গ্রামে দোকানে গেলে চানাচুর টিকটিকি লজেন্স দিত। বর্ধমান শহরে এসে দেখলাম তা আর দিচ্ছে না। পলাশন বা সেহারাবাজারে বাজারে মুদির দোকানে গেলে বলতো, চা খাবে?
বর্ধমান শহরে সে-সবের বালাই নেই।
এখানে কিনিই বা ক-টাকার? সরষের তেল প্রথম দিকে ঘানির তেল আনতাম গ্রাম থেকে। এখন কিনি। একশো গ্রাম করে কিনি। তখনও শহরে পলার ব্যবহার ছিল।
লোকে চার পলা পাঁচ পলা তেল নিত।
গ্রামে সত্তর দশকে দেখেছি, সরষের তেল কেনার ক্ষমতা নাই। দুগোদাকে বলছেন গরিব মানুষ দু ফোঁটা তেল ঢেলে দাও না হাতের তেলোয়। বড্ড খড়ি উঠছে। ১০ পয়সার সরষের তেল নিতে দেখেছি বহুজনকে। একটু ডিম ভাজি করে খাবে। বহুজনের গা ছিল খড়খড়িয়া। গায়ে তেল পড়তো না বহুদিন। মাথার চুল চিটচিটা। শীতকালে সেজন্য মানুষ একটু ভালো করে সরষের তেল কিনে মাখতো। মাথার চুলে গায়ে সব জায়গায় সরষের তেল। আমাদের এলাকায় তখন সরষে ও তিলের চাষ হতো। ১০ কেজি সরষেতে ৩৬০০- ৩৭০০ গ্রাম সরষের তেল হতো। আর ছয় কেজি সরষের তেলে চার কেজি তিলের তেল দিলে ৩৯০০ গ্রাম হতো বংশী কুণ্ডুর তেলকলে।
আমরা সাত কিলোমিটার দূরে বংশীকুণ্ডুর দোকানে সরষের ঘানির জন্য যেতাম। প্রায় সারাদিন লেগে যেত। বংশী কুণ্ডু ছিলেন পার্টির লোক। বাবার বন্ধু । তখন সিপিএমের লোকদের নিজেদের মধ্যে একধরনের আত্মীয়তা কাজ করতো। গ্রুপবাজির প্রবল অসুখ আত্মপ্রকাশ করতে একটু দেরি আছে। একবার শোনা গেল মীরেপোতায় গেলে চার কেজি পাওয়া যাবে।
সেবার সাইকেল ছিল সঙ্গে।
কিন্তু মীরেপোতা তো অনেকটা দূরে। এরমধ্যে হলো কী, লোডশেডিং। বসেই আছি বসেই আছি। বাড়ি থেকে আনা মুড়ি ভিজিয়ে চপ দিয়ে মেখে খেয়েছি।
একবার কারেন্ট এসেই চলে গেল। লোকে তখন আড়ালে বলতো জ্যোতি বসু এসেছে। পরে প্রকাশ্যেই বলতো। কারেন্ট থাকতো না অনেক সময়। ঝড়বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই।
তো কারেন্ট আসার পর জানা গেল, ঘানি কাজ করছে না। মিস্ত্রিকে খবর পাঠালে আজ আসতে পারে বা কাল। কী আর করা যেতে হল মীরেপোতা।
সেখানে গিয়ে শুনি বলছে। সরষে আর তিল দিয়ে দাও চার কেজি তেল দিয়ে দিচ্ছি। বাবার নির্দেশ ছিল, নিজের খেতের সরষে। জাত চিনি। মিল কী সরষে দিচ্ছে ঠিক আছে? রিফাইন তেল মিশিয়ে দিতেও পারে।
