ইন্দিরা গান্ধির ছেলে সঞ্জয় গান্ধি জরুরি অবস্থার সময় অঘোষিতভাবে সরকারে একটা বড় ভূমিকা পালন করতে থাকেন।
তাঁর পরিকল্পনা ছিল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, শহর সাজানো এবং মধ্যবিত্তের নাগালে থাকবে এমন গাড়ির পরিকল্পনা।
একটার নাম নাশ বন্দি। আরেকটা কুখ্যাত তুর্কমান গেটে বস্তি উচ্ছেদ। আরেকটি মারুতি কেলেঙ্কারি নামে খ্যাত। নাগরওয়ালা বলে এক ব্যক্তিকে ষাট লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাঙ্ক মারুতি গাড়ির কারখানা গড়তে। বাজারে জোর গুজব। এই তিনটি ঘটনা ইন্দিরা গান্ধির পরাজয়ে বিশাল ভূমিকা গ্রহণ করে।
যাই হোক, আমাদের গ্রামে ৫০ জন ব্যক্তি ভ্যাসেক্টমি করবে বলে নাম লেখান।
বিডিও নিজে আসেন। তখন ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় রচিত নট্ট কোম্পানি পরিবেশিত অরুণ দাশগুপ্ত বীণা দাশগুপ্ত খোকন সেন অভিনীত 'মা মাটি মানুষ' পালার বিশাল কদর। সেখানে বিডিও হচ্ছেন ন্যায় ও সততার প্রতিমূর্তি। ফলে জনমানসে বিডিও একটা বড় ব্যাপার।
তো দেখা গেল, নাম লেখানো ৫০ জনের মধ্যে একজন গরহাজির। আউশাড়া ব্রাদার্স ক্লাবের উদ্যোগে হচ্ছে। একজন না আসা মানে ক্লাবের সম্মানহানি।
ক্লাবের কর্মকর্তারা সব তরুণ ছেলে। কারও বিয়ে হয়নি। ছেলে পুলে দূরের কথা। নাহলে ক্লাবের সম্মান রক্ষার্থে তারাই কেউ শুয়ে পড়তো।
তো ক্লাবের সদস্যরা গেল ডাকতে, মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটিকে।
তিনি তো দেখেই ছুট।
তিনি ছুটছেন ক্লাবের ছেলেরাও পিছনে।
এক্কেবারে মোগলমারি।
প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে।
তো, ভ্যাসেক্টমি যাঁরা করলেন, তাঁরা পেলেন মাথাপিছু ৫০ টাকা আর ক্লাব পেল মাথাপিছু ১০ টাকা।
আরেকটি মজার ঘটনা ঘটে। ভ্যাসেক্টমি করেছেন এমন একজনের বউয়ের পেটে বছরখানেক বাদে বাচ্চা এল।
সেই নিয়ে নানা কথা।
বোঝা গেল, ভ্যাসেক্টমি ফুল প্রুফ নয়।
এরপর আউশাড়া ব্রাদার্স ক্লাবের উদ্যোগে আরেকটি কাজ হয়। ভালো কাজ।
চোখের ছানি অপারেশন।
কথায় কথায় ভুলে যাওয়ার আগে বলে নিই, মেয়েদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ অপারেশনের নাম ছিল লাইগেশন।
লাইগেশন করলে মেয়েরা ২৫০ টাকা করে পেতেন।
দু একজন মহিলা পরে লাইগেশন করেন।
এই প্রসঙ্গে আমার একটা বহুদিনের জমানো কথা বলতে ইচ্ছে করছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আম্বেদকরের বাবা যদি জন্মনিয়ন্ত্রণ করতেন তাহলে কী হতো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আম্বেদকর দুজনেই ছিলেন বাবা মায়ের চোদ্দতম সন্তান।
হ্যাঁ ১৪ নম্বর।
মোদি সাহেব এবং যোগী বাবু দুজনের বাবা মা-ই দুজনের বেশি সন্তানের অধিকারী।
মোদি সাহেব ছয় নম্বর।
যোগিজি?
