পয়লা বৈশাখ আসতো হালখাতার হাত ধরে। পয়লা বৈশাখ মানে নতুন জামা পরা, এমন কিছু ছিল না।
তবে চৈত্র সেল ছিল। মায়ের ঠেলাঠেলিতে বাবা মা বর্ধমান শহরে গিয়ে নতুন জামা কাপড় কিনে আনতেন। তখন একটা শব্দ চালু ছিল, রিবেট।
পয়লা বৈশাখের আগেরদিন চৈত্র সংক্রান্তি বা চৈত সংক্কান্তি। সেদিন বছর শেষ। স্কুল ছুটি। গাজনের বাজনা বাজছে কদিন ধরেই। সন্ন্যাসী হয়েছেন গন্তা বেনে। তিনিই শিবপূজারী। সঙ্গে থাকেন মুচিপাড়া/ দাসপাড়ার কয়েকজন পুরুষ। দন্ডি কাটা ঝাঁপ ইত্যাদি হয়। ওইদিন ডাব ছোঁড়াছুঁড়ি। ছোটদের দেখেই আনন্দ। ক্ষমতা নেই ডাব দখলের লড়াইয়ের। তবে পরদিন পাশের দুই দিকের বাজার সেহারা পলাশনে মুদি দোকান, ধানের খটি ও ধান আলুর ওষুধ এবং সারের দোকানে হালখাতা।
বাবার সাইকেলে চড়ে গেছি।
এ-দোকান সে-দোকান ঘোরাঘুরি। কোথাও লেবু জলের শরবত, কোথাও রঙিন পানি।
চা তেমন নেই। আজ শরবত আর মিষ্টির দিন।
বসিয়ে খাওয়ানো কম।
প্যাকেট প্রথা আর ক্যালেন্ডার দেওয়া।
ক্যালেন্ডার হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের কথা মাথায় রেখেই। কাবা শরিফ আছে আর বাবা শিব কিংবা লক্ষ্মী। বাকি দেব-দেবী অন্তত আমাদের এলাকায় পাত্তা পেতেন না।
গণেশ তখন ব্যবসায় লালবাতি জ্বলার প্রতীক।
সবচেয়ে বেশি যে ক্যালেন্ডার হতো তাতে থাকতে কাজী নজরুল ইসলামের ছবি। আর লেখা --ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি? ১৯৭৬ পর্যন্ত কবি বেঁচে।
রবীন্দ্রনাথ কম। রাজনৈতিক নেতাদের ছবি ছিল না।
একমাত্র নেতাজী।
তাও বাঁধা ছবি ঘোড়ায় চড়া নেতাজী।
ডায়েরি দিতে দেখিনি।
যদিও বাবা সমেত গ্রামের মানুষদের গুপ্ত প্রেসের ডায়েরি ব্যবহার করতে দেখেছি। তা কিছুদিন পরেই ছিঁড়ে যেত অল্প। প্রখ্যাত লেখক ও প্রশাসক আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেছি এখনো গুপ্ত প্রেসের দিনপঞ্জি ব্যবহার করেন।
বাবাদের পাঞ্জাবীর বুক পকেটে কলম, চশমা আর ডায়েরি।
ছোট।
আর কাঁধে থাকতো ব্যাগ।
রঙ দিয়ে তখন দল চেনা হতো না।
কংগ্রেসের লোকও লাল ব্যাগ ব্যবহার করতেন আর লাল পার্টির মানুষ সবুজ।
সবুজ রঙের আর্টেক্স কলম তো ঘরে ঘরে।
আমাদের গ্রামে হালখাতা হতো দুটি জায়গায় এক দুগোদার দোকানে। বয়স্করা বলতেন মতিলালের দোকান। একটু বড়রা দুগো কলুর দোকান। আমরা দুগোদার দোকান। দুগোদার বাপও দাদা, দুগোদাও দাদা। সবার দাদা বাপ ব্যাটা।
আমপাতা দিয়ে সাজানো হতো। লাগানো হতো কাগজ কেটে বানানো শিকলি।
আর হতো ছোটমামার ডাক্তারখানায়।
আমরা ছোটরা কাগজ কেটে শিকলি বানাতাম।
ছোটমামা পেশায় শিক্ষক। নেশায় চিকিৎসক। প্রথমে ছাতু ডাক্তারের কম্পাউন্ডারি পরে বর্ধমানের বড় ডাক্তারদের সঙ্গ করে মামার নাম বাক হয়।
আমাদের গ্রামেই মামার বাড়ি।
মামা লম্বা টুকটুকে ফর্সা। বড়ভাই কংগ্রেসের বড়নেতা। ছোটভাই প্রবল সিপিএম। কিন্তু বড়ভায়ের বিরুদ্ধে কোনো কথা কোনোদিন বলেননি।
