তা করিও নি। আমার মন সব সময়েই চাইত নতুন কিছু করতে, নতুন অভিজ্ঞতার শরিক হতে। উন্নত থেকে আরও উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা। আর তখন তো নতুন দেশ আবিষ্কারের উত্তেজনায় মেতে আছি। তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো এ দেশের সমাজ ব্যবস্থা, রাজনীতি, শিল্প, সংস্কৃতি, নিয়মকানুন, আদব-কায়দার বারি আকণ্ঠ পান করছি। সেই সঙ্গে আছে জীবন যাপনের সংগ্রাম। কাজ, পড়াশোনা এবং নতুন কাজের সন্ধান। নষ্ট করার মতো সময় নেই এক মুহূর্ত।
বাড়ির কাছেই এক ব্যবসায় একটা কাজ পেলাম। অতি সাধারণ কাজ, মাইনেটা একটু বেশি। এদের উৎপাদিত দ্রব্যের জন্য যে সব জিনিসপত্র এরা কিনত সেগুলো যখন আসত তখন সেগুলো যথাযথ আকার ও মাপের কিনা সেটা পরীক্ষা করে তুলে রাখা হত। সেই কাজের দায়িত্ব ছিল আমাদের দুজনের উপর। আমরা দুজনেই ভারতীয়। অন্য জন পুরনো অভিজ্ঞ কর্মী – আমি তার কথামতো কাজ করি। একবার এমন কিছু জিনিস এলো সেগুলো ঠিক পরিমাণে এসেছে কিনা তা পরীক্ষা করতে আমার সহকর্মী অসুবিধায় পড়েছিল। এর জন্য কিছু অঙ্কের প্রয়োজন ছিল যা ওর আয়ত্তের বাইরে। আমি ওকে সাহায্য করেছিলাম। স্টোর ম্যানেজারের প্রশ্নোত্তরে ও জানিয়েছিল নতুন লোকটা (অর্থাৎ আমি) অঙ্ক করে দেখিয়ে দিয়েছিল। তা শুনে ম্যানেজার আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল, জিজ্ঞেস করেছিল আমি কিছু পড়াশোনা করেছি কিনা। আমার সঙ্গে কথা বলার পর ম্যানেজার বলল – তুমি কাল থেকে আমার অফিসে কাজ করবে, আমার হিসাবের কাজে সাহায্য করবে। আমার কর্মোন্নতি হল। কয়েক মাস এ কাজ করার পর একাজও ছেড়ে দিলাম।
লন্ডনের টটেনহ্যাম কোর্ট রোডে একটা কম্পিউটার তৈরির কোম্পানি ছিল। তারা ছোট ছোট কম্পিউটার, সেডী ও সুজী নামে কম্পিউটার তৈরি করত, সে কালের মিনি। এগুলো মূলত অ্যাকাউন্টিং মেশিন, আজকের তুলনায় প্রায় আদিম। মেশিন কোড, রেজিস্টার, অসিলোস্কোপ ইত্যাদি সহযোগে এদের প্রোগ্রাম করতে হত। খুব সহজ ছিল না। ততদিনে আমার সেই কম্পিউটার কোর্সটা শেষ হয়েছে। কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেছি। বেশ কয়েকটা ইন্টারভিউ পেরিয়ে এরা আমাকে ওদের কোম্পানিতে নিয়োগ করল। আমি আমার মনোনীত ও আকাঙ্ক্ষিত পেশায় অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রথম সুযোগ পেলাম।
সদ্যোজাত ছোট কোম্পানি। স্নাতক ও কৃতি ছাত্রের সংখ্যা কম ছিল এখানে। তাছাড়া সে যুগে পেশা হিসাবে কম্পিউটার কর্ম খুব আকর্ষণীয় বা জনপ্রিয় ছিল না। এদের কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যা আমি সমাধান করতে সক্ষম হয়েছিলাম। সেজন্য অচিরেই আমি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও’রাইলি সাহেবের নেক নজরে পড়ি। এখানে ট্রেনিং নিয়ে এবং কিছুদিন অভিজ্ঞতা অর্জন করেই অনেকেই অন্য কোম্পানিতে চলে যেত। আর যখনই কেউ চাকরি ছেড়ে চলে যেত তখনই মিস্টার ও’রাইলি আমাকে ডেকে আমার বেতন বৃদ্ধি করতেন। জীবনে কখনো আমার বছরে এতবার এমন আশাতীত বেতন বৃদ্ধি হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যেই আমার উপর কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব এসে পড়ল। তার মধ্যে একটা হল নতুন কর্মীদের ট্রেনিং দেওয়া।
ব্রিটেনে এসে বর্ণবৈষম্য নিয়ে নানা রকমের কথা শুনছিলাম, নানা অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পড়ছিলাম, টিভিতে দেখছিলাম নানা ভয়াবহ দৃশ্য। আমাকে এখনো পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনার শিকার হতে হয়নি, শুধু একদিন ছাড়া। অ্যান্ড্রু নামে একটি যুবক নতুন কাজে যোগ দিয়েছিল। ডেরেক, আমার ম্যানেজার, আমাকে অ্যান্ড্রুকে ট্রেনিং দেওয়ার দায়িত্ব দিল।
অ্যান্ড্রু খুব ধনী পরিবারের ছেলে। পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা করেছে। কিন্তু এ-লেভেল পাস করার পর আর ইউনিভার্সিটিতে যায়নি। সে যুগে এ-লেভেল পাস করলেই ভাল কাজ-কর্ম পাওয়া যেত। খুব অল্প সংখ্যক ছাত্রই উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী ছিল। অ্যান্ড্রু যে বড়লোকের পাবলিক-স্কুলে-পড়া ছেলে সেটা ওর পোশাক-পরিচ্ছদে, হাবভাবে, চালচলনে, ভাষার উচ্চারণে, পকেট-ভর্তি টাকার ভারে, পরোক্ষভাবে সকলকে বুঝিয়ে দিত।
এ-হেন কট্টর ইংরেজ তনয়কে ট্রেনিং দেওয়ার ভার পড়ল সদ্য-আগত তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক এক ভারতীয়ের উপর। এটা বোধহয় অ্যান্ড্রুর মনঃপূত হয়নি। প্রথম দিনে ওকে আমি কয়েকটা টেস্ট দিয়েছিলাম। টেস্ট রেজাল্ট নিয়ে ওর সঙ্গে বসে আলোচনা করছিলাম, দেখাচ্ছিলাম ও কোথায় কোথায় ভুল করেছে। এমনি একটা ভুল আমি ওকে দেখিয়ে দিলাম। অ্যান্ড্রু আমার মন্তব্যে ভ্রূক্ষেপ না করে কয়েক মিনিট আমার মুখের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকল। তারপর স্তব্ধতা ভেঙে আমাকে বলল – “হান্ড্রেড ইয়ার্স এগো ইউ উড হ্যাভ পলিসড মাই স্যুসজ।” (Hundred years ago you would have polished my shoes)।
আমি হতবাক। তীব্র অপমানবোধ ও মুহূর্ত পরে শরীর-অবশ-করা এক গভীর শূন্যতা আমাকে আচ্ছন্ন করল। ওর উক্তির উত্তরে কোনো ভাষা আমি খুঁজে পেলাম না। তাছাড়া গালাগাল তো দূরের কথা, জীবনে আমি কখনো কোনো অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করিনি। আমি চুপ করে থাকলাম। কথাগুলো বলে অ্যান্ড্রু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলা বাহুল্য, অ্যান্ড্রুকে আর এই কোম্পানিতে দেখা যায়নি।
ক্রমশঃ