আমরা যে সামান্য কিছু হয়ে উঠতে পেরেছি, বা বেঁচে বর্তে আছি, তাতে আমাদের বাবা মা পরিবার ছাড়াও শিক্ষক শিক্ষিকাদের অবদান অনস্বীকার্য।
আমার প্রথম শিক্ষক পটল ঠাকুর। পেশায় বিদ্যালয়ের পিয়ন। বাকি সময় পুরোহিতগিরি ও ছোট বাচ্চাদের পড়ানো। কার্যত আমার হাতে খড়ি পটল কাকার কাছেই। বাড়িতেও কেউ স্লেটে লিখতে শিখিয়ে থাকতে পারেন। মনে নেই। এরপর আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেন শম্ভুনাথ থান্দার। তপশিলি জাতির মানুষ। আমাদের বৈঠকখানায় থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াতেন। দিদিমণিদের মধ্যে পেয়েছি দুজনকে। এক শেফালি হালদার। চমৎকার গান গাইতেন এবং ভালো অঙ্ক করাতেন। শেফালিদি পরে আমাদের মামিমা হন। মামার বন্ধু মানিক চৌধুরীকে বিয়ে করে। শেফালিদি বিয়ের পর সামান্য পূজা আচ্চা করলেও পরে আশ্চর্যজনকভাবে নামাজে বিশ্বাসী হন। প্রসঙ্গত, মানিক চৌধুরী ছিলেন জন্মসূত্রে মুসলিম। শেফালিদির আরেকটি বৈশিষ্ট্য, পুরোদস্তুর বর্ধমান শহরের মেয়ে হয়েও গ্রামের জীবনে অদ্ভুতভাবে মানিয়ে নেন। তিনটি বাড়িতে ভাড়া থাকার পর আমাদের গ্রামেই বাড়ি করেন।
দিদিমণির গান ও নাটক শেখানো দেখে অষ্টম শ্রেণিতে পাঠরত আমাদের এক সহপাঠী বলেছিল, শ্লা বিয়ে করতে হলে দিদিমণিকেই বিয়ে করবো।
তখন অবশ্য দিদিমণির বিয়ে হয়নি।
আরেকজন মাস্টারমশাই ছিলেন লক্ষ্মীবাবু। তখন তাঁকে তাঁর গ্রামের নাম ধরে বলা হতো। মাস্টারমশাইদের নাম ধরে বলা আমাদের গ্রামের সংস্কৃতি ছিল না।
শম্ভুনাথ থান্দার কাষ্ঠকুড়ুম্বার মাস্টারমশাই। আমাদের গ্রাম থেকে বহু দূরে। মনে মনে কতবার যে ওই গ্রামে গিয়েছি। মাস্টারমশাইয়ের ছায়াসঙ্গী ছিলাম। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় স্যারের বিয়ে হয়। আমাদের গ্রামেই। মনে মনে আশা ছিল, আমাকে অন্তত নেমন্তন্ন করবেন। সঙ্গত কারণেই করতে পারেননি। করলে সব ছেলে মেয়েকেই করতে হতো। কিন্তু আমার এই দুঃখ বহুদিন ছিল।
স্যার দারুণ ফুটবল খেলতেন।
জুনিয়র হাইস্কুলের এক শিক্ষক টুকলি ধরার জন্য ছিলেন বিখ্যাত। তাঁকে জব্দ করার আ.. বলে একজন প্রতিজ্ঞা করেন। সপ্তম শ্রেণির পরীক্ষা। আ.. পরীক্ষার সময় বারবার পকেটে হাত ঢোকাচ্ছে। আর স্যারের দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে।
স্যার ভাবছেন, নির্ঘাত টুকলি। পকেটে হাত ঢুকিয়ে থ।
আ... পকেট ফুটো করে তার মধ্যে লিঙ্গ ঢুকিয়ে সুতো দিয়ে বেঁধে রেখেছে। আর পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে সেটিকে শক্ত করছে। মাস্টারমশাই ভেবেছেন টুকলি।
তা বের করতে গিয়ে লজ্জায় এক শেষ।
সেই থেকে মাস্টারমশাইয়ের পকেটে হাত ঢোকানো বন্ধ।
এই গল্প আমাদের আগের বড়দের। কিন্তু গল্পটি চিরবহমান।
