পর্ব ৪২
দইওয়ালা। আমাদের গ্রাম সেই পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায়। শামলী নদীর ধারে।
ডাকঘর।। রবীন্দ্রনাথ
ছোটবেলায় দূর বললেই বাঁকুড়া পুরুলিয়ার কথা মনে হত। 'ডাকঘর' নাটকে বড়দা অমল ও মেজদি সুধা করেছিল। আমি বেশি করে মনে রেখেছিলাম পাঁচমুড়া পাহাড়ের কথা। দার্জিলিংয়ের কথা শুনতাম। সাহস করিনি ভাবতে। কত খরচ। এক একজনের নাকি যাতায়াতে ৬০ টাকা লাগে। তারপর থাকা খাওয়া। তিন থেকে পাঁচ টাকা করে নাকি ভাতের প্লেট। ওরে বাবা। কত দামি জায়গা। কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি দেখতাম বইয়ে। আর একটা গান, আমরা সবাই মিলে/ টাইগার হিলে/ সূর্য দেখব (উদ্ধৃতি ভুলে আমার জুড়ি নাই, মাফ করে দেবেন); গাইতাম বেসুরে। যাব কলেজে পড়ার সময়, শিক্ষামূলক ভ্রমণে, এমনই সাধ ছিল মনে। তবে ছোটবেলায় দার্জিলিং বইয়ে পড়ার জিনিস বলেই মানতাম। চা কমলালেবু আর সিঙ্কোনার দেশ। কিন্তু বাঁকুড়া পুরুলিয়া আমি হরহামেশা যেতাম। মনে মনে। বাবা পৌষ মাসে ধান কাটার মুনিষ আনতে যেত। তখন তো মোবাইল নাই। গিয়ে বায়না করে আসতে হত। পরে চিঠি পাঠানো। ইচ্ছে হত যাই। ফেরার সময় বাবা আনতেন, কাঠের চিরুনি। কি চিকন কাজ! বাবার মাথা যন্ত্রণা হত। এক আদি-বাসিন্দা চিকিৎসক নাকের কাছে কাঠের সূচ ফুটিয়ে নাকি ভাল করে দিয়েছিলেন, সে শুনে আরো আগ্রহ। চে গুয়েভারার গল্প শুনেছি। আমাকেও হতে হবে বিপ্লবী ডাক্তার- মনে মনে ভাবতাম।
শালের জঙ্গলের ছবি একটা কল্পনা করে নিয়েছিলাম। সবুজ জলপাই পোশাক, পকেটে পিস্তল। আর আমার মৃতদেহ বহুকাল আমি দেখেছি, এই সেদিনও, জঙ্গলে, লড়াইয়ের ময়দানে।
কাজ করতে আসা মাঝি মেঝেনরা সন্ধ্যাবেলায় রান্না চড়াত। বিকেলে ফিরে এসে নিত সিধে। চাল ডাল নুন তেল হলুদ লঙ্কা।
পেঁয়াজ আদা মাঝে মধ্যে। মুরগির মাংস খাওয়ানো হত ধান ঝাড়ার শেষ দিন। তখন কোনো বিশ্রামের দিন ছিল না। রবিবার মানে ছুটি? সে তো ইস্কুলে, সরকারি অফিসে। খেটে খাওয়া মানুষের আবার ছুটি কি? গেরস্থের ছুটি নাই, গৃহিণীর নাই, মুনিষের নাই। তবে মাহিন্দারের বছরে ১২ টা ছুটি ছিল। মাসে একটা। এছাড়া বিয়ে শাদি আত্মীয় বাড়ি গেলেও ছুটি মিলত। মাহিন্দার মানে মাস মাইনের লোক। নামে মাস মাইনে। আসলে সোম বচ্ছরের লোক। খাটবে খুটবে। এবং সাধারণ ব্যতিক্রম বাদে দিলে মাহিন্দার বাড়ির লোক। বংশানুক্রমে চলত। আমাদের যিনি ছিলেন তাঁরও তাই।
তিনি ছিলেন আমাদের গার্জেন এবং বন্ধু। লুকিয়ে কত যাত্রা দেখতে যে পালিয়েছি তার সঙ্গে। সে গল্প আরেকদিন। করতেই হবে।
