রাণাঘাটের পাশে কুটীরপাড়া।
সেখানে অসাধারণ এক নার্সারি আছে। আছে নাটকের মঞ্চ। গাছবাড়ি। কড়কনাথ মুরগি, তুর্কি মুরগি, দেশি মোরগ চাষের আয়োজন। জৈব পদ্ধতিতে হচ্ছে সব্জি চাষ। ড্রাগন ফলের চাষ শিখে নিরন্তর শিখিয়ে চলেছেন মানুষকে। দিব্যেন্দু বিশ্বাস। বামপন্থী। গাছ ও সংস্কৃতি পাগল মানুষ। বছরে পকেট থেকে তিন চার লাখ টাকা খরচ করে করেন ছয়দিনের নাট্যোৎসব।
বন্ধু বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে আলাপ হলো।।
আজ রাণাঘাট আসতে হয়েছিল বিবেকানন্দ নিয়ে বলতে। দিব্যেন্দুদা হাজির। বলা শেষে তাঁর নার্শারিতে নিয়ে গিয়ে অসাধারণ ভুরিভোজ।
বাগানের সব্জি দিয়ে লাবড়া, আলু ভাজা, বেগুনি, খাসির মাংস, ডাল, বেগুন ভাজা, বাগানের টমেটোর চাটনি, পায়েস, পাঁপড়, হরেকরকম মিষ্টি ( একটার বেশি ভয়ে) খাইনি। শেষে জয়নগরের খাঁটি মোয়া জোর করে খাওয়ালেন বৌদি।
পরে জিজ্ঞেস করলেন, কাল কি কাজ?
বুঝিনি। বললাম।
বললেন, থেকে যান। জমিয়ে আড্ডা হবে।
রাতে ১০ ডিগ্রি ঠান্ডায় বোগেনভিলিয়া, ডালিয়া, অর্কিড, হাস্নুহেনা, গোলাপ সহ শতেক গাছের মাঝে থাকার আমন্ত্রণ।
কত কষ্টে যে দিব্যেন্দুদা এবং অবশ্যই নিজেকে সামলেছি!
তবে এর মাঝেই গেলাম বাদল মণ্ডলের বাড়ি।
নির্লোভ সৎ বামপন্থী। দিব্যেন্দুদার মতোই আদর্শবাদী।
১৯ বিঘা জমিতে লিচুর চাষ করছেন ১৯৭৭ থেকে।
ড্রাগন ফলের চাষ শুরু করেছেন ২০২২ এর ৮ মে।
কে কবে কী চাষ করেছেন দিব্যেন্দুদার মুখস্থ।
ড্রাগন ফলের চাষ করতে চাননি বাদলদা।
জোর করে করিয়েছেন দিব্যেন্দুদা।
পুরানো বামপন্থী অভ্যাস।
নিজের শুধু নয়, অন্যদেরও ভালো হোক।
তাই, জোর করে ধরে ধরে বুঝিয়ে চাষ করাচ্ছেন ড্রাগন ফল। পতঞ্জলইর রামদেবের বাগান বিষয়ে উপদেষ্টা দিব্যেন্দুদা। দেড় কোটি টাকার ওপর ড্রাগন ফলের চারা বেচেছেন গত বছর।
লোককে দিয়ে চাষ করিয়ে নিজে কিনে অন্যত্র বিক্রি করেন।
দিব্যেন্দুদা ও বাদলদার বড় আক্ষেপ, কেন থাকলাম না। এই শীতে সারারাত আড্ডা হতো।
আড্ডায় বড় লোভ।
কিন্তু প্রচুর লেখা ও কাজ বাকি।
সামনে বইমেলা।
আসতেই হলো। ফিরতে ফিরতে বসে বসে লিখছি।
লিখতে লিখতে মনে পড়ল, আমার খেয়ালি বাবার কথা।
কত কত নতুন চাষ যে করেছেন।
তবে সে-সব সব্জির চাষ।
বাবার ফল ফুলের চাষে তেমন ঝোঁক ছিল না।
একবার রায়গঞ্জ গেলেন, নিয়ে এলেন বেগুন চারা। রায়গঞ্জের বেগুন তুলোর মত নরম আর হাল্কা। এক পিস বেগুনভাজা এক বড় তস্তুরি/ প্লেট ভর্তি হয়ে যেত।
উত্তরভারত ঘুরে এসে আখ চাষ যব চাষ। ঝাড়খণ্ড থেকে ভুট্টার চাষ শুরু করলেন। মুর্শিদাবাদ ঘুরে এসে পাটের ঝোঁক বাড়ল।
তারপর কোথা থেকে কে জানে বিট গাজরের চাষ শুরু হল খামারে। আর চাল বেয়ে উঠতে লাগল লাউ।ওই লাউয়ের ডাল শুকনো হতে একদিন সেই শুকিয়ে আমি আর ছোটভাই জইনুল বিড়ি বানিয়ে খেয়ে বেদম মার খেলুম।
তাতে অবশ্য আরেকটা লাভ হলো, মা বললেন, নিজে দু তাড়া বিড়ি খাচ্ছে, তার বেলা।
প্রথমে এক তাড়া ছাড়লেন। পরে বিড়ি খাওয়াই ত্যাগ।
আর ঘরের পিছনে ওল হতো হতো কোনো যত্ন ছাড়াই। তার পাশে হল, কচুর বাগান।
১৯৭২-এর পর বাবা গ্রাম ছাড়া হতে ওই কচু আমাদের সংসার চালাতে সাহায্য করেছে।
আমাদের সব জমির চাষ বন্ধ করে দেয় তৎকালীন শাসকদল।
ফলে কচু বিক্রিই হয় আর্থিক অবলম্বন।
কচু খেগে যা, তাই বলতে বাধে।
বাবা বেঁচে থাকলে দিব্যেন্দুদার সঙ্গে জমতো ভালো।
দিব্যেন্দুদাও বাবার মতো পার্টি পাগল, নাটক ও সংস্কৃতি পাগল মানুষ।
ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো স্বভাব।
লোককে ধরে ধরে নাটক দেখান, ভালো গান শোনান আর ফল ফুলের চাষ করতে বলেন।
বলেন, শুধু ধান চাষ করে বাঁচবে না।
চাষিদের ঘরে ঘরে গিয়ে বোঝান, আর্থিক স্বনির্ভরতার কথা।
আমাদের মানিকতলা খালপাড়ের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝেও এসেছিলেন এটা বোঝাতেই।
দিব্যেন্দুদাদের মাঝে কমিউনিস্ট স্বপ্নগুলো বেঁচে থাকবে।
নিজে ভালো থাকাই যথেষ্ট নয়, অন্যকেও ভালো রাখতে হবে।
বাগানের গায়ে সব ধর্মের কথা লিখে রেখেছেন।
সর্বধর্মসমন্বয়ে বিশ্বাসী। নিজে তো বামপন্থী মানুষ।
মানুষের কল্যাণই তাঁর ধর্ম।
বাদলদার বাড়ি গিয়ে দেখি আইনজীবী ছেলেও চাষের পোকা।
চাষ ভালোবাসেন। আজকাল তো একটু পড়ালেখা শিখলেই চাষকে ঘৃণা।
চাষা তো গালাগাল এদেশে।
গর্বের নয়।
সেদিন পড়লাম, এক অতি বিখ্যাত আইটি ব্যবসায়ী তাঁর সন্তানকে কৃষক বানাতে চান।
কর্পোরেটগুলোও সব চুক্তি চাষে ঢুকছে।
আর আমরা চাষকে ঘৃণা করে নিজেদের বেকার ভাবা শিখছি।
কায়িক শ্রম মানে হীনতার কাজ।
একটা ব্যাগ সরালে, ঝাঁট দিলেও আমাদের সম্মান চলে যায়, এত ঠুনকো আমাদের সম্মান চলে যায়।
অথচ আমরা বিবেকানন্দ জয়ন্তী পালন করছি ঘটা করে।
আজ আর দুটো ভালো ঘটনা ঘটল।
এক পাড়ার কুকুরদের জন্য কয়েকটি চটের বস্তা/ বড়ে জুটলো বাদলদার বাড়িতে। বাদলদার বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে দেখি চটের ওপর এক কুকুর শুয়ে। আমাকে দেখে বাদলদার আইনজীবী ছেলে সৈকত সরাতে গেলেন, আমি বললাম, আমি কুকুর সহ প্রাণীদের ভালোবাসি।
একটা বড় ভীমরুলের চাক হয়েছিল গত সাত মাস ধরে।ভাঙাতে প্রাণ মন সায় দেয় নি।
বাদলদা বাড়িতে ছিলেন না। ফিরে কুকুরের গায়ে চাদর দিলেন। আজ বেজায় শীত।
সে দেখে পাড়ার কুকুরদের কথা উঠতেই বস্তা মিলল।
আমি কথায় কথায় বললাম, আপনি ১০০ জন মানুষের উপকার করলে ৮০ জন বেইমানি করতে পারে, আড়ালে নিন্দা করতে পারে, কিন্তু ১০০ জন কুকুরের উপকার করলে একজনও বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।
আর ফেরার সময় দিব্যেন্দুদা ট্রেনের কামরা পর্যন্ত এলেন।
স্টেশনে দেখি এক পরম 'স্বর্গীয়' (স্বর্গ বলে কিছু কি আছে?) দৃশ্য।
এক অতি বৃদ্ধা শয্যাশায়ী মহিলাকে ওষুধ খাওয়াচ্ছেন আরেক বৃদ্ধা ভিখারিণী।
দিনটা আলোময় ছিল, রাতটাও।
শীত আর মনে নেই,সেখানে প্রজাপতি উষ্ণতা।