আমাদের গ্রাম ও আশপাশের গ্রামের কোনও মানুষ, হিন্দু মুসলমান আদিবাসী, কেউই বৃহস্পতিবার ধান বিক্রি করতেন না।
বৃহস্পতিবারকে হিন্দু মুসলমান সবাই বলতেন লক্ষ্মীবার।
লক্ষ্মীবার ধানের খটি বন্ধ থাকতো।
বাজারের বড় মুদি দোকান বন্ধের দিনও ছিল লক্ষ্মীবার।
ভালো ভালো দোকানের নাম হতো লক্ষ্মী দিয়ে। দুর্গা রাজত্ব করতে শুরু করেছেন আশির দশকের পর।
গ্রাম বাংলায় ছিলেন বসন্ত, কলেরা, বাঘ, শেয়াল, ভালুক, সাপের থেকে বাঁচানোর দেবীদের রাজত্ব।
আমাদের গ্রামে ওলাইচণ্ডী পূজার পর ছিল মনসার পূজা।
মূর্তি আসতো না। মাঠে পূজা। অরন্ধন হতো। একদিন উনুনকে অবসর দেওয়া হতো।
হিন্দু মুসলমান সব বাড়িতেই মাটির উনুন ছিল। গ্যাসের কথা কল্পনাতেও আসেনি। ফ্রিজের নাম শুনিনি। টেলিফোনের কথা জানতাম। দুটো দেশলাই বাক্স সুতো দিয়ে জুড়ে আমরা টেলিফোন বানিয়েছি। গরমকালে কাঁচা তাল কেটে তার শাঁস আঙ্গুল দিয়ে বের করে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। শহরের মতো কেটে বের করে নয়। সেই তালের মাঝে কঞ্চি জুড়ে আমাদের গাড়ি হতো। তালপাতার ওপরে কেউ বসলে তাকে টেনে নিয়ে যেতাম।
লোহার রিঙ বানিয়ে লাঠি দিয়ে হেট হেট করে নিয়ে দৌড়াতাম শীতকালে।
লক্ষ্মীপূজা হল মূর্তি এনে প্রথম ১৯৭৬-এ। পণ্ডিতপাড়ায়। তখন পুরানোরা বলতেন চাঁড়ালপাড়া, নবীনরা পণ্ডিতপাড়া। ওই পাড়ার সবার পদবী পণ্ডিত। তিন পরিবারের সদস্য বেড়ে এবং যুদো/ পৃথক হয়ে ১৯৭৮ নাগাদ আটটি পরিবার হয়। এখন অনেক। লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে নাটক করেন দাদা ও দাদার বন্ধুরা।
কে দেবে জবাব?
রাজদূতের লেখা।। নায়ক দাদা। খলনায়কের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন জয়দেব পণ্ডিত। মাত্র দুজন অভিনেতা ছিলেন জন্মসূত্রে 'হিন্দু'। বাকি সবাই জন্মসূত্রে 'মুসলমান'। হ্যাসাক জ্বালিয়ে অভিনয়। মঞ্চ হয় বাড়ির মহিলাদের কাপড় দিয়ে। পর্দা বিছানার চাদর।
সেফটিপিন দিয়ে দিয়ে কাপড় জুড়ে তিনদিক ঘেরা মঞ্চ।
মাইক একটা ছিল। মাঝখানে গোল মতো মাইক্রোফোন। কে পরোয়া করে মাইক্রোফোনের। মুখেই সব। এই নাটক থেকে যাত্রার দলে নতুন রক্ত উঠে এল। নতুন অভিনেতাদের বাবারা ছিলেন যাত্রার দলে। নতুনরাও মাঘ মাসে যাত্রা করল। বেশ ভালো অভিনয়।
