পর্ব ৩৬
জীবনে 'বর্ণপরিচয়' আর ধারাপাত ছাড়া যে বইটির সঙ্গে আমার পরিচয়, তার নাম জেনেছি, পড়েছি, কিন্তু বিন্দু বিসর্গ বুঝিনি, তার নাম, 'রাষ্ট্র ও বিপ্লব'। বইটির সঙ্গে পরিচয়ের একটা অদ্ভুত ইতিহাস আছে। সত্তর দশক। কমিউনিস্ট পার্টি করার অপরাধে বাবা ঘর ছাড়া গ্রাম ছাড়া। তো বাড়িতে প্রায়ই তল্লাশি চালাতে আসত পুলিশ। আসলে তৎকালীন শাসক দলের স্থানীয় নেতার চাপে এই প্রতিহিংসামূলক আচরণ। কিছুই পেত না। তাও আসত। আর দেখা মিলত ইদানীং জাতে ওঠা সিআরপি বা কেন্দ্রীয় বাহিনী। আমাদের বাড়ির উঠোনের রান্নার চুলো গুলোতে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে বোমা বন্দুক খুঁজত। এবং আগে বলেছি, যাওয়ার সময় মাঠকোটা ঘরের দোতলায় থাকা দাদুর মদের নানা ধরনের দু-একটা গ্লাস নিয়ে পালাত। একবার আমার মা, খুবই সুন্দরী ছিলেন, তখন ৩২-৩৩ বয়স বড় হেঁসো ধরে বলেছিলেন, ঘরে বোমা বন্দুক কিছুই নাই, আবার এলে হেঁসো দিয়ে দু-একটার গলা কেটে মেরে তবে মরবো। তারপর থেকে আর সিআরপি বা এখন ভালোবাসার কেন্দ্রীয় বাহিনী ঘরে ঢুকত না।
আমার বড়মামা ছিলেন কংগ্রেসি। স্থানীয় নেতার বিরুদ্ধ গোষ্ঠী। তিনিও এসে হাজির হন। মা তাঁকে বলেন, এই তোদের দলের গান্ধীবাদী অহিংসার নমুনা। বড়মামা মাকে খুব সম্মান করতেন। পরে দলের উপরতলার নেতাদের কিছু বলেন। সিআরপি অত্যাচার বাড়ির খামার পর্যন্ত হয়। যাক,বইয়ের কথায় ফিরি।
আমাদের থানায় সত্তর দশকে সমর মুখোপাধ্যায় বলে এক বড় দারোগা চাকরি করতে আসেন। তিনি নাকি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। তোতলামি থাকায় ছেলে মেয়েরা হাসাহাসি করত। চাকরি ছেড়ে দেন। দিয়ে পুলিশে ঢোকেন। দারোগা হন। তাঁকে নিয়ে প্রচুর মজার গল্প ছিল। একবার সিরাজ বলে এক লড়াকু সিপিএম নেতাকে জমির মাঝ বরাবর তিন কিলোমিটার ছুটে ধরে ছিলেন। ধরে, খুব পেটান। সমরবাবু কমিউনিস্টদের দরদী ছিলেন। সিরাজ চাচাকে বলেন, তোদের কাউকে আমি পেটাই না। তোকে রামধোলাই দিচ্ছি। কেন বলত? কেন? সিরাজ চাচার প্রশ্ন। তুই না কমিউনিস্ট। কাঁধে পাইপগান নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিস। আমাকে একটা গুলি করতে পারলি না।
তো, সমরবাবু তল্লাশিতে এসেছেন। বাবা তাস দাবা ক্যারম এইসব প্রতিযোগিতায় প্রচুর পুরস্কার পেতেন। সেকালে পুরস্কার হিসেবে টর্চ দেওয়ার রীতি ছিল। অনেক টর্চ। একটা পাঁচ সেল টর্চ দেখিয়ে বললেন, এটা কী করা হয়? সিগন্যাল দিতে? মার ছিল চোখা জবাব, কংগ্রেসের এত ডাকাত, সেই ডাকাত রুখতেও তো টর্চ দরকার। সমরবাবু হেসে ফেলেন। মা বলেন, যারা আসল অপরাধী তাদের না ধরে ভাল লোকদের পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! আপনি তো শিক্ষিত লোক। আপনার খারাপ লাগে না! সমরবাবু জবাব দেন, চাকরির দায় মা। চাকরিটাই এমন, ক্ষমতার লোক যা বলে। তবে সমরবাবু একটু ব্যতিক্রমী ছিলেন।