আরেকজন মাস্টারমশাইয়ের নাম বিখ্যাত ছিল এলাকায়। তিনি সেহারা স্কুলের শিক্ষক।
আমাদের গ্রামে দুটি স্কুল। প্রাথমিক ও জুনিয়র। জুনিয়র মানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত।
সেহারা স্কুলের নামডাক ভালো। সেখানে উচ্চমাধ্যমিক আছে। প্রায়ই শোনা যেত কলেজ হবে। আজও হয়নি।
তো, সেই স্কুলে ষাটের দশকে খুব সমস্যা। ছেলেরা পাটিগণিত পারছে ভালোই।
সপ্তম শ্রেণিতে বীজগণিত ঢুকলেই ধেড়াচ্ছে। এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার সূত্র মনে রাখতে পারছে না। তখন তো প্রধানমন্ত্রীর একস্ট্রা টু এ বি সূত্র আমদানি হয়নি। হলে কী হতো বলা যায় না।
তখন তো স্টাফ রুমে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার হালহকিকত নিয়ে মাস্টারমশাইরা যথেষ্ট চর্চা ও আক্ষেপ করতেন।
বীজগণিত শিক্ষকের আক্ষেপ শুনে এক সাহিত্যের শিক্ষক বললেন, আমাকে একদিন ক্লাস দেবেন?
আপনি, অঙ্কের ক্লাসে?
তা অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই অনেক শিক্ষক ছিলেন যারা অঙ্ক এবং ইংরেজি দুটোতেই তুখোড়। আমাদের শিক্ষক পরেশনাথ চক্রবর্তী অর্থনীতি নিয়ে পড়েছেন। অঙ্ক এবং ইংরেজি দুটোতেই স্বনামধন্য।
তো বড় জোরাজুরি করায় সেই শিক্ষককে একদিন পাঠানো হল।
তিনি বোর্ডে গিয়ে লিখলেন, এ= হাগা, বি= মুত।
(হাগা+মুত) স্কোয়ার সমান হাগা স্কোয়ার + টু হাগা মুত+ মুত স্কোয়ার ।
ছেলেরা দূরে থাক, আশপাশের ২০-৩০ কিলোমিটার দূরের সবাই শিখে গেল বীজগণিতের ফর্মুলা। মাঠে মাঠে চাষ করতে করতেও বহুদিন চলে ওই কাহিনি।
আরেক মাস্টারমশাই অঙ্কে ভীতু ছেলেমেয়েদের বলতেন, বাবা ছাতাটাও অঙ্ক জানে। অঙ্ক জানে বলেই ওটা কাজ করছে। তোরা পারবি না?.
আইসক্রিমের হিসেব জানিস। ক পয়সায় কটা?
মার্বেল / কাচের গুলি ক নয়ায় কটা?
অঙ্ক তো জানিস, শুধু করতে চাস না। কর মন দিয়ে। যেমন করে বিয়ে বাড়িতে খাবার খাস ভালোবেসে, তেমন ভালোবেসে অঙ্ক করদিনি।
সেহারা হাইস্কুলের আরেক শিক্ষক ছিলেন বিশ্বনাথ রায়। তখন আমি ফুল কবিতা ভালোবাসতাম না। বিপ্লবে বিশ্বাসী।
কবিতা লিখতে শুরু করেছি ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে। ওই বৃষ্টি ইত্যাদি পর্যন্ত দৌড়। তিনি একদিন কবিতা লিখে আনতে বললেন, আধুনিক কবিতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো হলে হবে না।
আনার পর তিনি এত প্রশংসা করলেন, আমি আধুনিক কবিতার ভক্ত হয়ে উঠলাম এবং ফুলের।
দিলীপবাবু নামে এক শিক্ষক এলেন দশম শ্রেণিতে। গেমস টিচার। গেমস টিচার মানে ধরেই নেওয়া হতো পড়াশোনায় দুর্বল। ফলে, একটু অবজ্ঞা জুটতো। তিনি বর্ধমান শহর থেকে আসতেন। ফর্সা টুকটুকে চেহারা। গলায় সোনার চেন। হিরো হিরো দেখতে। কিছুদিন পরেই স্কুলের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে ছেলেদের পায়খানা পেচ্ছাপ ঘরের দেওয়ালে ইটে প্লাস প্লাস দেখা গেল।
