পর্ব ৬২
আমাদের গ্রামে বা আশপাশের গ্রামে খুন জখম হতো না। তা বলে কি, হাতাহাতি হতো না? সে-ও বলার মত নয়। তবে তেড়ে যাওয়া, কুঁদে কুঁদে ছুটে আসা ছিল। ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ ছিল। মারপিটের উপক্রম হতো। বউ বেটিরা টেনে ধরত। আর দু’পক্ষই গজরাতো, ছাড় আমাকে দেখব ওর একদিন কী আমার একদিন। চাইলেই হাত ছাড়াতে পারত। কিন্তু ছাড়াত না। কিন্তু মুখে তর্জন গর্জন চলত। একবার এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে সেই আত্মীয়কে তাঁর বাড়িতে সম্পত্তি গত বিবাদে নিগৃহীত হতে দেখি ভাইদের হাতে। ছোট ভাই মেজভাই মিলে গলায় বসে যায়, বড়ভাইয়ের। বাড়িটি আমার খুব প্রিয় জায়গা ছিল। আমি তারপর থেকে আর যাই নি বাধ্য না হলে।
আমি তখন পঞ্চম শ্রেণি। ভাইদের বউদের মধ্যে ছিল খুব ভাব। কোনো বিবাদ ছিল না। বড়ভাই বিয়েতে বউয়ের মারফৎ ফারাজ পেয়ে ২০ বিঘা বেশি জমি ভোগ করতেন রাগ সেখানেই। বাপ ব্যাটার লাঠি নিয়ে রুখে দাঁড়ানো দেখেছি। কিন্তু রক্তারক্তি হতো না। আওয়াজ শুনলেই গ্রামের লোক হাজির হয়ে যেতেন।
তবে ১৯৭২-৭৫ গ্রামে বন্দুক নিয়ে শান্তিবাহিনীর টহল দেখেছি। আমাদের বৈঠকখানায় বসে আমার বাবার পার্টির লোকদের চোর অপবাদ দিয়ে পেটান দেখেছি। এক ব্যক্তি শারীরিক কারণে কুঁজো ছিলেন। তিনি শান্তি বাহিনীর ভয়ে মুরগির ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন। সেকালে বাঁশ ও মাটি দিয়ে চার পাঁচ ফুট উঁচু এবং আট বা দশ ফুট চওড়া করে হাঁস মুরগির ঘর বানানো হতো। হাঁস মুরগি ছাগল গোরু ছিল বহু মানুষের আয়ের ধারাবাহিক উৎস। জমিতে তো তখন একবার চাষ। বছরে তিন মাসের বেশি কাজ জোটে না। অনাহার অর্ধাহার শাক খেয়ে বাঁচা জীবন ৬০ শতাংশ মানুষের। তো মুরগির ঘর থেকে বের করে বেদম পেটান হয়, মানুষটিকে।
খুন হতো দামোদর নদীর ধারে (নদ) নতু কয়রাপুর বন্তির গ্রামে। একবার নাকি চারজন খুন হন সাইলেন্সর লাগান বন্দুকে। মাঠে কাজ করতে করতে খুন। সে বোধহয় ১৯৭৭-৭৮। তারপর গোটা থানা এলাকায় ৩০০ গ্রাম কোথাও খুন হয়নি। একটু ভুল হল, ১৯৮০ নাগাদ একজন গৃহবধূ খুন হন। স্ত্রী ছিলেন বয়সে বড়, কালো। একটু পুরুষালি বেশ লম্বা চেহারা। খুব খাটতে পারতেন। স্বামীর অভিযোগ, অন্য মেয়ে দেখিয়ে এই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাতে বর্ধমানে সিনেমা দেখে নূরপুর আর আউশাড়ার মাঝের মাঠে ছুরি মেরে খুন।
গ্রামের লোক স্বামীকে ধরে পিটিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করে পুলিশে তুলে দেন। সেই দেখেছিলাম, অমানুষিক মার। সহ্য করতে পারছিলাম না। মানুষটি ভাল ছিলেন। কী করে যে খুন করেছিলেন কে জানে!