পরের বছর বড়দের দলেও কেউ কেউ ঠাঁই পেলেন। আমার বাবা তো রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা। ৫০ বছরের বেশি সময় অভিনয় করেছেন। আমাদের চার ভাইয়ের সঙ্গেই যাত্রা করেছেন। আমাদের সেজ বৌমার সঙ্গেও।
ঘরে ঘরে মেয়েদের চাল জমিয়ে দান ধ্যান করা ছাড়াও নিজেদের ফিতে আয়না চিরুনি সেফটিপিন নকল হার দুল কেনার জন্য ভরসা ছিল লক্ষ্মীর ভাঁড় আর হাঁস মুরগি ছাগল পালন।
হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মুরগি পালন করতেন না। তাঁদের ঘরের মেয়েরা হাঁস পালন করতেন। কোনও হিন্দু বাড়িতেই মুরগি ঘরে রান্না করা যেত না। ফিস্টিতে খেতে হতো। মুরগিকে বলা হতো রামপাখি। মুরগির ডিমকে রামফল। জ্বর সর্দি হলে শরীর দুর্বল হলে প্রেসার লো হলে গ্রামের ডাক্তার মুরগির হাফ বয়েল ডিম খেতে নিদান দিতেন। তখন মুসলিম বাড়িতে গিয়ে মুরগির ডিম কিনে আনতে যেতো।
এখন তো মুরগির মাংস জলভাত পোল্ট্রির কল্যাণে। এই পোল্ট্রি আমাদের গ্রামে আসে বামফ্রন্টের বেকার ভাতা দেওয়ার কল্যাণে। বেকার ভাতা পেতেন তিনজন। তিনজনই কংগ্রেসি। এঁরা ম্যাট্রিক পাস করে কর্মবিনিয়োগ কেন্দ্রে নাম লিখিয়েছিলেন। নাসির চাচা ও সালাম চাচা ছিলেন উদ্যোগী মানুষ। দুজনেই আমার খুব পছন্দের মানুষ। তাঁদের রাজনীতি আমাদের পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে কোনও বাধা হয়নি।
বামপন্থী রাজনীতির কারণে ২০০৯ থেকে আমাদের পরিবারকে বয়কট করা হলেও সালাম চাচা, ধনা চাচা ও মাদু চাচা নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। এসেছেন। আর এসেছেন ব্রাহ্মণ সন্তান পীরে কাকা।
সালাম চাচা ও নাসির চাচা কর্মবিনিয়োগ কেন্দ্র থেকে বামফ্রন্ট সরকারের দেওয়া ঋণ নিয়ে গ্রামে প্রথম পোল্ট্রি করলেন। গ্রামের বাইরে মাঠে।
তখন ঘরোয়া মুরগির মাংসের দাম ২০ টাকা। ছাগলের মাংসের নাম তখন মাটন হয়নি। দশ টাকা কিলো।
এবার পোল্ট্রি এসে দাম হল ১৫ টাকা কেজি।
মুরগি কিনে নিয়ে এসে বাড়িতে এনে জবাই বা কেটে আগুন দিয়ে ঝলসে ছালের গায়ে লেগে থাকা পালকের গোড়া তুলে রান্না।
ছালসমেত মাংস খাওয়া ছিল রীতি। শুধু ছাল খেতে যে কী ভালো লাগতো!