পশ্চিম থেকে আসা মুনিষদের মাছ ধরা হলে মাছ দেওয়ার রেওয়াজ। গোরুর মাংস কিনে খেতে দেখেছি আদি বাসিন্দাদের। পশ্চিমী মুনিষদের বাড়ির পিছনের দেওয়ালে ঘর করে দেওয়া হত বাঁশ আর খড় দিয়ে তৈরি হওয়া ঘরে ওরা ঘুমত।
আমি সারা সন্ধ্যা ওদের উনুনের ধারে বসে বসে ওদের কাজ দেখতাম। ইচ্ছে করত ওদের সঙ্গে খেতে। ওদের রান্নার আলাদা সোয়াদ। আলাদা গন্ধ। আমাদের মত নয়। মন চাইত খড়ের ঘরের ভেতরে ঘুমাতে। সে ইচ্ছে পূরণ হয় বড় বয়সে বৌ-মারার মাঠে মাঠ পাহারা দিতে গিয়ে। সেকালে ধান তোলার পর ক্লাবের ছেলেরা মাঠ পাহারা দিত। যাতে ধান চুরি না হয়। ধান পাহারার বিনিময়ে ধান পেত। বিঘে পিছু দশ গন্ডা আটি। সেই ধান ঝেড়ে জমানো হত। সেই টাকায় গ্রামের রাস্তা, খেলার মাঠ, সুবিধা বঞ্চিতদের মেয়েদের বিয়েতে অর্থসাহায্য- কত কি হত? কারো শরীর খারাপ হলে চিকিৎসায় সাহায্য করত ক্লাব। ক্লাব ধারও দিত, বিনা সুদে। ফুটবল খেলার মাঠের সংস্কার করত। ক্লাব মানেই অপচয় নয়। মদ নয়। বরং উল্টো ছিল। ক্লাব ছিল গ্রামের সবচেয়ে গর্বের জিনিস। ভাল ছেলেদের সম্পাদক করা হত। আমারও স্বপ্ন ছিল, ক্লাবের সম্পাদক হওয়ার, হয়েওছিলাম। বাবা দাদা একসঙ্গেই ক্লাব করতেন। ফুটবল খেলতেন। যাত্রা করতেন। আমরা সব ভাইয়েরা বাবার সঙ্গে যাত্রা করেছি। দিদি বোনেরা নাটক করেছে। কিন্তু যাত্রা নয়। যদিও বাবার খুব ইচ্ছে ছিল, আমাদের ঘরের সবাইকে নিয়ে একটা যাত্রা করার। মায়ের দাপটে তা হয়নি।
মেয়েদের বিয়ে দিতে পারবে যাত্রা করালে?
যাত্রা করা মেয়েদের কি বিয়ে হয় না?
হয়, যাত্রাওয়ালাদের সঙ্গে?
আমিও তো যাত্রা করি।
ওই জন্যেই তো যাত্রা করতে দেব না। যাত্রাওয়ালা লোক উড়িয়ে পুড়িয়ে দেবে। দেখছি তো। আমার বাবা মায়ের ভাষায়, ঘর জ্বালায়ে পর ভালায়ে।
কথায় কথায় দূরে চলে এসেছি। পশ্চিমাদের দলে অল্পবয়সী মেয়ে পুরুষ থাকত। বড়লোকের বখাটে দু'একজন ছুঁকছুঁক করত। গ্রামে দু-তিনজন বখাটে ছিল। একবার এক বড়লোকের বখাটে ধরাও পড়ল, এক আদিবাসিনীর সঙ্গে। সেই দলটার আসা বন্ধ হয়ে গেল। মন খারাপ হয়ে গেল। ওই দলে এক পিসি ছিলেন। কোঁদা মুখ। বড় বড় চটা খেতেন। নাকে রূপার বড় নথ ছিল। আর সারা বুক জুড়ে সুন্দর উল্কি। যেন গয়না পরিয়ে রেখেছে কেউ। আজ কতশত অশ্লীল ট্যাটু সেইসব উল্কিকে ভেঙায়। পিসি কিসসা বলতেন। মারাং বুরুর অলৌকিক কাহিনি। শিকারের কাহিনি। তাঁর দামাল বরের কথা, হাতির সঙ্গে লড়াইয়ে মারা যাওয়ার কথা। পিসি আর সাঙ্গা করেন নি।
কেন? বাঘের বাচ্চার সঙ্গে ঘর করে নেংটিদের সঙ্গে থাকা যায়? বুল তুই।
