সেকালে সপ্তম শ্রেণিতে উঠলেই ছেলেরা ক্লাব বানাতো।এখন কী করে?
আর কেউ কেউ কবিতা লিখতো।
১৯৭৮-এ আমি সপ্তম শ্রেণি।
আমরা গ্রামের ছেলেরা একটা ছোটোদের ক্লাব করে ফেললাম। নাম অরুণোদয় সংঘ। বাড়ি বাড়ি বই চেয়ে একটা ছোটো লাইব্রেরি গড়া হল। আমাদের বৈঠকখানা ঘরের আলমারি হলো সেই বইঘরের ঠিকানা। ক্লাবের দপ্তর আমাদের বৈঠকখানা। বাবাকে বলতেই রাজি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হৈহৈ করে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন হতো। জুনিয়র হাইস্কুলে ছুটিই থাকে।
আমরা ১৫ আগস্ট পতাকা তুলে গোটা গ্রাম ঘুরে মাতিয়ে দিলাম।
শিবুভাইকে মাত্র ১৫ টাকা দিয়ে মাইক বাজানো হলো।
তরুণ অপেরার 'আমি সুভাষ' পালা চললো।
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি-- ছিল তখন স্বাধীনতা দিবসের সমার্থক।
অশ্রাব্য নানা সিনেমার হিন্দি গান তখন স্বাধীনতা দিবসের মানে বোঝাতো না।
মুক্তির মন্দির সোপান তলে/ রাণার/ কোনো এক গাঁয়ের বধূ/ কোন দেশেতে তরুলতা/ একলা চলো রে এইসব বাজতো।
আর বাজতো 'সিরাজউদ্দৌলা' পালা।
ক্লাবে কংগ্রেসি সমর্থকও ছিল।
তাঁকেই সম্পাদক করেছিলাম।
আমি সাংস্কৃতিক ও সমাজসেবা সম্পাদক।
তা ঠিক হলো ওইদিন দুটো কাজ করা হবে।
এক, ক্যানেল পার হয়ে জলে ভিজে যেতে হয় গোপীনাথপুর রেলস্টেশন।
ক্যানেলে বাঁশের ব্রিজ করা হবে।
আমাদের ও অন্যদের বাঁশ ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে পেরেক ঠুকে দারুণ একটা ব্রিজ হলো।
আনন্দে শুয়েই পড়লাম আমরা ব্রিজে।
দুদিকে হাতল রাখা হলো।
দু একজন বড়োও এসে হাত লাগালেন আমাদের উৎসাহ দেখে।
সন্ধ্যার সময় যাওয়া হলো দাসপাড়ায় মদের ডাঁটি ভাঙতে।
প্রথমে বোঝানো হলো। আগে কয়েকবার শুনিয়ে আসা হয়েছে। স্বাধীনতা দিবস থেকে কিন্তু মদ বন্ধ। এখন তো উলটা দেখি।
কথা না শোনায় শুরু হলো ভাঙা।
কী বিটকেল গন্ধ।
ভাটি খানার মহিলা গাল দিলেও পাড়ার বাকি মহিলারা বললেন, খুব ভালো কাজ করেছো।
এবার শুরু হলো নিরক্ষরতা দূরীকরণ কাজ।
রাতের বেলায় পড়াতে শুরু করলাম। নাইট স্কুল।
দুজন বাধ্য ছাত্র জুটলো।
একজন জন্মসূত্রে মুসলিম একজন চর্মকার।
রাতে ওঁরা আমার কাছেই বৈঠকখানায় শুতে লাগল।
তো আরেক ১৫ আগস্টের কথা মনে আছে-- সেখানে গ্রামের তরুণরা সব ন্যাড়া হয়ে গেল। নেতৃত্বে আমার বাবা।
আমাদের বৈঠকখানার সামনে লাইন দিয়ে বসে ন্যাড়া হওয়া শুরু হলো।
প্রতিজ্ঞা গাঁয়ে ফুটবলের কোনো শিল্ড ভোটে নি, ঢোকাতেই হবে।
আমাদের গ্রামের সিনিয়র টিম দারুণ ফুটবল খেলতো।
কিন্তু সেমিফাইনালে গিয়ে আটকে যেতো।
ফাইনালে আর উঠতো না।
ফুটবল আর যাত্রা পাগল গ্রাম আমাদের।
গ্রামের ফুটবল ম্যাচ থাকলে সাত থেকে সত্তর সবাই সে যতোদূরেই হোক ম্যাচ দেখতে যাবে।
৫ কিমি ১০ কিলোমিটার ২০ কিলোমিটার--পরোয়া নাই।
একবার আনগুনোর মাঠে খেলা।
গ্রাম থেকে বাসে সাইকেলে শ তিনেক লোক। আমাদের দর্শকদের সঙ্গে কেউ পাল্লা দিতে পারতো না।
চিৎকারে কেবল জার্মানরাই পারতো আমাদের সঙ্গে। ( সব রকমের জার্মান!)।
আমাদের দলের একজন ছিল, তার নাম দেওয়া হয়েছিল কাঁড়।
কাঁড় মানে মোষের শিংয়ের মতো শক্ত হাড়।
সে কঠিন চার্জ করলে বিপক্ষের পা ভাঙা অবধারিত।
আনগুনোর হোম টিম।
কিন্তু দর্শক আমাদের বেশিরভাগ।
প্রথমেই মন্টু ভাই মারলো শট, আমরা চেঁচামেচি করছি, গগন গগন।
'গগন গগন; মানে মেরে আকাশের দিকে পাঠিয়ে মাঠ পার করে দেখিয়ে দাও-- কাকে বলে পায়ের জোর।
বল গোলপোস্ট পার করে ধানজমিতে।
আর ওমনি একদল নেচে নিল মাঠে।
রেফারি হইহই করে উঠলেন।
থামলো উৎসাহীরা।
আনগুনো গ্রামের নাম ছিল -- তাঁরা এক গোল খেয়ে গেল। উৎসাহ দিতে গ্রামের লোকেরা আসতে শুরু করেছে।
জব্বর জমেছে খেলা।
কী হয় কী হয় ভাব।
এমন সময় কাঁড়ের সঙ্গে চার্জ।
লোকে বলছে, দে ভেঙে দে পা।
পা সত্যিই ভাঙল।
আর শুরু হয়ে গেল গণ্ডগোল।
দে দৌড় দে দৌড়