অপরিচয় এক বড়ো সমস্যা। অনেকেই জানেন না মুসলিম বিয়ে / সুন্নতে যাত্রা (পালা)র খরচ দেওয়ার রীতি ছিল। সত্যপীরের পালা তো হাজামি হলেই। হাজামি মানে খতনা দেওয়া। মুসলিম বিয়েতে যেমন করে সরস্বতী পূজার সময় রঙিন কাগজ কাটা হয় তেমন কাগজ কেটে বিয়ে বাড়ি সাজানো হয়। গোবরজল দিয়ে উঠোন / খামার নিকানো হয়। হলুদ মাখানো মুড়ি হয় কুসুম বীজ দিয়ে। মুড়ি ও খইভাজা হয় বস্তা বস্তা। গুড় মাখানো মুড়কিও হয়। ওই খইমুড়ি বাড়ি বাড়ি পাঠানো হয়। কোথাও এটাও নেমন্তন্নের একটা ধরণ। বিয়ের দুদিন দিন বা সাতদিন আগে গায়ে হলুদ। গায়ে হলুদের তত্ত্ব আসবে কনে এবং বর--উভয় পক্ষ থেকেই। আনুষ্ঠানিক আইবুড়ো ভাত পর্ব চলে অন্তত দুদিন। এর আগে নানা বাড়িতে আইবুড়ো ভাত খাওয়ার পালা স্বতন্ত্র। বাড়ির আইবুড়ো ভাতে পায়েস/ ক্ষীর থাকবেই। একে বলে ক্ষীর খাওয়ানো। সন্ধ্যে বেলায় দৈনিক ক্ষীর বা পায়েস খাওয়ানোর আসর বসে। সেজেগুজে কনে বা হবু বর বসে। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী আসে। সামনে রাখা নানা ধরনের খাবার, মাংস, মাছ, পোলাও, ক্ষীর বা মিষ্টি খাওয়ায়। সাধ্যমতো টাকা বা সোনা দেন। ৩০-৩২ রকম খাবার দেখেছি কিছু কিছু বাড়িতে। ইদানীং তো টিভির দাপটে সে সংখ্যা কতো পিথাগোরাস জানেন।
আর বাড়তি যোগ চুমু।
বয়স্করা মাথায় চুমু দেন। অল্প বয়সিরা হবু বর বা কনের ঠোঁটে হাত ঠেকিয়ে নিজের হাত ঠোঁটে দিয়ে চুমু।
চুমুর অঢেল আয়োজন। ফ্লাইং কিসওয়ালারা দেখলে তাজ্জব বনে যাবেন।
আর সেই সময় চলে ঢাক ঢোল বাজিয়ে বিয়ের গীত। যা অধিকাংশ সময়েই তক্ষুণি রচিত। কবি গানের মতো চলে সওয়াল জবাব।
একটা গীত মনে পড়ছে:
আতর বিবি চাদর গায় শুকনা মুখে চুমা খায়।
আদি রসের ইঙ্গিতে শিল নোড়ার রূপকে কান লাল হতে পারে সদ্য তরুণ তরুণীর। বাঁশবনে চাঁদ নয় শরীরী প্রেম লাজরক্ত হয়ে উঁকিঝুঁকি মারে।
দুপুর বেলায় চলে রঙ খেলা।
বিয়ের আগের দিন তা তুমুল আকার ধারণ করে। চৌবাচ্ছা বা বড়ো পাত্র রঙ ভর্তি করা হয়। অনেক সম্পন্ন বাড়িতেই পেতলের পিচকিরি থাকতো।
আমাদের বাড়িতে একাধিক পেতলের পিচকিরি দেখেছি।
শুরু হতো রঙ দিয়ে শেষ পুকুরের পাঁক/ কড়াইয়ের কালি দিয়ে। মেহেন্দি মাখা তো ছিলই।
ছেলের বিয়ে হলে গ্রামের লোকজন ধরতো আগের দিন দুপুরে খাওয়ানোর পাশাপাশি একটা যাত্রা/ নাটকের খরচ দিতে। যেমন যৌতুক তেমন আব্দার। গ্রামে তো সবাই জানে কত টাকা বা কতো ভরি সোনা বা জমি পাচ্ছে। দাবি, সেই অনুযায়ী।
বিয়ের আগের দিন দুপুরে গ্রামের লোককে ছেলের বাড়ির লোক মাংস ভাত, কুমড়ো মাংসের হাড়, টক ডাল দিয়ে পেট পুরে খাওয়াতো।
সাইফুল নামে একজনের বিয়ের আগের দিনে ভোজে অপূর্ব মাংস রান্না হয়েছিল। শুধু মাংস। আলুর মিশেল নেই। এতো নরম সুসিদ্ধ মাংস রান্না আজো জিভে জল আনে।
রাঁধুনির নাম আজ জানতে ইচ্ছে করে। পরিবেশক থাকতেন মোক্তারভাই। বিয়ে শাদি মওত --- সবেতে মোক্তারভাই, গুঁড়ুভাইদের টিম হাজির।
