বছর তের আগে পাড়ায় এসে দেখি তিনটি কালো কুকুর। খুব আপত্তি সবার। আমারও খারাপ লাগে। একটা কুকুরের পিছন দিয়ে রক্ত বের হয়। সিঁড়ি জুড়ে রক্ত দাগ। এক সরকারি কর্মকর্তাকে বললাম। তিনি এক চিকিৎসকের ফোন নম্বর দিলেন। ডা. মুখার্জি। পশুপ্রেমী। তিনি বললেন, কুকুরটার বোধহয় ক্যান্সার হয়েছে। অপারেশন দরকার। ১৫০০ টাকা লাগবে। আমি একজনকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। যিনি নিতে আসবেন তাকে দিয়ে দেবেন।
আমার একটু খারাপ লাগল। আমাদের সমস্যা। উনি কেন টাকা দেবেন।
যাক, চিকিৎসা হল। কুকুরটি ফিরে আমার ঘরের সামনে দরজায় আশ্রয় নিল। খাবার দেওয়া শুরু করলাম।
তিনটি কুকুর। নারী ভুলুনি।
আর বাকি দুই তার অনুগত প্রেমিক। একদিন ভুলুনি উধাও। ফিরল কদিন পর এক সিংহ মার্কা রঙের ষণ্ডামার্কা একজনকে নিয়ে। এক নারী তিন পুরুষ।
আগের তিন কুকুরের রঙ ছিল কালো।
এর রং পিলে।
এর আগে ভুলুনির ছিল একছত্র অধিকার।
অন্যদের খাবার খেয়ে নেয়। অন্যরা কিছু বলতো না উল্টে কৃতার্থ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকত।
নতুন প্রেমিক গুন্ডা টাইপ। সে সবার খাবার খেয়ে নেয়।
দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়াতে হয়।
একদিন ভুলুনি রাস্তায় দুর্ঘটনায় মারা গেল।
এর আগে পাড়ায় নতুন কুকুর এনেছে একটি পরিবার। দেশি পাঁচটি লাল রঙের কুকুর। তাঁরা এদিকে এলেই মারামারি শুরু হতো।
ভুলুনি মারা যাওয়ার পর দুই কালো প্রেমিক মারা গেল । শোকেই বলা যায়। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিল একেবারেই।
গুণ্ডাটির কিন্তু হেলদোল দেখা গেল না। নতুন বান্ধবী জুটে গেল তার।
আগে আমি কালো কুকুর দলের পক্ষ নিতাম। দেখতাম বে পাড়া থেকে লাল রঙের কুকুরের দল এসে হামলা করতো কালো কুকুরদের ওপর।
কিছুদিন পর দেখা গেল লাল রঙের কুকুরের সংখ্যা দশের বেশি। তাঁর পাঁচটি আমার খাবারের অপেক্ষায়।
পাঁচ অল্পদিনে দশ হলো। দশজনেই আশ্রয় নিল। আস্তানার সামনে।
খাবারের পরিমাণ বেড়েছে।
কিছু লোকের বিরক্তিও সমানে।
এক 'ভদ্রস'লোক বিষ দিয়ে মেরে দিলেন পাঁচটি কুকুর। শিয়ালদহ এন আর এস কাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে। শিয়ালদহ এন আর এসে হোস্টেলে ২১টি কুকুরকে বিষ দিয়ে কে বা কারা মেরে দেয়।
ইতিমধ্যে একটি ছোট বাচ্চা জন্মেছিল। সে খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল আমার। আওয়াজ পেলেই দল নিয়ে ছুটে আসে। সামনে দাঁড়িয়ে না খাওয়ালে খায় না ভুলুনির মতো।
আমি এর কোন নাম দিই নি। কুকুরের মায়া বড় মায়া। সে বড় হল। তরুণী হল।
এক রাতে দরজা খুলতেই কুকুরটি ঘরে ঢুকে পড়ে আমার শোবার ঘরে চলে এল। অতি কষ্টে তাকে বের করা গেল।
পরদিন একই কাণ্ড।
এর পরদিন কুকুরটি হারিয়ে গেল।
একেও কি মেরে ফেলল? কদিন খুব খুঁজলাম। এদিকে সেদিক।
তারপর দিন পাওয়া গেল। প্রবল চিৎকার কুকুরের দলের।
দেখি শীর্ণ না খাওয়া ময়লা মাখা চেহারা নিয়ে তিনি হাজির।
ওকে ডেকে খাবার দিলাম। দেওয়া মাত্রই বিরোধীদের আপত্তি।
কেন খাবেন ও?
খেয়ে রাতে ঘরের সামনে থাকল।
এভাবে কদিন কাটার পর তাকে দেখা গেলনা।
এখন অন্য কুকুরের চিৎকার শুনলেই বুঝি--ও ফিরেছে।
একদিন ২০১৮তে শঙ্খ ঘোষের বাড়ির রবিবারের আড্ডা সেরে দেখি ও হাজির।
খেতে দিচ্ছি। ভয়ে খাচ্ছে না। অন্য পক্ষ হাজির।
তাঁরা সংখ্যায় চারজন।
এ একা।
সংখ্যালঘু।
নিজের জন্মভূমিতে সে পরবাসী।
ভীত।
শঙ্কিত।
বলশালীর সাহায্য ছাড়া নবাগতদের আক্রমণে সে অসহায়।
এখন কুকুরের দল আরেক দলের সঙ্গে ঝগড়া করলে আমি বলি, মানুষের স্বভাব পেয়ে গেলি।
একদল আরেকদলকে সহ্য করতে পারিস না!