আমাদের শোবার ঘরে তল্লাশি চলছে। আমাদের ঘরে একটা বড় রেডিও ছিল। সেটা দেখিয়ে বললেন, ও পিকিং রেডিও শোনা হয়। পিকিং শব্দটি সেই প্রথম কর্ণগোচর। এটা বলেই ঘাঁটতে লাগলেন বই, একটা বই পেয়ে বাকি পুলিশদের আড়াল করে বললেন, এই বাড়িতে এতবড় রেডিও অনেক কিছু পাওয়া যাবে। যাও ভালো করে সার্চ কর। বাকি পুলিশরা বের হয়ে যেতেই একটা লাল রঙের মলাট-ওয়ালা বই জামার বোতাম খুলে ভেতরে ভরে নিলেন। বানান করে পড়ে দেখি, 'রাষ্ট্র ও বিপ্লব'। ভ ই লেনিন। এই বই পেলে তো কেস দিতেই হয়। সমরবাবু আড়াল করলেন বইটিকে।
এরপর আমাদের বাড়িতে বহু বই আমি পাই, যার মলাট ছিল না। ছেঁড়া। সে-রকম একটা বই পড়ি। বইটার নাম জানতে আরো আট বছর লাগে। ম্যাক্সিম গোর্কির 'মা'।
পর্ব ৩৭
আজ বাংলা কালপঞ্জি অনুযায়ী ১৬ অগ্রহায়ণ। আর্যরা দিনপঞ্জির হিসেব জানত না, বুঝত না। তাদের কাছে দুটি পর্ব। ছয় মাস ছয় মাস করে। একটি অগ্রহায়ণ। এই অগ্রহায়ণ বাংলায় অঘ্রাণ। এখনো গ্রাম-বাংলা বাংলা দিনপঞ্জি মেনে চলে। অঘ্রানে হয় নবান্ন। নবান্নের পর কোথাও কোথাও ধান পেকে ওঠে। যেসব জমিতে আলু সরষে বোনা হবে সেখানে লাগান হত আইআরএইট বা আইরেট ধান। তাড়াতাড়ি পেকে ওঠে। এবং আশ্বিন কার্তিক মাস কলকাতার নবকৃষ্ণ দেববাবুদের কাছে অকাল উৎসবের দিন হলেও গ্রামে হাহাকার পর্ব। মাঠে কাজ নেই। ঘরে ধান নেই চাল নেই। আটা নেই। সুদখোর মহাজনের কাছে বাঁধা দেবে এমন সোনা রুপো এমনকি কাঁসা পিতলের বাসনকোসন নেই। ছেলের ভুজনো, বা অন্নপ্রাশনে পাওয়া উপহারও চলে যেত মহাজনের গর্ভে। বউ চেঁচাত। হাত থেকে খোলার সময় ছেলে। ভুজনো খুব কম বাড়িতেই হত। হলেও ছেলের। মেয়ে তো অনেক বাড়িতেই বালাই। তাঁদের আবার ভুজনো। মুসলিম সম্পন্ন বাড়িতে আকিকা হত। ভুজনোর মত। সেখানে এত বাছ-বিচার আমাদের গাঁয়ে ছিল না। তবু মেয়েরা ছিল সাধারণভাবে মেয়েছেলে। তাঁদের অত কথা কী? এই ছিল সাধারণভাবে ধারণা। বিচার আচারে তাঁদের ঠাঁই আড়ালে। উনিশ শতকে সত্তর আশির দশকে মহিলা সমিতির দাপট নেই। মহিলা বিচার-কর্ত্রী নেই।
কিন্তু খিদের জ্বালা বড় জ্বালা মেয়েরাই ধার করতে বের হত। বরেরা অপারগ হলে। আমাদের বাড়িতে ১৫-২০ জন প্রার্থীকে মাঝে মাঝেই দেখা যেত। একটু চাল একটু আটা-প্রার্থনা।
অঘ্রাণের ১০ তারিখে গাঁয়ের ধারের জমিগুলোর ধান পাকত। সম্পন্ন চাষিদের মড়াই তখন ফাঁকা। পরস্পরের খাতিরের জমিতে বোরা বা বস্তা নিয়ে দাঁড়াত মনিব এবং তার মুনিষ। জমিতেই কেটে ঝেড়ে বিলি। পৌষ না আসা পর্যন্ত এমন চলত। সমস্যা তৈরি করত বাদল-ই। তথা টানা বৃষ্টি। এখন যাকে শহরের লোক মিডিয়ার কল্যাণে নিম্নচাপ বলে ডাকে।
বাচ্চাদের বৃষ্টির পানি জলে আনন্দ হলেও বাবা কাকাদের মুখ যেত শুকিয়ে। বৃষ্টি না থামলে মাঠের ধান মাঠেই রয়ে যাবে। সোম-বচ্ছর খাবে কি পোলা পান? আশ্বিনের ঝড়ের ক্ষতির চেয়ে অঘ্রাণ পৌষের বৃষ্টি ছিল কালান্তক।
এখনো গাঁয়ের অর্থনীতি পঞ্চায়েত, ১০০ দিনের কাজ, দু"টাকা কেজি চাল, হিল্লি দিল্লি কলকাতা সুরাট কাজ করতে যাওয়ায় অভাব কমেছে। আমার গাঁয়ে। কিন্তু সব জায়গায় তো এমন দশা নয়। এই নিম্নচাপ যাকে ডাকা হচ্ছে জাওয়াদ নামে তার বৃষ্টি কোন সর্বনাশ ডেকে আনবে কে জানে?