তো সেখানেও বিরাট লাইন। দুপুরে গেলাম ছাতু ডাক্তারের চেম্বারে। ছাতু দাদো আমাদের পাশের বাড়ির মানুষ। এখানে দুই ভাই উঠে এসেছেন। শ্বশুর বাড়ির এলাকা। ছাতু ডাক্তারকে তখন ধন্বন্তরী বলা হতো। দার্জিলিংয়ে বিলেতি সাহেব ছিলেন সার্জেন। তাঁর সঙ্গে কম্পাউন্ডারি করে ডাক্তারি শিখেছেন। বিরাট পসার। লোকে বলতেন, বর্ধমানের পাশ করা ডাক্তার ফেল মেরে যায়।
ওষুধ দেওয়া হতো বানিয়ে। বোতলের গায়ে কাগজের খোপ কেটে দাগ।
আমরাও ছোট মামার ডাক্তারির চেম্বারের জন্য কাগজ কেটে খোপগুলো বানাতাম। পোশাকি নাম, ওষুধের লেবেল। লেবেল দেখে খাওয়া।
ছাতু ডাক্তার আমাকে খুব স্নেহ করতেন। বই পড়ার ঝোঁক আর পাকা পাকা প্রশ্ন করার জন্য। ছাতু ডাক্তার, তাঁর বড় ভাই খুব ফিটফাট থাকতেন। সাদা আলখাল্লা জাতীয় পোশাক। তার ওপরে শীতকালে থাকতো জওহর কোট। একটা সাদা রঙের লাল কাজ করা আরবি ধরনের গামছা গলায় থাকতো পরে। খুব সুন্দর দেখাতো।
দারুণ রসিক মানুষ।
সম্পর্কে দাদো হতেন। কংগ্রেসের সমর্থক। কিন্তু আমার বাবার সঙ্গে সুসম্পর্ক।
ছড়া কেটে কথা বলতেন।
একটা কথা মনে আছে:
খেঁদি পেঁচি নূরজাহান
আলো নেভালে সব সমান।
বলেই বলতেন, নূরজাহান কে বলতো?
আমাদের সুন্দরী নুরু ফুফুর নাম ছিল নূরজাহান।
কিন্তু আমি বুঝতাম, উনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের বউ ভারত সম্রাজ্ঞীর কথা বলছেন। ইতিহাসে আগ্রহ থাকাটা কাজে লেগেছিল।
তখনকার দিনে আপনার চেনা অচেনা মানুষ আপনাকে মানে ছোটদের অঙ্ক বিজ্ঞান ইতিহাস ইংরেজি থেকে প্রশ্ন করতেন। পড়াশোনা না জানারা লোকরাও ধরতেন ধাঁধা।
একটা ধাঁধার সমাধান আজও হয়নি।
৩৬টা গোরুকে নয়টা গোঁজে বিজোড় সংখ্যায় বাঁধতে হবে।
এই সমাধান করতে পারলে নাকি ১০ হাজার টাকা পুরস্কার।
কে দেবে? কেন দেবে? এখন আর মনে পড়ছে না। কিন্তু খুব চালু ছিল।
আর ছিল একটা ধাঁধা:
চিৎ করে ফেললাম
তার উপরে চাপলাম
ছাতু দাদো এই ধাঁধাটি ধরেছিলেন আমাদের।
বলতো দেখি, কেমন স্কুলে পড়ছো?
তখনকার দাদোরা যথেষ্ট রসিকতা করতেন।
ধাঁধাটি আপাতদৃষ্টিতে যৌন গন্ধী হলেও নিরীহ।
শিল আর নোড়া।
লুই পাস্তুর কে?
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন কে?
এইসব প্রশ্ন করতেন ছাতু দাদো এবং অন্যরা।
ছাতু দাদো এলেই মা বলতেন ডেকে নিয়ে আয়।
ঘরে আসতেন। বসতে চাইতেন না। বলতেন, ফিরতে হবে। চেম্বারে লোক বসে আছে। থাকতোও। ভোর থেকে ভিড় করে।
মা চারটে ডিম সেদ্ধ আর ঘন দুধের চা এলাচ দিয়ে বানিয়ে দিতেন।
দাদো হেসে বলতেন, চারটে ডিম খাওয়ার বয়স কি আর আছে রে?
