মানুষ কাকে খোঁজে সারা জীবন?
কোনও ব্যক্তিকে?
নিজেকে?
নিজের শৈশবকে?
ফেলে আসা সময়কে?
উৎপল দত্তের 'টিনের তলোয়ার' নাটকের ময়না ফিরে যেতে চাননি তাঁর অতীতে। কারণ, সেখানে খিদে দারিদ্র আর অবমাননা রাজত্ব করে। তাতে ভালো কিছু নেই!
রমা রঁল্যার অপু মাফিক চরিত্র জাঁ ক্রিস্তফ কি শৈশব ভালোবাসতো, যাঁকে পরতে হতো মায়ের কাজের বাড়ির ফেলে দেওয়া পোশাক।
অপুকেও পরতে হয়েছে হোস্টেলে বন্ধুদের নতুন পোশাক।
আমাদের শৈশবের সবকিছু ভালো নয়, তবু আমরা শৈশবে ফিরতে চাই। কেন? কেন? কেন? কোনও পাঠক বন্ধু যদি বলেন।
একটু ভুল হল, পাঠক নয়, সহ-লেখক।
ভালো পাঠকই তো ভালো লেখাটা লিখিয়ে নেন।
অপু জাঁ ক্রিস্তফের দারিদ্র্য নিজের জীবনে প্রত্যক্ষ করতে হয়নি। সে দেখেছি যৌবনে। কলকাতায় বাঁচার জন্য লড়তে এসে।
তবে এখনকার গ্রামীণ মেলার তুলনায় তখনকার মেলার চেহারাটা দেখলে বুঝতে পারি গ্রামের মেলা ও অর্থনৈতিক জীবনের ছবিটা।
দোকানপাটের চরিত্র বদলে গেছে। আগে শুধু থাকতো সব মিলিয়ে গোটা ১০-১৫ টি দোকান। বৈশিষ্ট্য গ্রামীণ। বারোয়ারিতলা তথা ওলাইচণ্ডী পূজার কাছে জিলিপি, জিভে গজা, গজা, কাঠিভাজা, এবং রসগোল্লার দোকান। পরপর দুটি। তারপর চপ বেগুনি পাঁপড়ভাজা। আর গোলামহলের দুপাশে মাঝেরপাড়া যাওয়ার রাস্তা ধরে বাচ্চাদের খেলনার দোকান। লাট্টু, কটকটি, তালপাতার সেপাই, বাঁদর লাঠি, ছোট ঢোল ইত্যাদি। থাকতো সংসারের জিনিস। খান দুই তিন দোকান। হাঁড়ি কুড়ি, অ্যালুমিনিয়াম ও লোহার কড়াই, তাওয়া, কাঠের বেলুনি, খুন্তি ইত্যাদি। আগে বেশিরভাগ থাকতো লোহার। মাটির হাঁড়ি কুড়ি, জালার দোকানও বসতো। আশির দশকে তার ঘন্টা বাজল। স্টিলের বাসনকোসন ঢুকল ১৯৮৫র পর।
আনির দোকান বা মনোহারি দোকান বলতো লোকে। স্টিলের হাতা খুন্তি বাসনপত্র বিদায় দিল মাটির হাঁড়ি তাওয়া পাতিলকে। অ্যালুমিনিয়াম তামচিনি অবশ্য রয়ে গেল। এখন তো ম্যালামাইনের যুগ। ২০২১-এ দেখলাম বাইকের দোকান। শাড়ি জামা কাপড় সালোয়ার কামিজ --সব বিক্রি হচ্ছে। আর মাঝে মধ্যে কাঠের নাগরদোলা আসতো। ২৫ পয়সা করে টিকিট।
বাচ্চাদের জন্য ছিল বন্দুকের দোকান। সেখানে থাকতো রবারের ফুটবল, ছোট বল--অজস্র বল।
নানা রঙের। আর প্ল্যাস্টিকের ক্রিকেট ব্যাট।
এবার মেলায় একটাও বলের দোকান দেখলাম না।
মেয়েদের সাজগোজের জিনিস তো মেলার অঙ্গ। মেয়েরা আর ছোট ছেলেমেয়েরাই তো মেলায় কেনাকাটা করে।
আমি খুব আংটি কিনতে পছন্দ করতাম। চার আনা থেকে আট আনা দাম। ১৯৯৩-এ কালীঘাটে রথের মেলায় শেষ কিনেছি আঙটি। আট আনার দাম তখন হয়েছে দশ টাকা।
গিল্টি করা গয়নার দোকান দু তিনটি বসতো। কাচের বাক্সে চুড়ি দুল বালা।
আর ছিল কাচের চুড়ির দোকান।
মেলায় বড়রা বলতেন, সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ।
কত কিশোরী আর নারীর হাতের ছোঁয়া পাচ্ছে চুড়ি পরাতে গিয়ে।
এবার কাচের চুড়ির দোকান দেখলাম না। দোকানপাট প্রায় ১০০।
শহুরে ছাপ। কাপড়ের তাঁবুর রেস্টুরেন্টে মোগলাই পরোটা, চাউমিন, চিকেন ও এগরোল। দু দুটো ফুচকার দোকান।
গ্রামের এক মেয়ে তাঁর বরের দোকানে সাহায্য করছেন দেখে আনন্দ হলো। আগে মহিলা দোকানদার দেখিনি। এবার দেখলাম। মেয়েটি জন্মসূত্রে মুসলিম। এটাও একটা বড় ঘটনা।মুসলিম মেয়ে মেলায় দোকানদারি করছে। বোরখা হিজাব পরা কাউকে মেলায় পাইনি।
