মাজারটা করি আর বাজারটা করি। বলছিলেন এক প্রায় প্রৌঢ় মানুষ। ঘুটিয়ারি শরিফের দরগাহে। অন্যরা ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে কাজ করছিলেন, আমি বসে বসে দেখছিলাম, চারপাশ। দেখি একজন বলছেন, নিজে বড় হয়েছি টাকার বস্তা ধরে ছেলে বড় হয়েছে টাকার বস্তা ধরে।
আমার আর কি চাই, মাজার আর বাজার করে জীবন কাটিয়ে দেবো।
মেটিয়াবুরুজের দানশীল শিক্ষানুরাগী আলমগীর ফকির, শাজাহান ভাই ও এস নেওয়াজ ভাইদের আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম ঘুটিয়ারি শরিফে এক শিক্ষাবিস্তারপ্রয়াসী মহিলার শিক্ষাবিস্তারের কাজ দেখতে। মঞ্জু লস্কর নাম। বনগাঁর মেয়ে। বিয়ে হয় ঘুটিয়ারি শরিফে। মাধ্যমিক পাশ করার খুব ইচ্ছা ছিল। শ্বশুরমশাই সাথ দেন। তিন মাসের ছেলে নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন। এরপর বিএ, এম এ দুই পাশ করেছেন। মাধ্যমিক পাশ করার পর থেকেই টিউশন করতেন। সংসারের জন্য এবং নিজের ভালোবাসা থেকে। তারপর তাঁর ইচ্ছে হয়, স্কুল গড়ার। দশ বছরে তাঁর এখন চারতলা স্কুল। সাড়ে পাঁচশো ছাত্রছাত্রী। কেজি টু পিজি মঞ্জুর স্বপ্ন। স্বামী গোরুর মাংস ব্যবসায়ী। তিনি তেমন পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি। কিন্তু স্ত্রীর ইচ্ছা পূরণে অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন। নিজেরা থাকেন দোতলায়। একতলা, তিনতলা ও চারতলা স্কুল। চারতলায় আছে মেয়েদের হোস্টেলও চল্লিশজন আপাতত থাকেন।
মাসে মাত্র হাজার টাকায় থাকা খাওয়া। স্বামী বছরে ছয় সাত লাখ টাকা ভর্তুকি দেন। ছেলে আইন পড়ে প্রশাসনিক চাকরি করার লক্ষ্যে পড়ছে। বড়ছেলে দত্তক নেওয়া। মায়ের খুব ভক্ত।
ভারতের বহু তীর্থস্থান আমি ঘুরেছি। তারাপীঠ থেকে শুরু করে ভারতের প্রায় সব বড় হিন্দু তীর্থভূমি। শুধু রামেশ্বর, কেদারনাথ ও সোমনাথ মন্দির যাওয়ার সুযোগ হয়নি। মুসলিম তীর্থভূমি আমি কোথাও যাইনি। একবার এক পীরতলায় গিয়েছিলাম। পশ্চিমপাড়ায়। তাতে বাড়িতে বকুনি শুনতে হয়। ঘুটিয়ারি শরিফ সম্পর্কে শুনেছিলাম নানাকথা। সব তীর্থভূমি ও তীর্থস্থান ঘিরে নানা কথা থাকে। পীরস্থান ঘিরে সবচেয়ে বেশি যে কথা চালু, হিন্দু মুসলমান সব সম্প্রদায়ের মানুষ আসেন। আমাদের এলাকার পশ্চিমপাড়ার পীরস্থানে মল্লিক পাড়ার কিছু মুসলিম যেতেন। আর বেশিরভাগ যেতেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। বিশেষ করে বাগদি বা বর্গ ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের মানুষ। একদিন গিয়ে সারাদিন সেখানে থেকে খাওয়া দাওয়া সব করতেন। কয়েক বছর আগে সমস্যা হয়। একপক্ষের অভিযোগ অনিয়ম করছে। নিষিদ্ধ পানীয় খাচ্ছে। আরেকপক্ষ অস্বীকার করে গাজোয়ারির অভিযোগ করেন।
