ছবি: রমিত
কবিরাজ দম্পতি
কবিরাজ দম্পতি, সুদীপ্ত ও নীলাঞ্জনা কবিরাজের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল অনুর সুবাদে। আমি জানতাম না কি ভাবে কোথায় ওদের প্রথম দেখা হয়েছিল। নীলাঞ্জনার মুখে পরে শুনেছিলাম নেহেরু সেন্টারের এক বক্তৃতা সভার পর লাউঞ্জে ওদের আলাপ হয়েছিল। একদিন অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছিলাম অনুর এক নতুন বন্ধু হয়েছে যার সঙ্গে ও টেলিফোনে ঘন্টার পর ঘন্টার কথা বলে। ক্রমশ আমাদের দুই পরিবারের সখ্যতা গড়ে উঠল এবং কালে কালে তা ঘনিষ্ঠ ও নিবিড় হয়ে উঠল। প্রায়শই আমরা নীলাঞ্জনা-সুদীপ্ত-র বাড়ি যেতাম ও ওরাও আমাদের বাড়ি আসত।
অনু প্রায়ই আমাদের বাড়িতে গানের আসরের আয়োজন করত। সে সব আসরে কবিরাজ দম্পতির উপস্থিতি প্রায় সিকিউরিটি কাউন্সিলের পার্মানেন্ট মেম্বারের মত অবধারিত ছিল। এছাড়াও আমাদের বাড়িতে বিশেষ সুধী ও গুণীজনের আড্ডাতেও সুদীপ্ত-নীলাঞ্জনা আমন্ত্রিত হত। সুদীপ্তর অতি ব্যাস্ত কার্যসূচীর মধ্যেও ওরা আমাদের কখনো নিরাশ করেনি।
সুদীপ্ত কবিরাজ তখন লন্ডনে সোয়াস-এর (S O A S – School of Oriental and African Studies, Univarsity of London) অধ্যাপক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সুদীপ্ত কবিরাজের নাম দেখেছি, তার লেখার উদ্ধৃতি পড়েছি। সুদীপ্ত JNU তে Political Science-র অধ্যাপক ছিলেন, এবং ছিলেন Agatha Harrison Fellow at St. Antony's College, Oxford। সুদীপ্ত এখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
আমি সে সময়ে টেগোর সেন্টার ইউকে-এর চেয়ার পার্সন ছিলাম। টেগোর সেন্টার থেকে আমরা তখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লেখকদের লেখা নিয়ে একটি উচ্চমানের এন্থোলজি প্রকাশ করার পরিকল্পনা করছিলাম। সেই বই-র জন্য আমি সুদীপ্তর কাছে একটি প্রবন্ধের অনুরোধ করেছিলাম। সুদীপ্ত একটি দীর্ঘ ও উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ লিখে আমার অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। আমি তার জন্য কৃতজ্ঞ।
অনেক মানুষের ভিড়ের আড্ডায় সুদীপ্ত বা নীলাঞ্জনার সঙ্গে কথা হত না বেশি। ওদের সঙ্গে আড্ডা জমে উঠত তখনই যখন ওরা দুজনে আমাদের বাড়ি আসত বা আমরা যেতাম ওদের বাড়ি। অনু নীলঞ্জনার সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই ফোনে কথা বলত কিন্ত আমার কখনও সে সু্যোগ হত না। নীলাঞ্জনার ফোন এলে যদি কখনো আমি ধরতাম তখনই অনু এসে তাড়াতাড়ি ফোনটা কেড়ে নিত- ওর আর সবুর সইত না। আমি তাই কখনো নীলাঞ্জনার সঙ্গে দু’মিনিটের বেশি কথা বলিনি। আজ অনু বাকহীন, বধির, মস্তিষ্কের বোধলুপ্ত। প্রিয়জনদের চিনতে পারে না আর। তবু এখনো মাঝে মাঝে নীলাঞ্জনা ফোন করে অনুর খবর নেয়। আমার সঙ্গে কথা হয়- অনুর শরীর কেমন, আমি কেমন আছি, ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর রাজনীতি, গান, স্মৃতি রোমন্থন ইত্যাদি- কথা বলতে বলতে মিনিট ঘণ্টার হিসেব থাকে না।
