কলকাতায় বলে ইফতার, গ্রাম বাংলায়, বিশেষ করে বর্ধমান বলে এফতার। 'ফ' থাকতো না 'প' এপতার হয়ে যেতো। ইপ্তারি কথাটাও বেশ চালু ছিল।
আমাদের জন্মের সময় গ্রামে মসজিদ ছিল না। পাশের গ্রাম উদগড়ায় একটা মক্তব খাড়া হয়েছিল। আদমপুর থেকে উঠে আসা মানুষরা ওখানে থাকতেন বলে পাড়ার নাম হয়েছিল আদমপুর। এখন লোকে বলে কয়েতপাড়া। কয়েতবেল গাছের নাম থেকে নাম। মজার বিষয়, বেশিরভাগ পাড়ার দু খানা নাম থাকতো। যেমন চাঁড়ালপাড়া/ দিঘিরপাড়া, বাগদিপাড়া/ রসপুকুর, দখিনপাড়া/ উদগড়া, সাঁওতালপাড়া/ খাবড়িগড়, উত্তর চাঁড়াল পাড়া/ পণ্ডিতপাড়া, মুচিপাড়া/ দাসপাড়া, মল্লিকপাড়া/ পাঠানতলা, বামুনপাড়া/ বেনেপাড়া, কাছারিপাড়া/ বারোয়ারিতলা।
ভালো নামগুলো বাবার মতো বামপন্থীরা বলতেন।
এখন সবাই বলেন।
জাতি নাম আর নেই। শুধু বামুনপাড়া রয়ে গেছে।
বামপন্থীদের সচেতন প্রয়াসে জাতনাম ধরে ডাকা উঠে গেছে।
গ্রামে মসজিদ সত্তর দশকে। তখন আমরা স্কুলে পড়ি। চোখের সামনে দেওয়াল হতে দেখেছি। ভিত গড়ার সময় হাজির ছিলেন গ্রামের একমাত্র মন্দির শিবমন্দিরের পূজারী গন্তা বেনেসহ বহু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।
আমার বাবা যৌবনে মধ্য যৌবনে ছিলেন ঘোরতর নাস্তিক। ইদ বকরিদের নামাজ পড়তেন। সত্তর দশকে রাজনৈতিক কারণে গ্রাম ছাড়া হয়ে তাবলিগ জামায়াতের সঙ্গে তিন চিল্লা বা তিন চল্লিশ অর্থাৎ ১২০ দিন ঘুরে এসে আবার নাস্তিক হয়ে গেলেন।
রোজা রাখতেন না। কিন্তু এফতার বা ইপ্তার বা এপ্তারি হতো।
দাদি আর মা রোজা রাখতেন। শেষ জীবনে মা উল্টো। মা রাখতেন না।
যাক, বাবা রোজা না রাখেন ইপ্তারি/ ইফতারি করতেন ঘটা করে।
দলিজে বসতো ইফতারি।
ইফতার পার্টি কথাটা তো এই বছর পনের শিখলাম। কলকাতায় মাঝে মাঝে নিমন্ত্রণ জোটে। মাঝে জোটে না। সেখানেই অবশ্য শেখা নয়, ইফতার পার্টি বাজপেয়ি ঘটা করে করতেন। তারপর এ-বাংলায় এলো।
এই ইফতারি ঘিরে বাড়িতে সাজো সাজো রব। রোজাদার দুজন। খাইয়ে তো বিশ পঁচিশ জন।
আমরা ভাই-বোনরা ছাড়া বাবার ১০-১২ আছেন।
আছেন গৃহসহায়িকা, বারো মাসের কিরসেন ( কৃষাণ), বাগাল ( গোরু ছাগল চরানোর বালক)।
তবে ছোটোরা সবটা ফ্রিতে সারতাম এমন নয়। পয়লা রোজা ও সাতাশে রোজা রাখা হতো। বলা ভালো রাখার চেষ্টা হতো।
প্রথম রোজা আর সাতাশে রোজা রাখার খুব ধূম ছিল। দারুণ খাওয়া দাওয়া। মানে ইফতার।
ছোটো বেলায় কয়েকবার রোজা রাখার চেষ্টা করেছি, খুব সফল হই নি। মনে হতো এই বুঝি থুতু গিলে ফেলেছি।
একবার ২৭ রোজার দিন বেলা তিনটা পর্যন্ত ভালোই কাটিয়ে দিলাম। আর কাটে না।
তো মাটির বাড়িতে কড়ি বর্গা থাকে।
আমাদের পুরানো বাড়িতে কড়ি বরগার উপরে কাঠ দিয়ে বই রাখা থাকতো।
তো আমি তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। গল্পের বই পড়তে উঠে পড়লাম।
প্রথম পাতা ছেঁড়া। বইয়ের নাম নেই। তখন পুলিশের ভয়ে রাশিয়ান বইগুলোর লাল মলাট ছিঁড়ে রাখা হতো। পড়ছি।
একটা লাইন খুব মনে ধরে গেল,
ঝড় ও ঝঞ্ঝা মৃত্যু তুফানে আমার হৃদয় সদা তোমাতেই বিশ্বস্ত।
আমি আমার বেসুরো গলায় গাইতে শুরু করলাম।
করেই খেয়াল হলো, আরে গান গাইলে যদি রোজা ভেঙ্গে যায়।
মন খারাপ।
এমন সময় চোখ গেল টাঙানো শিকের দিকে।
সেখানে খাবার।
না খাব না!
