পর্ব ৩৪
শীতের কুয়াশামাখা ভোরে মানুষ উঠে পড়ত গ্রামে। একে বলত ঝুঝকো ঝুঝকো ওঠা। বিহান বেলা বলতে শুনিনি কাউকে। তবে আমার দাদি বলতেন, সবের ও শাম। ঠাকুরদার সঙ্গে কর্মসূত্রে উত্তরপ্রদেশের কানপুরে কাটানোয় উর্দু ও হিন্দি শব্দ তাঁর মুখে জবরদস্ত খেলত। দাদি বলতেন, চোখে দেখতে পাই না ভাই। কিন্তু ২০ টাকার নোটকে দু’ টাকা বললেই বলতেন, অতটা চোখ খারাপ হয়নি ভাই। রান্নাও করতেন চমৎকার। লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে ভালো-মন্দ খাওয়াতেন। আমার বাবার সৎ মা। মৃত্যুর আগে কিন্তু কোনোদিন জানতে পারিনি। সৎ ছেলেকে যে এত ভালোবাসতে পারে কেউ, না দেখলে বিশ্বাস হত না। নিজের জানের অঙ্গ ছিল যেন। মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক খানিকটা সর্বজয়া ও ইন্দির ঠাকরুনের মত ছিল। রাগ করে দু’ একদিন আত্মীয়-বাড়ি কাটিয়ে আসতেন। তাতে বাবার কাছে মায়ের বকুনি বাড়ত। এই রাগ করেই একবার হাজির হলেন, বাবার এক বন্ধুর বাড়ি। সঙ্গে নিয়ে গেলেন জমানো খান-চল্লিশেক বাদশাহি মোহর। বিশাল একটা বার্মা সেগুনের সিন্দুক ছিল। একটা গোটা মানুষ যেতে পারত। সেখানে লুকানো থাকত সেসব। আমাকে বলতেন, তুই যত খুশি পড়বি। আমি পড়াবো। আমি বাবার মত দেখতে বলে এবং রঙ কালো বলে, ঠাকুমার একটা বাড়তি টান ছিল। একবার তিন রঙের লাল-সবুজ-নীল পাথর-ওলি একটা সোনার আঙটি আমাকে দিলেন। সেটি পরে ঘুরছি। মা নিয়ে নিলেন। ঠাকুমার পছন্দের রান্না ছিল আলু পোস্ত। ঠাকুমার ঘরের পেছনে ছিল জামগাছ। সেই গাছের ছায়ায় রান্না করার একটা চুলো করেছিলেন দাদি। আলু-পোস্ত সেখানেই রান্না করতেন। চুলোশাল বা রান্নাঘরে নয়। তিনমুখো-চারমুখো মাটির উনুন অনেক গেরস্ত বাড়িতেই ছিল। আমাদের বাড়িতেও। খড়, কাঠ, কুটি, কঞ্চি দিয়ে আগুন হত। খড়ে জল থাকলে রান্নায় ধুঁয়ো বুলে যেত। কেউ খেতে পারত না। এখন দেখি স্মোকড চিকেন, স্মোকড হিলসার খুব কদর।
জামগাছের তলায় দাদি আমাকে ইশারা করে ডাকত। এক বাটি আলু পোস্ত দিয়ে বলত – কাল্টা, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। তোর মা দেখলে ...