ঘুটিয়ারি শরিফে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের মতোই দলে দলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ যান। পীরের মাজারের কাছে ১৩ বিঘার বেশি জমি দান করেছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। এবং পীরবাবার নিয়ম অনুযায়ী মাজারের দিকের এলাকায় গোরু জবাই নিষিদ্ধ। লাখ লাখ মানুষ আসেন এখানে
কাঁকুড়গাছি মানিকতলা এলাকায় একসময় বহু মুসলিম বাস করতেন। তাঁদের এক বড় অংশ ১৯৪৬, ১৯৬৪-র দাঙ্গার জন্য পূর্ব বঙ্গে চলে যেতে বাধ্য হন। ওখানে শীতকালে পীরের উরস হয়। উরসে লাখ লাখ মানুষের জমায়েত। এখানেও পীরের উরসে মাছ মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। শুধু ডিম চলতে পারে। সবাই খেতে পারেন। দৈনিক হাজার হাজার মানুষের জন্য রান্না হয় দিনরাত। খিচুড়ি/ তেহারি ইত্যাদি।
অনেকটা এলাকা বেদখল হলেও এখনও যথেষ্ট জায়গা আছে। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ভিড়।
কথা হচ্ছিল বৃষ্টি জল রেডিও টিভি নিয়ে সেখানে ফেরা দরকার। ফিরবো। তার মাঝে একটা খবর দিই, আজকাল কাগজে কাজ করার সময় দেখতাম, নিয়মিত, মেদিনীপুর ও ফুরফুরার পীরের উরস নিয়ে খবর লিখতেন এক ব্রাহ্মণ সন্তান। আমি একটু অবাকই হতাম। পীর মানেন শহরের মানুষ! মাজার নিয়ে খুব ভক্তি ছিল না। এখন বুঝতে পারি, পীর, মাজার, দরগাহ, দাতাবাবা, পাথর চাপড়ি ইত্যাদি জায়গা মানুষের মিলন স্থান। এখন তো এক জায়গায় দেখি, মাজার ধ্বংসে মেতে উঠেছেন একদল লোক। এখানেও দেখি মসজিদ মন্দির গুঁড়িয়ে দিচ্ছে বুলডোজার দিয়ে, রাম মন্দির নিয়ে রাজনীতি ব্যবসা করা একদল ক্ষমতালোভী। বলা দরকার আরেকটি কথাও, ওলাইচণ্ডী পুজো উপলক্ষে মেলায় আমাদের গ্রামে শুধু নয় বাঁকুড়া বর্ধমানের গ্রামের পর গ্রামে মেলা যাত্রায় অংশ নিতেন হিন্দুর চেয়ে বেশি মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ।
দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনা জুড়ে বনবিবি, দক্ষিণ গাজি, বামুনপীরের মেলা বসে। সেখানে সব ধর্ম সব জাতের মানুষ মেলেন। হাওড়ায় লেখক অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর বাড়ির কাছে ওলাবিবিতলা। তাঁর ছেলে সুদীপ বসুর মুখে একাধিকবার শুনেছি ওই জায়গার কথা। ওই এলাকায় গিয়েছিও। উরস, পূজা উঠলে তো খাবার কথা উঠবেই। ভোগ, প্রসাদ, ক্ষীর, পায়েসের প্রসঙ্গ।