আরেকটি খুন হয়। পাশের নূরপুর গ্রামে। নিজের জামাইবাবু খুন করেন। আমারই এক প্রিয় বন্ধু শুকুরকে। শুকুর অত্যন্ত ভদ্র শান্ত সুদর্শন ছেলে। বিধবা মা ও এক দিদি। ওই প্রথম আমাদের এলাকায় অগভীর নলকূপ বা সাবমার্শিবল বা মিনি ডিপ টিউবওয়েল আনে। ২০ বিঘা জমিতে দু’বার চাষ শুরু করে। সোনা ফলায় জমিতে। আমিও একসময় কলেজে পড়ার সময় ওই পথে ঝুঁকি। ভাল করে চাষ করতে হবে। মাস খানেক গ্রামে গিয়ে থাকি গরমের ছুটিতে। একজন হিতৈষী বললেন, চলো বালি খাদ লিজ নিই। তোমার তো অনেক চেনাজানা। হয়ে যাবে।
বালি খাদ? মানে তোলা মদ মারামারি? ওপথে নেই। তাই চাষে মন। কিন্তু রাজনীতি এমন টান দিয়েছে, ছাত্র রাজনীতি আমার কৃষক হওয়া হল না।
তবে শুকুর আমি আর নহিরের রাত জাগা স্বপ্নগুলো নাড়া দেয়। শুকুরের জমির ধানের রঙ হতো কালো সবুজ। আমার বাবাও যখন চাষে মন দিতেন ধানের রঙ হতো কালো সবুজ।
চাষি যে কতখানি কবি, চাষের সময় না গেলে বুঝবেন না। কালো সবুজ ধানের রঙ সব চাষির স্বপ্ন। ওই শুকুর এক রাতে পাশে শুয়ে থাকা জামাইবাবুর গুলিতে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল।
পর্ব ৬৩
কেন খুনোখুনি হতো না? আমি অনেক ভেবে দেখেছি, এর বড়ো কারণ গ্রামীণ ন্যায্য বিচার। এক পক্ষের ঝোল টেনে বিচার না করা। পার্টি গত বা দলগত হিসাব না মেনে বিচার করা। যতই গ্রামীণ জীবনে সালিশি ব্যবস্থাকে গাল দেওয়া হোক, সালিশি ব্যবস্থা আছে বলে, গ্রামের লোক মামলা হামলা করে ফতুর হয় নি। ১৯৯০-এর পর সবকিছুতেই পার্টি ঢুকে মুশকিল।
আমাদের গ্রামে হাকিম বা হেকিম সাহেব বলে একজন ছিলেন। জুরি বোর্ডের সদস্য। এক বিধবা ও তাঁর সন্তানদের অন্যায়ভাবে ঠকানোর বিরোধিতা করে ২৫০ বিঘা জমি খোয়ান ব্রিটিশ আমলে। রাতারাতি ৫০০ বিঘার আয়মাদার থেকে ২৫০ বিঘার মালিক হয়ে যান। ন্যায্য বিচার করে ২৫০ বিঘা জমি হারান। জমিদার ছিলেন বিধবার দেওর। দাদা মারা যাওয়ার পর সম্পত্তি গ্রাস করতে চান। জুরি বোর্ডে থেকে তিনি বিধবার পক্ষ নেন। ম্যাজিস্ট্রেট দারোগা বিক্রি হয়ে যান। হেরে যান বিধবা। হেকিম সাহেবও। তাঁর সম্পর্কে কথা ছিল, হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। তাঁদের সময়েই গ্রামে যাত্রার শুরু। ফতে চৌধুরী ও তিনি গাঁয়ের বড় খুঁটি।
গ্রামে কলেরা ঠেকাতে হিন্দু মুসলমান মিলে ওলাই চণ্ডী পূজা চালু এবং তাঁকে ঘিরে যাত্রা ১৩২০-এর বানের পর।
হাকিম সাহেবের মৃত্যুর পর গ্রামের মানুষ স্মরণ নিলেন তাঁর বিধবা স্ত্রী নবিসন বিবি। তাঁর তামাক খাওয়ার প্রসিদ্ধি ছিল এবং দাপটের। ছোটো জমায়েত হলে সদর দরজার এপাশে বসতেন। মাঝে পর্দা।