যেন নিজের ছেলে বা মেয়ের বিয়ে।
এতো ভালোবেসে সব কাজে হাত লাগাতেন।
রাঁধতেনও খুব ভালো। বাবুর্চিদের সে-সময় রান্নায় সে সময় এক কিলো মাংসে ৫০০ গ্রাম পেঁয়াজ দিতে দেখেছি। কী স্বাদ সে মাংসের। চম্পারণ মিট হার মানবে।
এখন গুঁড়ু ভাইয়ের ছেলে আবসার মামা, মামার ছেলেরা, ধূপো ভাইরা সেই দায়িত্ব স্বেচ্ছায় পালন করেন।
মোক্তারভাই বলতেন, এক হাঁড়ি হাড় কুমড়ো -- এক ফোঁটা রক্ত। বলতেন, আর দিতেন। সঙ্গে রসিকতা।
থালা ভর্তি করে হাড় কুমড়ো খেতাম। আমি নিজে দু থেকে তিন থালা হাড় মাংস খেতাম। কনের বাড়ি বিয়ের দিন কুমড়ো মাংস করা ছিল নিন্দার। সেখানে শুধু মাংস আলুর পদ। আলুও বেশিরভাগ জায়গায় থাকতো না। কুমড়োর ব্দলে কনেপক্ষ করতো ছোলার ডাল আর হাড়প্রধান মাংস দিয়ে হাড্ডি গোস্ত।
এখন নিজে রান্না করি-- কুমড়ো মাংসের সে স্বাদ পাই না। মুসলিমদের ৯৯% বিয়ে গ্রামে গরমকালে হতো তাই টক ডাল। একটা আবশ্যিক বিষয় ছিল। কবি জিয়াদ আলির কাছে শুনেছি, হাওড়ায় বিয়েতে কুমড়ো মাংস হতো। এবং জিয়াদদার ব্যাখ্যা, গরমকালে বিয়ের একটা বড় কারণ সস্তায় ভালো কুমড়ো ও গোরু পাওয়া যাবে। এছাড়া শতখানেক আত্মীয় তো কম করে বাইরে থেকে আসবে। থাকবে কোথায়? শীতকাল হলে মেলা ঝামেলা। কাঁথা কম্বল লেপ। গরমকালে সে ঝামেলা নেই। বাড়ির উঠোন, আঙ্গিনা বা এগনে, দাওয়া, বারান্দা থাকলে বারান্দা তালাই পেতে শুয়ে পড়। নাহলে শতরঞ্জি বা ত্রিপল তো আছেই। গোরুর গাড়ির উপরে শুতেও মজা। বিয়ের আগের রাত তো রান্নাবান্না মিষ্টির ভিয়েন দেখেই কেটে যেতো। ছটরা ছাড়া বাকিরা অনেকেই চোখের পাতা এক করতেন না।
নিমন্ত্রণ ছিল চার রকমের।
১. বাড়ি পিছু একজন
২. হাঁড় মানা (মানে হাঁড়ি চড়ানো মানা। সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যে সব খাবে)।
৩. হাজিস মজলিস (হাজির মজলিস, মানে বাবিতে অতিথি এলে তারও নিমন্ত্রণ)
৪. পছন্দ মতো। কোনো বাড়ির তিনজন কোনো বাড়ির দুজন বা একজন।
বাবা নেতা হওয়ায় নয়, খানদানি বাড়ি ও গ্রামীণ সম্পর্কের কারণে সব বিয়েতেই নিমন্ত্রণ জুটতো। গ্রামেই মামা মাসির বাড়ি। লতায় পাতায় প্রচুর আত্মীয়। মায়ের জ্যেঠতুতো বোনের নয় ছেলে। দুজন ছাড়া সবার বিয়েতে বরযাত্রী গেছি।
নিমন্ত্রণ ছিল অঢেল।
আর বাবার তো সব বাড়িতে নিমন্ত্রণ এবং বাড়তি দায়িত্ব। আমি ছিলাম ল্যাংবোট। হিন্দু মুসলিম ৩০০ বাড়ির সব বিয়েতেই গেছি।
মজার ব্যাপার হয়েছিল, একবার মিষ্টি কিনতে গিয়ে। বিয়ের আগের দিন সোনা/ পোশাক/ শাড়ি/ প্যান্ট পাঠাতে/ দিতে হতো। সঙ্গে মিষ্টির হাঁড়ি।
তা আমি আর আমার এক বন্ধু মিষ্টি কিনতে গেছি। সাইকেলে ফিরছি। ক্যানেলের ধারে এসে বন্ধু বলল, দাঁড়া দুটো মিষ্টি খাই। দুই বাড়ির মিষ্টি।
ধরা পড়ে যাবি তো।
চুপ। হাঁড়ির মুখের শালপাতা ফাঁক করে দু চারটে মিষ্টি খেলে কী বুঝবে। ওই তো হাঁড়ি খুলবে আর বালতিতে ঢালবে। তাছাড়া ভিয়েন বসেছে, ওই রসগোল্লা ছেড়ে এসব কে দেখবে?
