পড়া হতো। তার চেয়েও গল্প হতো বেশি।
এই গল্পই একবার আমার প্রাণ বাঁচায়।
পূজার ছুটি। কলেজ হোস্টেলে আমি একা। জ্বর চলছিল। বিকেলের দিকে মনে হল জ্বর ছেড়েছে। গায়ে হাত দিয়ে কোনো উষ্ণতা টের পাচ্ছি না।
বিকেলে হোস্টেলে ফিস্ট।
কৌশিক লাহিড়ী কৌস্তভ সায়ন ওদের আসার কথা।
শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে।
কৌশিক এলো সবার আগে। এসে দেখে বলল, বাবুর্চি সাহেব, শুয়ে কেন?
বললাম, জ্বর এসেছিল। এখন নেই।
কৌশিক তখন ডাক্তারি পড়ছে।
গায়ে হাত দিয়ে বলল, গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে ছোটাছুটি।
শহরের এক নার্সিংহোমে নিয়ে গেল।
থার্মোমিটারে দেখে ১০৫ জ্বর।
তখন ফোন এত ছিল না। মোবাইলের প্রশ্ন নেই। তবু বহু মানুষ চলে এসেছেন।
জ্বর কমাতে ইঞ্জেকশন দেবেন কম্পাউন্ডার।
কী ইঞ্জেকশন? আমি জানতে চাই?
দুয়েকজন বলেন, তুই কি আবার ডাক্তারিও পড়ছিস নাকি?
আসলে অঞ্জনদা বলেছিলেন, জ্বর কমাতে অনেক সময় ক্লোরামফেনিকল ( ঠিক লিখলাম তো!) ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। এটা অনেকের সহ্য হয় না। পরীক্ষা করে দিতে হয়।
ক্লোরামফেনিকল শুনেই আমি বললাম, আগে পরীক্ষা করো।
ওরা করবে না।
আমিও নাছোড়বান্দা।
শেষে পরীক্ষা করতে অল্প দেওয়া হল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটা কালো হয়ে গেল। পরে ঘা হয়ে যায়।
আজো সেই চিহ্ন আছে।
বর্ধমান শহরে আমার প্রথম শিক্ষক ও বন্ধুর নাম অঞ্জনদা। অঞ্জনদার কাছে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত--সব করতাম। অসাধারণ পণ্ডিত মানুষ। প্রতি বছর দু চারটে ছেলে মেয়ে জয়েন্ট পায়। বর্ধমান শহরের অতি ধনী বাড়ির ছেলেমেয়েরা, বিশেষ করে শহরের একমাত্র ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁর কাছে পড়েন।
শহরের সবচেয়ে ধনী কে ?
চন্দ্রচূড় মুখার্জি না এককালে সাড়া জাগানো খবর, দেবযানী বণিকের বাবা ধনপতি দত্ত-- কে বেশি বড়লোক --সে নিয়ে তর্ক থাকলেও দু বাড়ির গৃহশিক্ষক অঞ্জনদা।
চন্দ্রচূড় মুখার্জির বাড়ির আঁখি পড়াশোনায় ছিল খুব ভালো। এখন ইংল্যান্ডে। পড়াচ্ছেন। গবেষণা করছেন।
ইন্দ্রজিৎ যশ-- ধনীর ছেলে। বিজ্ঞান পড়ে। রসায়নে তুখোড়। কিন্তু সাহিত্য পড়ছে চুটিয়ে। অঞ্জনদার প্রভাবে।
বিষ্ণু বসুরা তখন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সবকটি উপন্যাসের অনুবাদ ছাপছেন।
প্রতিটি বই ২৫ টাকা।
ইন্দ্রজিৎদা কিনলো।
আমরা পড়লাম পালা করে।
ধনপতি দত্ত ওরফে ধনু দত্তের ছেলে বিপ্রদাস দত্ত আমেরিকায় পড়াশোনা। শহরে 'দাস ক্যাপিটাল' কে খুঁটিয়ে পড়েছেন? বিপ্রদাস দত্ত।
অঞ্জনদার সঙ্গে বিপ্রদাসবাবুর কাছে যাওয়া হলো। অগাধ পড়া। কিন্তু মার্ক্সবাদী নন।
অঞ্জনদার একটা সাইকেল ছিল। অঞ্জনদা তেমন ঢ্যাঙা-- সাইকেলও তেমনি। সাইকেল হাতে নিয়ে হাঁটতেন অঞ্জনদা।
বর্ধমান শহর অনেকটা চিনেছি অঞ্জনদার সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে।
অঞ্জনদা আমাকে ছাড়তেন না। আমিও।
বাবুরবাগে ভাড়া থাকতেন। মর্গ পেরিয়ে যাওয়া। গন্ধে বমি আসতো।
অঞ্জনদা রিক্সাওয়ালাদের সঙ্গে গল্প জুড়েছেন।
কী খবর বুলছে রে।
অঞ্জনদা পুরুলিয়ার ভাষা ছাড়েন নি।
তারপর মিঠাপুকুরে কুমোর গলি।
খৈনি দাও হে।
খৈনি ডলে একটু সুখ দুঃখের খবর।
তারপর বিসি রোড পেরিয়ে ডাক্তার রমেন মুখার্জির বাড়ি। অঞ্জনদা তো পড়াবেন। আমি কী করি?