সুদীপ্তর সঙ্গে কথা বলে তৃপ্তি পেতাম। ওর বিশ্লেষণ শক্তি অসাধারণ, দৃষ্টি অনন্য। জটিল বা দৈনন্দিন যে কোন বিষয়ই হোক তার উপর সাধারণ মানুষের যা মতামত, তা ওর সঙ্গে আলোচনা করার পর বদলে যাবে। চিরদিনের লালিত ভাবনাকে নতুন করে চিন্তা করতে ইচ্ছা হবে। আমার অতি পরিচিত বস্তুকে এতকাল যে দৃষ্টিতে দেখেছি তার যে আরও একটা দিক আছে তা সুদীপ্তর সঙ্গে কথাবলার পর আবিষ্কার করেছি। নিরিবিলিতে আমাদের কথাবার্তা হত যখন আমরা পরস্পর পরস্পরের বাড়িতে যেতাম। ওরা যতদিন লন্ডনে ছিল ততদিন এমনই দেখা সাক্ষাৎ প্রায়ই হত। আমেরিকা চলে যাওয়ার পরও আমাদের দুই পরিবারের মেলামেশা বন্ধ হয়ে যায়নি। প্রতি গ্রীষ্মে ওরা লন্ডনে ও শীতে কলকাতায় আসে। আমরাও শীতে কলকাতায় থাকি। আনন্দের সঙ্গে বলি নীলাঞ্জনা-সুদীপ্ত লন্ডনে বা কলকাতায় আমাদের সঙ্গে কখনো দেখা করতে ভুলেনি। এটা আমাদের গর্ব।
আমাদের বাড়ির গানের আসরে আমার আর এক বন্ধু ভাস্কর দত্ত নিয়মিত আসত। ভাস্কর কবি ও সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ভাস্কর অনুর গানের এক অকৃত্রিম ভক্ত। ভাস্করের কথায় পরে আসছি। এইসময় সুদীপ্তর ভাস্করের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমাদের বাড়িতে।
সুদীপ্তর মত নীলাঞ্জনাও প্রেসিডেন্সিতে পড়ত, একই সময়ে একই সঙ্গে। সুদীপ্ত-নীলাঞ্জনার সঙ্গে আলাপের আগে অরিন্দমের মুখে ওদের নাম শুনেছিলাম। কাকতালীয়ভাবে ওদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। অরিন্দম একদিন বলেছিল, “নীলাঞ্জনাদির গান শুনবেন, রেওয়াজি গলা; আপনার ভাল লাগবে।” সত্যিই ভাল গায়। মার্গ সংগীতে চর্চিত গলা। সবিতা দেবীর কাছে তালিম নিয়েছে। আমাদের বাড়িতে অনেক বার গান গেয়েছে; কোন অহমিকা নেই। অনুরোধ করলেই তানপুরা নিয়ে বসে যেত। কিছুকাল আগে আমেরিকা গিয়ে কিছু রেকর্ড করেছে। আমাদের বাড়িতে গানের আসরে আমাকে সব সময়েই অতিথি আপ্যায়নে ব্যাস্ত থাকতে হত। মন দিয়ে কখন কারো গান শোনা হত না; নীলাঞ্জনারও না। কিছুদিন আগে নিরিবিলি একান্তে ওর রেকর্ড শুনছিলাম। পেশাদার সারেঙ্গী বাদকের সংযোগে সে গান অনবদ্য হয়ে উঠেছিল।
বন্ধ জানালা খুলে দিলে পুরানো দিনের হাওয়ায় পারিজাতের সুবাস বয়ে আনে। মৃত মাধুরীর কণা ভরিয়ে দেয় মনকে।
লেখক, সুদীপ্ত ও নীলাঞ্জনা কবিরাজ
একদিন পোস্টে একটা খাম এলো। খুলে দেখি একটা বই– ‘মার্ক্স ও স্বর্গের সন্ধান’, লেখক সুদীপ্ত কবিরাজ। সুদীপ্ত পাঠিয়েছে আমেরিকা থেকে। সুদীপ্তর লেখা আমার ভাল লাগে। ওর লেখা আমার মনকে নাড়া দেয়, চিন্তার খোরাক যোগায়। এ বইও তার ব্যাতিক্রম নয়। সুদীপ্ত প্রধানত ইংরেজীতে লেখে, ওর বাংলা বই বিরল। মননশীল বুদ্ধিজীবী সমাজের একটা অংশ ওর লেখার পাঠক। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় সুদীপ্ত কবিরাজের নাম দেখেছি, ওর লেখার উদ্ধৃতি পড়েছি। কিছুদিন আগে লন্ডনের সানডে টাইমস-র কলামিস্ট ম্যাথু সৈয়দ-র লেখায় সুদীপ্ত কবিরাজের মতামতের উল্লেখ দেখলাম। বহুদিন বাংলা ভাষায় এমন গুরুভার প্রবন্ধের বই পড়িনি। বই পড়া শেষ করে আমার মতামত দিয়ে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলাম। সে চিঠিতে বিভিন্ন বিষয়ে আমার নিজস্ব বক্তব্যও ছিল। কিছুটা সেই কারণে এবং কিছুটা ওই বই পড়ে আমার মনে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা জানানোর জন্য সেই চিঠির কিছু অংশ নীচে তুলে দিলাম:
“প্রবন্ধগুলি দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ভাগ মস্তিষ্কের রাজ্য। মনন (intellect) যার অধিপতি। যুক্তি, তর্ক, তত্ত্ব, ন্যায়, গভীর দৃষ্টি, সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ পাঠককে অভিভূত করে রাখে। এখানে উল্লেখ করা উচিত এই সব আপাত শুষ্ক বিষয়সমূহ সাবলীল হয়ে উঠেছে লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও স্থান কালের নিপুণ মিশ্রণে। তুলনামূলক দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি, সমাজবিজ্ঞান নিয়ে ক্ষুরধার বিশ্লেষণ এ বইয়ের বিশেষ আকর্ষণ। কিংবদন্তি সব আন্তর্জাতিক দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের পশাপাশি অবধারিত বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ পাঠককে, মৌমাছি যেমন ফুলরেণুতে নিমজ্জিত হয়ে যায়, তেমনই নিমগ্ন করে রাখবে। যে সব চিন্তক ও দার্শনিকদের বক্তব্য চিন্তা ভাবনা আলোচিত হয়েছে তাঁদের সঙ্গে যদি পাঠকের যথেস্ট পরিচয় থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে এই রচনাগুলি পাঠককে বিস্মিত পুলকে চমৎকৃত করবে। লেখকের পান্ডিত্যের প্রকাশ আছে কিন্তু আস্ফালন নেই।
দ্বিতীয় ভাগ হৃদয়ের রাজ্য। এখানে দয়া, ভক্তি, ভয়, বোধ, আবেগ, অনুভূতি, রূপ, রস ভইড় করে এসেছে। ভাষা অনেক গতিময়– দুর্বোধ্য ও সৃষ্ট (manufactured) শব্দের উপস্থিতি অপেক্ষাকৃতভাবে কম। স্বচ্ছন্দ সহজ পাঠ, অনায়াসে মরমে পশে। ভাবতে অবাক লাগে যে দুই ভাগই একই কলম থেকে নিঃসৃত। কিছু কিছু অংশ অতি উচ্চমানের সাহিত্য সৃষ্টির তুল্য– মন ভরে যায়।
একটা উদাহরণ দিই। আমেরিকায় হেমন্তে গাছের পাতার রঙ পালটিয়ে এক অপরূপ কল্পলোকের ছবি আঁকে। এই নৈসর্গিক দৃশ্য চোখে যে না দেখেছে ভাষায় তাকে সেই অনুপম আনন্দের স্বাদ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। লেখকের মাউন্ট ওয়াশিংটনে ফল কালার্স দেখতে গিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালোবাসি’- শোনার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি নিয়ে যা বর্ণনা দিয়েছেন তা আমায় মুগ্ধ করেছে। কোনো সুগীত রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে আমার যখন প্রাণ ভরে উঠে, অপরিসীম তৃপ্তি মনকে আচ্ছন্ন করে, ভাষায় যা প্রকাশ করতে পারি না, তখন অস্ফুট স্বরে শুধু উচ্চারিত হয় সাধু, সাধু। এই অংশটুকু শেষ করে উচ্ছসিত হয়ে আমি তেমনই রব তুলেছি – সাধু, সাধু।