এই ভ্যাসেক্টমি অপারেশনের পাণ্ডা ছিলেন ফজলুল হক। কংগ্রেস জমানা। কংগ্রেস পরিবারের সন্তান। ফলে যোগাযোগ বেশি। ফজলুল হক বামফ্রন্ট আমলে প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নিয়েছেন। গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত।
ফজলুল হক একটা লেখা পাঠিয়েছেন। তিনি লিখে পাঠিয়েছিলেন মাঘ মাসে। আমার দেরি হল, পোস্ট করতে।
'রায়না থানার প্রতিটি গ্রামে চলছে বিভিন্ন বারোয়ারি পূজাকে কেন্দ্র করে সম্প্রীতির গ্রামীণ মেলা। সেই সব মেলায় একদিকে যখন চলছে নানা ধরনের দোকানে বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনার মানুষের যাওয়া আসা তেমনি জিলাপি পাঁপড় ও নানান খাবার জিনিস বেচাকেনা। এই এলাকায় একদিকে বারোয়ারি পূজাকে ও আর একদিকে পীরের মেলাকে কেন্দ্র করে মেলা হয় প্রতি বছর। দেবীবরপুর, শুকুর, রসুইখণ্ড, বায়ড়া, রূপসোনা, বুড়ার, গোপীনাথপুর, বোড়া,রামবাটি পশ্চিমপাড়া, রসপুকুর, আউশাড়া, নূরপুর প্রভৃতি গ্রামগুলিতে মেলা হয় বহু বছর ধরে। সেই মেলা উপলক্ষে চলে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যার মাধ্যমে প্রতিভার খোঁজ পাওয়া যায়। এক সময় এমন গেছে গ্রামে গ্রামে অ্যামেচার যাত্রার দল ছিল অনেকগুলো করে । সেখানে গ্রামের ছেলেরাই অভিনয় করতো। শ্রোতা বসার জায়গা ছিল না। তখনকার দিনে যাত্রা লোকশিক্ষার বাহন হিসেবে কাজ করতো। ভাল ভাল অভিনেতা তৈরি হতো। যেমন অবিশ্বাস্য হলেও সত্য আউশাড়া গ্রামে ছিল দশটি অ্যামেচার দল --আউশাড়া ব্রাদার্স ক্লাব, গ্রামীণ নাট্য সমাজ, নটতীর্থ যাত্রা ইউনিট, অজাতশত্রু যাত্রা ইউনিট, মেহনতি ফান্ড, সিংহ বাহিনী যাত্রাদল, নবজাগরণ সংঘ,ত্রিমূর্তি যাত্রা সমাজ, আমরা কজন যাত্রা দল ও সবুজ সংঘ। এই সমস্ত ক্লাবের ছেলেরা যাত্রা করতো সে কী আনন্দ কী উৎসাহ। এমনকি একরাতে দুখানা দলের যাত্রা হয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে নানান কারণে ওই সব ক্লাবগুলো উঠে গেছে। এখন অ্যামেচার দল বদলে পেশাদার দল যাত্রা হয়।
আসলে গ্রাম্য সংস্কৃতি কোথায় যেন থমকে গেছে। মানুষ যেন দিনে দিনে আনন্দহারা হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে উঠে যেতে বসেছে খেলাধুলা শরীর চর্চা।
এ অবক্ষয়ের ভাবনার দিকে সবার নজর দেওয়া প্রয়োজন আছে।'
যাত্রার কথা যখন এলো, বলেই ফেলি, দীনেশদার গল্প।
আগে বলেছি? মনে পড়ছে না।
গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে।
একই খাবার যেমন রোজ খাই, মাঝে মাঝে জানা গল্পও শুনতে ইচ্ছে করে।
যাত্রার মরশুম আসতো ধান তোলার সঙ্গে।
এতো শহর নয়, গ্রামে যখন চরম অভাব, আশ্বিন কার্তিক মাস, তখন উৎসবের আয়োজন করে আলোয় ঝলসে দিতে হবে দারিদ্র্য।
