তেত্রিশ বছর কেটে গেল, কেউ কথা রাখেনি। এ-কথা আমার গ্রামের দিদিদের বোনেদের সম্পর্কে বলা চলে না। দেখা হয়তো হয় না। কিন্তু দেখা হলে মনেই হয় না, কতদিন দেখা নেই। এই যেমন, ঝুনুদি। আমাদের গ্রামের শান্ত সুভদ্র মাস্টারমশাই শান্তি চক্রবর্তীর মেয়ে। দেখা হল ৩৩ বছর পেরিয়ে। দেখা হতেই বললেন, আয়। ঘরে আয়।
একেবারে শোবার ঘরের ভিতরে বন্ধু তাপস, ওর বউ, বোন রুনুর সঙ্গে বসে জমিয়ে আড্ডা হল। কবে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে আমি 'আজকাল'- এ একটা দীর্ঘ রবিবাসরীয় লেখা লিখেছি, বদলে যাচ্ছে গ্রাম। দিদি যাকে বলে লাইন বাই লাইন বলে দিতে পারলেন। জানালেন, আজকাল-এ আমার লেখা বা খবর বের হলেই পাড়া সুদ্ধ সবাইকে জানতেন, আমার ভাই লিখেছে। এখনও নাকি টিভিতে দেখালে, পাড়ার লোকদের বলেন, আমার ভাই।
গতকাল ঝুনুদিকে ফোন করেছিলাম। 'হিন্দু' বিয়ের আশির দশকের প্রথা নিয়ে জানতে। কথায় কথায় জানালেন, মেজদির কথা। বললেন, মর্নিং স্কুল বা দিনের স্কুল তোদের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতাম। ঘরে ঢুকে বসতাম। রুবি ছিল আমার বন্ধু। রুবি আমার মেজদি। একসঙ্গে স্কুল যেতাম। একসঙ্গে ফিরতাম। ঝুনুদির মুখেই জানলাম, মেজবুবু ক্লাসে ফার্স্ট হতো। সেকেন্ড যিনি হতেন, সেই দীপুদা এখন আমেরিকায়। বিজ্ঞানী। দীপুদার মা নাকি দীপুদার কপালে কাজলের টিপ দিয়ে দিতেন ছোটবেলায়, যাতে নজর না লাগে। তিন মেয়ে এক ছেলে। দীপুদা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের সঙ্গেই আসন পেতে বসতেন। তখন স্কুলে বেঞ্চ ছিল না। নিজের নিজের আসন নিয়ে যেতে হতো। আমাদের সময় অর্থাৎ বছর চারেক পরে তৃতীয় শ্রেণি থেকে বেঞ্চ চালু হয়
মেজবু এইট পর্যন্ত পড়ে। তারপর বিয়ে হয়ে যায়, সেকালের রীতি মতো। গ্রামে এইট পর্যন্তই ছিল। ক্লাসে প্রথম হয়েছে বরাবর। একবারের জন্যেও সেকেন্ড হয়নি। পরেও মাস্টারমশাইদের মুখে শুনেছি, চলন্ত ওয়ার্ড বুক ছিল রুবি। সেই মেয়ে চোদ্দ পেরিয়ে পনের পড়তে না পড়তেই গেল লোকের বাড়ি হাঁড়ি ঠেলতে। আর সেকেন্ড বয় গেল আমেরিকা। বিজ্ঞানী হতে। সেকেন্ড বয় ছিলেন সেহারা হাইস্কুলের রসায়ন শিক্ষকের সন্তান। মেজবুকে পড়া দেখিয়ে দেওয়ার তেমন কেউ ছিলেন না। আব্বা রাতদিন রাজনীতি সমাজসেবা নাটক ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত। কোনওদিন আমাদের পড়াতে বসাননি। অ আ ক খ, স্লেটে আগে ঘোষানো ও ঘষানোর নিয়ম ছিল। স্লেটে একজন লিখে দিতেন, তার ওপর দাগা বোলাতে হতো পেন্সিল দিয়ে। আজকালকার ছেলে মেয়েরা তো স্লেট পেন্সিল কী জানলোই না!
আমার মেজদিকে মাত্র ১৭ বছর বয়সে মরতে হয়। বধূহত্যা। নোড়া দিয়ে দাঁত ভেঙে মুখে বিষ দিয়ে মারা হয়। পরের দিন তাঁর স্বামীর সঙ্গে অন্যত্র গিয়ে ঘর বাঁধার কথা ছিল।
যথেষ্ট পণ পাওয়া যায়নি এবং সুন্দরী বউয়ের বই পড়ায় বড় মন, এই ছিল শাশুড়ির অভিযোগ।
আমার খুব অবাক লাগে, রবীন্দ্রনাথের মতোই আমার বাবা কেন, অল্প বয়সে বড় এবং মেজ মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন?
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমার একটা বড় আক্ষেপ। কী ভাবতেন, পীরালি ব্রাহ্মণ তথা মুসলমান সংসর্গ দোষ আছে বা ব্রাহ্ম বলে মেয়েদের বিয়ে হবে না? নাকি পরিবারের হালচাল দেখে? না হলে কেন এত অস্থির হতেন?
আমার বাবা যথেষ্ট প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। বড়দি মেজদি দুজনেই নাটক করত। খেলাধুলা করতো। কোনও বাধা দেননি।
কিন্তু বিয়ে কেন অষ্টম শ্রেণি পাসের পরই?
প্রথমত, গ্রামের স্কুলে অষ্টম শ্রেণির বেশি ছিল না। ৯৯ শতাংশ মেয়ের পড়াশোনা এখানেই শেষ। হিন্দু মুসলমান সবাই এরপর পাত্র খুঁজতে শুরু করতেন।
তবে গ্রামের দুই শিক্ষক এই ভুল করেননি।
ঝুনুদির বাবা শান্তি চক্রবর্তী এবং উমাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। উমাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম দুই মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে দিলেও ছোট মেয়ের দেননি। সে অবশ্য আমার সেজদি এবং ছোটবোনের ক্ষেত্রেও খাটে। সেজদির বিয়ে হয় ২১+ বয়সে। ছোটবোন এম এ বিএড পাস করার পর ২৪ বছর বয়সে। মেজদির সহপাঠিনী ও প্রাণপ্রিয় সই ঝুনুদি গ্রামের প্রথম মেয়ে যে কলেজে ভর্তি হয়। ঝুনুদি পঞ্চম শ্রেণি থেকেই বাবার স্কুলে পড়তে যেতেন। তিন কিলোমিটার দূরে, পলাশনে। সেখান থেকে মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে যান ছয় কিলোমিটার দূরে শ্যামসুন্দর কলেজে।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করার আগেই হাওড়ায় বিয়ে হয়। বিয়ের পর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেন ও পরবর্তী উচ্চশিক্ষা করেন।
ঝুনুদিকে জিজ্ঞেস করছিলাম, হিন্দু বিবাহ রীতি নিয়ে।
গায়ে হলুদের সময় মেয়ে হলে তিনজন এবং ছেলে হলে পাঁচজন এয়োতি লাগে। তাঁরা গান করে করে ছেলে বা মেয়েকে মায়ের কোলে বসিয়ে দেন । মেয়ের মুখ ঢাকা থাকে। যাতে সূর্য দেখতে না পান।
এই মহিলারা হবেন 'নিখুঁতি'। বিধবা হলে চলবে না।
ধান দূর্বা তেলের ব্যবহার তো আছেই। এছাড়া সকালে সাত পুকুরের জল তুলে আনার রীতি আছে কোনও কোনও বাড়িতে