মা গ্রামের মেয়ে। দাদোও।
দাদো বাইরে বসে আছি দেখে কম্পাউন্ডারকে ডেকে বললেন, ঘরে দিয়ে এসো। ভাত না খেয়ে যেন না পালায়।
পাকা দোতলা বাড়ি। লাল রঙের মেঝে। দাদোর বউ অল্প বয়সে মারা যান। পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলেকে মানুষ করেছেন বড় ভাবি। তাঁর সন্তান ছিল না। বড় স্নেহময়ী রমণী। আমরা বলতাম বড় মা।
বড় মা আমাদের গ্রামের মেয়ে।
বড় খাতির করে খেতে দিলেন। তাঁর হাতের রান্নাও ছিল চমৎকার।
বিকেলে সরষের তেল নিয়ে ফিরলাম। সঙ্গে নিয়ে আসা হল খোল। ওই খোল গোরুকে খাবার হিসেবে দেওয়া হতো।
সরষে ভাঙাতে কত করে বাণী বা মজুরি ছিল?
এক কেজিতে ছয় বা আট পয়সা। পরে বেড়ে দশ পয়সা হয়।
একবার গম ভাঙতে গিয়ে কী সমস্যা। গরম কাল। মাথায় করে সাত কিলোমিটার দূরের গম কলে গিয়েছি। সকাল সকাল। কারেন্ট থাকলে হয়ে যেতো। ট্রেনে করে ফিরতাম।
বিডিআর ট্রেন। মিটার গেজ। রেল লাইনের ধারেই ছিল গম কল। ছুটে এসে ট্রেন ধরা যেত।
এই ট্রেন ছিল খুবই মজার। জানালায় শিক ছিল না। কাঠের জানালা। জানালা দিয়ে মালপত্র ঢোকানো বের করা হতো। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে ঠেলে জানালা দিয়ে গেদে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো।
ছাড়া বা থামার সময় ছুটে ওঠা নামা যেতো।
একবার এইভাবে নামতে গিয়ে ছিঁচড়ে যাই। পরে শিখি, নেমে দাঁড়াতে নেই ট্রেনের সঙ্গে ছুটতে হয়।
একটা কথা খুব চালু ছিল, এই ট্রেন একদিন হাওড়া যাবে। কারালাঘাটে ব্রিজ হবে। দামোদর নদের ওপর। সেই ব্রিজ দিয়ে মশাগ্রাম হয়ে হাওড়া। হাওড়া থেকে বাঁকুড়া।
এতদিনে সে স্বপ্ন সফল হয়েছে।
কয়লা দেওয়া স্টিম ইঞ্জিন আগেই বাতিল।
পরে হয়েছিল ডিজেল ইঞ্জিন।
বাঁকুড়া দামোদর রিভার রেলওয়ে অতীত।
এখন বিদ্যুৎ চালু। পূর্ব রেল।
হাওড়া থেকে বাঁকুড়া যাওয়া খুব সহজ হয়ে গেল।
মশাগ্রাম ছিল একটা রোমান্টিক জায়গা। মনে মনে কত ছবি এঁকেছি।
বাঁকুড়া বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর ছিল স্বপ্ন।
বাদাম মুড়ি, ঘটি গরম চানাচুর, বেলেতোড়ের ম্যাচা আর ইন্দাসের খাজা নিয়ে চলা রেল হকারদের কথাও আজ ইতিহাসের পাতায়। পুরোপুরি নয়।
এখন ট্রেনে চা মিষ্টি পাওয়া যায়। বাদাম মুড়ি সিঙ্গারা ভেজিটেবল চপ মাখা সন্দেশ চীনা খেলনা।
রুমাল ব্যাগ মায় সুজনি।
ইতিহাস আরেকভাবে তৈরি হয়।
ঘুগনি কি মেলে?
পুনশ্চ: পাঁচ পয়সা ছিল দেশলাই কাঠির বাক্স। টেক্কা মার্কা দেশলাই মিলতো।
পরে এলো শিব কাশীর ছবি দেওয়া দেশলাই।