অগ্ঘান পোষে লোকের ঘরে ধান উঠবে দুটো পয়সার মুখ দেখবে ছছল বছল হবে সংসার।
গোরু ছাগল মুরগি ভিখারি সবাই খুশি।
গেরস্তের ঘরে ধান উঠচে, ঘরে ঘরে আমোদ আল্লাদ। বরের গলা জড়িয়ে নতুন পুরনো সব বউয়ের বায়না, এবার কিন্তু ওই গয়না/ শাড়িটা দিতে হবে। কতা দিয়েচো, ধান উটলে।
ছেলে মেয়েরা খুশি। পরীক্ষা শেষ। যত খুশি খেলো। লুকোচুরি খেলার আদর্শ সময়। খামারে খামারে ধানের খড়ের, কুটির মেলা।
লুকনো সোজা।
তারপর সাঁঝবেলায় বাড়ি থেকে এটা সেটা এনে নিজেরাই রেঁধে বেড়ে ফিস্টি।
এবং গ্রামে গ্রামে মেলা ও যাত্রার আয়োজন।
আমাদের গ্রাম থেকে নয় কিলোমিটার দূরে কুকুরা গ্রাম।
কুকুরায় যাত্রা হতো। সেই যাত্রার বাঁধা বিনে পয়সার প্রশিক্ষক আমার বাবা।
বাবা কোনও দিন স্কুলে মাস্টারি করেননি। কিন্তু বহু গ্রামে তাঁর পরিচয়, মাস্টার মশাই। যাত্রা নাটক শেখানোর মাস্টার।
কুকুরায় বাড়ি ছিল দীনেশদার।
দীনেশদা খোঁজ খবর নিয়েই আসতো, আমাদের ধান ঝাড়া মড়াই বাঁধা হয়েছে কিনা।
কিন্তু দু-একবার হিসাবে মিলতো না।
দীনেশদা যদি দেখতো ধান ঝাড়া শেষ হয়নি, নিজেই লেগে যেতেন।
এই এই হাত চালিয়ে সব।
মাস্টার মশাই ভালো বলে ফাঁকিবাজি চলবে না।
এ বাবা দীনেশ, ধান রুইতে ঝাড়তে সব পারি।
দীনেশদার মূল লক্ষ্য, মায়ের মন গলানো।
মাকে দেখলেই প্রণাম।
কিন্তু ধান ঝাড়া মড়াই বাঁধা শেষ না হলে প্র ণামে কাজ হবে না, দীনেশদা জানতেন।
দীনেশদা রীতিমতো ধনী চাষী।
শ্যামলা গায়ের রঙ। মুখটি ভারি মিষ্টি। তেমন মিষ্টি কথা।
দীনেশদা দু তিনদিন দরকারে থেকে যেতেন।
তারপর সব গোছগাছ করে মাকে বলতেন, কাকিমা মাস্টার মশাইকে নিয়ে যাই?
তিনি তো একপায়ে খাড়া। আমার কথা কানে নেবার সময় আছে?
মায়ের বাণী।
ন্না, কাকিমা, আপনি বলতে মাস্টার মশাই অজ্ঞান। বলেন, ও না থাকলে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া হতো না। সংসার একাই সামলায়।
মায়ের মন একটু গলছে, দেখে, দীনেশদা বললেন, এবার মাত্র ১০ দিন।
দশ দিনে কবে ফিরেছে?
মনে নেই সেবার মাত্র তিনদিন।
তিনদিন পর ফিরে আবার গিয়ে যে একমাস।
কী বলবো, কাকিমা ছোঁড়াগুলো যে ছাড়তেই চায় না। বলেই আবার, এবার কিন্তু আপনাকে যাত্রা দেখতে যেতেই হবে। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।
গাড়ি মানে গোরুর গাড়ি।
আমি গেলে হবে বাবা। রাবণের চিতা নেভে আর না। সারাদিন জ্বলছে। কিষেন কুটুম পার্টির লোক। যেতে পারি? বলো।
দীনেশদা বুঝলেন, ভাত নরম হয়েছে, একটা প্রণাম সেরে বাবার জামাকাপড় ধুতি গামছা ব্যাগে পুরে বাবার দাবার আড্ডায় হাজির।
সেখান থেকে তোলা দায়।
একবার নিয়ে গিয়ে ফেললে, একমাসের আগে ছাড়া নেই!