দ্বিতীয় অর্ধে এমন সাহিত্য সুধারস ছড়িয়ে আছে অনেক পাতায়। সাহিত্য সৃষ্টির অনবদ্য প্রকাশ।
…
পড়তে পড়তে অনেক কথা মনে হয়েছে। অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি, আবার নতুন প্রশ্ন জেগেছে। অনেক যুক্তির সঙ্গে একমত হয়েছি, আবার কিছু যুক্তিতে মন সায় দেয় নি। দু একটা উদাহরণ দিই।
লেখক বলছেন– হেগেল পড়ে বিশ্বাস করতে পারলে সিপিআই-সিপিএম-নকশালদের বাদানুবাদ এবং মারামারি অন্যরকম হতে পারত। (পৃ: ১১৮) অন্যরকম কী হতে পারত তার কোনো ইঙ্গিত নেই। কী হলে কী হত তা আমরা জানি না। সে কালের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা হেগেল পড়েননি বা হেগেলে অনীহা দেখিয়েছেন তার মূল কারণ, আমার মনে হয়, মার্ক্স নিজে প্রথম জীবনে বার্লিনের Young Hegelians-র সদস্য থাকলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হেগেলীয় দর্শনে আস্থা হারিয়ে Young Hegelian-দের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেছিলেন। আদি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কাছে মার্ক্স ছিলেন ভগবান। এবং মার্ক্স যেহেতু হেগেলে বিশ্বাস করেননি সেহেতু, আমার মনে হয়, কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা হেগেল চর্চা করেনি।
এ প্রসঙ্গে আরো একটা প্রশ্ন জাগছে। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস আর মার্ক্স ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, একসঙ্গে বহু কাজ করেছেন। মার্ক্স ও এঙ্গেলস দুজনে মিলে লিখেছিলেন বহু আলোচিত The Communist Manifesto। মনে হয় মার্ক্স-এর চিন্তা ভাবনায় এঙ্গেলস-র প্রভাব আছে অনেক। অথচ লেখকের মার্ক্স বিষয়ক প্রবন্ধে এঙ্গেলস নিয়ে কোন আলোচনা নেই, এক দুবার সামান্য উল্লেখ ছাড়া। কোন বিশেষ কারণ আছে কি?
পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা আছে। কিছুকাল আগে আমাকে প্রায় বাধ্য হয়েই দীর্ঘ দুবছর কলকাতায় থাকতে হয়েছিলো। দেখেছি, যদিও সংখ্যায় অনেক কম, আজও কিছু তরুণ ছাত্রছাত্রী, যুবক যুবতী এবং অল্প কিছু বুদ্ধিজীবি বিচ্ছিন্ন বা সংঘবদ্ধভাবে মার্ক্সবাদ চর্চা করে। ইউনিভার্সিটি মহলে ছাত্রদের কোলাহল চোখে পড়ে। দেশ থেকে ফিরে আসার পর একটা প্রশ্ন প্রায়ই অবচেতন মনে ঘুরে বেড়ায়। এই সংকলনটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম সে প্রশ্নের উত্তরটা পাব কিন্তু স্পষ্ট ভাবে পাইনি। গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে কম্যুনিস্ট পার্টি, তা সে যে ফর্মেই হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। নিঃসন্দেহে পার্টি নেতারা এর চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত।
আমার প্রশ্ন ছিল: কেরলে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টি এখনো টিঁকে থাকলো অথচ পশ্চিমবঙ্গ থেকে উধাও হয়ে গেলো; কেন ?
