পর্ব ৬০
শুক্রবার দোল। শনিবার হোলি। এবার শুক্রবার দোলের রঙের সঙ্গে পড়েছে শবে বরাত। চলে যাওয়া মানুষদের স্মরণে দান ধ্যান করেন মানুষ। এছাড়া বাড়িতে তৈরি করা হয় চালের আটার রুটি, পোলাও (বিরিয়ানি হতো না এভাবে ঢালাও আকারে)। নানা রকম হালুয়া, ছোলার ডালের হালুয়া, গাজরের হালুয়া ছিল বিখ্যাত। হতো ফিরনি। এ-রকম শহুরে টাইপ না। খাসকানি তথা সুগন্ধি গোবিন্দভোগ চাল হামানদিস্তায় আধ পেটা করে একটু চাল একটু চালের আটা তার সঙ্গে দুধ। দুধ ফোটানো হতো এলাচ তেজপাতা দিয়ে। একটু হালকা মিষ্টি। কথায় কথায় কিসমিস পেস্তা কাজু দিয়ে দেশি ফিরনির সব্বোনাশ করতে শেখেনি মানুষ। সে যে কী ভালো কী ভালো। আমার মা ও বড়দির হাতে এই ফিরনি আমি কোথাও পাইনি। খুঁজছি। নিজে চেষ্টা করেছি। হয়নি। দাঁড়ায়নি।
আর ছিল মাংস বিতরণ। আলু দিয়ে মাংসের মাঝপাতলা ঝোল। চালের আটার রুটি ডুবিয়ে খেতে কী যে আরাম। ওটা চাপ বা ভুনা বা কষা দিয়ে জমে না। ঘেঁটে যায়। চালের আটার রুটি আর মাঝপাতলা আলু মাংসের ঝোল। মুখ মারতে শেষে হালুয়া। নরম নয় অথচ শক্ত নয়। মাইসোর পাক একশো পাক খেয়ে ফেললেও এই পাক পবিত্র ছোলার ডালের হালুয়ার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারবেনি। এ আমি হলফ করে বলতে।
এটা নামানোর পর থালায় জুড়োতে দেওয়ার সময় থালায় একটু গাওয়া ঘি মাখিয়ে রাখতে হবে। মনে হবে, খাওয়ার সময় স্বর্গ বেহেস্ত এখানেই এখানেই। সবে বরাতে বিজয়ার নাড়ু সংগ্রহের মত তরুণ যুবক বালকের দল মুখ ঢেকে নিজেদের বহিরাগত ফকির মিসকিন সেজে গলা নকল করে বলে বেড়াত ঘরে ঘরে:
আমরা ফকির মিসকিনের দল।
আল্লাহর বান্দা।
তোমাদের দুয়ারে দোয়া চাইতে এসেছি।
দোয়া মানে খাবার দাবার দাও।
আমাদের দাদাদের দলে ছিলেন এক ব্রাহ্মণ সন্তান। তাঁর মত গোমাংস খেতে আমি কাউকে দেখিনি। পাঁচ ছয় কিলো মাংস খেয়ে ফেলা তাঁর কাছে জলভাত।
মহিলারাই তো দিতেন। তাঁরা সব বুঝতেন। বুঝেও না বোঝার ভান করতেন। আমাদের এলাকার মানুষ খুব রসিক। বলতেন, এমন ফকির মিসকিন পেলে আরেকবার নিকাহ বসি রাঁঢ় (বিধবা) হয়ে।
চমকাবেন না। মুসলিম সমাজে বিধবা মেয়েদের বিয়ে জলভাত। মুসলিম মেয়েদের পছন্দের গালাগাল, স্বামীর উদ্দেশে, এতো লোক মরে তুই কেন মরিস না। চারকাহারে যা। মানে চারজন লোক কফিন বয়ে - স্বামীকে নিয়ে যাক। আমার মায়ের সবচেয়ে রাগের গাল ছিল, চারকাহারে যাও।
সত্যি যখন বাবা গেলেন, আমার ঘুরতে ভালোবাসা মা, গ্রামের বাড়ি ছেড়ে আমৃত্যু নড়লেন না। টানা তিনবছর স্মৃতি আগলে পড়ে থাকলেন একাকী বিশাল এক ফাঁকা বাড়িতে।
যে কথা হচ্ছিল, মুসলিমরা হিন্দুদের মতই দৈনিক সন্ধ্যায় প্রতি ঘরে শিকল খুলে আলো দেখায়।
আর শবে বরাতের দিন মোমবাতি জ্বালায় ঠিক দীপাবলির মত। ধূপ প্রতি ঘরের জানালা ও দরজায়। বারান্দা রেলিং ভরিয়ে তোলে মোমবাতির আলোয়। তাজমহল বলে একটা মোমবাতি খুব জনপ্রিয় ছিল। আর ছোটোদের ছিল কালীপুজোর মত বাজি পোড়ান। হাউই চরকি সাপবাজি ধানিপটকা। আমি নবম শ্রেণিতে ছয় কিলোমিটার দূরে সেহারাবাজারে পড়তে যাওয়ার আগে এইসব খুব করেছি।
দু-দমা তিন-দমা বোমা ফাটান ছিল অবশ্য না-পসন্দ। বিকট আওয়াজ হতো। চৌবাচ্চায় পুরলে তো কথাই নেই। তবে তুবড়ি দারুণ লাগত। আর ছিল বন্দুকের ক্যাপ ফাটান। শবে বরাতে দাদি বলতেন, দাদো পরদাদো সহ পূর্ব পুরুষরা ভিটে দেখতে আসেন। তাই বাজি ফাটাতে নেই। কে শোনে!
