আহা রে আহারে মিলল সিঁদল। আসাম থেকে বাংলা ভাষা আন্দোলন ও সংস্কৃতি সংগঠক দীপক সেনগুপ্ত সিঁদল শুঁটকি এনেছেন। এলেই নিয়ে আসেন। আমার খুব প্রিয়। অথচ ২০১১-র আগে কখনও এটা খাইনি। হাইলাকান্দিতে গিয়ে খাই। ২০১০-এ ট্রেনে দুর্ঘটনায় আমি প্রচণ্ড আহত হই। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা। চারটি পাঁজর ভাঙ্গা। মেরুদণ্ডে চোট। আঙ্গুল ভাঙ্গা। অপারেশন হয়েছে। আমাদের ভাষায়, কড়া অ্যান্টিবায়োটিক চলছে মাসাধিককাল ধরে। (কড়া অ্যান্টিবায়োটিক শুনলেই ডাক্তার ক্ষেত্রমাধব দাস চেঁচিয়ে উঠবেন, কড়া আবার কী?) মুখ বিস্বাদ। পেট খারাপ লেগেই আছে। খেতে ইচ্ছে করে না। খেয়ে সুখ পাই না। এমন সময় আসামে এক সর্বভারতীয় আলোচনাসভায় যেতে হয় নীতীশ ভট্টাচার্যের আমন্ত্রণে। সেখানেই এক অধ্যাপক বাড়ি থেকে সিঁদল শুঁটকি (হিঁদল) এনে খাওয়ান। তারপর অতিথিশালাতেও জোটে। আসার সময় আমাকে এক বাটি সিঁদল দেন কাচের কৌটায়। আমি ২৫ দিন ধরে আঙ্গুলে একটু একটু করে লাগিয়ে খাই। এরপর ত্রিপুরায় খাই। লিখতে লিখতে মনে পড়ল, শিলিগুড়িতে আমার এক ডাক্তার বন্ধুর ত্রিপুরী শাশুড়ি খাইয়েছিলেন শুঁটকি। তখন এটা যে সিঁদল জানতাম না। অনেকেই অবাক হবেন জেনে, আমাদের গ্রাম বাংলার বহু এলাকাতেই শুঁটকি খাওয়া হয়। বেশ খাওয়া হয়। বর্ধমান বীরভূম মুর্শিদাবাদ সর্বত্র।
কিন্তু সে-সব চিংড়ি শুঁটকি, পুঁটি শুঁটকি, বিমলা শুঁটকি, নোনা ইলিশ।
বিমলা এখন বুঝি লটে শুঁটকি। আর ছিল ফ্যাঁসা মাছের শুঁটকি। মাথায় করে গ্রামে বেচতে আসতেন শুঁটকিওয়ালা। একজন আসতেন সাইকেল করে। সাইকেল তখন মহার্ঘ বস্তু। বিয়েতে লোকে পণ হিসেবে নেয়।
তাঁর কাছে নোনা ইলিশ মিলতো। পেঁয়াজ ভাজা ভাজা করে কষা নোনা ইলিশ যে কী দারুন।
পৃথিবীর সব মা-ই তাঁর ছেলের কাছে সেরা রাঁধুনি। আমার মায়ের নোনা ইলিশ শুঁটকি ছিল অপূর্ব। আরেকটি ছিল ফলুই মাছের রোস্ট। ফলুই মাছকে নোড়া দিয়ে কুঁচে ভেতরের কাটা সমেত মাংস বের করে কাঁটা বেছে বেছে বাদ দিয়ে আদা জিরে ধনে নুন সামান্য লঙ্কা দিয়ে মাখিয়ে ভেতরে পুরে পেট সেলাই করে এপাশ ওপাশ হালকা করে তেল দিয়ে সেঁকে সেঁকে গোটা ফলুই মাছ পরিবেশন। আমার অকালপ্রয়াত বড়দিও এটি করতেন। আমি তাঁর বাড়ি গেলেই দিদি খোঁজ করতেন ফলুই মাছের। আমার দিদি বোনেরা সবাই রন্ধন পটিয়সি। মায়ের প্রভাবে গরম মশলা কম, গোটা জিরে শিলে বাটার রাজত্ব কড়াইয়ে।
এই রান্না প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল, একবার, বোধহয় ১৯৭৭/৭৮, পাশের গ্রাম ধারানে ফুটবল ম্যাচ খেলা। সেমিফাইনাল। আমাদের গ্রামের হোমটিম বেশ ভালো ছিল। কিন্তু সেমিফাইনালে গিয়েই আটকে যেত। এইজন্য বাইরে থেকে খেলি/ খেলোয়াড় হায়ার করে আনা হয়েছে। বর্ধমান শহর থেকে একদল। সঙ্গে এলাকার প্রসিদ্ধ খেলোয়াড় জিন্না। একমাথা কোঁকড়া চুল। ফর্সা রঙ। বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে যেত। তখনকার দিনে ৫০ টাকা প্রতি ম্যাচ। আমাদের গ্রামকে টাকা দিতে হয়নি। গ্রামে বোনের বিয়ে হয়েছে।
কী করে টাকা নেয়!
গোলকিপারের নাম যতদূর মনে পড়ে রামু। বর্ধমানের খ্যাতিমান খেলোয়াড়। দাদা তখন রাজ কলেজের জিএস। তাঁর সুবাদে এসেছে। পয়সা লাগেনি। কিন্তু খাওয়া দাওয়ার মোচ্ছব। আমাদের বৈঠকখানায় উঠেছে। গর্বে বুক ফুলে উঠছে। একবার খেলোয়াড়দের দেখছি আরেকবার ছুটছি চুলোশালে।
পুকুরে জাল ফেলে বড় বড় মাছ ধরা হয়েছে। অন্যবার ভাজা মাছ জোটে পাতি করে। এবার সব বাইরের জন্য।
কিন্তু এক বিরাট হাঁড়িতে লম্বা লম্বা আলু আর টমেটো দিয়ে মাছের ঝোল হয়েছে। লালচে রঙ। মনে পড়তেই খিদে পেয়ে গেল, তাহলে তখন কী অবস্থা হয়েছিল ভাবুন।
ভাবছি, জুটবে!
আমার মা মাছের ঝোল তরকারি করলে মাছ ভাজতেন না। এতে স্বাদ দারুন খুলতো।
কিন্তু দুঃখের কথা কী আর বলি, খেতে বসে দেখলাম, সে-সব আমাদের জন্য নয়।
বাবার কড়া হুকুম, খেলিদের খাবার, খেলিরাই খাবে।
বিপুল ভোজনের পর তিন কিলোমিটার মাঠে মাঠে হেঁটে চললেন তাঁরা। আমরাও ।
কেউ কি সাইকেলে করে নিয়ে গিয়েছিল তাঁদের, মনে নেই।
যাক, খেলার আগে একটু দৌড়ঝাঁপ। আপ্লুত। গোলি/ গোলকিপারকে মনে হল লেভ ইয়াসিন। কিন্তু খেলা যত এগোতে লাগল, বিপক্ষ দলের দাপট বাড়ল। হায়ারি খেলিরা পা বাঁচিয়ে খেলতে লাগল। সেমিফাইনাল হাতছাড়া। লোকে বলল, হোম টিম হলে জান লড়িয়ে খেলত, হারতো না।
আগের অধ্যায়ে লিখেছি প্রমোদ দাশগুপ্তের কথা। মনে পড়ল প্রমোদ দাশগুপ্ত দলকে বিপ্লবী পার্টি থেকে বিপ্লবী গণপার্টি করে তোলেন। এই নিয়ে আসানসোলের প্রবাদপ্রতিম শ্রমিক নেতা হারাধন রায়ের আক্ষেপ শুনেছি।
হারাধন বাবুর কথা সবিস্তারে লিখতে হবে পরে। আপাতত, এটুকু বলা যাক, নীলরঙা চাইনিজ শার্ট। শুতেন একটা তক্তাপোশ জাতীয় চৌকিতে। তাতে একটা পাতলা চাদর। থাকতেন পার্টি অফিসেই। একবার তাঁর সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে কয়লাখনি এলাকায় যাচ্ছি। একজায়গায় জিপ থামিয়ে একজন কানে কানে একটা খবর দিলেন। এক স্থানীয় পার্টিনেতা খুনের খবর। হারাধন রায় আক্ষেপ করলেন, বিপ্লবী পার্টিকে বিপ্লবী গণপার্টি বানিয়ে প্রমোদবাবু যে ক্ষতি করলেন, তার খেসারত দিচ্ছি।
পরে বুঝলাম, অন্তর্দলীয় খুন। সেটা ১৯৯০।
প্রমোদ দাশগুপ্তের স্মরণসভা হয়েছিল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে।
সুবিশাল সমাবেশ।
জ্যোতি বসু, সরোজ মুখোপাধ্যায়, ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ বক্তা। ছিলেন জনতা দলের প্রফুল্লচন্দ্র সেন, ইন্দিরা কংগ্রেসের গোপালদাস নাগ। ইন্দিরা গান্ধী তখন কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত। দুবার বিতাড়িত হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কংগ্রেস থেকে।
১৯৭০-এর দশকে কংগ্রেস দুটো। আদি কংগ্রেস নব কংগ্রেস।
১৯৮০-র দশকেও দুটো।
মূল দল কংগ্রেস (আর)। আর বিপক্ষে কংগ্রেস (ইন্দিরা)।
জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি তখন দেবরাজ আর্স। তিনি দায়িত্ব নিয়ে পরাজয়ের পর ইন্দিরাকে দল থেকে তাড়িয়ে সভাপতি হয়ে রয়েছেন। সেই দলের প্রতিনিধি প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। সিপিএমের লোকজন তাঁকে গুন্ডা বলত। প্রিয়-সুব্রত তখন জুটি। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন। কিন্তু বক্তা নন।
বক্তৃতা করেন প্রিয় দাশমুন্সি।
সবার শেষে বলতে দেওয়া হল। বলার আগে বলা হল, সংক্ষেপে ভাষণ দেবেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি।
মাত্র সাত মিনিট বলেন।
অনুপ্রাস আর ভাষার ছটায় কাব্যিক বাচনভঙ্গিতে মাতিয়ে দিলেন সভা।
এতক্ষণ যে বক্তৃতা হয়েছে সব ম্লান। জ্যোতি বসুর চেয়েও সেদিন ভাষণ দিয়ে জনপ্রিয় হয়ে গেলেন প্রিয় দাশমুন্সি।
সবাই বললেন, বক্তা বটে।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রমোদ দাশগুপ্তের ভূয়সী প্রশংসা করে বললেন, রাজনৈতিক শিষ্টাচার শিখতে হবে প্রমোদ দাশগুপ্তের কাছে।
লোকে বলল, বক্তৃতা করা শিখতে হবে প্রিয়র কাছে।