গ্রামের জনসংখ্যা মেলার সময় তিন চারগুণ বৃদ্ধি পায়। আত্মীয় কুটুম তো বটেই, গ্রামের পুরানো বাসিন্দারাও ফেরেন। যেমন তাপস চক্রবর্তী আর তাঁর তিন দিদি বোন এসেছিলেন। এসেছিলেন সাধন কাকা তথা তপন সরকার।
তপন কাকা এখন হাওড়ায় প্রতিষ্ঠিত হোমিওপ্যাথি ডাক্তার ।
কথা হচ্ছিল, মেলার দোকানপাটের সেগুলো বলে নিই। কলকাতার কেষ্টপুর বা নাগেরবাজারের রথের মেলার সঙ্গে খুব তফাৎ আর নেই আমাদের আদ্যিকালের আউশাড়া গ্রামের মেলার।
বিরাট নাগরদোলা। আর ক'বছর ধরে আমাদের আর মুন্সিদের যৌথপুকুর তালপুকুরে মোটর বোট চলছে।মালিকদের ফ্রি। পয়সা লাগে না। তবু চড়া হয়নি।
মেলায় তিনটি জিনিস দেখতে পেলাম না। আমার দেখার ভুল হতে পারে বলে ঋজুর সঙ্গে সকালে মেলালাম।
এক, খোসাসুদ্ধ বাদাম ভাজা
দুই, ঘুগনি
তিন, নানা কিসিমের বইয়ের দোকান। ভাগ্য গণনা, জ্যোতিষ, সিনেমার বই এবং গানের বই।
গ্রামের মেলায় ঘুরে গিয়েছিলাম আদিবাসী পাড়া। রাত হয়েছে। সব বাড়ি ঘোরা হয়নি। ফিরতে হল। পরে দেখা যাবে। ফেরার পর খবর পেলাম উত্তরপাড়ার চাঁদুচাচা মারা গেছেন একটু আগে।হিন্দু মুসলিম আদিবাসী কেউ মারা গেলেই মসজিদের মাইকে ঘোষণা হয়।
হয়েছে।
চাঁদুচাচা আমাকে কোনওদিন তুই বলেননি।ছোট থেকেই তুমি।
বড় শৌখিন মানুষ।
সবসময়।
পড়াশোনায় তেমন আগ্রহ ছিল না, কিন্তু খেলাধুলায় দুরন্ত।
গ্রামে তিনজন বুট পরে মাঠে নামতেন। গোলাম রসুল, চাঁদু এবং গোরাচাচা।
চাঁদুচাচার অনেক গল্প আছে। পরে লিখবো।
চাঁদু চাচা চলে গেছে। মেলা চলছে।
আমার একটা পুরানো কথা মনে পড়ল।
সাধন কাকার মা মারা গেছেন।
সাধন কাকার মা খুব শৌখিন এবং শহুরে ধরনের ছিলেন। নিজের মধ্যে থাকতেন। বড় সুন্দরী এবং অভিজাত ব্যবহার।
সুতোর সেলাইয়ের কাজ জানতেন অসাধারণ।
হিন্দু মুসলমান সব সম্প্রদায়ের মেয়েরা শিখতে আসতেন বিকেল বেলায়।
বামুনপাড়ার একদল মহিলা বকুলতলায় বসে তাস খেলতেন, লুডো খেলতেন। সে-সব আসরে সাধন কাকার মা নেই। তিনি আছেন সেলাই ফোঁড়াই নিয়ে।
একটা সুতোর কাজের কথা আমার আজও মনে আছে।
মনে হচ্ছে, যেন রাশিয়ার স্তেপ ভূমি।সোভিয়েত নারী / সোভিয়েত দেশ পত্রিকার ছবি দেখে আঁকা।
সাধন কাকার মা যেদিন মারা গেলেন, সেদিন মাঠে চটের সিনেমা হলে সিনেমা প্রদর্শনী।
সাধন কাকার মা মারা গেছেন, সিনেমা থামে নি।
চলেছে।
ঘটনাচক্রে সেদিন রাতে আমি গ্রামে গিয়েছি।
বাবা বাড়ি ফিরলেন রাতে।
খেলেন না।
কেন?
রাগ হয়েছে?
মায়ের ওপর রাগ হলে বাবা খেতেন না।
আমি ভাবলাম, সেটাই।
বললাম, খাবে চলো।
না।
কেন?
সরকার কাকিমা মারা গেছেন।
সেতো কাল শ্মশানে যাবে, ছেলে মেয়েরা এলে।
আমিও গিয়েছিলাম। তুমি দেখে এসেছো তো?
হ্যাঁ। ওখানেই ছিলাম।
তবে খেয়ে নাও।
শোন, সরকার কাকিমা নয় রে, আউশাড়া গ্রাম আজ মরে গেল!
কেন? আমি বিস্মিত।
একজন মানুষ মারা যাওয়ার পরও সিনেমা চলবে পাশেই মাঠে। ভাবতেও পারছি না। এটা আমাদের গ্রাম? মনুষ্যত্ব কি মরে গেল?
বাবা তখন আর পার্টি করেন না।
নতুন নতুন নেতা সব, বাবার যন্ত্রণা বুঝি।
ভোট হারানোর ঝুঁকি কেউ নেবেন না তরুণদের চটিয়ে।
এ-বছর চাঁদুচাচার মৃত্যুর পরদিন গ্রামে যাত্রা ছিল। হয়েছে কি হয়নি খোঁজ নিইনি আর।