ইংরেজি গল্পের বই পড়তে ভয় পেতাম, ওখানে পেলাম।
একটু একটু করে পড়া স্বাগতার কাছে।
পরে ওই বাড়িতে আমি টিউশন পড়িয়েছি।
শহরে কে কার প্রেমে পড়ছে, কোন নেতা টাকা খাচ্ছে-- অঞ্জনদা গেজেট পুরো।
'নতুন সংস্কৃতি'-র কার্তিকদার সঙ্গে আলাপ অঞ্জনদার সূত্রে।
থাকবার জায়গা নেই।
অঞ্জনদা নিয়ে গেলেন কমলসায়রে এক ধনীর বাড়ি।
ভাইকে নিয়ে থাকবো?
ভাড়ার ঘর অঞ্জনদা ঠিক করে দিলেন।
উচ্চমাধ্যমিক পড়ছি।
এগারো ক্লাসের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা।
পরদিন পদার্থ বিজ্ঞান পরীক্ষা।
আর আগের দিন 'শোয়াইক গেল যুদ্ধে' নাটক টাউন হলে।
অঞ্জনদা বললেন, ১৯৮৩র ১৫ জানুয়ারি তুমি কি 'শোয়াইক গেল যুদ্ধে' নাটক আর দেখতে পাবে?
না।
কিন্তু পরীক্ষা তুমি আবার দিতে পারবে।
অতএব নাটক দেখা।
পরদিন রাতে জুলিয়াস সিজারের শেষ সাতদিন।
পরদিন দুপুরে রসায়ন।
এক যুক্তি।
ওই বছর পদ্মজা নাইডু কলেজের ৭৫ বছর।
ভীমসেন যোশী, রবিশঙ্কর, আমজাদ আলী খান-- দিকপাল সব শিল্পী।
উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত তখনো বুঝতাম না, এখনো কি বুঝি।
প্রথম রাতেই ভীমসেন যোশী।
উসখুস করছি। ভালো লাগছে না। অঞ্জনদা ছাড়বেন না।
কিছু বুঝছি না অঞ্জনদা।
ওহ, শোনো গাইছেন একটাই লাইন, দেবাদিদেব মহাদেব। শুনে যাও কিছুক্ষণ।
শুনলাম।
বুঝে না বুঝে সুরে ভক্ত হয়ে গেলাম উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের।
প্রচুর পড়তেন। নানা বিষয়।
ছেলে বাপ্পাকে পাড়ার সাধারণ স্কুলে ভর্তি করলেন। ভালো স্কুলে নয়।
শিখলে ওখানেই শিখবে।
আমার চেনা দুচারজন ছেলেকে সপ্তম শ্রেণিতে প্রচুর সাহিত্যের বই পড়তে দেখেছি-- বাপ্পা তাঁদের মধ্যে সেরা।
এতো পড়তো বাপ্পা। কিন্তু ক্লাসের পড়ায় মন নাই।
কিন্তু নবম শ্রেণি থেকে বাপ্পা বাবার মতোই অঙ্ক বিজ্ঞানে জায়েন্ট হয়ে উঠলো।
আমার বাপের সঙ্গে অঞ্জনদার একটা মিল ছিল বেশ, ছেলেকে শুয়োরের বাচ্চা বলা।
বৌদি বলতেন, কাকে গাল দিচ্ছো?.