বড় বিচার হলে, মানে বেশি মানুষ হলে দলিজ/ খানকাহ/ বৈঠকখানা ঘরে। চিকের পর্দার আড়ালে। বিচারে দু’পক্ষকেই হাত মেলাতে বলতেন। বলতেন, বলো, আমার ব্যবহারে দুঃখ পেলে মাফ করে দাও। একপেশে বিচার ছিল না। ফলে ক্ষোভ থেকে মারামারিও ছিল না।
স্বামী নেই। ছেলে কলকাতায় চাকরি করতে গিয়ে বন্ধুর চক্রান্তে বিষপানে শেষ। ভাইপোকে আশ্রয় করেছেন। হেকিম সাহেবের আত্মীয়ার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ভিটে ভাগ রুখেছেন। ভাইপোও নাটক যাত্রার নেশায় মশগুল। মদ ও শুয়োরের মাংস দেদার চলে। লিভার পচে/ যক্ষ্মায় মারা গেলেন। ৪২ বছর বয়সে।
নিজের ছেলের বউ পরমা সুন্দরী। মাত্র ১৬ বছর বয়স। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এক সৎ সুদর্শন মৌলানার সঙ্গে বিয়ে দিলেন খরচাপাতি করে। তিন বিঘা আয়তনের এক বাকুলে এক বিধবা প্রৌঢ়া এক বিধবা ভাইপো বধূ ও এবং ভাইপো বধূর দুই নাবালক ছেলে মেয়ে নিয়ে বাস। ছেলের বয়স ছয় মেয়ের ছয় মাস।
কোনো পুরুষ মানুষ নেই। জমিজমা সামলানো বিচার নিজের প্রজাদের প্রতিদ্বন্দ্বী আয়মাদারের শত্রুতার হাত থেকে রক্ষা। দুরন্ত নাতিকে সামলান শিক্ষার ব্যবস্থা, দুধের শিশুর মা চলে গেছে। তাঁর বাপ মা নিয়ে গেছেন বিয়ে দেবেন বলে। বাধা দেননি। তাঁরও তো ভবিষ্যৎ আছে। এই নবিসন বিবি নিজের পাতের ভাত তুলে দিতেন ভিখারিকে।
নাতির বিয়ের পর নাতবউকে বলেছিলেন, না খাওয়া লোক এলে নিজের খাবার দেবে। খাবার খাওয়া হয়ে গেলে পারলে রেঁধে দেবে। উপায় না থাকলে মুড়ি গুড় দুধ দেবে। খেয়ে যেন ভিক্ষা চেয়ে বা দুপুরে এলে না খেয়ে না যায়।
আজীবন দেখে এসেছি, আমাদের বাড়িতে দু-তিনজনের চাল বেশি নেওয়া হতো। বড় বাড়ি, নাত বৌকে বলেছিলেন, আমার শখ কী জানিস। ঘর গমগম করবে। পাঁচ ছেলে পাঁচ মেয়ে নিবি। মেয়েদের পড়ালেখা শেখাবি। দানধ্যান মিল মহব্বত শেখাবি।
হিন্দু মুসলমান ছোট বড় উঁচু নিচু দেখবি না। আমাদের বাড়িতে গৃহ সহায়িকা ছিলেন একাধিক মুসলিম নারীর সঙ্গে এক চর্মকার বা মুচির মেয়ে। বাগদি সাঁওতাল মুসলিম কিষান ছিল। ফলে মানুষ হয়েছি মিলেমিশে। জাতি ধর্মভেদ না শিখে।
নেপাল ধাউড়ে, টগর ভাই, লালু সরেন সোম বচ্ছরের কিষান। আর গৃহ সহায়িকা মুক্তো খালা/ রমিসাবুববু, সঙ্গে লক্ষ্মী বৌদি। রোজ আসতো মুংলা দিদি বা মঙ্গলা সরেন দিদি। আমার মাকে মা বাবাকে বাবা বলত।
এদের শিক্ষাই আমার শিক্ষা।
জীবনের পাঠশালায় শিখে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছে আমার গ্রাম, আমাদের পরিবার।