শালপাতা ফাঁক হলো।
দুজনে খেতে খেতে সব শেষ। শুধু রসটুকু পড়ে।
বন্ধু বলল, তোর থেকে দু চারটে দে ভরে দিই। একবারে খালি দেওয়া ঠিক হবে না। একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, বিয়ের দিন বর বা কনের হাতে লোকের সামনে উপহার দেওয়ার অশ্লীল প্রথা ১৯৮২ পর্যন্ত আমার গ্রাম বাসকালে দেখিনি। যা হতো আগের দিন। স্কুলের শিক্ষকরা নিমন্ত্রিত থাকলে তাঁরা কেবল সেদিন উপহার নিয়ে আসতেন।
বিয়েতে তেমন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় না হলে বা বন্ধুবান্ধব হলে বই দেওয়ার খুব চল ছিল।
আসল ও নকল বিমল মিত্র, প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর ছিল খুব রমরমা। আরেকজন ছিলেন ফাল্গুনী। পুরো নাম মনে পড়ছে না। মনে পড়েছে, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়। সত্তর দশকে বামপন্থীরা বই উপহারে বৈচিত্র্য আনলেন। রাশিয়ান লেখক চেখভ, তলস্ত্ পুশকিন, তুর্গেনিভ, গোগল মায় ম্যাক্সিম গোর্কি ও মায়াকোভস্কি চলে এলেন। বাঙালি লেখকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ নজরুল, সুকান্তের কবিতার পাশাপাশি জায়গা করে নিলেন শঙ্খ ঘোষ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, রাম বসু , দীনেশ দাস। ঔপন্যাসিক হিসেবে শরৎচন্দ্র অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
আমি বই পড়তে ভালোবাসি জেনে লোকে আমাকে বই কেনার দায়িত্ব দিত।
আমি পছন্দ মতো বই কিনে আনতাম। পড়ে দিতাম বা পরে চেয়ে পড়তাম। কিছু বই ফেরৎ যেতো না। বলেই নিতাম। পড়তাম আর খুব কাঁদতাম।
ধৈর্য রাখতে না পেরে শেষ পাতায় গিয়ে দেখে নিতাম, নায়ক নায়িকার মিল হলো কি না। বর্ধমান শহরে প্রথম বর্ষে পড়ার সময় একবার বন্ধু কৌস্তভের দাদার বিয়েতে হলো ঘোর ঝামেলা।
বিয়েতে সব বন্ধুর নিমন্ত্রণ।
খেতে যাওয়ার আগে খেয়াল হলো উপহার কেনা হয়নি।
এদিকে দোকানপাট রাত নটায় বন্ধ হয়ে গেছে। আমি বললাম, আমার কাছে কয়েকটা নতুন বই আছে।
প্রথম পাতায় নাম লেখা। ছিঁড়ে ফেলা হল। তারপর লেখা হলো, গৌতমদার বিয়েতে। গৌতমদা ইঞ্জিনিয়ার।
বিয়ে শেষ। কদিন পর কৌস্তভ বলল, দাদা তোদের ডেকেছে। তুই একটু আগে যাবি।
আমি খুশি। আবার খাওয়াবে ঠিক। দিলদরিয়া লোক। ট্রেনের কামরায় দেখলেই খাওয়াতো।
এদিন দেখেই গৌতমদা তেড়ে মারতে এলো।
তোদের উপহার দিতে কে বলেছিল?
না মানে ১০-১২ জন খাবো। এক্কেবারে কিছু না দিয়ে।
ও তাই পড়া পুরানো বই?
কী করে বুঝলে?
ব্যাটা ভেতরের পাতায় তোর গোলাপী কালিতে কমেন্টস। বৌদি খুঁজছে টীকাদারকে।
বই খুলে দেখি পাতায় পাতায় মন্তব্য।
এরপর বই দেওয়ার আগে দেখে নিতাম টীকা দিয়েছি কিনা!
'উলু' যে আরবিয় প্রথা এটা সুকুমার সেনের বইয়ে পরে পড়েছি। তার আগে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে একটা লেবানিয় ছবি দেখি, সেখানে দেখি, বিয়ের নিবন্ধীকরণের জন্য বিরাট সারি। বাবা লেবানন ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। মেয়ে যাবে না। প্রেমিকের সঙ্গে থাকবে। প্রেমিক নাটক ও পার্টি পাগল মানুষ। সময় নেই আর। হয় বাবার সঙ্গে যেতে হবে নয় আজই বিয়ে করততে হবে। তাই বিমানবন্দরে যাওয়ার পথেই বিয়ের আয়োজন রাস্তায়। বন্ধুরা একজন নিবন্ধক বা রেজিস্ট্রারকে তুলে এনেছে সরস্বতী পূজার পুরোহিত অপহরণের কায়দায়। সেখানে দেখি, উলু দিচ্ছে বন্ধুবান্ধবরা।
পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে উলু নেই। বাঙালি হিন্দুদের বিয়েতে আছে।
বর এলে বা বিয়ে পড়ানোর সময় উলু দেওয়া হয়।
মুসলমানদের বিয়েতে গায়ে হলুদ অন্তত দুদিন আগে দেওয়া হয়। তিন দিনের দিন বিয়ে। আমাদের এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের বাড়িতে বিয়ের সময় গায়ে হলুদ একদিন। বিয়ের দিন।
ভোরে উঠে কাক পক্ষী ডাকার আগে সাত সধবা মহিলা কলসী বা ঘটে করে সাত পুকুরের জল নিয়ে আসবেন। এর নাম 'নিশিজল'। দুপুরে গায়ে হলুদের পর নিশিজল দিয়ে চান করবে বর বা কনে।
স্নানের আগে মাথায় ঢালা হবে তেল। সর্ষের তেল। একটা ছোট নোড়া দিয়ে গড়িয়ে সেই তেল পড়বে সিঁথিতে সেখানে ঠেকানো থাকে পান পাতা। সেই পাতা দিয়ে তেল পড়বে কুলোয়। কুলোয় রাখা থাকে চাল আর বিউলির ডাল। বর বা কনে তেল দিয়ে তা মাখাতে হয়। হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়েই এই রীতি।
গায়ে হলুদের আগে হিন্দু মুসলিম দুই বাড়িতে বর বা কনে পক্ষ থেকে তত্ত্ব আসে। তত্ত্ব নিয়ে আসা লোক হয় ধুরন্ধর। আসলে গোয়েন্দাও। বুঝে নিয়ে যায় আসল হালচাল। বন্দোবস্ত। নাপিতদের পাঠানো হতো বেশিরভাগ জায়গায়। মুসলমানদের বেলায় হাজাম। রঙ্গ রসিকতায় চাপান উতোরে এই লগ্নযাত্রীরা মাত করে দিতেন। বিকেল হলে মেয়ে বঊদের দল আসতো লগন দেখতে। কী কী দিয়েছে--কী কী দেয়নি তার বিদেন বা টীকা ও ব্যাখ্যান চলতো।
সাধারণত যা থাকতো-- গয়না ও গয়নার বাক্স, আয়না, চিরুনি একাধিক, পমেটম, স্নো পাউডার, পাউডার কেস, হিমানী বা আফগান স্নো-র ছিল কদর, লিপস্টিক, নানা ধরনের শাড়ি, বেনারসী, সায়া ব্লাউজ, ব্রা।
এই ব্রা কদিন পরেই হাঁড়ি কড়ায় মাজায় ব্যবহৃত হতো।
এছাড়া আত্মীয় স্বজনের জন্য শাড়ি ধুতি জামাকাপড় থাকতো। মাপ ও হিসেব আগেই দু পক্ষ দু পক্ষকে সরবরাহ করতো।
আর বিয়ের দিন বরপক্ষ কনে পক্ষকে জব্দ করতে বিশাল খাইয়ে লোক নিয়ে যেতো।
যাঁরা এক ঝুড়ি লুচি এক বালতি মাংস বা মিষ্টি সাবড়ে দিত। সে গল্প আরেকদিন।