কাকে আবার নিজেকে।
অঞ্জনদার জীবিকা ছিল টিউশন।
শহরের সব নেতাকে চিনতেন।
চাকরির জন্য উমেদারি করেন নি।
অপ্রিয় সত্য বলতেন খুব।
এবার নির্বাচনের আগে চাইছিলেন বিজেপি বিরোধী কোনো সভায় বলবেন।
হলো না।
অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করবেন না।
টিউশন কমছিল।
কারণ, ঘরে বসে পরীক্ষার দিন ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা দিতে দেবেন না।
পরীক্ষার মাঝে ফোন করে উত্তর জানলে বলবেন না।
একবার জোর করে টাকা পাঠানোয় কথা বন্ধ রাখলেন কদিন।
আর বললেই বলতেন, তুমি আমার ভাই তোমাকে বলবো।
সঞ্চয় ছিল অল্প
ভাঙতে চাইছিলেন, আমি না করছিলাম। আমরা থাকতে কেন তুলবেন।
আচ্ছা, বলবো।
শুধু ফোনটা ভরতে দিতেন।
৩০ জুলাই ২০২১ চৈতন্য নিয়ে বলছিলাম। ফোন আসছিল বারবার। ফোন ধরে বললাম, অঞ্জনদা শেষে কথা বলি।
বললাম। দু তারিখে মোবাইল টপ আপের কথা হলো।
তারপর বললাম, সামনের সপ্তাহে বর্ধমান আসছি।
ইচ্ছে ছিলো, অঞ্জনদাকে নিয়ে শান্তিনিকেতন যাবো।
কতদিন কোথাও যাই না।
উনিও।
হঠাৎ বললেন, এতো দিন সময় কী পাবে?
আমি ভাবলাম করোনার কথা বলছেন। করোনার ভয় পাচ্ছিলেন খুব।
বুঝতে পারি নি, চলে যাওয়ার কথা বলছেন।
২ আগস্ট ২০২১ ভোরে চলে গেলেন।
বাপ্পা বললো, অবসাদে।
পরে শুনলাম, আত্মহত্যা।
আমি যেতে পারিনি।
কাঁদলাম ।
আমার বড়দি আত্মহত্যা করেছিলেন।
আমি বড়ো ভয় পাই।
বড়ো আত্মহত্যাকে।
অঞ্জনদা ক্ষমা করবেন।
আপনার হাসি মুখটাই মনে রাখতে চাই।
হাঁটছেন আর সবার সঙ্গে রসিকতা করছেন।
বলেছিলেন, আমার মরার পর পাশে থেকো।
আমৃত্যু।
এই কথাটা রাখবো।
কিন্তু আপনি কী করলেন অঞ্জনদা-- এভাবে অপরাধী করে গেলেন আমাদের।
আর কত আত্মমর্যাদা সম্পন্ন অঞ্জনদাকে যে কেড়েছে-- করোনা কাল?
কত?
আমরা হাম দো হামারা এক প্রজন্মের মানুষ নয়। আমাদের ছিল যৌথ পরিবার। যদিও আমার বাবা ছিলেন একা। ভাই ছিল না। কিন্তু মাসি পিসি কাকা জ্যেঠা তাদের ছেলে মেয়ে পার্টির লোক যাত্রা নাটকের লোক বাবার বন্ধু দাদার বন্ধু--সবমিলিয়ে বাড়ি সারা বছর সরগরম। গরম বা বর্ষার ছুটিতে কথাই নাই। পূজার ছুটিতে আত্মীয় স্বজন তত আসতো কি? আসতো তো মাঘ মাসের মেলায়।
মেলা লোক।
কিন্তু কেউ না এলেও তাঁরা থাকতেন স্মৃতিতে। আমাদের বা অন্য ছোটোদের ভাত তরকারি মিশিয়ে গোল্লা পাকানো হতো। ছোটো ছোটো গোল্লা।
একেকজনের নাম করে খাওয়ানো হতো।
দাদা খায়, দিদি খায়, ভাই খায়, অমুক খায় তমুক খায়। এমনকী বাড়ির কুকুরের নামও বাদ যেতো না।
সবমিলিয়ে আত্মীয়তা।
সে জীবন কি আর আসবে না?
(ক্রমশঃ)