পিসিরা সকালে কড়কড়ে ভাত আর চিংড়ি শুঁটকি পেঁয়াজ কুঁচি কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মেখে ভাত খেতেন। কেউ কেউ নুন আর কাঁচা সরষে তেল মেখে খেতেন। গুড় দিয়েও কড়কড়ে ভাত খেতে দেখেছি। এরপর রান্না করা ভাত নিয়ে মাঠে চলে যেতেন সবাই। দুপুরে একসঙ্গে খাবেন। মাথায় পিঠে গায়ে দুপুরের রোদে। ধানক্ষেতে পা ছড়িয়ে। আমার মনে হত, কি সুন্দর জীবন। গোধূলি বেলায় একসঙ্গে গান গাইতে গাইতে ফিরত। সন্ধ্যায় কেউ কেউ দাস পাড়া যেতেন লুকিয়ে ধানি মদ আনত। লুকিয়ে, যদি বাবু দেখলে বকে। আদি বাসিন্দাদের প্রায় সবাই ছিলেন ১৯৭৭-র পর বাম সমর্থক। এখন তাঁরা কি জানতে ইচ্ছে করে।
একবার শীতের ধান কাটার সময় ভোট পড়ে। ওঁরা ভোট দিতে চলে যান। না গেলে ঠিক হবে না। ওঁদের আসা যাওয়ার খরচ দিতে হত মালিককেই। এর নাম, রাহাখরচ। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টিএ-র মত।
# আমাদের খেজুরের রস হত খুব। আমাদের নিজেদেরই বেশ কয়েকটি গাছ ছিল। গাছি কাটতো। বাড়িতেই খেজুরের গুড় হত। আর হত খেজুর গুড়ের চা। ২০১৫ তে বাগবাজার মেলায় দেখি খেজুর গুড়ের চা। আমি আর বিশিষ্ট আইনজীবী একরামুল বারি নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। খাই। সেই স্বাদ পাই নি। এখন শুনি, গাঁয়ে গাছ আছে, গাছি নাই। তাই খেজুর রস হয় না।
# মাঠে ধান দেখতে গিয়ে তালপুকুরের পাড়ে মহুয়া কুড়াতাম। একটু পচা। কি আশ্চর্য মাতাল করা গন্ধ। ভাবতাম মহুয়া কী না কি সব পেয়েছির আসর হবে। শুশুনিয়া পাহাড় বেড়াতে যাই ১৯৯৬-এ। সঙ্গী-সাথীরা আমার মহুয়া প্রীতি শুনে মহুয়া কেনে। ঘরে ফিরে বোতল খুলেই গন্ধে বিচলিত। এতো সেই মহুয়া নয়, যা স্নিগ্ধ মন মাতান। এতো আনন্দময় নয়। নর্দমায় তড়িঘড়ি সমর্পণ। আমার আর মহুয়া খেয়ে মাতাল হওয়া হল না। স্কচ হুইস্কিতেও তো বঞ্চিত।
# দূরে রেললাইন দিয়ে যেত আগুনের গাড়ি। মানে বিডিআর রেল। বর্ধমান বাঁকুড়া রিভার রেলওয়ে। মিটার গেজ ট্রেন। ধিকিধিকি চলে। সে দেখে মন যেত বাঁকুড়া।
এই বাঁকুড়ার সঙ্গে ক্লাস ওয়ানেই জুটল আরেকটা জায়গা। বাংলাদেশ। একদিন দুপুরে স্কুল চলছে, ওয়ানে পড়ি, হঠাৎ উড়োজাহাজের বিকট আওয়াজ। আগে মেঘের গায়ে সাদা সাদা চলমান রেখা দেখে ভাবতাম ওগুলো রকেট যাওয়ার চিহ্ন। সবাই চমকে উঠে বাইরে ছুটে গিয়ে দেখি, মড়মড় করে গাছের বিরাট ডাল ভেঙে পড়ছে। বিরাট একটা তেঁতুল গাছ ছিল স্কুলের কাছে। তার বড় ডাল। কেউ কেউ বলল, প্লেন মেরে দিয়ে গেছে। বিজ্ঞরা উড়িয়ে দিলেন। প্লেন ধাক্কা মারলে তো আগুন জ্বলে যেত।
তবে কি হাওয়ায় পড়ে গেল? তবে প্লেন খুব নিচু দিয়ে উড়তে দেখেছি আমরা সবাই। কদিন খুব জোর গবেষণা চললো। কেন প্লেন গেল কোথায় গেল?
