পথ তো পথ নয়।
পথ মানে ইতিহাস। ইতিহাসের দলিল। পথে চলে কত কিছু। শহরে গাড়ি ঘোড়া বাস ট্রাম ট্রেন বাইক সাইকেল.. ।
গ্রামে সেকালে চলত কিছু সাইকেল আর বাকি গোরু বা মোষের গাড়ি।
গ্রামে ১৯৮০ পর্যন্ত কারও মোটর সাইকেল ছিল না।
পরে কলকাতায় থাকা একজন কেনেন।
সেটা নিয়ে চাপতে গিয়ে তাঁর ভাই পড়লেন খেজুর কাঁটার ঝোপে। গ্রামে তো মাত্র গুটিকয়েক সাইকেল আর খান চল্লিশেক গোরুর গাড়ি।
মোটর সাইকেল, লরি কচ্চিৎ কদাচিৎ গাড়ি গ্রামে কোনও কারণে ঢোকা মানেই পিছনে পিছনে ছোটদের দৌড়। আমরাও খুব দৌড়েছি । বালি বা ইটের লরির ডালা ধরে উঠে কিলোমিটার খানেক দূরে গিয়ে নেমে হইহই করে ফিরেছি।
আমি শেষবার গোরুর গাড়ি চেপেছি নয়ের দশকের মাঝামাঝি।
নরওয়ের বাসিন্দা ও লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিকসের গবেষক আরিল এঙ্গেলসন রুড গবেষণার কাজে আমাদের গ্রামের বাড়িতে টানা ১১ মাস ছিলেন। মাইনাস ৪০ ডিগ্রি এলাকায় জন্ম আরিলের। থাকতে লাগলেন চল্লিশ প্লাস গরমের গ্রামে।
খালি গায়ে দরদর করে ঘামতেন। তখন লোডশেডিং হতো খুব। তালের হাতপাখা নিয়ে হাওয়া খেতেন বাঙালির মতো।
পরনে নীল চেক লুঙ্গি আর লালচে দুধে আলতা গা নিয়ে আরিলকে যা দেখাতো!
আরিল কিন্তু কোনওদিন গরম নিয়ে অভিযোগ করতেন না।
আরিল ঘুরতেন খালি গায়ে। গ্রামের ৯৯ শতাংশ পুরুষ মানুষ তখন তাই করতেন। খালি মসজিদের ইমাম, তিনি অন্য গ্রামের মানুষ, জামা পরতেন। আর যে পাঁচজন মানুষ শিক্ষকতা কাজে নিযুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে দুজন পাঞ্জাবি গায়ে ঘুরতেন বাকি তিনজন লুঙ্গি এবং খালি গা।
স্কুলে যাওয়ার সময় আলাদা কথা।
এদের মধ্যে দুজন ছিলেন ব্রাহ্মণ সন্তান।
আরিলও খালি গা।
কেন?
বাকিদের কাছে গোটা গ্রামটাই তাঁদের বাড়ি। আরিলের কাছেও।
পাশের গ্রামে বা সভা-সমাবেশে গেলে সবাই অবশ্য ধুতি পাঞ্জাবি পরে যেতেন। আরিল তখন প্যান্ট আর ইস্ত্রি না করা জামা।
আরিল প্রথম দিকে হেঁটে হেঁটেই ঘুরতেন। পরে সাইকেল বাহন হলো।
গ্রামের এবড়োখেবড়ো রাস্তায় সাইকেল চালানো আল্পস জয়ের সামিল।
আরিল তাতেও কয়েকবার ঠোক্কর খেয়ে সসম্মানে পাশ করে গেলেন।
আরিলের মুখে শুনেছিলাম, ঠান্ডার দেশ বলে ওদের মদ খেতেই হয়।
আমি শর্ত দিয়েছিলাম, গ্রামে থাকতে মদ খেতে পারবে না।
সমস্যা হবে।
তখন কী জানতাম আর ২০ বছর পর মদ গ্রামে জলভাত হয়ে যাবে!
আরিল আমার গ্রামে প্রথম আসেন ১৯৮৮ তে।
থাকতে এলেন ১৯৯২-এ।
ওঁর স্ত্রী ধনীঘরের মেয়ে এলিজাবেথ গ্রাম দেখার শখে এলেন ১৯৯৪-এ।
বাস রাস্তা থেকে তিন কিলোমিটার পথ।
কীভাবে আসবেন?
কেন, যেভাবে লিজ কোনোদিন আসে নি?
কীভাবে? পালকিতে?
নতুন বৌ মন্দ হয় না!
শেষপর্যন্ত সাব্যস্ত হল, না পৃথিবীর আদি যানগুলোর একটা গোরুর গাড়ি, গোরুর গাড়িতে আসবে। আর আরিল হেট হেট হেট করতে গোরুর গাড়ি চালাবেন!
বাঁশের তৈরি গোরুর গাড়িতে
ছই বা ছত্রি সাজিয়ে এলিজাবেথকে আনা হল আমাদের বাড়ি।
লোকে সাদা সাহেব দেখেছেন, সামনাসামনি মেম সাহেব দেখেননি।
ভিড় ভেঙে পড়ল রাস্তায়।
এলিজাবেথের খুব মজা।
আরিলেরও।
গোরুর গাড়ির গল্পের আগে হয়ে যাক, আমার শহরবাসের ইটপাথরের জীবনে প্রবেশ পর্ব।
আমি তো সাইকেলে চাল ডাল তেল আলু পেঁয়াজ হাঁড়িকুড়ি কড়াই নিয়ে বর্ধমান শহরে হাজির হলাম ১৯৮৩-র জানুয়ারিতে। পৌষ সংক্রান্তির পরদিন। পৌষ সংক্রান্তির দিন বাড়ি ছাড়তে নেই। তাই।
এসে উঠলাম শহরের গোলাহাট এলাকায়। দুপুরে খেয়ে দেয়ে বিকেলে বের হলাম সাইকেল নিয়ে।
তখন বরফ কল বলে একটা কল ছিল। সেই মোড় পেরোতেই উল্টো দিক থেকে একটা বাসের জোর আগমন।
অল্পের জন্য বেঁচে গেলাম।
এরপর এদিক সেদিক ঘুরে কার্জন গেট এলাকায়।
এতদিন হেঁটে হেঁটে ঘুরেছি। আজ নিজের সাইকেল। মজাই আলাদা।
যাঁরা অভিজ্ঞ, তাঁরা জানেন, বর্ধমান আর বহরমপুর সাইকেল ও রিকশার জন্য বিখ্যাত। রিকশা ও সাইকেলের যানজট লেগে যেত দাপ্তরিক সময়ে বর্ধমান শহরের রাণিগঞ্জ মোড়ে।
আমি কার্জন গেটে উঠেছি বিসি রোড পার হয়ে একটা রিকশা সাইকেলের হ্যান্ডেলে মারল ধাক্কা।
আমি কিছুই বলার আগে রিকশাচালক গাল দিলেন, শুয়োরের বাচ্চা।
বুঝলাম নতুন দেশে এসে পড়েছি।
আমাদের গ্রামে বা আশপাশের এলাকায় আমার বাবাকে কেউ গাল দেবেন ভাবাই যায় না।
আমিও যে শহুরে হয়েছি বোঝাতে রিকশাচালকের পাশে গিয়ে বললাম, শেষমেশ এই গালাগাল!
আর জানেন না বুঝি?
আমার বাবাকে আপনি কী করে চিনলেন?
শুয়োরের খাটালে থাকতেন বুঝি!