একেকটা জায়গা একেকরকম।
মনোভঙ্গি আলাদা। মন দেওয়া নেওয়ার পালাটা যদিও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের যুগ থেকেই এক।
সেহারাবাজারে প্রেমের গল্প কম। কিন্তু প্রচার খুব বেশি। প্রেমের ইচ্ছে থাকলেও এখানে সে-সব করবে কী করে? সবাই সবার চেনা। সব ঘটনাই এদিক ওদিক থেকে বাড়ির লোকের কানে পৌঁছে যায়।
কাকু জেঠুর দল দায়িত্ব নিতে ভালোবাসে এ-সব বিষয়ে।
--কী শুনছি সব, একটু নজরে রেখো।
আর নামধাম পৌঁছালে বাড়িবন্দি কদিন।
দাদারা লাফাত বেশি, বোনের ক্ষেত্রে, অনেক হয়েছে, আর পড়তে হবে না।
তবু প্রেম আসতো লাফিয়ে ঝাঁপিয়েই আসতো।
মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক আলাদা বিদ্যালয়ে পড়েছি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তো আরেক জায়গায়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামে। নবম দশম বাজারে। এগারো বারো জেলা শহরে।
প্রেমের বিচিত্রগতি। তবু সেহারাবাজারে সর্বাধিক আলোচিত ছিল সু.. আর গো..র প্রেম।
দুজনেই খুব ফর্সা। এবং সুন্দর।
ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় গো.. প্রেম নিবেদন করায় সু.. জুতো খুলে ছুঁড়ে মারার ভঙ্গি করেছিল। সে তো রাধাও কৃষ্ণকে মারতে বাকি রেখেছিল প্রথম প্রস্তাবে। সেহারাবাজারে প্রেম মানে তো কোন দোকান বা পার্কে বসা নয়। ওই স্কুলে যাওয়ার সময় রিটায়ারিং রুমের যাত্রীদের সামনেই একটু আলাদা কথা বলা। চিঠি আদান-প্রদান। সেহারাবাজারে ছিল জংশন স্টেশন। বিডিআর ট্রেন। মিটার গেজ নয় একটু উন্নত। ধিকিধিকি চলে। দিনে দুবার ক্রশিং। সকাল দশটায়। বেলা সাড়ে তিনটায়। বাঁকুড়া থেকে ছেড়ে রায়না যায়। রায়না থেকে ছেড়ে বাঁকুড়া। সেহারাবাজার জমজমাট এই জংশনের কারণে। বহু লোক এসে দুড়দাড় করে নামে। ছুটে এসে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে ওঠে। দুটো বাস দাঁড়াত। একটা লোকাল একটা এক্সপ্রেস। এক্সপ্রেসে ভাড়া বেশি। সময় লাগে কম। তাই তাড়াতাড়ি ভর্তি হয়ে যেত। তখন ছাদে ওঠার চল। ছাদ ভর্তি হয়ে যেত। বিডিআর ট্রেনের ছাদেও উঠতেন শতশত মানুষ। আমরাও ট্রেনের ছাদে বসেছি। জানালাতেও লোক পা দিয়ে দাঁড়াত। কয়লার ইঞ্জিন। বিদ্যুতের নয়। তাই সমস্যা কম।
কী ঝিক কু ঝিক করে ট্রেন আসতো।
যাত্রীরা নেমেই ছুট।
তবে যাদের তাড়া থাকতো না, তারা চা চপ পেঁয়াজি খেতেন। ট্রেনের একটা রিটায়ারিং রুম ছিল। বেশ বড়। তবে চেয়ার বেঞ্চ দেখিনি। বসলে মাটিতে বসো। আর ছিল একটা ক্যান্টিন। সেখানে চা ছাড়াও ভেজিটেবল চপ আর সর টোস্ট এবং মাখন টোস্ট পাওয়া যেত।
চপ বেগুনি ১০ পয়সা। চা ১৫ পয়সা। টোস্ট ২৫ পয়সা। ভেজিটেবল চপের দাম চড়া। ২৫ পয়সা।
আর মিষ্টি পাঁউরুটি, কেকের সঙ্গে মিলত ভিতরে ক্রিম দেওয়া একটা খাবার। নাম মনে পড়ছে না। ২০ পয়সা দাম। এখন ১০ টাকা। সঙ্গে ছিল গজা এবং বেলেতোড়ের ম্যাচা সন্দেশ।
ম্যাচা সন্দেশের যে কী অদ্ভুত রকমের একটা অপূর্ব স্বাদ ছিল বলার নয়।
পরে বেলেতোড়ে গিয়েও খেয়েছি, কিন্তু সে স্বাদ মেলেনি। ম্যাচার চেয়েও বেশি জনপ্রিয় ছিল লুকিয়ে লুকিয়ে সু.. আর গো..র প্রেম দেখা। আরেকজনরা প্রেম করত। স্কুলের কেরানির ছেলে এবং বাজারের এক ধনী মুসলিমের মেয়ে।
ছেলে নয় আমরা তাঁকে লোকই ভাবতাম। ব্রাহ্মণ সন্তান। দু'জনের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু সু আর গো-র প্রেম স্থায়ী হল না। চার বছর চলার পর ভেঙে গেল। গো.. বড়লোকের নাতি। সু..র বাবা সরকারি কর্মচারী। তবে কারণটা অর্থনৈতিক নয়, অন্যকিছু। এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল খেলোয়াড় সু..র গৃহশিক্ষক হলেন।
সে নিয়েই মন কষাকষি। গো..ও ভালো ফুটবল খেলত। গৃহশিক্ষকের কাছে নস্যি। হিরো। তাঁরও গলায় সোনার চেন। গো..র মতোই।
বর্ধমানে দেখলাম, স্কুল ছুটি হলেই দশম থেকে দ্বাদশের কেউকেটারা ছোটে কার্জন গেট। কারণ, মিউনিসিপ্যাল গার্লস স্কুলের ছুটি হবে। পাঁচ মিনিট আসতে লাগবে তাঁদের। কেউ আসবে রিকশায়। কেউ সাইকেলে। কেউ হেঁটে। মেয়েদের স্কুলটা শহরের পশ্চিম দিকে। জেলাশাসকের দপ্তর, কোর্ট পেরিয়ে তবে সেই স্কুল। কোর্ট এলাকার দক্ষিণ দিকে টাউন স্কুল। মিউনিসিপ্যাল গার্লস স্কুলের মেয়েদের দেখতে তাঁদের সুবিধা বেশি। কারণ কোর্টের কাছেই তাঁদেরও স্কুল। মিউনিসিপ্যাল বয়েজ স্কুল জিটি রোডের গায়ে।
সেখান থেকে কার্জন গেট কাছে। কার্জন গেটে বাস রিকশা সাইকেল সবমিলিয়ে একটু যানজট থাকতোই, স্কুল ছুটির সময় প্রেমোৎসুক বা দর্শন অভিলাষীদের ভিড়ে কার্জন গেটের যান চলাচল সঙ্গিন হয়ে উঠতো।
যান চলাচলের অবস্থা সঙ্গিন হলেও মনগুলো রঙিন।
যাকে যার পছন্দ, সে তো তাকাতোই, অভীষ্ট জন যদি একবার, চোখ তুলে তাকায় তাহলে তাকে আর পায় কে? বুঝেছে বুঝেছে!
চারচোখের মিলন হলে সে তো লটারি পাওয়ার সামিল।
মিউনিসিপ্যাল গার্লস স্কুলের মেয়েদের নবম শ্রেণি হলেই শাড়ি পড়তে হতো। মিউনিসিপ্যাল বয়েজ স্কুলের লাল প্যান্ট সাদা জামা। এগারো বারোতে ইউনিফর্ম নাই। কিন্তু মেয়েদের স্কুলে কড়া নিয়ম। সব ক্লাশেই ইউনিফর্ম।
সাদা শাড়ি সাদা ব্লাউজ। শাড়ির পাড় একটু বাদামি ঘেঁষা নীল। অপূর্ব রঙটা।
শ্যামলা উজল চোখের মেয়ে দুয়েকজন ছিল, যাদের কাছে সুচিত্রা সেনও ফেল।
সব মফস্বল শহরের গল্পটা বোধহয় একটু একরকম। বালক বিদ্যালয়ের দশমের প্রথমের সঙ্গে বালিকা বিদ্যালয়ের প্রথমার সম্পর্ক হবে দ্বন্দ্ব দিয়ে শুরু, প্রেম দিয়ে শেষ।
টিউশন অঙ্কে ইংরেজিতে প্রতিযোগিতা, মূলত জয়েন্ট এন্ট্রান্সের। বিতর্ক সভায়, কুইজের আসরে এই প্রতিযোগিতা ঝলমল করে উঠতো।
বর্ধমান শহরের গল্পটাও এ-রকম ছিল। শহরের সেরা বালক বিদ্যালয়ের প্রথম সরস্বতী পূজার রাতে বালিকা বিদ্যালয়ের সেরার সঙ্গে রাত নটা পর্যন্ত পুকুর পাড়ে বসে গল্প করেছে--এ যে কত বড় খবর আজকের প্রজন্ম বিশ্বাস করতেই চাইবে না।
এক সেরা বালিকা এখন ইংল্যান্ডে। প্রকৌশলী। ছেলেটি জীবনীমায় জীবন অতিবাহিত করছে। মিতালি টেকেনি। সাধারণ বিজ্ঞান স্নাতক সাম্মানিক ছেলের সঙ্গে শিবপুরের বাতাসের বেগ মেলেনি আর।
এর মধ্যে ঘটল এক নতুন ঘটনা। শহরের সেরা বালিকা বিদ্যালয়ের সেরা নৃত্যশিল্পী প্রেম করে ফেলল শহরের পড়াশোনায় ভালো ছেলের সঙ্গে নয়, ফুটবলের সেরার সঙ্গে। রাশিয়ায় ফুটবল খেলতে গিয়েছিল এক ছেলে দেশের হয়ে। শহরের বড় গর্বের নাম। দাবা। অদ্ভুত তার নাম।
তার সঙ্গে প্রণয়মত্ত হেমা মালিনীর দলে নাচ করা মেয়ে।
সে যেমন দেখতে, তেমন পড়াশোনায়। নাচেও বিদ্যুৎগতি। নামটিও রোমান্টিক। শেষে প্রিয়া আছে। তবে ডাকনামটি বড় আধুনিক।
গোটা শহরের ছাত্র মহলে গুঞ্জন তাদের নিয়ে।
সে প্রেম পরিণতি পায় নি।
পরে, রাজ কলেজে ইংরেজি পড়তে আসে মেয়েটি। আগে যাকে অহঙ্কারী মনে হতো, কলেজে ভর্তির পর দেখলাম সে বেশ বিনয়ী। তার বন্ধু ছিল শহরের এক প্রখ্যাত ডাক্তারের ইংরেজি মাধ্যমে পড়া মেয়ে। প্রথমে ইংরেজি মাধ্যমে পড়া মেয়েরা আমাদের কলেজে এড়িয়ে চলতো। তাদের সঙ্গে কিছুদিন অমিতাভ বচ্চন ম্যানিকিউর পেডিকিউর নিয়ে আলোচনা করার পর আমাদের সক্রিয় সদস্য হতো। উদার হাতে চাঁদা দিত।
এদের অনেকেই এখন ইংল্যান্ড এবং আমেরিকা নিবাসী।
শহরে একটা কথা চালু ছিল, গ্রামের ভালো ছেলেগুলো আসে শহরে। শহরের ভালো ছেলেগুলো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে শহর ছাড়ে।
আর সুন্দরী মেয়েরা বিদেশে বরের সাথে পাচার হয়।
তার আগে শহরে দীর্ঘশ্বাস ফেলার জন্য কিছু দেবদাস রেখে যায়।