তবে সেটি ছিল, ঈর্ষাজাত।
দিলীপবাবু ওইসব দিকে পা মাড়াননি।
কিছুদিন পরেই তিনি আমাদের নয়নের মণি হয়ে উঠলেন।
বর্ধমান থেকে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত দুই কোচ রথীনবাবু এবং সুবোধবাবুকে নিয়ে এসে ফুটবল কোচিং শুরু করালেন।
১০ কিলোমিটার মাঠে মাঠে ছোটাতেন তাঁরা। ক্লাসে এসে ঢুলতে লাগলাম।
বুঝলাম, ক্লাসে প্রথম স্থান ধরে রাখতে গেলে ভালো ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার সাধ ছাড়তে হবে।
আমাদের সঙ্গে পড়তো মনোজ। দারুণ ফুটবল খেলতো। কিছুদিন পর বাস্কেটবল মাঠ হলো। মনোজ তাতেও অনবদ্য।
আমার আগ্রহ ছিল খুবই। সুযোগ পেলেই খেলতাম। দিলীপবাবু আমি তত ভালো খেলোয়াড় না হলেও খুব স্নেহ করতেন।
তাঁর অতি স্নেহ আমার বিপদের কারণ হয়েছিল। মাধ্যমিক পরীক্ষায় ক্লাসের ফার্স্ট বয় আর কিছুতে না পাক কর্মশিক্ষা ইত্যাদিতে লেটার পেতো। আমি কর্মশিক্ষার কাজ, সমাজসেবা, রেডক্রসের কাজ, কর্মশিক্ষার খাতা সুন্দর করা-- সব করেও লেটার পাইনি।
কারণ, দিলীপবাবুর ভালোবাসা।
তিনি বাইরে থেকে পরীক্ষা নিতে আসা এক্সটার্নালের কাছে আমার এত প্রশংসা করলেন, কুচকাওয়াজ করে দেখানোর সময় তিনি আমাকেই কমান্ড দিতে ডাকলেন। এ বিষয়ে সেরা ছিল বিশু, মনোজ, সুবীর। আমি খুব দুর্বল। নিজে জানতাম। দিলীপবাবুর অগাধ আস্থা।
ডোবালাম তাঁকে এবং নিজেকে।
লেফট রাইট কমান্ড ভুল হয়ে গেল।
আর ছিলেন গজেন্দ্রবাবু। লজিক পড়াতেন। আমাদের সময় অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে পড়তে হতো। নবম দশম দুটো ক্লাস একসঙ্গে নিতেন। তাঁর নিজের ছেলে অনুপম, চন্দনাদি আমাদের সঙ্গে পড়তো।
আমাকে প্রশংসা করে করে আমার আত্মবিশ্বাস অতিরিক্ত হয়ে গেল।
অতি আত্মবিশ্বাস ভালো নয়, সেটা পরে বিলক্ষণ বুঝেছি।
কিন্তু এটা দেখেছি, নিজের ছেলের চেয়েও অন্যের ছেলে মেয়েকে কী ভালোবাসাই বাসতেন শিক্ষকরা।
সুবীর আমাদের সহপাঠী। সুবীরের চেয়ে ভবানীবাবুর ভালোবাসা ছিল আমাদের প্রতি বেশি।
পরেশবাবুর বড় ছেলে বড় ভালো। কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে গিয়ে নিজের ছেলের খেয়াল রাখতেই পারেননি।
শিক্ষকদের মধ্যে প্রবাদপ্রতিম সমাজসেবী ও ছাত্র দরদী শিশিরকুমার দত্ত আজও বেঁচে আছেন। তাঁর বিখ্যাত সই শিকুদত্ত কতজন যে নকল করেছে কর্মশিক্ষার খাতায়।
ভালোই সই করতে শিখেছিস রে সব, হেসে বলতেন।
সেই বয়স ছিল একটানে রামায়ণ, মহাভারত লেখার, রবীন্দ্রনাথ নজরুল নেহরুর সই নকল করার। হাতের লেখা ভালো করার। খাতায় লাল দাগ না দেখার।
এবং স্যারেদের ভালো হয়েছে বা গুড দেখার।
ভেরি গুড লিখলে পায় কে?. সাইকেল চালানোর গতি বেড়ে যেত। বেসুরো গলায় গান লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো।