একটা খবর পড়লাম সকালে।
এক ভদ্রলোকের কান থেকে কাঁকড়া বিছে উদ্ধার। কাঁকড়া বিছের কামড় সাংঘাতিক। যিনি খেয়েছেন তিনিই জানেন। সাধারণ বিছের কামড় আমরা গ্রামের বাসিন্দারা কম বেশি সকলেই খেয়েছি। জ্বলেছি। পেঁয়াজের রস তাতেও কাজ না হলে হোমিওপ্যাথি বেলা ডোনা। কাঁকড়া বিছে কানে ঢোকার প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ছোটো বেলায় কানে মাঝে মধ্যে পিঁপড়ে ঢুকত। এটা বেশি ঘটত রাতে। প্রথমে চেষ্টা হতো নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকার। তাতে কোনো কোনো সময় বের হয়ে যেত। আর টোটকাও ছিল একটা, কানে সর্ষে তেল ঢেলে দেওয়া। কিছুক্ষণ পরে মরে যেত পিঁপড়ে।
ছোটো বেলায় আরো একটা জিনিস দেখেছি, কারো কারো কানে পুঁজ হয়ে যেত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই ঘটনা বেশি চোখে পড়ত।
কাগজ পড়লে আজো এই আন্তর্জালের যুগেও নতুন কিছু জানা যায়। সাংবাদিকতা পেশা ছিল, সেই অভ্যাসে সকাল বেলায় উঠে ছয় খানা কাগজ পড়ি। ছোটোবেলায় দুটি বা তিনটি কাগজ পড়ার সুযোগ হতো। তাও এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে বা দোকানে।
বেলায় আসতো কাগজ। সেহারাবাজার ছিল সেন্টার। পলাশনের অশোক ঘোষ মালিক। প্রথমে বড় ছেলে পড়ে ছোটো ছেলেও কাজে যোগ দেন।
ছোটো ছেলে ছিল আমাদের বন্ধু। ভদ্রলোক খুব ভালো ছিলেন। ধারে জ্ঞান ও বিজ্ঞান, কিশোর ভারতী, শুকতারা দিতেন। কিস্তিতে দাম দিলেও চলতো। চার আনা করে। পড়তে ভালোবাসেন জানলে খুশি হতেন। এটা শুধু ওঁর ব্যবসা ছিল না, ভালোবাসাও। ছেলেরাও এক গুণ পেয়েছিলেন।
আমি ছোটো তাই কাগজ পড়তে হতো উল্টোদিক থেকে।
বড়রা পড়ছেন, আমি উল্টোদিক দিয়ে পড়ছি। এতে আমার খুব লাভ হয়েছে। পড়ার শক্তি বেড়েছে এবং মনে রাখার।
এই সূত্রেই জানি একটা শব্দের নাম, এনকেফেলাইটিস। তখন বড় হয়ে গেছি, সপ্তম অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। আর পিছন দিক থেকে কাগজ পড়তে হয় না। সামনে পড়ার অধিকার জন্মে গেছে। আমাদের জুনিয়র হাইস্কুলে আনন্দবাজার আসতো। স্কুলের কোনো মাস্টারমশাই আসার সময় নিয়ে আসতেন।
সেহারা থেকে কাগজ আসার নিয়ম ছিল আলাদা। কেউ বাজারে গেছেন। ফিরছেন। ঘোষ মশাই ডেকে বললেন, এই কাগজ দুটো নিয়ে যা। যিনি বাজারে গিয়েছিলেন তিনি আগে কাগজ পৌঁছে তবে বাজারে যেতেন। অনেক সময়ই কাগজ নির্দিষ্ট লোকের বাড়ি পৌঁছাত পরে। কারণ দুগোদার দোকানে একদল বসে আছেন, কখন কাগজ আসবে। তাঁরা পড়ে তারপর পাঠাবেন।
এই সমবায়িক জীবন আজ ভাবা যায়?
কথা হচ্ছিল এনকেফেলাইটিস নিয়ে। জাপানি এনকেফেলাইটিস। কেউ কেউ বলতেন, এনকেফেলাইটিস ভুল এনসেফেলাইটিস। ঈপ্সিতা ভালো বলতে পারবেন। এনকেফেলাইটিস বা এনসেফালাইটিসে আমাদের গ্রামের আদিবাসী পাড়ায় পাঁচ ছয় জন মারা যান।
শুয়োর ছিল আদিবাসী পাড়ায়। কেউ কেউ বললেন, শুয়োর সরাতে হবে। বাবা বললেন, এটা অনেকের জীবিকা। তাড়িয়ে দিলেই হবে?
আমাদের সময় ভাদ্র আশ্বিন মাস ছাড়া মশা ছিল না। এখন সারা বছর মশা।
মশারি ছিল খুব কম ঘরে। ৩০ থেকে ৫০ টাকা দাম। কিন্তু ১৯৭৯-৮০ তে ৩০ টাকা অনেক টাকা। একজন খেতমজুরের প্রায় মাসিক মজুরি।
বাবা দিবসে বাবাকে, মা দিবসে মাকে নিয়ে লেখা হয় না। কেমন আদিখ্যেতা মনে হয়। কিন্তু ১০০ পর্ব পার করে বাবাকে নিয়ে একটু লেখা যেতে পারে।
লেখার ব্যাপারে বাবার কুঁড়েমি আমি পেয়েছি। ১১০ পেট্রোলের দাম হয়েছে আগেই , কাদামাটির হাফলাইফ ১০৪ ছুঁল, দেখে একটু অবাক। ১১০ ছুঁতে পারবে তাহলে! একবার শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়দা রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য পোস্ট করেছিলেন, ধারাবাহিকতার অভাব আছে। এটা নাকি রবি ঠাকুর কয়েছেন!
ভাবা যায় না।
ভদ্রলোক যা লিখে গেছেন তা বুঝে পড়তেই তো দুটো জীবন লেগে যাবে।
ধারাবাহিকতা থাকলে তো পাঠককে মিথ্যা কথার ফুলঝুরি ছোটাতে হতো।
আমার সামাজিক কাজে ধারাবাহিকতা আছে। লেখায় একেবারেই নাই।
২০১৫ তে একটা লিখেছিলাম । তারপর দীর্ঘ দীর্ঘ বিরতি। এটা গ্রামচারণী।
তা বাবার কথাও আবার লিখি আজ।
দুনিয়ার সব মানুষের কাছেই তাঁর বাবা বোধহয় অদ্ভুত।
আমার বাবাও তাই।
প্রচুর পিটুনি এবং চড় খেয়েছি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, নবম থেকে পাখনা গজিয়েছে, দূরের বিদ্যালয়ে পড়তে যেতে শুরু করেছি, রুখে দাঁড়াতেও শিখে গেছি। একাদশ শ্রেণিতে তো 'তারাস বুলবা' পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে একটা কাণ্ডই ঘটিয়ে ফেলেছিলাম। সেটা সবিস্তারে বলা যাবে। পরে।
নবম শ্রেণির পর আর মার খাই নি।
বাইরের লোকের কাছে বাবা আর ঘরে দুই সত্তা। বেশিরভাগ সময় বাবা বন্ধু, রাগলে দুর্বাসা।
ছোটো বেলায় দেখেছি, মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হলে তিনদিন খাওয়া বন্ধ।
গোটা গ্রাম জেনে যাবে বাবার রাগ হয়েছে। কোথাও কিছু খাচ্ছে না।
কলের জল শুধু।
মা পরোয়া করতো না, খেয়ে নিত। শুধু আমাদের প্রতি মুখ ঝামটা বেড়ে যেত।
আর খাবে না -- কেন?
বাবার যুক্তি, খেলেই রাগ পড়ে যাবে। তাই খাবে না। মাকে দেখিয়ে দেখিয়ে কলের জল খেত, খাবার খেত না।
আমার একটা পিটাই মনে আছে।
সত্তর দশকে গ্রামে গ্রামে সবুজ বিপ্লবের ধাক্কায় শ্যালো বা অগভীর নলকূপ বসানোর ধূম পড়ে।
আমাদের গ্রামে তখন ২০ বিঘের ওপর জমির মালিক ১০ জন।
৮ জন শ্যালো বসিয়ে ফেললেন।
আমাদের একটা মাঠেই এক কিস্তিতে তখন টানা ২১ বিঘা জমি।
জমির মাথায় সাঁওতাল পাড়া। আমাদেরই জায়গা।
সেখানেই জমির মাথায় বসলো আমাদের শ্যালো।
কিছু দিন পর সবার শ্যালো 'ফেল' করে গেলো।
জল উঠছে না।
জলের লেয়ার/স্তর অনেক নীচে।
এদিকে বাবা কংগ্রেসের মিথ্যা মামলা ও হামলার জেরে গ্রাম ছাড়া।
জমি চাষ করতেও দিচ্ছে না কংগ্রেস।
১৯৭৪-এ আমার বড়দা ক্লাস নাইনের ছাত্র, শ্যালোকে ধান ভানার মেশিন বানিয়ে ফেলল।
কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা, আমাদের বাড়িতে ধান ভাঙানোও যাবে না।
এক কংগ্রেসি নেতা বড়ো হলারের মেশিন বসিয়েছে, ধান ভাঙার।
দাদার মুখে শুনেছি, লোকে আমাদের পাশে থাকবে বলে, রাতের আঁধারে ধান আর কাগজে লিখে টাকা নিজেরাই রেখে যেতেন।
আমাদের চাষ বন্ধ। আয় শুধু দুটো কচু বিক্রি আর ধান ভাঙার টাকা। বাড়িতে গৃহসহায়ক, কৃষি শ্রমিক মিলিয়ে ১৪-১৫ জন লোক। তার সঙ্গে রাতের আঁধারে পার্টি নেতাদের যাতায়াত। অভাবী ও পার্টি দরদীদের আর্থিক সাহায্য। জেরবার অবস্থা।
বাবা ফিরলেন ১৯৭৬-এ।
তারপর ১৯৭৭ এলো।
কী উত্তেজনা সবার।
মিটিং ডাকতে হয় না, খামারে হাজার খানেক লোক জমে যায়।
বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার সন্ধ্যায় লাঠি হাতে হাজার খানেক দল লোক।
এতো দিনের অত্যাচারের প্রতিশোধ নেবে। অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে।
খালি বলছে, একবার অনুমতি দাও।
বাবা বলছেন, প্রতিশোধ নেওয়া যাবে না।
গুঞ্জন শুরু হয়েছে, বলি না, গান্ধীবাদী কমিউনিস্ট।
সবার এক কথা, অত্যাচারীদের বাড়িগুলো গুঁড়িয়ে দেবো সব।
বাবা বললেন, অপেক্ষা করুন। রাতে ৭.৪০-এ জ্যোতি বসু আর প্রমোদ দাশগুপ্তের ভাষণ আছে।
কী বলেন শোনো।
পিনপতন নীরবতা। স্তব্ধ।
কেউ কথা বলছেন না।
একটু ফিসফিস চলেছে, পিডিজি ( প্রমোদ দাশগুপ্ত ) কড়া লোক। জঙ্গি মনোভাব। হুকুম দেবেই। (তখন জঙ্গি মানে লড়াকু বোঝাত, মুসলিম সন্ত্রাসী নয়)।
কিন্তু না, এলো শান্তির আবেদন।
লোকে হতাশ। কিন্তু শুনলেন।
লাঠি নিয়ে বের হলো মিছিল।
জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে।