ছোটমামার ঘরেও আমপাতার গেট। শিকলি ঝোলানো। শুধু মঙ্গল ঘট নেই।
আর সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন নেই। বাকি সব এক।
আমপাতার হিন্দু মুসলমান হয়নি, হালখাতারও।
গ্রামের দোকানে ক্যালেন্ডার দিত না। কিন্তু বোঁদে জুটতো সবার।
একটু খেয়ে একটু প্যাকেটে নিয়ে।
গ্রীষ্মই একজন গ্রামীণ শিশু ও বালককে স্বাধীন হতে শেখায়। সে শিখে যায় আইসক্রিমওয়ালার পিছু পিছু হেঁটে যেতে। শিখে যায় দরদাম। পয়সা না আছে তো কী? বাড়ির খাটের তলায় শুয়ে আছে বালিশয্যায় শত শত আলু। তার থেকে দু তিনটি গেলে জিভ আত্মা ও জীবাত্মা পরিতৃপ্ত হয়।
আইসক্রিমওয়ালা চারটে আলুতে একটা আইসক্রিম বললে, সে বলতে শিখে যায়, তিনটে দেবো, দেবে তো দাও।
তার সাবালকত্ব আসে,
আম গাছে গুলতি বা ঢিল মেরে আম পেড়ে, খেজুর গাছে চড়ে খেজুর পেড়ে, এবং বলাই বাহুল্য, দুপুরে খররোদে সবাই যখন ঘুমের অতলে, তখন ঘুমানোর ভান করে পড়ে থেকে পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়া নিঝঝুম গ্রাম ভ্রমণে।
একটু পরে বলছি,এই ভ্রমণে এক বিপদের কথা।
তার আগে আরো আছে পাঠ।
শীতে সে গায়ে জল ঠেকাতে চাইতো না, গ্রীষ্মে পুকুরে আমরা সবাই রাজা, জলের রাজত্বে।
এই দেখুন, শহুরে হাওয়া লেগেছে, গ্রীষ্ম গ্রীষ্ম করছি। আরে ওর আসল আদি অকৃত্রিম নাম তো, গরমকাল। ছুটির নাম গরমের ছুটি। সামার জানতাম সামার ভ্যাকেশন নাগরিক ব্যাপার। কলকাতায় শুনছি। গরমকালে চৈত মাস পড়তে না পড়তে শুরু হয়ে যায় সকালের ইশকুল। সকালের না মন্নিং স্কুল। পোশাকি নাম মর্নিং তো জানে না, তার আর আর নাই।
মন্নিং স্কুল ভারি মজা। ছটায় স্কুল। টিফিন আধ ঘন্টা নয়, পনের মিনিট। আর ওই পনের মিনিটেই কত মজা। আধঘন্টা টিফিন মানে বাড়িতে ভাত খেতে আসা। বাড়ির কাছেই স্কুল। প্রাথমিক বিদ্যালয় আমাদের পূর্বপুরুষদের দেওয়া জায়গায়। পুকুরের এপার ওপার। দু মিনিটও নয়। মন্নিং ইশকুলে টিফিন নিয়ে যাই সবাই। টিফিন মানে মুড়ি গুড়/ বাতাসা বা চিনি। মাঝেমধ্যে আলুভাজা জিরে দিয়ে। কখনো বেসনের বড়া। ও জল দিয়ে মেখে খেতে কী মজা।
আর গাওয়া ঘি দিয়ে দিলে তো চিনি দিয়ে কথাই নেই।
বাবলু মুঠো মুঠো চিনি খেতো। প্যান্টের দু পকেট ভরে আনতো। একবার ওর মুখে দাদ হলো, তো আমরাও কয়েকজন বাকি থাকি কেন? চিনি চিনে নিয়ে দাদ নিল। আর ছিল খেজুর খাওয়া। ভোরে উঠে খেজুর গাছতলায় ছোটো। এর সঙ্গে কুশি কুশি আম।
কারো ব্যাগে আছে ঝিনুক। কেউ এনেছে নুন লঙ্কা বেটে। আমের ঝক্কাস নুনলঙ্কা সোহাগ। একজন ছিল ব্রাহ্মণ সন্তান। সদ্য উপনয়ন হয়েছে। ক্লাস টুতেই যজমান জুটেছে। এক বন্ধুর মা চুল দিয়ে তার পা মুছিয়ে দিয়েছে। বন্ধু কিছু বলে নি, ইশকুলে ছুতোনাতায় মার। এবং স্যারের কাছে নালিশ। কিন্তু কোনো সাক্ষী নাই।
কেউ তো দেখেই নি। কখন কে কী করেছে!