দাদি যে বাড়িতে বাদশাহি মোহর নিয়ে যান, সেখান থেকে খবর আসে, তাঁর নাকি খুব দাস্ত/ কলেরার মত পায়খানা হচ্ছে। নিয়ে আসা হল। বাঁচলেন না। মরার আগে বাবার বন্ধুকে বারবার ডেকে পাঠালেন। তিনি এলেন না। বাদশাহি মোহর দাদির সঙ্গে হারিয়ে গেল।
মরার সময় মুখে পানি দেওয়ার নিয়ম। সবাই মিছরি-ভেজানো পানি দিতে লাগল। আমাকেও ডাকা হল দিতে। দিলাম।
প্রিয় ছেলে পার্টির কাজে বাইরে ছিল। শেষ দেখা হল না।
দাদির মরার পর আত্মীয়-স্বজন আসবে। তাঁদের জন্য সরু চাকরি করতে হবে। আমি তখন ক্লাস ফাইভের ছাত্র। হাফ-প্যাডেল ছেড়ে সাইকেলে প্রমোশন হয়েছে। কিন্তু তখন আশ্বিন মাস। কাদা রাস্তায় চলে চলে মাটি এবড়ো খেবড়ো। সাইকেল চলে না। দু’জন গেলাম গুড় কিনতে। ১০ কেজি গুড় মাথায় নিয়ে ফিরলাম দু’ কিলোমিটার দূর থেকে।
‘পথের পাঁচালী’ যতবার পড়ি, আমার দাদির কথা মনে পড়ে।
পর্ব ৩৫
গ্রামের ভোরে মানুষ উঠে গোরু ছাগলকে গোয়াল থেকে বের করত। মেয়েরা মুরগি/হাঁস ছাড়ত মুরগি/হাঁসের ঘর থেকে। আর কোনো কোনো বাড়িতে ছেলেমেয়েরা ভোরে উঠে দুলে দুলে সুর করে পড়ত। আমাদের বাড়িতে ভোরে উঠে পড়তে বসা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। এর দু’টি কারণ। এক, বাবা বলতেন, পরীক্ষার আগে ভালো করে ঘুমানো উচিত। আর দুই, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলত, ভোরে উঠে সুর করে পড়ারা ফেল করে।
আমি কোনোদিন সুর করে পড়তে পারতাম না। মনে মনে পড়া। এর বড় কারণ, বই না পড়ে গল্পের বই পড়লে বাড়ির লোক ধরতে পারত না।
পড়ার সময় আমি এবং আরো অনেকের বালিশ নিয়ে বসার অভ্যাস ছিল। বই রাখতে সুবিধা হয় বলে দাবি। আসলে বালিশের তলায় গল্পের বই ঢুকিয়ে দেওয়া সহজ।
গল্পের বই বলতে সহজলভ্য ছিল, নব কল্লোল, প্রসাদ। নব কল্লোল দিয়েই আমার গল্পের বই পড়ার শুরুয়াত। ক্লাস টু-তে। কী মার মেরেছিলেন উত্তরপাড়ার মাস্টারমশাই! আমাদের বৈঠকখানার পাশ দিয়ে স্কুল যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা ছিল। যাচ্ছিলেন।
এদিকে বিপ্লবী নায়ক রফিক ট্রেনে ইংরেজদের ক্যাশবাক্স লুঠ করতে গিয়ে গুলি চালিয়ে বমি করে ফেলেছে মানুষের রক্ত দেখে। এবং অজ্ঞান। সে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কী হবে ভেবেই আমি অস্থির। বলছি, ওঠো ওঠো।
ফলে উত্তরপাড়ার মাস্টারমশাই আসার আগেই বই লুকোতে পারিনি।
আর বই পড়তে পড়তে স্কুলের সময় হয়ে গেছে খেয়াল নেই। ঘরের পাশে আমাদের পূর্বপুরুষদের দেওয়া জায়গাতেই স্কুল।
সময় লাগত না যেতে।
ঝপাং পুকুরে ডুব মারো আর ছোটো। ভাত আমি আগেই খেয়েই রাখতাম। চুল টুল আঁচড়ানোর বালাই আমার ছিল না।
স্কুলে গিয়ে উত্তরপাড়ার মাস্টারমশাইয়ের ডাক।
এই শোন।
গেছি।
ওই লাঠিটা আন।
যাকে মারা হবে তাকেই আনতে হবে তার লাঠি – এই দস্তুর।
আমি তো বুঝিনি, আমাকেই মারবেন। তাহলে দৌড় দিতাম হয়তো।
আধঘন্টা পিটুনি।
পেকে গেছে ছেলে। নব কল্লোল পড়ছেন। বলছেন আর মারছেন। ওই আমার প্রথম ও শেষ মার খাওয়া।
উত্তরপাড়া মাস্টারমশাইয়ের কল্যাণে আমি বুঝলাম এই সব বই লুকিয়ে পড়তে হবে।