কিন্তু একটা ঢিলও পড়লো না কারো বাড়িতে।
উল্টো ফল হলে, মানে কংগ্রেস আবার জিতলে কী হতো জানি না।
১৯৭৮ এ পঞ্চায়েত নির্বাচন। বাবা জিতলেন বিপুল ভোটে।
বাবার কাজ গেলো বেড়ে। মেজাজও গেল চড়ে। বাড়িতে। হাস্কিং মেশিন বন্ধ করতে পারছেন না।
দাদা কলেজের জি এস। মাসে একবার বাড়ি আসে বন্ধু বান্ধব নিয়ে। তখন উৎসব।
ক্লাস এইটে পড়ি।
১৯৭৯।
সেদিন এইটের ইতিহাস পরীক্ষা।
বার্ষিক পরীক্ষা। জুনিয়র স্কুল। ওটাই শেষ পরীক্ষা।
বাবা ধানকল চালাচ্ছেন।
আমিও ধানকল চালাতে জানতাম। কিন্তু একটা জায়গা নড়বড়ে হয়ে গেছে। কাগজ গুঁজেও কাজ হচ্ছে না। একজনকে কাগজ গুঁজেও ধরে থাকতে হয়।
আমি ধরে আছি।
আমার একটা স্বভাব ছিল, কাগজ ছেঁড়াফাটা যাই হোক পড়া।
কাগজটা দেখে আমার খেয়াল নেই, খুলে পড়তে শুরু করে দিয়েছি।
ধান ভাঙা বন্ধ।
কী হলো?
বাবা বলছেন, আমার খেয়াল নেই।
একটা চড় খেয়ে বুঝলাম গণ্ডগোল। বাবার গাল শক্ত হলেই আমি সাধারণত দৌড় দিতাম। আজ অসতর্ক। পেয়েছে।
কিন্তু চড় খেয়েই সজাগ হয়ে, দে দৌড় দে দৌড়।
৫০০ মিটার দৌড়ে এসে ধরেছে।
ধরেই গলায় পা, তোকে আজ মেরেই ফেলবো।
আমি কাঁদছিও না, ছাড়তেও বলছি না।
চুপ করে শুয়ে আছি।
এদিকে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয়। কোনোদিন স্কুল কামাই করি না। পরীক্ষা দিচ্ছি না। মোবাইল না থাকলেও সেযুগেও খবর বাতাসের চেয়ে দ্রুত ছড়াত।
খবর পেয়ে হেডমাস্টার মশাই এসে গেলেন।
বাবা ছাড়বেন না, ওর খুব অহঙ্কার। আমি চাই ফেল করুক।
আমি ওর মধ্যেই বলছি, ইতিহাসে আমি কোনোদিন ফেল করবো না।
বাবা বললেন, তোকে যেতেই দেবো না।
এদিকে অন্য শিক্ষকরাও হাজির।
আধঘন্টা পর হলে গেলাম পরীক্ষা দিতে।
ধুলোটুলো ঝেড়ে।
স্যাররাই কেউ কলম এনে দিলেন।
এই বাবার মতো অসাধারণ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি।
যাত্রা নাটক গান কবিতা পোস্টার দাবা ক্যারম তাস ফুটবলে দক্ষ। ক্রিকেটে ততো জোরদার নন। কিন্তু ছোটোদের সঙ্গে শেষবয়স পর্যন্ত খেলেছেন। ভলিবল শিখেছেন ৫০ পেরিয়ে।
পার্টি অন্ত প্রাণ।
কিন্তু ১৯৮৭তে ছাড়লেন পার্টি। বাবার বয়স তখন ৫০।
লিখে বললেন, আমি এই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ পাওয়ার যোগ্য নই, কারণ আমার এখনো অনেক বিঘা জমি আছে। আর এই পার্টিটার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ দেওয়ার যোগ্যতাই নেই, কারণ পার্টিটাই কমিউনিস্ট পার্টি নয়, ভোট ও ক্ষমতার রাজনীতিটাই জানে!
(ক্রমশঃ)