আপনি যথার্থই বলেছেন, পাশ্চাত্যের class আর ভারতবর্ষের শ্রেণী সমার্থক নয়। শ্রেণীর কোন প্রতিশব্দ বাংলাতে নেই। পঞ্চাশ দশকেরো বেশী পশ্চিমে বাস করার পর এ দেশের class structure আরো স্বচ্ছ হয়েছে আমার কাছে। পশ্চিমে এক class-এ জন্ম নিয়ে এক জীবনেই অন্য class-এ উত্তীর্ণ হতে পারা যায়- আমাদের দেশে যা অসম্ভব। ভারতবর্ষে শ্রেণীভেদের অজস্র শাখা প্রশাখায় জন্ম সূত্রে মানুষকে আস্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। কোন কর্ম সাধনা দিয়েই সে শ্রেণী উত্তরণ করতে পারে না। জীবন থেকে জন্মের লেবেলটা ছিঁড়ে ফেলা কঠিন। দলিত চিরদিন দলিতই থাকে। মন্ত্রী বা স্পীকার বা রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরেও তথাকথিত কুলীন সমাজ তাকে সম মর্যাদায় গ্রহণ করতে নারাজ। পাশ্চাত্যের কোন মানুষই ভারতবর্ষের জাতপাত শ্রেণীভেদ বুঝতে পারবে না। মার্ক্স সাহেবের পক্ষেও তাই সেটা সম্ভব হয়নি। পুরুষানুক্রমে এ সমাজের শরিক না হলে এদেশের শ্রেণীভেদের মর্মান্তিক সত্যের পরিচয় পাবে না সে। দলিতের যন্ত্রণা অপরিসীম— একমাত্র সে-ই বুঝতে পারে তার ব্যথা।
কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।।
… …
পরিশেষে রবীন্দ্রনাথ। অপার অসীম রবীন্দ্রনাথ। লেখকের দৃষ্টি দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে আবার দেখছি, এবার মূলত রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তা ও তাঁর ধর্ম প্রসঙ্গে।
রবীন্দ্রনাথের বৈষ্ণব প্রেম সর্বজনবিদিত। বৈষ্ণব ভাবধারার প্রতি আকর্ষণের আগেই তিনি বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছিলেন। জয়দেব বিদ্যাপতির স্বর্ণযুগ শেষে বৈষ্ণব সাহিত্য ক্রমশই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে ও অষ্টাদশ শতকে প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যায়। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে সদ্য সাবালক বাংলা সাহিত্যের হাত ধরে বৈষ্ণব সাহিত্য আবার নড়ে চড়ে ওঠে। সেই সময় প্রথম কৈশোরে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয় বৈষ্ণব কাব্যের সঙ্গে এবং অচিরেই এর ভাষা ও সৌন্দর্য কিশোর মনকে এক কল্পরাজ্যে নিয়ে যায়। বৈষ্ণব পদাবলীতে ব্যবহৃত ব্রজবুলির শব্দমাধুর্য, ছন্দঝংকার ও গীতিময়তা কিশোর রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করে ও বৈষ্ণব ভাবধারায় আকৃষ্ট করে। ভানুসিংহের পদাবলী তারই ফসল। বৈষ্ণব দর্শন ও ধর্মে রবীন্দ্রনাথের পরিচয়সূত্র ধরে পরের বক্তব্যে আসছি।
লেখক বলছেন- রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তা একটা বিশাল বিষয়, এখানে অপ্রাসঙ্গিক, সংক্ষেপেই বক্তব্য। (পৃঃ ৩৯০)। আমি মানছি, এ একটা বিশাল বিষয়। এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। তবুও আলোচনা আছে বেশ কয়েক পাতা জুড়ে- গভীর, তথ্যপূর্ণ, ও ধারালো বিশ্লেষণসহ। এ আলোচনায় আমি দু’একটি মন্তব্য যোগ করতে চাই। রবীন্দ্রনাথের ধর্ম কী? উপনিষদ তাঁর সাথী, বৈষ্ণব ভাবধারায় আকৃষ্ট, ব্রাহ্ম সমাজে উপাসনা করতেন, স্বভাবে মিস্টিসিজম-এর রূপ। অধ্যাপক সুশোভন সরকারের ভাষায়- ধর্মসজ্ঞীত ও ধর্ম সংক্রান্ত সব রচনায় তিনি বারবার যে-মূল সুর ধ্বনিত করেছেন, আমি মনে করি যে অরগানাইজড, এমন কি সাধারণ পারসোনাল রিলিজিওন থেকে তা স্বতন্ত্র।… আমার মনে হয় নিকটতম কোন ধর্মে যদি তাঁকে যুক্ত করা যায় তা সে হিউম্যানিজম। তাঁর সত্য পরিচয় তিনি একজন হিউম্যানিস্ট। তাঁর ধর্ম মানুষের ধর্ম। শেষ বয়সে তাঁর এই উপলব্ধি আরো দৃঢ় হয়েছে, যা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর ১৯৩০ সনে দেওয়া Religion of Man বক্তৃতায়।
রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর কে? লেখক বলছেন- ঈশ্বরের একেক অবতার একেক কবির কল্পনা থেকে সৃষ্টি হয়ে ওঠে। … রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও ঈশ্বরের এক সবিকল্পক অবতার দেখতে পাই। কবিতা পড়লেই সবসময়েই তাকে পরিস্কার দেখা যায়। যদিও তার কোনো নাম কবি দেননি।-(পৃঃ ৩৯১)। আমার মনে হয় কবি তার একটা নাম দিয়েছেন। কবিতা গানে যে নাম বারবার ফিরে আসে সেটা – জীবনদেবতা। এই জীবনদেবতাই রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর।
… লেখকের রবীন্দ্র বিষয়ক আলোচনা আমাকে স্পর্শ করেছে। অনেক নতুন ভাবনার সূত্রপাত হলো। কিন্তু যত রবীন্দ্রনাথ পড়ি ততই উপলব্ধি করি কোথাও যেন একটা আবরণ আছে সেটা কিছুতেই ভেদ করতে পারি না। রবীন্দ্রনাথকে বোঝা এবং বোঝানো দুরূহ। রবীন্দ্রনাথ চিরদিনই নিজেকে কুয়াশার আবছায়া আড়ালে ঢেকে রেখেছেন, নানা ভাবে, নানা ছলে। আমরা কখনই তাঁকে সম্পূর্ণ দেখতে পাই না, বুঝতে পারি না। আমরা তাঁর মনের নাগাল পাই না।
আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কি, / হায় বুঝি তার খবর পেলে না।
পারিজাতের মধুর গন্ধ পাও কি, / হায় বুঝি তার নাগাল মেলে না।।
… …
বিষয়সূচি অনুসরণ করলে দেখা যাবে এই বইয়ের সিংহভাগ জুড়ে আছে গণতন্ত্র বিষয়ক আলোচনা, বিশেষ করে, ভারতবর্ষের গণতন্ত্র, প্রায় পাঁচ অধ্যায় নিয়ে। ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের ইতিহাস, মার্ক্স-র পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবর্ষের তথা পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্র– ঐতিহাসিক ও আধুনিক– এসবের বিশদ বিবরণ বোধহয় পাঁচ অধ্যায়ে সম্ভব নয়। যে পরিসর আছে সেখানে মোটামুটি পৃথিবীর সর্বকালের চিন্তক ও ঐতিহাসিকদের থিয়োরি ও যুক্তি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ আলোচনায় যাঁরা এসেছেন তাঁরা প্রায় সকলেই বিগত দিনের- আধুনিক চিন্তকরা প্রায় অনুপস্থিত। অনুমান করি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও গবেষক মহলে অনেক নতুন থিওরির জন্ম হয়েছে, বিশেষ করে লিবারাল গণতন্ত্র নিয়ে। গত একশত বছর ধরে গণতন্ত্রের বিবর্তন লক্ষণীয়। অধুনা প্রয়াত এবং জীবিত চিন্তাবিদরা (Francis Fukuyama-র নাম করা যেতে পারা যায় কি?) আজকের দিনের গণতন্ত্র ও তার ভবিষ্যত নিয়ে কী ভাবছেন বা বলছেন তার কিছু আভাস দিলে আমার মনে হয় এ-লেখা আরো পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ হতো।
বৌদ্ধিক ও নান্দনিক দিক থেকে এ রচনাগুলি আজকের সমাজে বিশেষভাবে ভারতবর্ষে খুবই প্রাসঙ্গিক। লেখকের অনুসন্ধিৎসু ও বিশ্লেষক মন অজস্র বিষয়ে দিগন্ত বিস্তারী চিন্তাভাবনার প্রতিফলন। আপনার লেখা বহুমুখী হীরক টুকরো থেকে বিচ্ছুরিত আলোর মত, শুধু উজ্জ্বল নয়, দ্যুতিময়ও বটে।
ভবিষ্যতে আরো মণিমুক্তোর প্রত্যাশায় রইলাম। আশা করি হতাশ হব না।
শুভেচ্ছা রইল।
অমলেন্দুদা”
সুদীপ্ত এখনো নতুন কিছু লিখলে আমাকে পাঠায়। আমি গর্বিত বোধ করি। আমি কৃতজ্ঞ।