'আজ তোমার পরীক্ষা ভগবান ভগবান' বলে একটা গান খুব বাজতো তখন রেকর্ডে। টেপ রেকর্ডার এলেও তখন সিডি পেন ড্রাইভের কেউ নাম শোনে নি। কল্পনার বাইরে সে-সব।
চলতো মাইক। রেকর্ড বাজিয়ে। তিন রকম রেকর্ড। ছোট মাঝারি বড়।
কত কত নাম।
রেকর্ডের ওপর চমৎকার হরফে এবং আঁকায় কভার থাকতো।
ছোটগুলো পাতলা কাগজে।
বড়গুলো হার্ড কভার। ' মা মাটি মানুষ', নটী বিনোদিনী' এবং বিশেষ করে ' ময়লা আঁচল' ও 'সিরাজউদ্দৌলা' পালার রেকর্ডের ওপর আঁকা ও লেখা ভোলার নয়। আজও জানতে ইচ্ছা করে শিল্পীদের নাম। গতকাল সল্ট লেক ইজেডসিসি তে ভারত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন করতে এসেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষ।
তাঁর 'মা ভূমি', 'দখল' ছবির নামলিপি এখনও চোখের সামনে ভাসে।
'দখল' ছবির নাম লিপিকারের নাম জিজ্ঞেস করলাম।
বললেন সুবর্ণরেখা প্রকাশনার ইন্দ্রনাথ মজুমদারের ভাই বিমল মজুমদার।
আমি তখন ভাতের থালায় খাওয়া শেষে আঁকিবুকি কেটে পোস্টার লেখার নকল করি।
দাদি বকেন। মাও।
এতে নাকি ধার হয়।
আর দাদি খাওয়ার সময় অন্যমনস্কভাবে ভাত ছড়ালে বলতেন, ভাত ফেলো না ভাই। মা শাহাদান রাগ করবেন।
দাদি অনেকদিন দাদোর সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের কানপুরে থাকায় প্রচুর উর্দু শব্দ বলতেন। দাদো ইংরেজ সরকারের আমিন বিভাগে কাজ করতেন। নাটক ও যাত্রার নেশায় কলকাতায় ফেরেন। সে গল্পে প্রেম আছে। ঘোর প্রেম।
মা গাঁয়ের মেয়ে। মায়ের বাড়ির গায়েই বেনেদের ঘর।
আমার নানির সই বেনে বাড়ির নতুন বউ অন্নপূর্ণা দত্ত।
অন্নপূর্ণা দত্তের শাশুড়ি বলেছে, সালমা তুই একটু্ দেখে শুনে রাখিস।
নানার সঙ্গে দত্ত দাদু কলকাতায় থাকতেন ও কাজ করতেন।
মায়ের মধ্যে হিন্দুয়ানি ছিল ভালোই।
শুধু মা নয় আমাদের গ্রামে হিন্দু মুসলমানে দু একটা রান্না, বিবাহ রীতি ছাড়া পোশাক পরিধান খাবার দাবার কথা বার্তায় কোন তফাৎ ছিল না।
মা বলতেন, ভাত ফেলো না। মা লক্ষ্মী রাগ করেন।
টাকা জমানোর মাটির ভাঁড়ের সব বাড়িতেই নাম ছিল লক্ষ্মীর ভাণ্ডার।
সম্পন্ন হিন্দু বাড়িতে লক্ষ্মী থাকতেন মাটির কুলুঙ্গিতে।
আলাদা করে ঠাকুরঘর কোনও বাড়িতেই দেখিনি।
সেখানে বৃহস্পতিবার ফুল জল দিতেন।
ধূপ জ্বালানোয় সবাই সাবধান থাকতেন। কারণ বড় আগুন লাগে অসতর্ক হলে।
তবে দু কিলোমিটার দূরের পীরের দরগাহতে ধূপ এবং মাটির ঘোড়া দিতেন হিন্দু মুসলমান সবাই।
৭০ ভাগ হিন্দু আর বড়জোর ৩০ ভাগ মুসলমান ছিল পীরের দরগাহে মানত করার লোক।
রাস্তায় কাগজ কুড়িয়ে পেলে হিন্দু মুসলমান সব ছেলেই কুড়িয়ে মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করত।
আরবি হলে তো কথাই নেই, বাকি পাতাও জলে ভাসিয়ে দেওয়ার রীতি ছিল।
এতে নাকি মা সরস্বতী খুশি হন।
সরস্বতীর মা শাহাদানের মতো কোনও নাম শুনিনি।
ওখানে ছিল, খোদা বা আল্লাহ নেকি দেন।
বিদ্যার জিনিসকে সম্মান করলে।
আমার ছিল কাগজের ঠোঙা, টুকরো কুড়িয়ে পড়ার অভ্যাস।
এইরকম পড়তে পড়তে একদিন পেয়ে গেলাম, আলেকজান্ডারের মায়ের নাম।
পণ্ডিতি দেখাতে স্কুলের স্যারদের জিজ্ঞাসা করলাম।
দেখলাম কেউ জানেন না।
আমি বললাম, পড়া বিদ্যে থেকে ওলিম্পিয়া।
আমার বেশ নাম ছড়িয়ে দিল এই টুকরো কাগজ।