একবার মেদিনীপুরের উরসের বিরিয়ানি খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। মাটির হাঁড়ির রান্না অপূর্ব। পুরীতেও মাটির হাঁড়িতে ভোগ রান্না হয়। রান্নার কায়দা অভিনব। হাঁড়ির ওপর হাঁড়ি চাপিয়ে। খাওয়ার কথা উঠলে আমাকে থামানো দায়।
তেঘরিয়া লোকনাথ মন্দিরের মতো পায়েস কোথাও খাইনি। যেমন খিচুড়ি ভোগ সবচেয়ে ভালো খেয়েছি, ভেলোরে চিকিৎসা করাতে গিয়ে নারায়ণ মন্দিরে। আরেকবার খেয়েছিলাম, কলকাতায় রথযাত্রা উৎসবে। বাসে করে যাচ্ছি। একজায়গায় দেখি অল্প ভিড়। লাইন। কেন? কন্ডাক্টরসাহেবকে জিজ্ঞাসা করার আগেই নাকে এল আশ্চর্য খিচুড়ি ভোগের গন্ধ। নেমে পড়লাম। এত্ত ভালো এত্ত ভালো। আমি রাঁধুনির খোঁজ করলাম। দুর্গা পূজা কমিটির একজন কর্মকর্তা হিসেবে আমি ভালো রাঁধুনির খোঁজ নিতাম। সেই কারণে। গিয়ে জানলাম, পুরী থেকে এসেছেন। অজয় মহারাজ। প্রশংসা করার ফল হল এই এক হাঁড়ি ভর্তি খিচুড়ি লাবড়া আলুর দম চাটনি। সেটা আনতে গিয়ে বাসযাত্রী আমাকে বাহন ভাড়া করতে হয়।
খিচুড়ি অবশ্য আরও দুতিন জায়গায় ভালো খেয়েছি। সৌমেনের মা, এক মাস্টার মশাইয়ের স্ত্রী, আমাদের এক বন্ধু; আরও একটা অবশ্য যোগ করা দরকার-- খিচুড়ি আমার সবসময় সব ঋতুতেই প্রিয়।
তবে ভাতের চেয়ে বেশি কি?
আমি ভাত এবং মুড়ি প্রিয়। রাস্তার ধারের কুমড়ো পুঁইশাক রান্নার গন্ধ আমাকে টেনে বসিয়ে দেয় খেতে।
আজ শনিবার শিয়ালদহ এলাকায় আছি। খবর পেলাম, চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষের স্ত্রী নীলাঞ্জনা, খুকুদি, প্রয়াত হয়েছেন। খুকুদি এক অসাধারণ মানুষ ছিলেন। গৌতম ঘোষের ঘরে বসে মমতাশঙ্কর, ঋতুপর্ণা, চৈতী ঘোষাল স্মৃতিচারণ করছিলেন। শুনছিলাম মনোযোগ দিয়ে।
তার আগে কীভাবে যাবো?
গোল পার্কে থাকেন। ওখানেই থাকতেন আয়ান রশিদ খান। তাঁর উর্দু ও বাংলা কবিতায় ব্যাপক দখল ছিল। তাঁর এক অসামান্য বই পড়ে দেখা করতে চলে গিয়েছিলাম। পরে সাংবাদিক জীবনে প্রাক্তন মন্ত্রী শ্রীকুমার মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে আলাপ পরিচয় বাড়ে।
শিয়ালদহ থেকে যাবো কীভাবে? আমি উবের টুবের বাধ্য না হলে চড়ি না। আমি সবসময় বাপুজি কেকের দাম দিয়ে সবকিছু গুণ করি। কেউ কেউ যেমন সবকিছু হিন্দু মুসলমান পাকিস্তান বাংলাদেশ দিয়ে গুণ করেন।
