২০০০ সাল। আমরা কোক পেপসির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। এই সময় অর্থনীতিবিদ অমিয় বাগচীর বাড়ি গেছি। উনি বললেন, শুধু ভাঙলে হবে না, গড়তেও হবে। বলে খাওয়ালেন আমপোড়া শরবত। খেলাম। খেয়ে মনে হল এটা তো আমরা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি।
তখন আমরা রবীন্দ্র সদনে কোকাকোলাকে স্টল দেওয়ার বিরোধিতা করে বাংলা কোলা বলে হাত মেশিনে তৈরি এক ধরনের পানীয় বেচছি।
নাগেরবাজারের কাছে এক ভদ্রলোক ওই যন্ত্র বানাতেন। আমপোড়া শরবত আমি আগে খাই নি। নামও শুনিনি।
পয়লা বৈশাখ নববর্ষ উৎসব উদযাপনে শুরু করলাম। একটু নতুন জিনিস সংযোজন করলাম, লেবু কাঁচালঙ্কা দিয়ে।
গরম ছিল প্রচণ্ড।
বানাচ্ছি।
এক ভদ্রলোক মুখ মনে আছে, নাম জানা হয়নি। দুটো ঠান্ডা জলের বোতল ২০ টাকা দিয়ে কিনে এনে ঢেলে দিলেন।
পাঁচটাকার আমপোড়া খেতে কুড়ি টাকা খরচ।
এরপর নিজে কিনে খেলেন আরো চার গ্লাস।
আস্তে আস্তে আমি ওস্তাদ হয়ে গেলাম আমপোড়া বানানোয়।
আম পুড়িয়ে খোসা ছাড়িয়ে ক্কাথ ফ্রিজে রেখে দিতাম।
এরসঙ্গে যুক্ত করলাম, গোটা জিরা ভাজা মশলা, গোলমরিচ গুঁড়া, বিট নুন, সৈন্ধব লবণ।
আর শেষে দেওয়ার আগে একটু লেবুর রস ও শুকনো জিরা গুঁড়া।
আহ।
এই কাজ করেছি ১ বৈশাখ থেকে পঁচিশ বৈশাখ হয়ে ১১ জ্যৈষ্ঠ।
টানা ছয় বছর বেচেছি রবীন্দ্র সদনে।
পঁচিশে বৈশাখ তখন হতো সকালে জমজমাট।
২৫ থেকে পঞ্চাশ কেজি আমের শরবত বিক্রি হতো।
যাঁরাই কিনতে আসতেন আমরাও তৈরি করা পদ্ধতি শিখিয়ে দিতাম।
২০০২-এ প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে কলকাতায় কোকপেপসি বিরোধী আন্দোলন করি।
কলকাতায় দোকানে দোকানে ঘুরে প্রচার চালাই।
লস্যি শরবত ডাব আমপোড়া শরবত বিক্রি করতে বলি।
উল্টোডাঙ্গায় দুপুর রোদে এসে সংহতি জানিয়ে যান কবি শঙ্খ ঘোষ।
আমপোড়া শরবত বিক্রি ও প্রচার প্রসারে ভূমিকা নেন কলকাতা দূরদর্শনের প্রযোজক বিভাসদা।
এতে ভালো মন্দ দুই হয়।
আমার আত্মীয় এক বাচ্চা বলে, দেখো আমাদের বংশের একটা সম্মান আছে
আর তুমি প্রফেসার হয়ে আমপোড়া শরবত বেচো। লোকে কী বলবে বলো তো।
কলকাতা দূরদর্শন প্রায়ই দেখাতো এটা।
আর একটা ঘটনা। সত্যজিৎ রায়ের আলোকচিত্রী নিমাই ঘোষ, শিল্পী উৎপলেন্দু চৌধুরী, চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার প্রায়ই এসে আমপোড়া শরবত নিয়ে যেতেন।
এসে একটা বোতল দিয়ে যেতেন।
ছয় গ্লাস।
দু একবার ফেরৎ দিয়েছি।
ভালো মানের নেই বলে।
আপোস করি নি মানে।
পরে সত্যদা, রাজু, বাপী, সুতপা শিখে যায় ভালো করে শরবত বানাতে।
তো একবার হয়েছে কী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকদের উজ্জীবনী পাঠমালা।
শীতকালে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছেন তরুণ মজুমদার।
উনি আমাকে ওখানে দেখে বিস্মিত। তাকাচ্ছেন।
বলতে কিছু পারছেন না।
ভাব, আমপোড়া শরবত বিক্রি করনেওয়ালা এখানে কী করে?