আমার সেজদি রিজিয়া, শিশু বিদ্যালয় শিক্ষিকা জানালেন, মুসলিম বাড়িতে ছেলে হলে নয়জন নিখুঁতি মহিলা এবং মেয়ের বেলায় সাতজন 'নিখুঁতি' মহিলা লাগে গায়ে হলুদের সময়। ধান দূর্বা সরষে হলুদ লাগে। নোড়া দিয়ে গড়িয়ে দেওয়া হয় মাথায়। এর নাম উষু তেল।
এরপর গান গাইতে গাইতে মহিলারা ছেলে বা মেয়েকে নিয়ে গিয়ে মায়ের কোলে বসিয়ে দেন।
এখানে 'নিখুঁতি'র সংজ্ঞা হচ্ছে, বিধবা বা দুবার বিয়ে হলে হবে না। এবং তাঁর কোনও ছেলে বা মেয়ের মৃত্যু হলে হবে না।
মুসলমান সমাজে বিধবা বিবাহ ছিল। আমাদের গ্রামেও একজনের বিয়ে আমি ছোটবেলায় দেখেছি। তবে মুসলমানরা যত ভদ্রলোক হল, তত নানা কু-আচার শিখল।
আগে কন্যাপণ ছিল। পঞ্চাশের দশক থেকেই বরপণ একটু একটু করে চাল হয়। এখন তো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার অধ্যাপক শিক্ষক ব্যবসায়ী ইত্যাদি ভেদে পণ আকাশছোঁয়া।
বিধবাবিবাহ আর দেখি না। শুনিও না।
জাকাত দান ধ্যান এখনও আছে। এটাই সান্ত্বনা।
আজই একটা বই পড়ছিলাম। বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও চিন্তক আমীরুল ইসলাম ভাইয়ের জন্য বই কিনতে গিয়ে কেনা।
সেখানে দেখি, রবীন্দ্রনাথের মেয়ে রেণুকা অকালে রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। জামাই সত্যেন্দ্রনাথ বউ বা শ্বশুর কারোর প্রতিই কর্তব্য ঠিকঠাক পালন করেন নি। শ্বশুর রবীন্দ্রনাথের পয়সায় ডাক্তারি পড়তে বিদেশ গিয়েও পড়া শেষ না করেই ফেরেন।
বউ রেণুকা অসুস্থ। শ্বশুর তাঁকে নিয়ে আলমোড়া গেছেন চিকিৎসা ও হাওয়া বদলের জন্য। জামাই তখন পাঞ্জাব বেড়াতে ব্যস্ত।
রেণুকার মৃত্যুর সাত মাস পর জামাই আগ্রহ প্রকাশ করলেন শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা করতে। সেখানেও স্থায়ী হলেন না। কিন্তু আশ্চর্য উদারতা রবীন্দ্রনাথের। জামাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে ছায়ার। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। একটা হিল্লে হোক ছেলেটার। বিয়ের চার মাস পর মারা গেলেন সত্যেন্দ্রনাথ। ছায়া বিধবা হলেন। ভয়ঙ্কর মানসিক যন্ত্রণা পেলেন। ঠিক করলেন, ছেলের বিয়ে দেবেন বিধবার সঙ্গে।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার বাবার অদ্ভুত মিল আরেক জায়গায়। আমার মেজদির শোচনীয় মৃত্যুর পরও জামাইবাবু আমাদের বাড়িতে সাদরে গৃহীত হয়েছেন। পরের বউ বাবা মাকে নিজের বাবা মা বলেই জানতেন। নিয়মিত আসতেন। এই বৌয়ের অপমৃত্যুর পরও তৃতীয় বিবাহ করেন জামাই। তবু সম্পর্ক ত্যাগ করেননি। বাবার কথা ছিল, আমি কাউকে ছাড়ি না। যদি সে আমাকে না ছাড়ে।
আমার বড়দির মৃত্যুর পর জামাইবাবু বিয়ে করেন। তিনিও বাবা মায়ের মেয়ে হয়ে যান।
এখনও নিয়মিত যাতায়াত আছে আমাদের।
বাবারা কী করে এত উদারতা দেখাতে শিখেছিলেন?
বিস্ময় জাগে।