বড়দের রায় হল, বাংলাদেশে যুদ্ধ লেগেছে। ভারত পাকিস্তানে।
বিকেলে গোলামহলে ফুটবল খেলা নয়, রেডিও ঘিরে বসল সবাই।
রেডিওয় বাংলাদেশের যুদ্ধের খবর শোনা নেশা হয়ে গেল লোকের। আমারও।
ট্যাঙ্ক কামান যুদ্ধ গেরিলা মুক্তি মুজিব- কত কত শব্দ ঢুকে গেল আমাদের মাথায়।
বাংলাদেশ কোথায় কে কে জানে? গ্রামে একজনই 'বাঙাল' ছিলেন। নোয়াখালি চট্টগ্রাম কোন এলাকার। তিনি কিছু বলতে চাইতেন, কিন্তু তার কথায় কে কান দেয়, সবাই বিশেষজ্ঞ। সাদেক বাঙালের কথা শুনে লোকে হাসত। ফাটলকে বলতেন, হাটল। শালাকে হালা। দিঘিকে ঘিদি। ভাল মনের মানুষ। মজার লোক। যাত্রা থিয়েটারেও পূর্ববঙ্গের ভাষা থাকত চাকরদের মুখে হাস্যরস সৃষ্টির জন্য।
'বাঙাল' যে হাসিঠাট্টা নয়, গর্বের বস্তু নয় সেটা মালুম হল। একটা বিষয়ে সবাই একমত, এ বাঙাল সে বাঙাল নয়। আলাদা কিছু। ওরা বীর। গায়ে খুব শক্তি। মনে খুব জোর। নইলে পাঞ্জাবিদের মারতে পারে গো! খুব তাগদওয়ালা।
এই আলাদা কিছু জানবার আগ্রহের মাঝেই এল চোখ ওঠা রোগ। লোকে বললো, এর নাম জয় বাংলা। যুদ্ধের ফল।
পর্ব ৪৩
পয়লা পৌষ এলেই বাড়িতে প্রতিদিন সকালে পিঠে হত। চিতই পিঠে, নারকেল পুর দিয়ে গোঁজা, সেটা জলে সিদ্ধ করতে হত। এছাড়া হত জলের ভাপে ধুঁকি। একটু শুকনো শুকনো। এমনি খাওয়া যেত না। খেজুরের গুড়, বা বাঁধাকপি এবং হাড় মাংসের ঝোল দিয়ে দুর্দান্ত। একবার মুর্শিদাবাদ গিয়ে দেখি, ওটা সকাল সন্ধ্যা বিক্রি হয়। দাম এক টাকা।
পাটি সাপটা বাড়িতে হত না। ওই ধরনের আরেকটি পিঠে হত। সরু চাকলি হত। সরু চাকলি আবার দুটি ধরন। বাড়িতে সরু চাকলি মানে গুড়ের ফুটন্ত রসে সরু ছাকনি দিয়ে চালের মাখানো গুঁড়ি ফেলা। এছাড়া হত কলপিঠে। সেটা বহুকাল খাই না। দেখিও না কোথাও। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্র সদন চত্বরে সারারাত বাংলাভাষা উৎসবে আমার বোন সাহানারা করে খাইয়েছিল বহুজনকে। টাটকা টাটকা।
আমাদের বড়দিনের ছুটি। কিন্তু কেক পেস্ট্রি খেয়ে কিন্তু বড়দিন পালন ছিল না। ছিল ফিস্টি। প্রায় রোজ। দুপুরে সন্ধ্যায়। ডিম দিয়ে। ঘুঘু চড়ুইয়ের পাখির মাংস দিয়ে। কী অন্যায় করেছি। তবে চড়ুই পাখির মত ভাল মাংস কখনো খাইনি। ঝাল ঝাল করে রাঁধলে অমৃত। এখন তো চড়ুই নেই। ২৫ ডিসেম্বর মুরগির মাংসের ফিস্ট। ৩১ ডিসেম্বর হত হাঁসের মাংসের ফিস্টি। নিখিল বামুন। পূজা করে। ও তো প্রকাশ্যে মুরগির মাংস খেতে পারবে না। আমাদের গাঁয়ে ওসব সমস্যা নাই। মুরগিকে বলে রামপাখি। তবে বাড়িতে ঢোকে না। বাইরে চলে। কিন্তু পাশের গাঁ মিশ্র গ্রাম নয়। শুধুই হিন্দু। সেখানে বামুন মুরগি খায় শুনলে ঝামেলা হতে পারে। তাই ৩১ ডিসেম্বর মুরগি বাতিল, হাঁস। নিজেরাই রান্না করতাম। দিদিরাও যোগ দিত। বলত, এই সর তোরা পারবি না। পুড়িয়ে ফেলবি।
বললেই হল, বিয়ে শাদির বাবুর্চি কি মেয়ে?
আরে, ওরা শিখেছে, তোরা তো শুধু গুলি ডাং আর মার্বেল।
তোরাও তো খেলিস?
খেলি, কিন্তু রান্না করতেও জানি।
তোরা তো শুধু খেতে জানিস।
১৯৬৬ থেকে ১৯৮০ গ্রামে থেকে ১০-১২ বছর বয়সের মেয়েদের ছেলেদের সঙ্গে মার্বেল লুকোচুরি বুড়ি বসন্তী এমন কি ফুটবল খেলতেও দেখেছি। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত ছেলে মেয়ে একত্রে খেলত। সেভেনে উঠে গেলেই আলাদা।
আমাদের ফিস্ট হত ওয়ান থেকে ফোর আমাদের খামারে। ফাইভ থেকে পদোন্নতি হল। গোলামহলে বড়োরা যেখানে ফিস্টি করে, আমরাও ভিড়ে গেলাম। বড়ো হওয়ার ভারি ইচ্ছে তো তখন। ফিস্টের চাল ডাল আলু তেল কিনতে হত না। সবাই ঘর থেকে আনত। ডিমও 'ম্যানেজ' হয়ে যেত। ঝামেলা হত মুরগি হাঁসে। ধানের শিষ বেচা টাকায় আমরা তখন বড়োলোক। চাঁদা সমান ছিল না। সামর্থ্য অনুযায়ী। কেউ পাঁচ টাকা তো কেউ আট আনা। কিন্তু সবার সমান অধিকার।
যাঁরা বেশি চাঁদা দিতে পারত না তাঁদের কোনো হীনমন্যতা ছিল না। কারণ কেউ কিছু মনে করত না। কেউ টাকার অহংকার দেখালেই সে তো 'আউট'। আর দলে নেওয়া হবে না তাকে। পয়সার গরম দেখাচ্ছিস যা বাড়ির এগনে (আঙিনায়) তে গিয়ে নাচ।
ফিস্টিতে মাইক ছিল না। মাইকের হুল্লোড় ছিল না। নাচ ছিল না। মদ ছিল না। ছিল গল্প আর গল্প। এবং মাটি দিয়ে সদ্য গড়া উনুনের ফাঁক দিয়ে আসা আগুনে হাত সেঁকে নেওয়া। ছোট বেলায় এমনিতে আমরা শীতকালে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তাম। নটা সাড়ে নটার মধ্যে। কিন্তু বড়দিনের ছুটিতে সাতখুন মাফ।
১০-১২ ডিসেম্বরের মধ্যে পরীক্ষা শেষ। ২৩ ডিসেম্বর রেজাল্ট। আর পায় কে? পড়াশোনা? সে তো হবে সরস্বতী পূজার পর। ততদিন স্কুলে যাওয়া আছে। আছে আড্ডা আর খেলা। সরস্বতী পূজা করে তবে তো স্কুলের পড়া। তবে গল্পের বই পড়তাম দেদার। শীতে কুটুম বাড়ি যাওয়া হত খুব। কুটুমও আসতেন প্রচুর। কী আনন্দ। কী আনন্দ। এ গাঁয়ে সে গাঁয়ে যাত্রা। বড়দের সঙ্গে বসে জানুয়ারির শুরুতে ক্রিকেট খেলা শোনা। জানুয়ারির শুরুতে কলকাতায় ইডেনে টেস্ট খেলা হত। ইংরেজিতে ধারাবিবরণী চলত। কিছু বুঝতে পারতাম না। বাবারা কী করে বোঝেন অবাক হতাম। বাংলা ধারাবিবরণী হলে তো বিন্দাস। কথাই নেই।
হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে বল করতে আসছেন.....