শিয়ালদহ স্টেশন আজকাল খুব ঝকঝকে। খিদে পেয়েছিল। বাপুজি কেক কোথাও পেলাম না। ঢাকুরিয়া স্টেশনে নেমে এগোচ্ছি আমরি/ মণিপাল (আগের নিরাময়। এক টাকায় কেনে টোডি কোম্পানি। কতয় বেচল কেউ জানেন!)।
দেহ হস্তান্তরে দেরি আছে। খিদে চাগাড় দিয়ে উঠল। পথে লাভ হয়েছে, সাংবাদিক দীপক ব্যাপারী গাড়িতে একটু এগিয়ে দিয়েছেন। মালদহের সোনা শেখের সঙ্গেও দেখা হল স্টেশনে। যাক, খাওয়ার কথায় ফেরা যাক। ভাতের হোটেল পাই কোথায়? সকালে একবার খেয়েছি। আরও একবার খেলে মন্দ কী! আমার তো ভাত ছাড়া সহ্য হয় না। খোঁজ করে গেলাম। পড়ন্ত বেলা। গরম ভাত নামছে। আমি তো বেশি গরম খেতে পারি না।
লুচি, রসগোল্লা আর খাসির মাংস ছাড়া সবকিছু হাল্কা ঠান্ডা হলেই ভালো। বললাম, ঠান্ডা ভাত হবে না। হবে।
অল্প খাই। ভাত তুলে নিতে বললাম কিছুটা।
আর কী ভাগ্য! পেলাম পুইঁ শাকের তরকারি। তবে কুমড়ো নেই। দিদিই ব্যাখ্যা দিলেন। ৭০ টাকা কেজি। কী করে কিনি? আমি সুযোগ পেয়ে বললাম, বেশি করে মোদিকে ভোট দিন।
একজন রাগতভাবে তাকালেন। বলতেই হল, বেশিদিন থাকলে ১০০ টাকা কেজি চাল হবে। বেগুন ৩০০। দুশো টাকা তো দেখেই ফেলেছি।
দোকানদার দিদি নাতির বায়না সালাচ্ছিলেন। নাতি কাল চম্পাহাটিতে ফিরতে চায়। নাটকের পার্ট করবে কালীপূজায়।
সে করতে করতেই উত্তর দিলেন, ১০ বছর আগেই আট টাকায় সব্জি ভাত, ১০ টাকায় ডিম ভাত, ২০ টাকায় মাছ ভাত বেচেছি। পেট চুক্তি। যত খুশি ভাত ডাল নাও।
আর এখন কুমড়ো পুঁইশাক রান্না করতেই পারছি না।
তো, আজকের দাম দিয়ে দিই।
সব্জি ভাত ৩০ টাকা। ডিম ভাত ৪৫ টাকা। মাছ ভাত ৬০ টাকা।
ভাতের দাম আলাদা।
কালীপূজা পরশু। দেদার বাজি নিয়ে লিখে সমস্যায় পড়তে চাই না। তবে মনে করিয়ে দিই, আদা .. কোম্পানি বেনামে বর্ধমানে মিল ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে। কালীপূজার ভোগে খিচুড়ি লাবড়া চাটনি নানা ধরনের ভাজির সঙ্গে পায়েস খুব দুর্লভ হতে চলেছে।
বর্ধমান জেলার বিখ্যাত খাসকানি তথা গোবিন্দভোগ চালের দাম ১৭৬ থেকে ২৫৬ টাকা।
কেজিতে ৯০ থেকে ১৪০ টাকা বেড়েছে। গত কয়েকমাসে ।
চাষি অবশ্য যথারীতি কম দামে বেচেছেন।
ধানের অভাবী বিক্রি কবে যে বন্ধ হবে?
এবং জলের অভাবে চাষে দেরি এবং আকাশ ও বাঁধের জলে ধান সব্জি ডোবা।
আজই পড়লাম, ডিভিসি বাঁধ মাইথনে তৈরির পর থেকে আজ পর্যন্ত ড্রেজিং বা খনন হয়নি।
দাবিই তো তেমনভাবে ওঠেনি।
বাঁধ ভেঙে দেওয়ার দাবি ওঠার অনেকেই নানা কথা বলছেন। বলুন। বাঁধ কেন নানা দেশ ভেঙে দিচ্ছে সে-কথাও একটু হোক।
বাঁধ বা জলাধার কবে জল ছাড়বে সেইজন্য কৃষক পরিবারে রেডিওর খবরে কান পাতা ছিল অতি আবশ্যক।