সত্তর দশকে গ্রামে ছুটকো ছাটকা চুরি প্রায় হতো। এর কাঁসার থালা চুরি, তার বাটি চুরি।
সোনার জিনিসপত্রও হারাত। পুকুরে স্নানের সময় নাকছাবি, দুল হারানোর ঘটনা হরবখত। তো, গুণিন ডাকা হতো। হাত গুনে, বাটি চালিয়ে হারানো বা চুরির মাল উদ্ধারের চেষ্টা হতো।
ব্যাপারটা পুরোটাই বুজরুকি। এবং কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। কিছু কিছু সময় চোর ভয় পেয়ে রেখে যেত রাতের আঁধারে। আবার পুকুরে তল্লাশি করার লোকও ভাড়া পাওয়া যেত। কানের দুল, নাকছাবি উদ্ধার করত।
গ্রামে দুয়েকজনের নাম যে-কোনো চুরিতেই জড়াত।
বেঁধে খুব পেটানো হতো।
তাতে কাজের কাজ হতো না, কিছু মর্ষকামী লোকের সুখ হতো। একদলের মেরে, আরেক দলের মার খাওয়া দেখে।
আমার খুব মায়া হতো, চোর পেটানো দেখে।
একবার একজনকে তেঁতুল গাছের ডালে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে মারা হচ্ছিল। সেটা আবার আমাদের বাড়ির ধান চুরির ঘটনায়।
চোর চেনা। আমাদের বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই আসত। ভালো ছবি আঁকত। তাঁকে যত মারছে, সে আর্তনাদ করে বলছে, আমাকে মেরে ফেললেও ওই বাড়িতে আমি চুরি করেছি, বলতে পারবুনি।
আমরাও জানতাম, সে চোর নয়।
যারা চুরি করিয়েছে, তারাই পেটাচ্ছে স্বীকারোক্তির জন্য। আসল চোরকে ঢাকতে নকল চোরের ধোলাই।
তারমানে সে চোর নয় তা নয়, কিন্তু বড় চুরি সে করত না।
আমাদের বাড়িতে তো নয়ই।
দুপুর বেলায় সবাই মেরে ধরে চলে যাওয়ার পর আমার মা আমাদের মুনিষকে পাঠালেন, ওকে ছাড়িয়ে এনে ভাত খাওয়াতে।
গায়ে লাল চাকা চাকা দাগ।
ভাত খেতে পারছে না, হাত দিয়ে।
সে দৃশ্য ভুলতে পারি না।
পরে বললাম, ওরা তো জানে তুমি আমাদের বাড়িতে চুরি করতে পারো না, তবু মারলো কেন?
--ভাই আমি তো হাঁস মুরগি ডিম এইসব নিই পেটের দায়ে। ওরা চায়, আমি ডাকাতের দলে যোগ দিই, ডাকাতি কি আমি করতে পারি বলো?
আশ্চর্যের বিষয়, ভদ্রলোক আমাকে তুমি বলতেন।
কবিতা লিখতেন গোপনে। কবিতা পড়তে ভালোবাসতেন। আমার কবিতা, সেগুলো কবিতা হতো কী না জানি না, খুব তারিফ করতেন।
এখন আর বেঁচে নেই।
কিন্তু তার নামের আগে চোর শব্দটা লোকে বলতো।
ডাকাতদের কিন্তু কেউ কিছু বলেনি।
ওই যে তেঁতুল গাছে বেঁধে পেটানোর ঘটনা বললাম, সে সময় বাবা গ্রামে ছিলেন না।
আমার বাবা তখন যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দেওয়ার প্রতিবাদ করতে ১০০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে কলকাতা অভিযানে গেছেন।
আমাদের গ্রামে ডাকাতি কম হয়েছে। আমার মামাদের বাড়িতে একবার হয়। কংগ্রেসের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের ফসল। বড় মামাকে ডাকাতির নামে মেরে ফেলাই ছিল লক্ষ্য। সবাই জানত, কারা ডাকাতি করিয়েছে, কাদের দিয়ে, কিন্তু কিছু প্রতিকার হয়নি। বড়মামা সেদিন 'নীলরক্ত' যাত্রা শুনতে তিন কিলোমিটার দূরের বুড়ুল গ্রামে গিয়েছিলেন।
এই ঘটনার পর মামার বাড়িতে দু নলা বন্দুক এল।
কোনা বলে গ্রামের কংগ্রেসের এক বড় নেতা ডাকাতদের আসল সর্দার। আমাদের গ্রামের কয়েকজন ছিল আলাদা ডাকাত দলে। যে বন্দুক দিত, ডাকাতির ৫০% টাকা তার।
পরে ডাকাতি আমাদের এলাকায় উঠে যায়। ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট সরকার আসার পরে।
তার আগে ডাকাতির খুব ভয় ছিল।
ডাকাতি ছেড়ে দেওয়া একজন মানুষ আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমিও তাকে খুব পছন্দ করতাম। অনেক ডাকাতির গল্প শুনেছি।
কিন্তু সব লিখতে পারব না।
ডাকাতের দলে থাকা লোকদের ছেলেমেয়েরা কষ্ট পাবে।
পাশের গ্রাম ক্ষ্যামতায় একজন ডাকাত ছিল। দুর্ধর্ষ। লাঠি খেলায় ওস্তাদ। তার লাঠি ঘোরানোয় নাকি বন্দুকের গুলি আটকে যেত।
পরে তাঁর লাঠি খেলা দেখেছি।
শুধু লাঠিই দেখা যেত, মানুষটাকে নয়। এমন বনবন করে ঘোরাতেন দু হাতে দুটো লাঠি,
প্রমথ চৌধুরীর গল্পের কথা মনে পড়ে যেত।
একবারের একটা কথা মনে পড়ছে। বড়দির নতুন বিয়ে হয়েছে। বড়দির বাড়ি থেকে ফেরা হচ্ছে। বারবার বাবা বলে দিয়েছেন, সন্ধ্যার আগে ফিরবে সবাই। আমরা তো ছোটো। কিন্তু ফেরা হয়নি। গোরুর গাড়িতে করে ফেরা নয় দশ কিলোমিটার রাস্তা।
সেহারাবাজার পেরিয়ে রেনিগেট বলে ডিভিসির একটা জায়গা ছিল। ওইটা নাকি ডাকাতদের আস্তানা। ওখানে সন্ধ্যার পর লোক হাঁটতো না।
ওখানে আসতে না আসতে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার।
গোরুর গাড়ির তলায় লন্ঠন জ্বলছে।
আমরা ভিতরে সিঁটিয়ে বসে আছি। কথা বলা, হাঁচি কাশি বারণ।
এক মুহুর্ত মনে হচ্ছে একেকটা ঘন্টা।
যাক শেষ পর্যন্ত পার হয়ে এলাম।
কোনো অঘটন ঘটেনি।