রঙ জীবনে কম বলে গ্রামে রঙের খেলা ছিল খুব বেশি। মুসলিম বিয়ে বাড়িতে খুব কম করে তিন দিন রঙের খেলা চলত। পোশাকি নাম লগন ধরা। মানে বিয়ের লগ্ন। অন্য পক্ষ মানে কনে বা বর পক্ষ পরস্পরকে লগন পাঠাতেন। তাতে বেনারসি শাড়ি/ জামাকাপড় স্নো পাউডার সাবান ইত্যাদি নানা জিনিস থাকত। আর থাকত বিরাট আকারের মাছ ও মিষ্টি। আসতো হলুদও। সেই হলুদ বেটে শুরু হতো হলদি। এটা আদিবাসী প্রথা। নীহাররঞ্জন রায় পড়ুন। মঙ্গলাচরণ গায়ে হলুদ পান পাতা দিয়ে মুখ দেখা, এ-সব আদিবাসী অবদান। লগনযাত্রীদের একজন না একজন আমুদে রসিক মানুষ থাকতেন। বেছে বেছেই পাঠানো হতো। তাঁকে হলুদ মাখানো হতো কনে বা বরের পর।
আর মুসলিম বাড়িতে হতো সাঙ্ঘাতিক রঙ খেলা। আমাদের বাড়িতে একাধিক পিতলের পিচকারি ছিল। প্ল্যাস্টিকের পিচকারি তো আশির দশকে শহরে এসে শিখলাম। প্ল্যাস্টিক যাত্রার সেই শুরু। শেষ কোথায় কে জানে?
শুরু হতো হলুদ দিয়ে এরপর ধান সিদ্ধ করার চৌবাচ্চাতে গোলা হতো রঙ। জামাইবাবাজিদের তাতে ডোবান হতো। শালা শালিরা এই কর্ম করতেন। এরপর রঙ শেষ হলে ধান সেদ্ধ করার কড়াইয়ের কালি তেল দিয়ে মাখিয়ে রঙ খেলা। এসব ফুরলে পুকুরযাত্রা। সেখানে পাঁক মাখামাখি।
আর দোল বা হোলির সময় বালতি করে রঙ গুলে নিয়ে হিন্দু মুসলমান সবাই হাজির হতাম গোলামহলে। রঙের বিচিত্র ভুবন। তালপাতা বা খেজুর পাতার চাটাই বা পাটি বানাতে রঙ লাগত। কুড়ি পয়সা প্যাকেট। নানা রঙ হতো। লাল সবুজ নীল বেগুনি হলুদ বাদামি গোলাপি।
আভা কোম্পানির আবির তখন ৫০ পয়সা প্যাকেট। মূলত গোলাপি রঙের আবির। এতো লাল নীল আকাশি বেগুনি সবুজ গেরুয়া তখন হয়নি দোল। রঙ নিয়ে এত অকারণ মাথা ঘামাতেন কম লোক।
ফলে খেজুর পাতার রঙই ভরসা। কয়েকদিন থাকবে। পাক্কা। যতই তুমি সাবান ঘষো। বাঁদর রঙ প্ল্যাস্টিক রঙের তত্ত্ব আমাদের জানা ছিল না।
আমরা রঙ খেলতাম। রঙ ফুরোলে গোরুর গাড়ির চাকার রেড়ির তেলের কালি মাখতাম ও মাখাতাম। ভুষো কালি চেয়ে চিন্তে জুটত। সেসব করে পুকুরে অনেক দৌড় ঝাঁপ হামলা হামলি পাঁক মাখামাখি করে বাড়ি ফিরে ভরপেট ভাত খেয়ে পাগলের মত অবুঝ সবুজ ঘুম এবং স্বপ্নকন্যার খোঁজ। বিকেলে বার দু'য়েক খিচুড়ির আসরও বসেছে। ফিস্টি বলে।
আমাদের সময় আশির দশকে বিদ্যালয়ে আবির খেলা ছিল নিষিদ্ধ বস্তু। ভাবাই যেত না, রঙ দূরে থাক আবির খেলার কথা।
কলেজে দোলের আগের দিন অনেক নিয়ম কানুন মেনে আবিরের ছোঁয়া। অনেকেই পকেটে লাল আবির আনত পছন্দের মেয়ের কপালে আসল লক্ষ্য সিঁথি রাঙা করব বলে। মফস্বলের মেয়ে খুব বুদ্ধিমতী। অসম্ভব কৌশলে সে-সব সামাল দিত।
বর্ধমান জীবনে দোলের অনেক রঙিন গল্প আছে। ইটকাঠের জীবন অংশে সে-সব লেখার ইচ্ছে। শরীর ও সময় দিলে।
পর্ব ৬১
আমার খুব ইচ্ছে করত, আমাদের একটা ডালিম গাছ থাকবে। খাওয়া যাক আর না যাক লাল টুকটুকে ডালিম হবে। যেমন হয় সিরাজদের ঘরে। সিরাজ তার চেয়ে চার পাঁচ বছরের বড়। তবু সবাই সিরাজ ডাকে। সেও বড়দের সঙ্গেই বেশি বন্ধুত্ব হয় তার। সিরাজদের পাকা কলতলার পাশে ডালিম গাছের ডাল ঝুঁকে আসে। মাঠ তালপুকুরে বেড়াতে যাওয়ার সঙ্গী তার সিরাজ। জরুলে ফুফুর ঘর গিয়ে সে গাদাগুচ্ছের টারজান সিরিজের বই পড়ে এসেছে। সিরাজকে বলেছে। সে টারজান হবে। এক আমগাছ থেকে আরেক আমগাছে যাবে ডাল ধরে ঝুলে মাটিতে না নেমে।
যাওয়ার আগে সে একবার যাবে ডালিমতলায়। তার আগে ঘরে আসবে দখিনপাড়ায় নজির চাচাদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তায়। ওখানে মিনু বাবলুদের বাগানের জমির পাশে কী সুন্দর অপরাজিতা ফুল ফুটে থাকে। নীল সাদায় সাজান। চোখ ফেরান দায়। তার ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। ছেঁড়ে না। ফুলেদের ব্যথা লাগে যে। আর ফুটে থাকলে আরো কত লোক দেখতে পাবে। দোকানদারির কাজে দখিনপাড়ার মানুষজনকেও তো এপথেই যেতে হবে দুগোদার দোকান। মোতিদাদু মারা গেছেন। দুগোদা এখন দোকানি। ভাগ্নে কাজলকে নিয়ে দোকান চালাচ্ছে। অপরাজিতা ফুলের গাছ লাগানোর কথাও সে ভাবে।
ভাবে। কিন্তু হয় না। চাইতে হবে যে! চাইতে চির লজ্জা। কী করে বলবে ডালিম গাছের বীজ দাও। যদি হ্যাংলা ভাবে। ভাবে ডালিম খেতে চায় বলে, বলতে পারছে না। কটা সুন্দর টিয়াপাখি আসে ডালিম গাছে। একটা কাশীর পেয়ারা গাছ আছে। লাল টুকটুকে। সেগুলো ঠুকরে খায় টিয়াপাখি। ডালিমে ঠোকর মারে।
ডালিম গাছ আর অপরাজিতা ফুলের গাছের মাঝে আছে একটা বড় বট গাছ। সেটায় নাকি ভূত পেত্নি জিন একসঙ্গে বাস করে। দিনের বেলায় ভয় নাই। তখন নাকি ওঁরা ভাল হয়ে লুকিয়ে থাকে। রাত হলে কাউকে একা পেলে রক্ষে নাই। তবে কারোর কিছু হয়েছে, কেউ শোনে নি। তবে ভূত দেখেছে, মানে বেড়াল ভূত সে-কথা খুব চলে।
ডালিম গাছ আর অপরাজিতা গাছে ৭০০ মিটার দূরত্ব। বট গাছের গায়ে একটা বড় নালা। গরমে শুকনো। শীতে অল্প জল। বর্ষায় টইটম্বুর। লাফ দিয়ে পেরোতে হয়। একটু দূর থেকে ছুটে না এলে ঝামেলি। চার ফুট চওড়া। নালাটি দিয়ে ডিভিসির ক্যানেলের জল যায় পুব দিক ও দখিন দিকের মাঠে। পলাশন পশ্চিমপাড়ার লোকও এই নালার জলের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। চাষের জন্য। নালাটি পার বাঁ আর ডান পাশে জমি।
বাঁ পাশে চার বিঘে চার বিঘে আট বিঘে জমি । সুন্দর। এই জমি দেখলে তার বুক টনটন করে। মা বলে, ক্লাবের ফুটবল খেলার বুট কিনতে নাকি এই জমি বেচেছে বাপ। খুব রাগ হয়ে যায় তার। জমি কেউ বেচে? কেন বেচে জমি? সে কোনোদিন পয়সওয়ালা হলে এই জমি কিনে নেবে। ভাবে সে। জমির দুঃখ ভুলিয়ে দেয় অপরাজিতা ফুল। পাশে আছে নীল দোপাটি।
কবিতা মনে পড়ে তার, দিদির বইয়ে পড়েছে, 'নীল দোপাটি চুটকি পায়ের সন্ধ্যামণির নাকছাবি'।
সন্ধ্যামণি আর নোটনমণি এই দুই ফুল অনেক ঘরেই আছে। প্রায় সবার ঘরেই থাকত নোটনমণি। সকাল নটায় ফুটতো।
নোটনমণিরা সারা বছর তো থাকে না!