বলি মনকে।
হঠাৎ দেখি, হরলিক্সের শিশি।
হরলিক্স শুকনো হাতের পাতায় রেখে চেটে খেতে যা মজা, খেয়ে ফেললাম।
খেয়ে তো ফেলেছি।
রোজা তো ভাঙা।
না বললে, গুনা/ পাপ। বললে, হরলিক্স চুরির দায়।
তা শেষে বলেই ফেললাম।
মা বলল, তুই যে বেলা চারটে পর্যন্ত রেখেছিস, এই অনেক। এতেই খুদা সন্তুষ্ট।
আমি খিদে সইতে পারতাম না।
তাই ক্ষুধিতের যন্ত্রণা বুঝি।
শহরের ইফতারে যা থাকে:
১. আদা কুচি, নুন
২. লেবু
৩. কলওয়ালা ছোলা, মুড়ি
৪. ছোলা পসন্দ ( সিদ্ধ ছোলা ভাজি পেঁয়াজ আদা লঙ্কা গোলমরিচ দিয়ে)
৫. রূহ আফজা শরবত/ আমপোড়া শরবত
৬. মুর্গ হালিম
৭. ফিরনি
৮. নানা রকম মিষ্টি
৯. তরমুজ
১০. শসা
১১. পেয়ারা
১২. কলা
১৩. আপেল
১৪. বেদানা
১৫. খেজুর
১৬. কমলা/ মুসুম্বি লেবু
১৭. আলুর চপ
১৮. বেগুনি
১৯. মাংসের চপ
২০. রুটি
২১. মাংসের ভুনা
গ্রামে এত সব থাকতো না।
আমরা গ্রামে হালিমের নাম পর্যন্ত শুনিনি। হালিমের নাম শুনলাম ১৯৯১-এ বাংলাদেশ নির্বাচনের সময় ঢাকা গিয়ে।তখন সাংবাদিক। একুশের বইমেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা হালিমের স্টল দিত। সুন্দর সব বাংলা নাম। একটা স্টলের নাম মনে আছে--পৌষালী। আর মনে পড়ছে, কলমিলতা। আমি রোজ সন্ধ্যায় বইমেলা যেতাম বই দেখতে আর হালিম খেতে। সঙ্গে বাড়তি আকর্ষণ ছিল,ঝকঝকে ছেলেমেয়েরা আবৃত্তি করতো। ক্যাসেটের দোকান দিত। সাগর লোহানি তখন বেশ জবরদস্ত আবৃত্তিকার। বন্ধু আনিসের সৌজন্যে আলাপ এঁদের সঙ্গে।
পৌষালীর হালিম এবং হালিম বিক্রেতা (নি!) --দুটোই দারুণ ছিল।
কীসের আকর্ষণ বেশি ছিল--তা আর মনে করতে পারি নে।
গ্রামে তখন রোজা করতেন মূলত মহিলারা। পুরুষেরা হাতে গোনা। মসজিদে নামাজ পড়তেন আঙ্গুলে গোনা মানুষ।
পরে তারাবিতে ১০-১৫ জন হতেন। এখন শুনি শতখানেক মানুষ।
গ্রামে সাধারণভাবে ইফতারিতে থাকতো
১. আদা কুচি, নুন
২. লেবু
৩. কলওয়ালা ছোলা,
৪. ছোলা পসন্দ ( সিদ্ধ ছোলা ভাজি পেঁয়াজ আদা লঙ্কা গোলমরিচ দিয়ে)। ছোলা পসন্দ এখন দেওয়া। তখন ছিল ছোলাভাজি
৫. মুড়ি
৬. নুন চিনি লেবু দিয়ে শরবত
৭. শসা
৮. খেজুর
৯. আলুর চপ
১০. হিঞ্চের বড়া । মানে হিংচা বা হেলেঞ্চা শাকের বড়া। কম তেল দিয়ে সেঁকা সেঁকা। এইটা ছিল খুব প্রিয়।
এরপর ভাত এবং যা তরি-তরকারি ঘরে থাকে।
তরমুজ সস্তা ছিল। শসাও। তবু সবাই তা করতে পারতেন না। খেজুর লিখছি বটে, সব বাড়িতে হতো না। কিনে খাওয়ার চল, বড়লোকি চাল কম ছিল। কেউ এলে তাকেও তো খেতে দিতে হতো। একা একা আবার খাওয়া যায় নাকি।
অতি কৃপণ ছাড়া কেউ ভাগ না দিয়ে খেতেন না।
কেউ খেজুর কিনে প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠাতেন। সেটাই ছিল ভদ্রতা।
পয়লা রোজা আর সাতাশে রোজায় ভালমন্দ হতো।
সাতাশে রোজায় সিমুই থাকতো। পোলাও হতো। মাংসের আয়োজন থাকতো।
ভোরবেলায় মানে তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে সেহরি খাওয়া। আমি রোজা রাখি আর না রাখি সেহরি আর ইফতার খেতে ভুলতাম না।
আমি মানে আমরা মেদুর পেলব সবুজ মনের বালক বালিকারা।
চাহিদা ছিল সামান্য।
মা এক লোকমা ভাত খাইয়ে দেবে--আমি খাট থেকে শুয়ে শুয়ে খেয়ে নেবে। আর শেষে বাবা এক লোকমা।
এই তো আমাদের আনন্দের জীবন।
সেতো আর পাবো না--কোনোদিন।
চোখের জলে ভিজে লিখছি এই কথা।