বিমলকুমার মুখোপাধ্যায় আমাকে খুব স্নেহ করতেন।
বললেন, চেনেন এঁকে?
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ায়।
ভালো ছাত্র।
তরুণ মজুমদারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গভীর হয়ে গেল।
সৌজন্যে আমপোড়া শরবত।
আমাদের ছোটবেলায় আমপোড়া শরবত ছিল না। ছিল ডাব। লস্যি পাওয়া যেত বর্ধমান শহরে কার্জন গেটের মুখে। সেখানে রামপ্রসাদের শরবত ও ঠান্ডা পানীয়ের দোকান। সেখানে কোল্ড কফিও মিলত। গ্রামে ছিল নানা রকম শরবত, এর মধ্যে নুন লেবু চিনি ছিল আজকের ভাষায় মারকাটারি, লা জবাব। আর ছিল ঘোল এবং ডাব। এই ডাব নিয়ে আজ চড়কের দিনে একটা ভালো ঘটনা মনে পড়ল।
আমাদের গ্রাম দ্রাবিড় যুগের গ্রাম। প্রথম খণ্ডেই লিখেছি। মুসলিম বসতি কবে থেকে শুরু সে-নিয়ে পড়া কথা বলা যাবে। গ্রামের ৬৫ শতাংশ মুসলিম। গ্রামে ইদ বকরিদ দুর্গাপূজার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওলাইচণ্ডী পূজা আর গাজন। গাজন হতো চৈত্র মাসের শেষদিন। গাজনের দেবতা শিব। শিবকে সবাই মানেন। গ্রামের একমাত্র মন্দির ছিল, শিব মন্দির। তার পুরোহিত গন্তা বেনে। জাতে বেনে। আর গাজনের সন্ন্যাসী বেশিরভাগ মুচি সম্প্রদায়ের। সাতদিন ধরে উপোস করে গাজনের দিনে অনেক উঁচু থেকে ঝাঁপান দিতেন সন্ন্যাসীরা। তার আগে দণ্ডী কেটে আসতেন পুকুর থেকে। চৈত্র মাস। কাঠ ফাটা রোদ। সেই রোদে মাটিতে শুয়ে শুয়ে আসা। সন্ন্যাসীদের দলে থাকতো আমার গৌরদা। বাঙালি যাত্রাপালার নায়ক। সেই দেখে আমি তার অনুরাগী। গৌরদা না খেয়ে শুয়ে আছে, এটা আমাকে খুব কষ্ট দিত। তখন গরম বলে সকালে স্কুল। স্কুল থেকে ফিরে আমি শিব মন্দিরে গিয়ে বসতাম। তখন এসব নিয়ে কোনও ছুঁৎমার্গ ছিল না। গাজনের দিন হতো সবচেয়ে মজা। সবার শেষে অনেক উঁচু থেকে ঝাঁপ দেবে গৌরদা। নীচে কয়েকশো মানুষ। ধরে নেবে। নিয়ে মাথায় তুলে নাচবে। ওরাই তো তখন নায়ক।
সন্ন্যাসীদের ধরার দলে হিন্দু মুসলমান সব ধর্মের মানুষই থাকতেন।
ঝাঁপ দেওয়ার আগে সন্ন্যাসীরা ছুঁড়তেন ফুল বেলপাতা। সেগুলো পাওয়ার জন্য সব ধর্মের মানুষ ব্যাকুল। বাবা শিবের ছোঁয়া পাওয়া পুণ্য বা নেকির কাজ।
আর তারপরেই শুরু হতো আসল মজা।
ডাব কাড়াকাড়ির খেলা।