ভাবাই যায় না, দেশি মুরগির ছালের স্বাদ।
মুরগির ঠ্যাং ছিল রইস ব্যাপার। নাম ছিল, মুরগির রান। জামাইকে দেওয়া হতো। আর বড় মাছের মাথা।
মাথার তখন সম্মান ছিল।
এখনকার মতো মাথাহীন জীবন ছিল না।
পদবী না বললে, নাম শুনে বোঝা যেত না হিন্দু না মুসলমান ছেলে বা মেয়ে।
ঘরে ঘরে সোনা, হীরা, মানিক, মুক্তো নামের ছড়াছড়ি।
সোনা, হীরা, মুক্তো -- ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের নাম হতো।
বকুল ছিল ছেলেদের নাম।
দীপু ছেলে এবং মেয়ে -- দুজনকেই ডাকা হতো।
খোকা, কচি নামে ডাকা হতো ছোটদের। হিন্দু মুসলমান সব বাড়িতেই।
তপনকুমার, উত্তমকুমার, তরুণকুমার বহু ছেলের নাম।
কুমার বাদ যেত মুসলমানদের বেলায়।
পোশাক দেখে চেনার কোনও আলাদা উপায় ছিল না। পুরুষের দল ঘরে লুঙ্গি পরতেন। বাইরে ধুতি পাঞ্জাবি।
১৯৭০ এর পর থেকে নবীনরা বাইরে প্যান্ট শার্ট পরতে লাগলেন।
প্যান্টের আবার হরেক নাম। প্যান্টুলুন, বেলবটস, বেলবটম।
কোনও কোনওটা ৩২ ইঞ্চি হতো পায়ের দিকে। তলায় চেন দেওয়া থাকতো। উপরে চোঙা নীচে রাস্তা ঝাঁট দেওয়া।
চুলের কাটিং দু একজনের আলাদা হল। বিশেষ করে গোরাচাচা আর দক্ষিণ পাড়ার দুয়েকজনের। মিঠুন ছাঁট, বচ্চন ছাঁট এল। বাবার মতো যাত্রা করা লোকদের চুল ছিল ব্যাক ব্রাশ। স্কুলের ছেলেমেয়েদের চুলের কায়দাকানুন নিষিদ্ধ। পিঠের চামড়া তুলে দেবেন স্যাররা।
বিয়ে শাদিতে যাঁদের পয়সা আছে ব্যান্ড পার্টি আনাতো। ছেলের বিয়েতে। বুকে নারকেলের মালা পরে মেয়ে সেজে ব্যাপক নাচ হতো।
মাইক বাজাতো নিদেন পক্ষে। পয়সাওয়ালা মুসলমানদের বিয়েতে কনের বাড়িতে ঢোকার আগে দূরে পুকুর পাড়ে বসে প্রচুর বাজি পটকা ফাটিয়ে জানান দেওয়া হতো।
হিন্দু মুসলমান সব বিয়েতেই বরকে রাস্তায় আটকাতো ছেলে ছোকরারা । পণ অনুযায়ী টাকা আদায় করতো গ্রামের রাস্তা উন্নয়ন করার জন্য।
নতুন জামাইকে শালিরা লঙ্কার শরবত খাওয়াতোই।
হিন্দুদের বিয়েতে বাসরঘরে ছড়া গান বানিয়ে বানিয়ে গাইতেন বয়স্করা। পরে ওটা অন্ত্যাক্ষরী হল।
আর মুসলমানদের বিয়েতে তিনদিন ধরে ক্ষীর খাওয়ানি।
গায়ে হলুদ ছিল তিনদিনের।
ওই তিন দিন সন্ধ্যায় ক্ষীর খাওয়াতে আসবেন গ্রামের মানুষ। শুধু ক্ষীর নয় মাছ মাংস ডিম নানারকম মিষ্টি থাকতো। খাইয়ে তাঁকে আশির্বাদ বা দোওয়া করতেন সাধ্যমতো পয়সা দিয়ে।
এটা মেয়ের বা ছেলের নিজস্ব সম্পদ বলে গণ্য হতো।
আর বাজত ঢোল। নেচে গেয়ে জমিয়ে দিতেন আত্মীয় কুটুমরা।
বানিয়ে বানিয়ে গান তৈরি হতো।
বিয়ের আগের দিন ব্যাপক রঙ খেলা।
বড় বড় চৌবাচ্চা বা ড্রাম বা বালতিতে রঙ গুলে পিচকিরি দিয়ে হিন্দি সিনেমায় যেমন হোলি দেখেন তেমন কাণ্ড হতো।
বিয়ের আগের রাতে মুসলমান বাড়িতে কাগজের শিকলি কেটে বিয়ের আসর সাজাতেন অনেকেই।
আম গাছের ডাল হিন্দু মুসলমান সব বিয়েতেও গেটে লাগানো হতো।
এখন তো ডেকরেশনের যুগ।
বাড়ির ছেলে মেয়েদের শুধু খাওয়া আর সাজা এবং গুলতানি বা পরনিন্দা পরচর্চার কাজ।