বেচারির মা বলে দিয়েছেন, এই এঁটোকাঁটা খাবি নে।
খেজুর গাছে চড়ায় ওস্তাদের শর্ত আমি জিভে ঠেকিয়ে তবে দেব।
নে কী করে?
কত কত খেজুর গাছ।
তাঁদের নিয়ে কত কত প্রবাদ।
কত ধরনের স্বাদ। বিশেষ করে খাজা খেজুর তো আর ছাড়া যায় না। তো খেল সে। খালি বলল, কাউকে বলিস নি যেন।
বিশ্বাস করুন, ৩৭ জন ছেলে মেয়ে ছিল ক্লাশে কখনো বাইরে বলেনি।
কিন্তু কিছু কথা কি আর গোপন থাকে। তবে সে দোষ আমের কুশির। আম তো ছালসমেত নুনঝালে জাড়িয়ে খেয়ে নেওয়া হল, ইটে ঠুকে ঠুকে। কিন্তু কুশি কী করে? কুশিকে খুশি করতে দেওয়ালে নাম লেখা হল। আর এর ফল তো বুঝতেই পারছেন। সেকালে বাবা-মায়ের দল তো এত ভালো ছিলেন না, তাই মাস্টারমশাইদের দেখলেই একটা রেকর্ড বাজাতেন, সবার এক সংলাপ, হুবহু এক-- ভালো করে ঠেঙাবেন, তবে যদি মানুষ হয়।
বড় নয়, মানুষ--এই একটাই সান্ত্বনা।
কিন্তু মানুষ হতে গেলে মার খেতে হবে কেন?
গরমের রোদের কত কত রঙ। ভোরে এক, বেলা নটায় আরেক, স্কুলে ছুটির ঘন্টার সময় রোদ তো ফুরফুরে বসন্ত পরিধান।
ছোট ছোট ছোট। ঘরে যাও। ভাত আলুভর্তা আলু সেদ্ধ সাঁটাও। প্যান্ট গামছা নাও--পুকুরে ঝাঁপাও।
সাঁতার জানো না-- আরে কত কত ট্রেনার। দুজন হাত ধরবে দুজন বলবে, ঠ্যাং ছোঁড় ঠ্যাং।
কদিনেই পাক্কা জলবাজ হয়ে উঠবে। কলাগাছের ভেলায় চড়বে। ঘাট বানানোর কাঠ খুলে নিয়ে ভেলা বানাবে। জলদস্যুদের সঙ্গে লড়াই হবে। হাতে অস্ত্র কঞ্চির আদি অকৃত্রিম লাঠি।
জলে থেকে থেকে মুখে শ্যাওলা দেখা দেবে।
এবং এক এক করে, মায়েদের আবির্ভাব ঘটবে।
মুখে এক বুলি, উঠে আয় বলছি। তোর একদিন কী আমার একদিন।
মা, আর মাত্র পাঁচ মিনিট।
ভালো মানুষ মা ভুললেই পাঁচ মিনিট পঁচিশ। কিছু কিছু মায়ের হয়তো নিজেদের মধ্যে কথা নেই, কিন্তু পুকুরঘাটে এসে ঐক্যবদ্ধ।
হাড়মাস জ্বালিয়ে খেলে গো, যেমন বাপ তেমন বেটা।
এখন সনাতনপন্থী মৌলবাদীরা কী করবেন জানি না, বেটিরাও থাকতেন পুকুরে।
কেউ কেউ ডুব সাঁতার বা সাঁতারে ছেলেদের নাক কেটে দিতে পারতেন। জলের একটা খেলার কথা বলেছি, ঝালঝাপটা।
আরেকটা বলি, লুকোচুরি।
জলের মধ্যে চলতো খেলা।
একবার এই খেলায় একজন ছেলে বড়দের মতো আচরণ করতে গিয়ে বাদ হয়ে গেল, মেয়েদের সমবেত আপত্তিতে।
সেকালে ছেলে মেয়েরা একসঙ্গেই খেলতো। ১২ বছর বয়স পর্যন্ত ফুটবল, ক্রিকেট, বুড়ি বসন্তি, চু কিৎ কিৎ, এমনকি কবাডিও খেলতো।
এখন বুঝি, ঋতুমতী হওয়ার পর মেয়েদের সামনে নিষেধের বোর্ড স্থায়ী হয়ে যেত।